ঘুমের সময়
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।
জ্বলিছে নরম মোম
. ছোটো মোর ঘরে,
জ্বলিছে নতুন চাঁদ
. মেঘের শিয়রে |
এক মুঠো ছোটো চাঁদ,
. কত আলো তার,
এক মুঠো মিঠে আলো
. বালিশে আমার |
মোমের নরম চোখে
. স্বপ্নেরা ঝরে,
ঘুমের নরম চুমো
. দুই চোখ ভ’রে |
. *************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
পরিমল-কে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।
পদ্য যদি লিখতে তুমি পরিমল,
. মুগ্ধ হতাম সকলে,
হার মানাতে নামজাদা সব কবিদের
. ছন্দ-মিলের দখলে |
যত কথা --- আজগুবি আর অসম্ভব
. ঘুরছে তোমার মগজে,
দয়া করে কলম নিয়ে একটানা
. লিখতে যদি কাগজে !
কিন্তু তুমি নিজে কিছুই লিখলে না---
. আমায় দিলে উৎসাহ,
তুমি আমার করলে তোমার রাজকবি,
. আমি তোমার বাদশাহ |
ফল যা হ’লো, দেখতে তো তা পাচ্ছোই---
. এই যে ছোটো বইখানা,
আগাগোড়া একটি ছড়াও নেই এতে
. তোমার যেটা নয় জানা |
পাবো অনেক নিন্দে, খানিক প্রশংসা,
. কে-ই বা গায়ে তা মাখে !
ভালোবাসার সঙ্গে দিলাম, পরিমল,
. আমার এ-বই তোমাকে |
আমরা যখন ছোটো ছিলাম, পরিমল,
. মনে কি নেই কী হ’তো ?
ইচ্ছে হ’লেই চ’লে যেতাম ইস্পাহান,
. কটোপাক্সি, কিয়োতো |
জ্যোছনা-রাতে দেখতে পেতাম পরিদের
. জানলা থেকে লুকিয়ে,
অন্ধকারে ভূতের পায়ের আওয়াজে
. রক্ত যেতো শুকিয়ে |
এখন--- মোরা যেথায় আছি, দিনরাত
. আটকে আছি সেখানেই,
চাঁদের আলোয় নাচে না আর পরিরা,
. ভূত-পেরেতের দেখা নেই |
কিন্তু তোমার সঙ্গে থেকে, পরিমল,
. ফিরলো মনে সেই সব,
মনে হ’লো রাখবো বেঁধে কবিতায়
. তোমার আমার শৈশব |
অমনি, দেখো, কাগজ নিলাম একরাশ,
. কালি নিলাম দোয়াতে,
যা লিখেছি উজাড় ক’রে, পরিমল,
. দিলাম তোমার দু-হাতে |
. *************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
বারো মাসের ছড়া
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।
সবচেয়ে ভালোবাসি বৈশাখ মাস,
মূর্ত আশার মতো দীপ্ত আকাশ |
জ্যৈষ্ঠের খর তাপ তীব্রপরশ,
রোদ্দুরে যত রোষ আমে তত রস
দীর্ঘ দ্বিপ্রহর অবসরে ভরা,
সূর্য অস্ত যেতে করে না তো ত্বরা |
আষাঢ় আঁধার হ’য়ে আকাশে ছড়ায়
পাখা-পাওয়া পাহাড়ের চূড়ায়-চূড়ায় |
দলে-দলে চলে মেঘ, জ্বলে বিদ্যুৎ,
হঠাৎ বজ্র বাজে, বৃষ্টির দূত |
তারপর শ্রাবণের রিমঝিম রাত,
জুঁইফুলে গন্ধের স্বপ্ন-প্রপাত |
চুপ ক’রে শুয়ে-শুয়ে কী-যে ভালো লাগা,
জেগে-জেগে ঘুম আর ঘুমে যেন জাগা |
ঝরোঝরো ঝরে জল অতল অথই,
মনে হয় আমি যেন রুমি আর নই |
নই আর ছোটো মেয়ে দাঁত নড়ো-নড়ো,
কাউকে না-ব’লে আমি হ’য়ে গেছি বড়ো |
টুটুকে, দিদিকে, মা-কে গিয়েছি ছাড়িয়ে
নাগাল পান না বাবা দু-হাত বাড়িয়ে |
আমি যেন গল্পের, আমি যেন কোন
স্বপ্নের কাঞ্চনকুমারীর বোন |
ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি সেই আছি ছোটো,
মা বলেন, ‘বেলা হ’লো, রুমুমণি ওঠো |’
ভাদ্রের মুখে হাসি, চোখে তবু জল,
ঝরায় বাদল তার শেষ সম্বল |
আকাশে একটু লাগে নীলের পালিশ
ঝিকমিক রোদ ঠিক টাটকা ইলিশ |
রৌদ্রের রূপো হ’লো সোনা একদিন,
পুজোর গন্ধ নিয়ে এলো আশ্বিন |
গাল-ফোলা শাদা মেঘ আহ্লাদে খেলে,
সূর্যের একপাল উজ্জ্বল ছেলে |
কার্তিক ক্লান্তির কুয়াশায় মিশে
অঘ্রাণে ডেকে আনে ধান্যের শিষে |
ছোটো হ’য়ে আসি দিন, বেলা পড়ে ঢ’লে
পৌষের সুন্দর রৌদ্রের কোলে |
পাঁচটা না-বাজতেই সূর্য পলায়,
লম্বা ঘুমের রাত লেপের তলায় |
কালোকেলো কই মাছ লাল তেলে ভাসে
সবুজ মটরশুঁটি সাজে পাশে-পাশে |
আজ ভাবি, কাল ভাবি শীত বুঝি যায়
উত্তুরে হাওয়া তার উত্তর দ্যায় |
মর্মরে ঝংকারে মাঘ এলো ঐ,
গাছে-গাছে ডালে-ডালে লাগে হৈ-চৈ |
আজ কেন সব-কিছু লাগছে নতুন ?
গুনগুন গুঞ্জনে এলো ফাল্গুন |
উঁকি দেয় উত্সুক আম্রমুকুল,
তারি ফাঁকে কোকিলের বসে ইশকুল |
বাক্সে লুকায় যত কম্বল শাল,
হঠাৎ হাওয়ায় লাগে চৈত্রের তাল |
দিলখোলা দক্ষিণ, হালকা শরীর,
কত যেন ফুর্তির দিন-রাত্তির |
উত্তাপে উত্সাহে উচ্ছলে প্রাণে,
কাঁচা আম গ্রীষ্মের আশ্বাস আনে |
ঐরাবতের মতো বৈকালী মেঘে
উত্তাল ওঠে কালবৈশাখী রেগে |
ঝঞ্ঝায় উড়ে যায় পুরোনোর দায়
চৈত্রের সন্ধ্যায় বর্ষবিদায় |
. *************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
পাপ্পার জন্মদিনে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।
পাপ্পা, আমার ছোট্ট উঠোনটিতে
. ফুটেছিলো গোলাপ, চাঁপাফুল
অপ্ রাজিতার নীল চোখের তলে
. ঝুমকোলতার এলিয়ে-দেয়া চুল |
সূর্যমুখীর রং-মাখানো দিন,
. জুঁই-ফোটানো সন্ধ্যারাতের ঘোর,
ঘুমের কালো নদীর মোহানায়
. শিউলিফুলে শিউরে ওঠা ভোর |
যে-সব ফুল কী হ’লো, আজ তুমি
. শুধাও যদি--- কী দেবো উত্তর ?
পাপ্পা, আমার শীতের অবেলায়
. শুনতে কি চাও আলোর কলস্বর ?
তখনো যে আকাশ ছিলো লাল,
. ঘাসের মুখে শিশির ছলোছলো,
আলোর টানে যাদের আনাগোনা
. না-দিয়ে কি পারি তাদের, বলো !
তখন যারা আমার কাছে এসে
. চ’লে গেছে দণ্ড দুয়েক পরে,
কিংবা যারা পথে চলার ধুলো
. মুছে গেছে আমার দাওয়ার ‘পরে,
তাদের আমি দিয়েছি সব তুলে
. দু-হাত ভ’রে অপ্ রাজিতা, চাঁপা,
রক্তবরন উদ্ধত গোলাপ,
. স্বপ্নময় শিউলি কাঁপা-কাঁপা |
এমনি ক’রে বিলিয়ে দিলাম সব
. ভাবিনি তা তুচ্ছ কিংবা দামি,
তোমার জন্যে কিচ্ছু বাকি নেই,
. বাকি আছি কেবলমাত্র আমি |
পাপ্পা, আমার ছোট্ট বারান্দায়
. অনেকগুলো ছিলো পোষাপাখি,
সন্ধ্যা সকাল দুপুরবেলা ভরে
. সারাটা দিন রঙিন ডাকাডাকি |
ছোট্ট চড়ুই, ফুর্তি তার কত
. ভোরের বেলা আলোর জানালায়,
মধ্যদিনে ঠাণ্ডা ছায়া ফেলে
. ঘুঘুর ডাকে কান্না ঝ’রে যায় |
উপচে পড়ে বুলবুলির শিস,
. কোকিল তোলে উচ্ছ্বসিত তান,
যেন আমার আর কোনো কাজ নেই
. কেবল হাওয়ায় বিলিয়ে দেবো গান |
সে-সব গান কী হ’লো, আজ তুমি
. শুধাও যদি---- কী দেবো উত্তর ?
পাপ্পা, আমার পাতা-ঝরার দিনে
. কোথায় পাবো ফুলের খেলাঘর ;
পাখিরা সব যে যার গান সেরে
. মিলিয়ে গেলো দিনান্তের আলোয়,
গানগুলি সব ছড়িয়ে উড়ে গেলো
. নানাদিকে, নানান পথের ধুলোয় |
জানি না আর তারপরে কী হ’লো,
. হয়তো বা কেউ কুড়িয়ে নিলো ঘরে ;
বানের জলে ডুবলো বুঝি কত
. হয়তো আবার জাগবে নতুন চরে |
সব হারিয়ে শূন্য হাতে আজ
. তোমার কাছেই আস্তে এসে থামি,
তোমার জন্যে আর-কিছু তো নেই,
. আছি এখন কেবলমাত্র আমি |
. *************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
হাওয়ার গান
কবি বুদ্ধদেব বসু
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” থেকে নেওয়া |
হাওয়াদের বাড়ি নেই, হাওয়াদের বাড়ি নেই,
. নেই রে |
. তারা শুধু কেঁদে মরে বাইরে |
সারা-দিন-রাত্রির বুক-চাপা কান্নায়
নিশ্বাস বয়ে যায় উত্তাল, অস্থির---
. সে কোথায়, সে কোথায়, হায় রে |
বলে তারা, পৃথিবীর সব জল, সব তীর
ছুঁয়ে গেছি বার-বার দুর্বার ইচ্ছায়,
. তবু নেই, সে তো নেই, নেই রে |
সব জল, সব তীর, পাহাড়ের গম্ভীর
কন্দর, বন্দর, নগরের ঘন ভিড়,
অরণ্য, প্রান্তর, শূন্য তেপান্তর---
. সব পথে ঘুরেছি বৃথাই রে |
পার্কের বেঞ্চিতে ঝরা পাতা ঝর্ঝর,
শার্সিতে কেঁপে-ওঠা দেয়ালের পঞ্জর
চিমনির নিস্বনে, কাননের ক্রন্দনে
. তার কথা কেবলি শুধাই রে |
তেমনি মিষ্টি ছেলে দোলনায় ঘুম যায়,
আবছায়া কার্পেট কুকুরের তন্দ্রায়,
ঘরে-ঘরে জ্বলে যায় স্বপ্নের মৃদু মোম—
. সে-ই শুধু নিয়েছে বিদায় রে |
আঁধারে জাহাজ চলে, মাস্তুলে জ্বলে দীপ,
যাত্রীরা সিনেমায়, কেউ নাচে, গান গায় ;
আমরা তরঙ্গের বুকে হানি প্রশ্নের
আবিরাম নর্তন, মত্ত আবর্তন----
. সে কোথায়, সে কোথায়, হায় রে !
অবশেষে থামে সব, ডেক হয় নির্জন,
অকুল অন্ধকারে ফেটে পড়ে গর্জন,
সমুদ্র ওঠে দুলে, বাঁকা চাঁদ পড়ে ঝুলে---
. আমাদের বিশ্রাম নেই রে |
আমাদের বাড়ি নেই, দেশ নেই, শেষ নেই,
. কেঁদে-কেঁদে মরি শুধু বাইরে,
বার-বার পারাপার যত করি, তবু তার
. নেই, নেই, দেখা নেই, নেই রে !
সময় অন্তহীন, অফুরান সন্ধান,
বিশ্বের বুক ফেটে বয়ে যায় এই গান---
. কোনখানে গেলে তারে পাই রে !
. খুঁজে খুঁজে ঘুরে ফিরি বাইরে,
. সুরে-সুরে বলে যাই-নেই রে,
. চিরকাল উত্তাল তাই রে |’
. *************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
রুমির পত্র --- বাবাকে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।
. ও বাবা, ও বাবা
দিদি বললে আমায়, ‘হাবা !
. তুই এটাও বুঝিস না !
নিজে পদ্য বানিয়ে
বাবা ভোলান তা নিয়ে
. নেই সত্যি পরি-মা |
বলে বিজ্ঞানে কী, জানিস,
আছে অনেক রকম জিনিশ,
. অনেক অদ্ভুত জন্তু,
. জন্মদিনের পরি,
কিংবা জ্বর তাড়ানো পরি
. নেই সত্যিই কিন্তু |
ও-সব কুসংস্কারেই
দেশের দশা হ’লো এই
. এখন জওহরলালজী
যদি চল্লিশ কোটির
দেন ফরমাশ রোটির
. তবে লঙ্কা, আটা, ঘি
নিয়ে লাগবে যারা কাজে
বল তাদের কাছে বাজে
. তোর পরির মতো কী !’
আমি ভাবছি ব’সে তাই ;
যদি তিমি দেখতে চাই
. পাবো ছবি দেখতে বইয়ের,
তাতে বোঝাই যাবে না
তার কত্ত বড়ো হাঁ
. যেন জাহাজ-খাওয়া ঢেউয়ের |
আর যখন ঘুমের আগে
আমার কেমন ভালো লাগে---
. শোনো সত্যি কথাটা----
আমি ঠিক দেখতে পাই
তুমি যা লিখেছো তা-ই
. সেই চিঠির পরি-মা |
নিজ চক্ষের দেখায়
বুঝি মিথ্যেই শেখায়,
. আর সত্যি হ’লো তা-ই,
যা কক্ খনো দেখিনি,
. জল-পাহাড়ি তিমির
. মাইল-জোড়া হাই !
দিদির বিজ্ঞানের বই
ভুল করেছে নিশ্চয়ই---
. সত্যি না, বাবা ?
যদি পরি না-ই থাকে
তবে বলো তো কোন ফাঁকে
. মনে জাগলো পরির ভাবা ?
বাবা তুমি নিজেই ঐ
না-হয় পদ্য লিখেছোই
. কিন্তু পরি-মা
. সত্যি যদি না হন
তবে তুমি-ই বা কেমন
. ক’রে জানলে কথাটা !
আমার মনে হচ্ছে, শোনো,
পরি- মায়ের কোনো-কোনো
. কথা মোটেও শুনিনি,
তাই না-ব’লে-ক’য়ে
. সত্যি মিথ্যে হ’য়ে
. মিলিয়ে গেলেন উনি ?
. দিদিকে লাল ফিতে
মা-কে যেই দেখেছি দিতে
. কেঁদে বাধিয়েছি সেই হাট,
. হয়নি আমার করা
কিছু তেমন লেখাপড়া
. আজ বয়স হ’লো সাত |
খাবার সময় মিছিমিছি
আমার আছেই চ্যাঁচামেচি,
. সেটা বড়োই বিশ্রী,
আর আঁচল ধরে মা-র
. ঘ্যানঘেনে আবদার
. না- ক’রেই পারিনি |
. আমার এ-সব দোষে
দূর আকাশ-পারে ব’সে
. পরি-মা রাগ ক’রে
. আমায় দিলেন ফাঁকি ?
বাবা, সত্যিই তা-ই নাকি ?
. রাখো, রাখো ধ’রে |
আমি মন করলেম আজই
মুখে আনবো না আর পাজি,
. কক্- খনো না, কক্ খনো,
আর নাকি সুরের কাঁদা,
কিংবা বেড়াল-গলা সাধা
. আমার আবার যদি শোনো
তবে বেসো না আর ভালো,
তবে যা ইচ্ছে তাই বোলো---
. কিছু বলতেও হবে না,
. অঙ্ক আর ইংরিজি
আমি শিখবো নিজে-নিজেই---
. বলো, সত্যি পরি-মা !
আমি সত্যি হবো ভালো,
বাবা, সত্যি ক’রে বলো,
. দিদি কিছু জানে না,
আমার চোখেই আঁকা সে
ঐ দূরের আকাশের
. আমার সত্যি পরি-মা |
. *************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
পরি-মার পত্র --- বাবাকে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।
. শুনুন, মশাই শুনুন,
আপনি যতই কথা বুনুন,
. ছড়া যতই বাঁধুন না,
কেউ মানবে না আর, আছে
কোথাও দূরে কিংবা কাছে,
. কোনো সত্যি পরি-মা |
যখন ছোট্ট ছিলো রুমি,
ছিলো কুট্টুস, টুনটুনি,
. ঠিক দেখতে পেতো আমায়,
ঐ দূরের আকাশে
যেমন মেঘেরা ভাসে
. চাঁদের আলোর জামায় |
তখন জন্মদিনের ভোরে,
. কিংবা জ্বরের ঘোরে
. রুমি বলতো, ‘ও বাবা !
আমার মনে হচ্ছে আজই
হবেন পরি-মা ঠিক রাজি
. আমার চিঠি লিখতে আবার !’
. ঐ কথা যেই শোনা,
আমার অমনি আনাগোনা
. রুমির পাশে-পাশে,
. যেমন হাওয়ার হাত
নাড়ে আহ্লাদে হঠাৎ
. গাছে, পাতায়, ঘাসে |
সেই আহ্লাদি রুমির
অফু- রন্ত ঝুমঝুনির
. আর ছন্দ শুনি না ;
আর ছোটো তো নেই----ষাট---
আজ বয়স হ’লো আট
. রুমি ন’য়ে দিলো পা |
সেই কুট্টুস, টুনটুনি
আজ ইশকুল-পনঠুনি,
. আর দু-দিন পরেই ক’ষে
. বুঝি-বা তার দিদির
মতো সে-ও হবে গম্ভীর
. কেবল পড়া করবে ব’সে |
আজ যতই ভোলে বানান,
আপনি ততই ওকে শানান
. ব-ফলা ম-ফলায়,
আর যক্ষুনি নামতায়
ও একটুও আমতায়
. তক্ষুনি জোর গলায়
. হেঁকে বলেন, ‘রুমি !
তোমার এখনও দুষ্টুমি !
. করো শীঘ্রি মুখস্ত !’
দেখে বনেছি তাজ্জব,
তবে এও হ’লো সম্ভব---
. আজ রুমিও ব্যস্ত !
এখন সময় বড়ো কড়া ;
আছে ইংরিজির পড়া,
. আছে রিবন, জুতো, জামা,
. সভ্যতা, ভব্যতা,
আছে ভদ্ররকম কথা ;
. সময় নেই তো শুধু আমার !
তবে চক্ষু আরো বাঁকান,
আর বিদ্যে আরো শেখান,
. কেন মিথ্যে ছড়া লেখা ?
আমি যাচ্ছি ফিরে সেই
আমার দূরের বাসাতেই,
. সারা আকাশ ভ’রে একা |
. ঐ তো রুমি ঘুমোয় ;
আমি শুধু একটি চুমোয়
. তাকে ইচ্ছে দিয়ে যাই,
কাল জন্মদিনের ভোরে
যেন স্বপ্ন মনে প’ড়ে
. উঠে আবছা বিছানায়
ভাবে, ‘কে ছিলো এক্ষুনি ?
আমার নাম কে ডাকে শুনি ?
. কই, আর তো শুনি না !
. সত্যি কি তাহলে
গেলো আকাশ ভ’রে চ’লে
. ঐ আমার পরি-মা ?’
. *************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
দ্রৌপদীর শাড়ি
কবি বুদ্ধদেব বসু
“বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৫৩) থেকে নেওয়া। “দ্রৌপদীর শাড়ি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
রোদ্দুরের আঙুলে আঁকা
. মেঘের চেরা সিঁথি
হঠাৎ খুলে দিলো স্মৃতির
. অন্তহীন ফিতে।
এমনি এক মেঘলা দিন
সীমান্তের শাসনহীন,
ভবিষ্যত দেখা না যায়,
. অতীত হ’লো হারা।
দুঃস্বপনে পড়িলো মনে
. দ্রৈপদীর শাড়ি।
সেদিন মেঘে সোনার পাড়,
. রৌদ্র ভিজে-ভিজে ;
গাছের গায়ে আছাড় দেয়
. হাওয়ার হিজিবিজি।
দুপুর কেন বিকেল, আর
বিকেল হ’লো অন্ধকার ;
সন্ধ্যাকালে উচ্চহাসে
. সূর্য পেলো ছাড়া।
দুঃশাসন করিলো পণ
. দ্রৌপদীর শাড়ি।
ভাঙলো ঘুম, লাল আগুন
. ধৈর্যহীন শিরায়
উল্লসিত হুল্লোড়ের
. আনলো কড়া নাড়া।
আকাশে তারই স্বৈরাচার ;
কখনো নীল মেঘের ভার,
আলোর বাঘ কখনো ছায়া-
. হরিণে করে তাড়া ;
আশার দাঁত চিবিয়ে ছেঁড়ে
. দ্রৌপদীর শাড়ি।
স্বর্গে আর মর্ত্যো যেন
. বাঁধিয়া দিলো সেতু
অচির-পরিবর্তনের
. তুমূল মত্ততা।
আলো ছায়ার খেলার ঘরে
ভীষণ ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ে,
বজ্র শুনে লাফিয়ে ওঠে
. বিদ্যুতের খাঁড়া ;
মুষলধারে সাহস টানে
. দ্রৌপদীর শাড়ি।
প্রতিশ্রুত হাতুড়ি এলো
. অন্ধকারে ছুটে,
বাড়ালো হৃৎপিণ্ড তার
. চাঁদের মতো মুঠি।
আকাশ ভরে উঠলো সোর,
মন্ত্র-পড়া অন্তরাল
. দিলো না তবু সাড়া।
অসম্ভব দ্রৌপদীর
. অন্তহীন শাড়ি।
. *************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
কঙ্কাবতী
কবি বুদ্ধদেব বসু
“বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
তোমার নামের শব্দ আমার কানে আর প্রাণে গানের মতো---
মর্মের মাঝে মর্মরি’ বাজে, ‘কঙ্কা! কঙ্কা! কঙ্কাবতী!’
. ( কঙ্কাবতী গো )
দূর সিন্ধু তরঙ্গ-রোল অমাবশ্যায় অনবরত
( অন্ধকারের অন্তর-ভরা ছন্গ-শিহর স্পন্দমান )
সুপ্তির ’পরে স্বপ্নের ঘোরে ফেটে বেজে ওঠে গানের মতো,
অন্ধকারের অন্তর থেকে তরঙ্গ-রোল ইতস্তত
কেঁপে ফুটে ওঠে, ফেটে বেজে যায় ; ঢেউয়ের মুখের ফেনার মতো
. ( কঙ্কাবতী গো )
গড়ায় ছড়ায় সুপ্তির ’পরে স্বপ্নের ঘোরে সমস্ত রাত :
তেমনি তোমার নামের শব্দ, নামের শব্দ আমার কানে
বাজে দিন-রাত, বাজে সারা-রাত, বাজে সারা-দিন আমার প্রাণে
. ঢেউয়ের মতন ইতস্তত ;
ঢেউয়ের মতন গান গেয়ে যায় : ‘কঙ্কা, কঙ্কা, কঙ্কাবতী।’
. কঙ্কাবতী গো!
দিনের স্বপ্নে, রাতের স্বপ্নে তোমার নামের শব্দ শুনি,