পাত্রপাত্রী : কর্ণ, কুন্তী, দ্রৌপদী, কৃষ্ণ ও দুই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ স্থান : গঙ্গাতীরে এক বনভূমি কাল : কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরম্ভ হবার পূর্বদিন
[ মঞ্চের পশ্চাদ্ ভাগ অর্ধ-আলোকিত, সেখানে কর্ণ স্থির হ’য়ে দাঁড়িয়ে, তাঁর পিঠ দর্শকদের দিকে ফেরানো | সামনের আলোকিত অংশে দুই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ | ]
প্রথম বৃদ্ধ
আজ সেই দিন, আমরা যার অপেক্ষায় ছিলাম এতকাল : অঘ্রাণ মাস, তিথি কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী | দুপুর পেরিয়ে গেলো, সূর্য নামে পশ্চিমে | ধীরে, সূর্যদেব, ধীরে, আজ ত্বরা করবেন না, আজ বিলম্বিত হোক আপনার সান্ধ্য স্নান | সময় দিন, আমাদের সময় দিন, আমরা উত্কন্ঠিত, আমাদের সময় দিন | কেননা আজ সূর্যাস্তের আগে এক বিশাল সিদ্ধান্ত নেবেন নেতারা : কুরুকুল ধ্বংস হবে না রক্ষা পাবে, নারী কন্ঠে ক্রন্দনরোল উঠবে কিনা, মাতবে কিনা মহোত্সবে শেয়াল-কুকুর হস্তিনাপুরে-- সেই সিদ্ধান্ত | আমি তা-ই শুনেছি, কিন্তু ঠিক জানি না |
দ্বিতীয় বৃদ্ধ রাজা, তাঁরা আমাদের রাজা, রাজা, তাঁরা আমাদের রাজা, কুরুবংশীয় শূরবৃন্দ -- মহীপাল --মহান -- বেদে ও ব্রাহ্মণে শ্রদ্ধাবান, দেবতার প্রিয়পাত্র | তাঁদের রাজ্যে নেই দুর্ভিক্ষ বা দস্যুতা, নেই কুসীদজীবী, নেই সত্যভ্রষ্ট বিচারক | তাঁদের আশ্রয়ে সুখে আছি আমরা-- অন্তত ছিলাম : যতদিন না ধার্তরাষ্ট্র আর পান্ডবের মধ্যে বিরোধ একপাল ইঁদুরের মতো ছিন্ন করেছিলো সেই রজ্জু, সৌভ্রাত্র যার নাম, যা বেঁধে রাখে রাষ্ট্রকে | আপনারা
তাঁর জন্ম নিয়ে নানা লোকে নানা কথা বলে, তিনি নাকি পালিত পুত্র অধিরথের, তাঁর প্রকৃত পিতা এক রাজরাজেশ্বর | আমি কর্ণপাত করি না ও-সবে | দেবতার দয়া হ’লে কেন জন্ম নেবে না দীনের কুটিরে বীরত্ব, যশস্বীর উত্স হবে না অখ্যাত বীজ ? যাকে বলে প্রতিভা, তা সহজাত | আমি এই বুঝি |
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
কর্ণের কীর্তির কথা আপনারাও জানেন | দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষায় তাঁর মতো দক্ষ কেউ হননি -- অর্জুন ছাড়া | পাঞ্চালীর স্বয়ংবরসভায় লক্ষ্যভেদ করতে পারতেন ধরাধামে দু-জন মাত্র --অর্জুন, আর তিনি | তাই বুদ্ধিমান দুর্যোধন অর্জন করেছেন তাঁর সৌহার্দ্য অনেক আগেই -- অঙ্গরাজ্য উপঢৌকন দিয়ে সকলেই চায় বিক্রমশালী মিত্র, বিশেষত রাজারা |
প্রথম বৃদ্ধ
অনেকে কর্ণকে বলে উগ্রস্বভাব, দাম্ভিক, কিন্তু কর্ণের নিন্দুকেরা আমার বন্ধু হয়নি কখনো | আমি দেখেছি তাঁকে দিনের পর দিন এই গঙ্গার তীরে, বনভূমিতে, নিঃসঙ্গ | মৃগয়া তাঁর ব্যসন নয়, নারী তাঁর বিলাস নয়, প্রমোদে তিনি উদাসিন, নির্জনতা ভালোবাসেন | আমি তাকে জানি মহাপ্রাণ ব’লে, শুধু অস্ত্রবীর নন, সত্যনিষ্ঠ, দানে তিনি সূর্যের মতো উদার, ত্যাগে তিনি মহিমান্বিত : আর এও জানি এ-মুহূর্তে তাঁরই উপর নির্ভর-- কুরুকূল ধ্বংস হবে, না রক্ষা পাবে, রাঙবে কিনা ক্ষত্রশোণিতে কুরুক্ষেত্র, যুদ্ধ হবে --- কি হবে না |
কেননা তিনি কুরুপক্ষের স্তম্ভস্বরূপ , অথচ কুরুবংশের অনাত্মীয়, কুন্তী, মাদ্রী বা গান্ধারীর গর্ভজাত নন ; তাই ধর্মত তিনি পারেন যুদ্ধ থেকে স’রে দাঁড়াতে ; আর তিনি স’রে দাঁড়ালে দুর্যোধনেরও রণস্পৃহা নিস্তেজ হবে-- অন্তত আমার তা-ই ধারণা | কে না বোঝে পরাজয়ের চেয়ে অর্ধেক রাজত্ব অনেক ভালো, সর্বনাশের চেয়ে অনেক ভালো সুবিচার |
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
এ কী ! কুন্তী আসছেন, যশস্বিনী পৃথা, বিখ্যাত যদুবংশে যাঁর জন্ম, তিনি পেয়েছিলেন বন্দনীয় পান্ডুকে তাঁর ভর্তা, আর দেবতার বরে, দেবতার মতো পঞ্চপুত্র |
কুন্তীর প্রবেশ
কুন্তী
বৃদ্ধেরা, শুনুন | আমি মন্ত্রণাসভা ছেড়ে দ্রুত এসেছি এখানে নিজেকে চিন্তা করার সময় না-দিয়ে, এক আকস্মিক সংকল্পে উত্তেজিত | আমার এক কর্তব্য আছে -- অতি কঠিন -- বহুদিন ধ’রে অসম্পন্ন , আজ পালন করবো | কিছু বক্তব্য আছে, মুখে আনা সহজ নয়, কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হবে |
প্রথম বৃদ্ধ
আমার অনুমান আপনি কর্ণকে কিছু বলতে চান--- হয়তো কোনো গূঢ় বার্তা ? আমরা কি চ’লে যাবো, স’রে দাঁড়াবো ?
কুন্তী
অদূরে থাকবেন | শ্রবণের বাইরে যাবেন না |
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
তা
সাক্ষী থাকুন আমার স্বীকারোক্তির ;--- আপনাদের মার্জনা পেলে আমার মন আরো নির্ভার হবে |
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
দেবী, আমরা জানি না আপনি কী বলতে চান, আমাদের শোনা উচিত কিনা জানি না | কিন্তু যদি আমাদের যোগ্য ব’লে ভাবেন, সত্য পণ ক’রে বলছি, গোপন রাখবো |
প্রথম বৃদ্ধ
সত্য পণ ক’রে বলছি, গোপন রাখবো |
কুন্তী
অন্য এক কারণেও এখানে আপনাদের উপস্থিতি আমার কাম্য | আমি এসেছি কর্ণের কাছে এক প্রস্তাব নিয়ে-- শুভ প্রস্তাব, কর্ণের পক্ষে সৌভাগ্যময়, কুরুকুলের পক্ষে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলজনক, আর ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষেও আনন্দের | কিন্তু আমার আশঙ্কা, এই মঙ্গলসাধনের পরিপন্থী হবে কর্ণের আত্মশ্লাঘা | স্বপ্রতিষ্ঠ সে, স্বনির্ভর ; অন্যের কথা মানতে অনভ্যস্ত | তবু আশা : হয়তো সফল হ’য়ে ফিরতে পারি যদি আপনারা, মহদাশয় ব্রাহ্মণ, মুক্ত কন্ঠে সমর্থন করেন আমার প্রস্তাব |
প্রথম বৃদ্ধ
যদি ধর্মসংগত হয়, নিশ্চয় করবো | আমরা অন্তরালে যাই, আমাদের শ্রুতি রইলো এখানে |
[ বৃদ্ধেরা অর্ধালোকে প্রচ্ছন্ন হলেন | কর্ণকে উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেলো | ]
কুন্তী
[ কর্ণের দিকে অগ্রসর হ’য়ে ]
রৌদ্র প্রখর | বৃক্ষের মতো ছায়া ফেলে কর্ণ দন্ডায়মান | আমি খুঁজবো আশ্রয় সেই ছায়ায়, আমিআজ প্রার্থিনী |
[ কুন্তী কর্ণের পশ্চাদ্ ভাগে দাঁড়ালেন | ]
কর্ণ
( ফিরে তাকিয়ে, ক্ষণকাল পরে ) প্রণত হই, দেবী | আমি উন্মন ছিলাম, তাই লক্ষ করিনি আপনাকে | মার্জনা করবেন | আদেশ করুণ, আপনার কোন প্রিয় কর্ম আমার সম্পাদ্য ? আমি অধিরথের পুত্র, কর্ণ , রাধা আমার মাতা |
কুন্তী
( মুগ্ধ চোখে কর্ণের দিকে তাকিয়ে ) কর্ণ, আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে না ?
কর্ণ
পরিচয় অনাবশ্যক | অতিথিমাত্রেই অর্চনীয় | আমি প্রত্যহ দ্বিপ্রহরে কিছু দান করি যেদিন যাঁর দেখা পাই তাঁকেই | কিন্তু আপনাকে দেখে
( কুন্তীর মুখের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে ) মনে হচ্ছে কোনো রাজ্ঞী --- মহীয়সী ---- বীরাঙ্গনা | ইচ্ছে হয় তো আপনার পরিচয় বলুন |
কুন্তী
আর্যাবর্তে ও দক্ষিণাত্যে যবদ্বীপ থেকে যবনদ্বীপ পর্যন্ত অনেকেই আমার নাম জানে |
( ক্ষণকাল পরে ) আমি কুন্তী |
কর্ণ ( সবিস্ময়ে )
কুন্তী! অর্জুনের মাতা !
কুন্তী
যুধীষ্ঠির, ভীম, অর্জুনের আমি জননী--- এবং অন্য একজনের |
কর্ণ
অন্য একজনের ?
কুন্তী
জ্যেষ্ঠ সে, শ্রেষ্ঠ সে অতুলনীয় | অর্জুনের মতো বীর, যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মাত্মা |
কর্ণ
আমার
অর্জুন -- আর এই তেজস্বী পুরুষ, যাঁর নাম এখনো জানি না |
কুন্তী
তোমার সঙ্গে অচিরে তার দেখা হবে কর্ণ, দেখবে কেমন অবিকল সে প্রতিদ্বন্দ্বী তোমার : তোমারই মতো দীর্ঘকায়, আয়তাক্ষ, তোমারই মতো শক্তিমান, হৃদয়বান, মহত্তম বন্ধু, শত্রুর পক্ষে অসহন --- ভরতবংশের সেই প্রথম পার্থ, যার নাম--
( হঠাৎ থেমে, উচ্ছ্বসিত স্বরে ) কর্ণ, পুত্র আমার !
[ কুন্তী হাত বাড়িয়ে কর্ণকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হলেন, কিন্তু কর্ণ স’রে গেলেন পিছনে | ]
( কোমল স্বরে ) না--- না--- না ! আর অন্ধ থেকো না , কর্ণ, চিনতে শেখো নিজেকে, আমার কাছে জেনে নাও তোমার আত্মপরিচয়-- এই আমি : যার গর্ভ ছিলো তোমার প্রথম মর্ত্যলোক, যার ভুক্ত অন্ন প্রথম পথ্য ছিল তোমার, যার প্রাণবায়ুতে তুমি প্রথম নিশ্বাস নিয়েছিলে-- শোনো আজ তার মুখ থেকে, বিদ্ধ ক’রে নাও হৃদয়ে : তুমি কুন্তীপুত্র, তুমি সূর্যের সন্তান |
[ কর্ণ কুন্তীর চোখে চোখ রাখলেন, কিছু বললেন না | ]
নীরব কেন, কর্ণ ? ভাবছো এ-কথা অবিশ্বাস্য ? না কি বিস্ময়ে রুদ্ধ তোমার কন্ঠস্বর ?
কর্ণ
( উন্মনভাবে, স্বগতোক্তির ধরনে ) কবে, তা মনে পড়ে না, কার মুখ থেকে, মনে পড়ে না, কোনো কল্পনার কম্পন হয়তো, কোনো দূরশ্রুত প্রবাদ, কোনো গহন স্বপ্নে অতর্কিতে যা ভেসে ওঠে, জন্মান্তরের স্মৃতির মতো অস্পষ্ট--- আমি শুনেছিলাম, ভুলেছিলাম, ভেবেছিলাম, ভুলে যেতে-যেতে ভুলতে পারিনি মেনে নিতে-নিতে মানতে পারিনি রাজকন্যা কুন্তী আমার জন্মদাত্রী, আমার পিতা সূর্যদেব | . --- কিন্তু এ কি সত্য হ’তে পারে ?
কুন্তী
( ব্যগ্র স্বরে ) তুমি জানতে ? তুমি আগেই জানতে ? তাহ’লে দূরে ছিলে কেন এতদিন ? যদি স্বপ্নে তোমাকে ধরা দিয়েছিলো সত্য, তাহ’লে স্বগৃহে কেন ফিরে আসোনি ?
কর্ণ
আমার স্বগৃহ ? তা কোথায় ? ( ক্ষণকাল পরে, ভিন্ন সুরে ) . ---- কিন্তু কে নয়, কে নয় সূর্যের সন্তান এই জগতে ? যা-কিছু আছে সপ্রাণ, তৃণ, বৃক্ষ, জন্তু, মানুষ -- যারা পরস্পরকে আহার ক’রে বংশপরম্পর বেঁচে থাকে, জন্ম-জন্মান্তরে ঘূর্ণিত হয়-- সূর্য তাদের সকলেরই পিতা, সকলেরই প্রতিপালক | পশুর মলজাত যে-কীট, সেও তো সূর্যের সন্তান |
( ক্ষীণ হেসে ) হয়তে সেই অর্থেই ---- আমি |
কুন্তী
একমাত্র মা জানেন তাঁর সন্তান কে, একমাত্র মা জানেন তাঁর সন্তানের পিতা কে, তাই মাতৃবাক্য অবশ্যমান্য | এ-কথা মূর্খেও বোঝে | আর, কর্ণ, তুমি বিদ্বান |
কর্ণ
( কয়েক মুহূর্ত চিন্তা ক’রে )
. না --- আমি বিশ্বাস করি না ! এ কি সম্ভব যে সূর্যের তেজঃপুঞ্জকে কখনো সহ্য করতে পেরেছিলেন কোনো মানবী-- এমনকি দীপ্তিময়ী কুন্তী ?
কুন্তী
‘
তখন আদিত্য, পূষণ, দিনমণি, তরুণ সম্রাটের মতো সূর্যদেব প্রেরণ করলেন আমার অন্তস্থলে তাঁর দৃষ্টি-- একটি . কোমলতম রশ্মিরেখা-- অন্তত আমার তা-ই মনে হ’লো | নামলো গভীর নিদ্রা আমার . চেতনায় | জেগে উঠে বুঝলাম, আমি অন্তঃসত্ত্বা | আমার সেই পুত্র ---তুমি !