বুদ্ধদেব বসুর কবিতা
*
ঘুমের সময়
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


জ্বলিছে নরম মোম
.            ছোটো মোর ঘরে,
জ্বলিছে নতুন চাঁদ
.            মেঘের শিয়রে |
এক মুঠো ছোটো চাঁদ,
.             কত আলো তার,
এক মুঠো মিঠে আলো
.             বালিশে আমার |
মোমের নরম চোখে
.              স্বপ্নেরা ঝরে,
ঘুমের নরম চুমো
.              দুই চোখ ভ’রে |

.                *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
পরিমল-কে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


পদ্য যদি লিখতে তুমি পরিমল,
.                  মুগ্ধ হতাম সকলে,
হার মানাতে নামজাদা সব কবিদের
.                  ছন্দ-মিলের দখলে |
যত কথা --- আজগুবি আর অসম্ভব
.                  ঘুরছে তোমার মগজে,
দয়া করে কলম নিয়ে একটানা
.                  লিখতে যদি কাগজে !
কিন্তু তুমি নিজে কিছুই লিখলে না---
.                  আমায় দিলে উৎসাহ,
তুমি আমার করলে তোমার রাজকবি,
.                   আমি তোমার বাদশাহ |
ফল যা হ’লো, দেখতে তো তা পাচ্ছোই---
.                   এই যে ছোটো বইখানা,
আগাগোড়া একটি ছড়াও নেই এতে
.                   তোমার যেটা নয় জানা |
পাবো অনেক নিন্দে, খানিক প্রশংসা,
.                    কে-ই বা গায়ে তা মাখে !
ভালোবাসার সঙ্গে দিলাম, পরিমল,
.                    আমার এ-বই তোমাকে |


আমরা যখন ছোটো ছিলাম, পরিমল,
.                    মনে কি নেই কী হ’তো ?
ইচ্ছে হ’লেই চ’লে যেতাম ইস্পাহান,
.                    কটোপাক্সি, কিয়োতো |
জ্যোছনা-রাতে দেখতে পেতাম পরিদের
.                     জানলা থেকে লুকিয়ে,
অন্ধকারে ভূতের পায়ের আওয়াজে
.                     রক্ত যেতো শুকিয়ে |
এখন--- মোরা যেথায় আছি,  দিনরাত
.                      আটকে আছি সেখানেই,
চাঁদের আলোয় নাচে না আর পরিরা,
.                      ভূত-পেরেতের দেখা নেই |
কিন্তু তোমার সঙ্গে থেকে, পরিমল,
.                      ফিরলো মনে সেই সব,
মনে হ’লো রাখবো বেঁধে কবিতায়
.                       তোমার আমার শৈশব |
অমনি, দেখো, কাগজ নিলাম একরাশ,
.                       কালি নিলাম দোয়াতে,
যা লিখেছি উজাড় ক’রে, পরিমল,
.                       দিলাম তোমার দু-হাতে |

.                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বারো মাসের ছড়া
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


সবচেয়ে ভালোবাসি বৈশাখ মাস,
মূর্ত আশার মতো দীপ্ত আকাশ |  
জ্যৈষ্ঠের খর তাপ তীব্রপরশ,
রোদ্দুরে যত রোষ আমে তত রস
দীর্ঘ দ্বিপ্রহর অবসরে ভরা,
সূর্য অস্ত যেতে করে না তো ত্বরা |      
আষাঢ় আঁধার হ’য়ে আকাশে ছড়ায়
পাখা-পাওয়া পাহাড়ের চূড়ায়-চূড়ায় |
দলে-দলে চলে মেঘ, জ্বলে বিদ্যুৎ,
হঠাৎ বজ্র বাজে, বৃষ্টির দূত |    
তারপর শ্রাবণের রিমঝিম রাত,
জুঁইফুলে গন্ধের স্বপ্ন-প্রপাত |
চুপ ক’রে শুয়ে-শুয়ে কী-যে ভালো লাগা,
জেগে-জেগে ঘুম আর ঘুমে যেন জাগা |
ঝরোঝরো ঝরে জল অতল অথই,
মনে হয় আমি যেন রুমি আর নই |
নই আর ছোটো মেয়ে দাঁত নড়ো-নড়ো,
কাউকে না-ব’লে আমি হ’য়ে গেছি বড়ো |
টুটুকে, দিদিকে, মা-কে গিয়েছি ছাড়িয়ে
নাগাল পান না বাবা দু-হাত বাড়িয়ে |
আমি যেন গল্পের, আমি যেন কোন
স্বপ্নের কাঞ্চনকুমারীর বোন |
ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি সেই আছি ছোটো,
মা বলেন, ‘বেলা হ’লো, রুমুমণি ওঠো |’
ভাদ্রের মুখে হাসি, চোখে তবু জল,
ঝরায় বাদল তার শেষ সম্বল |
আকাশে একটু লাগে নীলের পালিশ
ঝিকমিক রোদ ঠিক টাটকা ইলিশ |
রৌদ্রের রূপো হ’লো সোনা একদিন,
পুজোর গন্ধ নিয়ে এলো আশ্বিন |
গাল-ফোলা শাদা মেঘ আহ্লাদে খেলে,
সূর্যের একপাল উজ্জ্বল ছেলে |
কার্তিক ক্লান্তির কুয়াশায় মিশে
অঘ্রাণে ডেকে আনে ধান্যের শিষে |
ছোটো হ’য়ে আসি দিন, বেলা পড়ে ঢ’লে
পৌষের সুন্দর রৌদ্রের কোলে |
পাঁচটা না-বাজতেই সূর্য পলায়,
লম্বা ঘুমের রাত লেপের তলায় |
কালোকেলো কই মাছ লাল তেলে ভাসে
সবুজ মটরশুঁটি সাজে পাশে-পাশে |           
আজ ভাবি, কাল ভাবি শীত বুঝি যায়
উত্তুরে হাওয়া তার উত্তর দ্যায় |    
মর্মরে ঝংকারে মাঘ এলো ঐ,
গাছে-গাছে ডালে-ডালে লাগে হৈ-চৈ |         
আজ কেন সব-কিছু  লাগছে নতুন ?
গুনগুন গুঞ্জনে এলো ফাল্গুন |      
উঁকি দেয় উত্সুক আম্রমুকুল,
তারি ফাঁকে কোকিলের বসে ইশকুল |
বাক্সে লুকায় যত কম্বল শাল,
হঠাৎ হাওয়ায় লাগে চৈত্রের তাল |
দিলখোলা দক্ষিণ, হালকা শরীর,
কত যেন ফুর্তির দিন-রাত্তির |
উত্তাপে উত্সাহে উচ্ছলে প্রাণে,
কাঁচা আম গ্রীষ্মের আশ্বাস আনে |       
ঐরাবতের মতো বৈকালী মেঘে
উত্তাল ওঠে কালবৈশাখী রেগে |         
ঝঞ্ঝায় উড়ে যায় পুরোনোর দায়
চৈত্রের সন্ধ্যায় বর্ষবিদায় |

.                   *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
পাপ্পার জন্মদিনে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


পাপ্পা, আমার ছোট্ট উঠোনটিতে
.                ফুটেছিলো গোলাপ, চাঁপাফুল
অপ্ রাজিতার নীল চোখের তলে
.                ঝুমকোলতার এলিয়ে-দেয়া চুল |
সূর্যমুখীর রং-মাখানো দিন,
.                জুঁই-ফোটানো সন্ধ্যারাতের ঘোর,
ঘুমের কালো নদীর মোহানায়
.                শিউলিফুলে শিউরে ওঠা ভোর |
যে-সব ফুল কী হ’লো, আজ তুমি
.                শুধাও যদি--- কী দেবো উত্তর ?
পাপ্পা, আমার শীতের অবেলায়
.                শুনতে কি চাও আলোর কলস্বর ?
তখনো যে আকাশ ছিলো লাল,
.                ঘাসের মুখে শিশির ছলোছলো,
আলোর টানে যাদের আনাগোনা
.                না-দিয়ে কি পারি তাদের, বলো !
তখন যারা আমার কাছে এসে
.                চ’লে গেছে দণ্ড দুয়েক পরে,
কিংবা যারা পথে চলার ধুলো
.                মুছে গেছে আমার দাওয়ার ‘পরে,
তাদের আমি দিয়েছি সব তুলে
.                দু-হাত ভ’রে অপ্ রাজিতা, চাঁপা,
রক্তবরন উদ্ধত গোলাপ,
.                স্বপ্নময় শিউলি কাঁপা-কাঁপা |
এমনি ক’রে বিলিয়ে দিলাম সব
.                ভাবিনি তা তুচ্ছ কিংবা দামি,
তোমার জন্যে কিচ্ছু বাকি নেই,
.                বাকি আছি কেবলমাত্র আমি |
পাপ্পা, আমার ছোট্ট বারান্দায়
.                অনেকগুলো ছিলো পোষাপাখি,
সন্ধ্যা সকাল দুপুরবেলা ভরে
.                সারাটা দিন রঙিন ডাকাডাকি |
ছোট্ট চড়ুই, ফুর্তি তার কত
.                ভোরের বেলা আলোর জানালায়,
মধ্যদিনে ঠাণ্ডা ছায়া ফেলে
.                ঘুঘুর ডাকে কান্না ঝ’রে যায় |
উপচে পড়ে বুলবুলির শিস,
.                কোকিল তোলে উচ্ছ্বসিত তান,
যেন আমার আর কোনো কাজ নেই
.                কেবল হাওয়ায় বিলিয়ে দেবো গান |
সে-সব গান কী হ’লো, আজ তুমি
.                শুধাও যদি---- কী দেবো উত্তর ?
পাপ্পা, আমার পাতা-ঝরার দিনে
.                কোথায় পাবো ফুলের খেলাঘর ;
পাখিরা সব যে যার গান সেরে
.                মিলিয়ে গেলো দিনান্তের আলোয়,
গানগুলি সব ছড়িয়ে উড়ে গেলো
.                নানাদিকে, নানান পথের ধুলোয় |
জানি না আর তারপরে কী হ’লো,
.                হয়তো বা কেউ কুড়িয়ে নিলো ঘরে ;
বানের জলে ডুবলো বুঝি কত
.                হয়তো আবার জাগবে নতুন চরে |
সব হারিয়ে শূন্য হাতে আজ
.                তোমার কাছেই আস্তে এসে থামি,
তোমার জন্যে আর-কিছু তো নেই,
.                আছি এখন কেবলমাত্র আমি |

.                      *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
হাওয়ার গান
কবি বুদ্ধদেব বসু
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” থেকে নেওয়া |


হাওয়াদের বাড়ি নেই, হাওয়াদের বাড়ি নেই,
.                      নেই রে |
.              তারা শুধু কেঁদে মরে বাইরে |
সারা-দিন-রাত্রির বুক-চাপা কান্নায়
নিশ্বাস বয়ে যায় উত্তাল, অস্থির---
.             সে কোথায়, সে কোথায়, হায় রে |
বলে তারা, পৃথিবীর সব জল, সব তীর
ছুঁয়ে গেছি বার-বার দুর্বার ইচ্ছায়,
.              তবু নেই, সে তো নেই, নেই রে |
সব জল, সব তীর, পাহাড়ের গম্ভীর
কন্দর, বন্দর, নগরের ঘন ভিড়,
অরণ্য, প্রান্তর, শূন্য তেপান্তর---
.              সব পথে ঘুরেছি বৃথাই  রে |
পার্কের বেঞ্চিতে ঝরা পাতা ঝর্ঝর,
শার্সিতে কেঁপে-ওঠা দেয়ালের পঞ্জর
চিমনির নিস্বনে, কাননের ক্রন্দনে
.               তার কথা কেবলি শুধাই রে |
তেমনি মিষ্টি ছেলে দোলনায় ঘুম যায়,
আবছায়া কার্পেট কুকুরের তন্দ্রায়,
ঘরে-ঘরে জ্বলে যায় স্বপ্নের মৃদু মোম—
.                সে-ই শুধু নিয়েছে বিদায় রে |
আঁধারে জাহাজ চলে, মাস্তুলে জ্বলে দীপ,
যাত্রীরা সিনেমায়, কেউ নাচে, গান গায় ;
আমরা তরঙ্গের বুকে হানি প্রশ্নের
আবিরাম নর্তন, মত্ত আবর্তন----
.               সে কোথায়, সে কোথায়, হায় রে !
অবশেষে থামে সব, ডেক হয় নির্জন,
অকুল অন্ধকারে ফেটে পড়ে গর্জন,
সমুদ্র ওঠে দুলে, বাঁকা চাঁদ পড়ে ঝুলে---
.                আমাদের বিশ্রাম নেই রে |
আমাদের বাড়ি নেই, দেশ নেই, শেষ নেই,
.                কেঁদে-কেঁদে মরি শুধু বাইরে,
বার-বার পারাপার যত করি, তবু তার
.                 নেই, নেই, দেখা নেই, নেই রে !
সময় অন্তহীন, অফুরান সন্ধান,
বিশ্বের বুক ফেটে বয়ে যায় এই গান---
.                  কোনখানে গেলে তারে পাই রে !
.                   খুঁজে খুঁজে ঘুরে ফিরি বাইরে,
.                   সুরে-সুরে বলে যাই-নেই রে,
.                   চিরকাল উত্তাল তাই রে |’

.                         *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
রুমির পত্র --- বাবাকে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


.        ও বাবা, ও বাবা
দিদি        বললে আমায়, ‘হাবা !
.                তুই    এটাও বুঝিস না !
নিজে        পদ্য বানিয়ে
বাবা        ভোলান তা নিয়ে
.                নেই   সত্যি পরি-মা |
বলে        বিজ্ঞানে কী, জানিস,
আছে        অনেক রকম জিনিশ,
.                 অনেক   অদ্ভুত জন্তু,
.        জন্মদিনের পরি,
কিংবা         জ্বর তাড়ানো পরি
.                 নেই   সত্যিই কিন্তু |
ও-সব         কুসংস্কারেই
দেশের        দশা হ’লো এই
.                 এখন জওহরলালজী
যদি        চল্লিশ কোটির
দেন         ফরমাশ রোটির
.                  তবে  লঙ্কা,  আটা, ঘি
নিয়ে        লাগবে যারা কাজে
বল        তাদের কাছে বাজে
.                  তোর  পরির মতো কী !’
আমি        ভাবছি ব’সে তাই ;
যদি        তিমি দেখতে চাই
.                  পাবো  ছবি দেখতে বইয়ের,
তাতে         বোঝাই যাবে না
তার        কত্ত বড়ো হাঁ
.                   যেন  জাহাজ-খাওয়া ঢেউয়ের |
আর        যখন ঘুমের আগে
আমার        কেমন ভালো লাগে---
.                   শোনো  সত্যি কথাটা----
আমি         ঠিক দেখতে পাই
তুমি        যা লিখেছো তা-ই
.                  সেই   চিঠির পরি-মা |
নিজ        চক্ষের দেখায়
বুঝি        মিথ্যেই শেখায়,
.                   আর  সত্যি হ’লো তা-ই,   
যা        কক্ খনো দেখিনি,
.        জল-পাহাড়ি তিমির
.                    মাইল-জোড়া হাই !
দিদির         বিজ্ঞানের বই
ভুল         করেছে নিশ্চয়ই---
.                    সত্যি না, বাবা ?
যদি         পরি না-ই থাকে
তবে         বলো তো কোন ফাঁকে
.                    মনে  জাগলো পরির ভাবা ?
বাবা        তুমি নিজেই ঐ
না-হয়        পদ্য লিখেছোই
.                    কিন্তু পরি-মা
.        সত্যি যদি না হন
তবে         তুমি-ই বা কেমন
.                    ক’রে   জানলে কথাটা !
আমার         মনে হচ্ছে, শোনো,
পরি-        মায়ের কোনো-কোনো
.                    কথা   মোটেও শুনিনি,
তাই        না-ব’লে-ক’য়ে
.        সত্যি মিথ্যে হ’য়ে
.                    মিলিয়ে গেলেন উনি ?
.        দিদিকে লাল ফিতে
মা-কে        যেই দেখেছি দিতে
.                    কেঁদে বাধিয়েছি সেই হাট,
.        হয়নি আমার করা
কিছু         তেমন লেখাপড়া
.                     আজ বয়স হ’লো সাত |
খাবার         সময় মিছিমিছি
আমার        আছেই চ্যাঁচামেচি,
.                    সেটা  বড়োই বিশ্রী,
আর        আঁচল ধরে মা-র
.        ঘ্যানঘেনে আবদার
.                     না-  ক’রেই পারিনি |
.        আমার এ-সব দোষে
দূর        আকাশ-পারে ব’সে
.                     পরি-মা রাগ ক’রে
.        আমায় দিলেন ফাঁকি ?
বাবা,        সত্যিই  তা-ই নাকি ?
.                      রাখো,   রাখো ধ’রে |
আমি         মন করলেম আজই
মুখে        আনবো না আর পাজি,
.                      কক্-  খনো না, কক্ খনো,
আর         নাকি সুরের কাঁদা,
কিংবা         বেড়াল-গলা সাধা
.                       আমার   আবার যদি শোনো
তবে        বেসো না আর ভালো,
তবে        যা ইচ্ছে তাই বোলো---
.                       কিছু  বলতেও হবে না,
.        অঙ্ক আর ইংরিজি
আমি        শিখবো নিজে-নিজেই---
.                       বলো,   সত্যি পরি-মা !
আমি         সত্যি হবো ভালো,
বাবা,         সত্যি ক’রে বলো,
.                        দিদি   কিছু জানে না,
আমার        চোখেই আঁকা সে
ঐ        দূরের আকাশের
.                         আমার  সত্যি পরি-মা |

.                         *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
পরি-মার পত্র --- বাবাকে
কবি বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “বারোমাসের ছড়া” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


.                শুনুন, মশাই শুনুন,
আপনি                যতই কথা বুনুন,
.                        ছড়া  যতই বাঁধুন না,
কেউ                মানবে না আর, আছে
কোথাও         দূরে কিংবা কাছে,
.                কোনো সত্যি পরি-মা |
যখন                 ছোট্ট ছিলো রুমি,
ছিলো                 কুট্টুস, টুনটুনি,
.                        ঠিক   দেখতে পেতো আমায়,
ঐ                দূরের আকাশে
যেমন                মেঘেরা ভাসে
.                        চাঁদের        আলোর জামায় |
তখন                জন্মদিনের ভোরে,
.                কিংবা জ্বরের ঘোরে
.                        রুমি   বলতো, ‘ও বাবা !           
আমার         মনে হচ্ছে আজই
হবেন                 পরি-মা ঠিক রাজি
.                        আমার  চিঠি লিখতে আবার !’
.                ঐ কথা যেই শোনা,
আমার                অমনি আনাগোনা
.                        রুমির পাশে-পাশে,
.                যেমন হাওয়ার হাত
নাড়ে                 আহ্লাদে হঠাৎ
.                        গাছে, পাতায়, ঘাসে |
সেই                আহ্লাদি রুমির
অফু-                রন্ত ঝুমঝুনির
.                        আর  ছন্দ শুনি না ;
আর                ছোটো তো নেই----ষাট---
আজ                বয়স হ’লো আট
.                        রুমি  ন’য়ে দিলো পা |
সেই                কুট্টুস, টুনটুনি
আজ                ইশকুল-পনঠুনি,
.                        আর   দু-দিন পরেই ক’ষে
.                বুঝি-বা তার দিদির
মতো                সে-ও হবে গম্ভীর
.                        কেবল পড়া করবে ব’সে |
আজ                যতই ভোলে বানান,
আপনি                ততই ওকে শানান
.                        ব-ফলা ম-ফলায়,
আর                যক্ষুনি নামতায়
ও                একটুও আমতায়
.                        তক্ষুনি জোর গলায়
.                হেঁকে বলেন, ‘রুমি !
তোমার                এখনও দুষ্টুমি !
.                        করো  শীঘ্রি মুখস্ত !’
দেখে                 বনেছি তাজ্জব,
তবে                 এও হ’লো সম্ভব---
.                        আজ রুমিও ব্যস্ত !
এখন                সময় বড়ো কড়া ;
আছে                ইংরিজির পড়া,
.                        আছে  রিবন, জুতো, জামা,
.                সভ্যতা, ভব্যতা,
আছে                ভদ্ররকম কথা ;
.                        সময়   নেই তো শুধু আমার !
তবে                চক্ষু আরো বাঁকান,
আর                বিদ্যে আরো শেখান,
.                        কেন  মিথ্যে ছড়া লেখা ?
আমি                 যাচ্ছি ফিরে সেই
আমার                 দূরের বাসাতেই,
.                        সারা   আকাশ ভ’রে একা |
.                ঐ তো রুমি ঘুমোয় ;
আমি                 শুধু একটি চুমোয়
.                তাকে   ইচ্ছে দিয়ে যাই,
কাল                জন্মদিনের ভোরে
যেন                স্বপ্ন মনে প’ড়ে
.                        উঠে  আবছা বিছানায়
ভাবে,                ‘কে ছিলো এক্ষুনি ?
আমার                 নাম কে ডাকে শুনি ?
.                        কই,   আর তো শুনি না !
.                সত্যি কি তাহলে
গেলো                 আকাশ ভ’রে চ’লে
.                        ঐ আমার পরি-মা ?’

.                         *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
দ্রৌপদীর শাড়ি
কবি বুদ্ধদেব বসু
“বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৫৩) থেকে নেওয়া। “দ্রৌপদীর শাড়ি” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


রোদ্দুরের আঙুলে আঁকা
.        মেঘের চেরা সিঁথি
হঠাৎ খুলে দিলো স্মৃতির
.        অন্তহীন ফিতে।
এমনি এক মেঘলা দিন
সীমান্তের শাসনহীন,
ভবিষ্যত দেখা না যায়,
.        অতীত হ’লো হারা।
দুঃস্বপনে পড়িলো মনে
.        দ্রৈপদীর শাড়ি।

সেদিন মেঘে সোনার পাড়,
.        রৌদ্র ভিজে-ভিজে ;
গাছের গায়ে আছাড় দেয়
.        হাওয়ার হিজিবিজি।
দুপুর কেন বিকেল, আর
বিকেল হ’লো অন্ধকার ;
সন্ধ্যাকালে উচ্চহাসে
.        সূর্য পেলো ছাড়া।
দুঃশাসন করিলো পণ
.        দ্রৌপদীর শাড়ি।

ভাঙলো ঘুম, লাল আগুন
.        ধৈর্যহীন শিরায়
উল্লসিত হুল্লোড়ের
.        আনলো কড়া নাড়া।
আকাশে তারই স্বৈরাচার ;
কখনো নীল মেঘের ভার,
আলোর বাঘ কখনো ছায়া-
.        হরিণে করে তাড়া ;
আশার দাঁত চিবিয়ে ছেঁড়ে
.        দ্রৌপদীর শাড়ি।

স্বর্গে আর মর্ত্যো যেন
.        বাঁধিয়া দিলো সেতু
অচির-পরিবর্তনের
.        তুমূল মত্ততা।
আলো ছায়ার খেলার ঘরে
ভীষণ ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ে,
বজ্র শুনে লাফিয়ে ওঠে
.        বিদ্যুতের খাঁড়া ;
মুষলধারে সাহস টানে
.        দ্রৌপদীর শাড়ি।

প্রতিশ্রুত হাতুড়ি এলো
.        অন্ধকারে ছুটে,
বাড়ালো হৃৎপিণ্ড তার
.        চাঁদের মতো মুঠি।
আকাশ ভরে উঠলো সোর,
মন্ত্র-পড়া অন্তরাল
.        দিলো না তবু সাড়া।
অসম্ভব দ্রৌপদীর
.        অন্তহীন শাড়ি।

.             *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
কঙ্কাবতী
কবি বুদ্ধদেব বসু
“বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৫৩ ) থেকে নেওয়া। “কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


তোমার নামের শব্দ আমার কানে আর প্রাণে গানের মতো---
মর্মের মাঝে মর্মরি’ বাজে, ‘কঙ্কা! কঙ্কা! কঙ্কাবতী!’  
.                                        ( কঙ্কাবতী গো )
দূর সিন্ধু তরঙ্গ-রোল অমাবশ্যায় অনবরত
( অন্ধকারের অন্তর-ভরা ছন্গ-শিহর স্পন্দমান )
সুপ্তির ’পরে স্বপ্নের ঘোরে ফেটে বেজে ওঠে গানের মতো,
অন্ধকারের অন্তর থেকে তরঙ্গ-রোল ইতস্তত
কেঁপে ফুটে ওঠে, ফেটে বেজে যায় ; ঢেউয়ের মুখের ফেনার মতো
.                                        ( কঙ্কাবতী গো )
গড়ায় ছড়ায় সুপ্তির ’পরে স্বপ্নের ঘোরে সমস্ত রাত :
তেমনি তোমার নামের শব্দ, নামের শব্দ আমার কানে
বাজে দিন-রাত, বাজে সারা-রাত, বাজে সারা-দিন আমার প্রাণে
.                                        ঢেউয়ের মতন ইতস্তত ;
ঢেউয়ের মতন গান গেয়ে যায় : ‘কঙ্কা, কঙ্কা, কঙ্কাবতী।’
.                                         কঙ্কাবতী গো!



দিনের স্বপ্নে, রাতের স্বপ্নে তোমার নামের শব্দ শুনি,


.                                               *************              

.                                                                               
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর