বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাট্য
প্রথম পার্থ
*
প্রথম পার্থ ( ১৯৬৯ )
কবি বুদ্ধদেব বসু

পাত্রপাত্রী : কর্ণ, কুন্তী, দ্রৌপদী, কৃষ্ণ ও দুই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ       
স্থান : গঙ্গাতীরে এক বনভূমি       
কাল : কুরুক্ষেত্র  যুদ্ধ আরম্ভ হবার পূর্বদিন

[ মঞ্চের পশ্চাদ্ ভাগ অর্ধ-আলোকিত, সেখানে কর্ণ স্থির হ’য়ে দাঁড়িয়ে, তাঁর পিঠ দর্শকদের
দিকে ফেরানো | সামনের আলোকিত অংশে দুই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ |
 ]


প্রথম বৃদ্ধ

আজ সেই দিন, আমরা যার অপেক্ষায় ছিলাম এতকাল :
অঘ্রাণ মাস, তিথি কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী |
দুপুর পেরিয়ে গেলো, সূর্য নামে পশ্চিমে |
ধীরে, সূর্যদেব, ধীরে,
আজ ত্বরা করবেন না,
আজ বিলম্বিত হোক আপনার সান্ধ্য স্নান |
সময় দিন, আমাদের সময় দিন,
আমরা উত্কন্ঠিত, আমাদের সময় দিন |
কেননা আজ সূর্যাস্তের আগে এক বিশাল
সিদ্ধান্ত নেবেন নেতারা : কুরুকুল ধ্বংস হবে না রক্ষা পাবে,
নারী কন্ঠে ক্রন্দনরোল উঠবে কিনা,
মাতবে কিনা মহোত্সবে শেয়াল-কুকুর হস্তিনাপুরে--
সেই সিদ্ধান্ত |
আমি তা-ই শুনেছি, কিন্তু ঠিক জানি না |


দ্বিতীয় বৃদ্ধ
                    
রাজা, তাঁরা আমাদের রাজা,
রাজা, তাঁরা আমাদের রাজা,
কুরুবংশীয় শূরবৃন্দ -- মহীপাল --মহান --
বেদে ও ব্রাহ্মণে শ্রদ্ধাবান, দেবতার প্রিয়পাত্র |
তাঁদের রাজ্যে নেই দুর্ভিক্ষ বা দস্যুতা,
নেই কুসীদজীবী, নেই সত্যভ্রষ্ট বিচারক |
তাঁদের আশ্রয়ে সুখে আছি আমরা--
অন্তত ছিলাম :
যতদিন না ধার্তরাষ্ট্র আর পান্ডবের মধ্যে বিরোধ
একপাল ইঁদুরের মতো ছিন্ন করেছিলো সেই রজ্জু,
সৌভ্রাত্র যার নাম, যা বেঁধে রাখে রাষ্ট্রকে |
আপনারা     
  
   



 
 
 
 
 
  
 
 
 
 
 
 
  
  
 

                    
  

  
  
  
  
  
তাঁর জন্ম নিয়ে নানা লোকে নানা কথা বলে,
তিনি নাকি পালিত পুত্র অধিরথের, তাঁর প্রকৃত পিতা এক
রাজরাজেশ্বর |
আমি কর্ণপাত করি না ও-সবে |  দেবতার দয়া হ’লে
কেন জন্ম নেবে না দীনের কুটিরে বীরত্ব,
যশস্বীর উত্স হবে না অখ্যাত বীজ ?
যাকে বলে প্রতিভা, তা সহজাত | আমি এই বুঝি |


দ্বিতীয় বৃদ্ধ

কর্ণের কীর্তির কথা আপনারাও জানেন |
দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষায়
তাঁর মতো দক্ষ কেউ হননি -- অর্জুন ছাড়া |
পাঞ্চালীর স্বয়ংবরসভায় লক্ষ্যভেদ করতে পারতেন
ধরাধামে দু-জন মাত্র --অর্জুন, আর তিনি |
তাই বুদ্ধিমান দুর্যোধন
অর্জন করেছেন তাঁর সৌহার্দ্য
অনেক আগেই -- অঙ্গরাজ্য উপঢৌকন দিয়ে
সকলেই চায় বিক্রমশালী মিত্র, বিশেষত রাজারা |

          
প্রথম বৃদ্ধ

অনেকে কর্ণকে বলে উগ্রস্বভাব, দাম্ভিক,
কিন্তু কর্ণের নিন্দুকেরা  আমার বন্ধু হয়নি কখনো |
আমি দেখেছি তাঁকে দিনের পর দিন
এই গঙ্গার তীরে, বনভূমিতে, নিঃসঙ্গ |
মৃগয়া তাঁর ব্যসন নয়, নারী তাঁর বিলাস নয়,
প্রমোদে তিনি উদাসিন, নির্জনতা ভালোবাসেন |
আমি তাকে জানি মহাপ্রাণ ব’লে,
শুধু অস্ত্রবীর নন, সত্যনিষ্ঠ,
দানে তিনি সূর্যের মতো উদার, ত্যাগে তিনি মহিমান্বিত :
আর এও জানি
এ-মুহূর্তে তাঁরই উপর নির্ভর--
কুরুকূল ধ্বংস হবে, না রক্ষা পাবে,
রাঙবে কিনা ক্ষত্রশোণিতে কুরুক্ষেত্র,
যুদ্ধ হবে --- কি হবে না |

কেননা তিনি কুরুপক্ষের স্তম্ভস্বরূপ ,
অথচ কুরুবংশের অনাত্মীয়,
কুন্তী, মাদ্রী বা গান্ধারীর গর্ভজাত নন ;
তাই ধর্মত
তিনি পারেন যুদ্ধ থেকে স’রে দাঁড়াতে ;
আর তিনি স’রে দাঁড়ালে
দুর্যোধনেরও রণস্পৃহা নিস্তেজ হবে--
অন্তত আমার তা-ই ধারণা |
কে না বোঝে পরাজয়ের চেয়ে অর্ধেক রাজত্ব অনেক ভালো,
সর্বনাশের চেয়ে অনেক ভালো সুবিচার |


দ্বিতীয় বৃদ্ধ

এ কী !
কুন্তী আসছেন,
যশস্বিনী পৃথা,
বিখ্যাত যদুবংশে যাঁর জন্ম, তিনি পেয়েছিলেন
বন্দনীয় পান্ডুকে তাঁর ভর্তা,
আর দেবতার বরে, দেবতার মতো পঞ্চপুত্র |


কুন্তীর প্রবেশ

কুন্তী

বৃদ্ধেরা, শুনুন  |
আমি মন্ত্রণাসভা ছেড়ে দ্রুত এসেছি এখানে
নিজেকে চিন্তা করার সময় না-দিয়ে,
এক আকস্মিক সংকল্পে উত্তেজিত |
আমার এক কর্তব্য আছে -- অতি কঠিন -- বহুদিন ধ’রে অসম্পন্ন ,
আজ পালন করবো |
কিছু বক্তব্য আছে, মুখে আনা সহজ নয়,
কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হবে |


প্রথম বৃদ্ধ

আমার অনুমান আপনি কর্ণকে কিছু বলতে চান---
হয়তো কোনো গূঢ় বার্তা ?
আমরা কি চ’লে যাবো, স’রে দাঁড়াবো  ?


কুন্তী

অদূরে থাকবেন |  শ্রবণের বাইরে যাবেন না |

দ্বিতীয় বৃদ্ধ

তা     

  

   
  
  
   
  
  
   
   
  
  
   
   
সাক্ষী থাকুন আমার স্বীকারোক্তির ;---
আপনাদের মার্জনা পেলে আমার মন আরো নির্ভার হবে |


দ্বিতীয় বৃদ্ধ

দেবী, আমরা জানি না আপনি কী বলতে চান,
আমাদের শোনা উচিত কিনা জানি না |
কিন্তু যদি আমাদের যোগ্য ব’লে ভাবেন,
সত্য পণ ক’রে বলছি,  গোপন রাখবো |


প্রথম বৃদ্ধ

সত্য পণ ক’রে বলছি, গোপন রাখবো |


কুন্তী

অন্য এক কারণেও
এখানে আপনাদের উপস্থিতি আমার কাম্য |
আমি এসেছি কর্ণের কাছে এক প্রস্তাব নিয়ে--
শুভ প্রস্তাব, কর্ণের পক্ষে সৌভাগ্যময়,
কুরুকুলের পক্ষে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলজনক,
আর ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষেও আনন্দের |
কিন্তু আমার আশঙ্কা, এই মঙ্গলসাধনের
পরিপন্থী হবে কর্ণের আত্মশ্লাঘা |
স্বপ্রতিষ্ঠ সে, স্বনির্ভর ; অন্যের কথা মানতে অনভ্যস্ত |
তবু আশা : হয়তো সফল হ’য়ে ফিরতে পারি
যদি আপনারা, মহদাশয় ব্রাহ্মণ,
মুক্ত কন্ঠে সমর্থন করেন আমার প্রস্তাব |


প্রথম বৃদ্ধ

যদি ধর্মসংগত হয়, নিশ্চয় করবো |
আমরা অন্তরালে যাই, আমাদের শ্রুতি রইলো এখানে |

[
বৃদ্ধেরা  অর্ধালোকে প্রচ্ছন্ন হলেন | কর্ণকে উজ্জ্বল  আলোয় দেখা গেলো |  ]

কুন্তী

[ কর্ণের দিকে অগ্রসর হ’য়ে ]

রৌদ্র প্রখর |
বৃক্ষের মতো ছায়া ফেলে
কর্ণ দন্ডায়মান |
আমি খুঁজবো আশ্রয় সেই ছায়ায়, আমিআজ প্রার্থিনী |


[
কুন্তী কর্ণের পশ্চাদ্ ভাগে দাঁড়ালেন |  ]


কর্ণ

( ফিরে তাকিয়ে, ক্ষণকাল পরে )
প্রণত হই, দেবী | আমি উন্মন ছিলাম,
তাই লক্ষ করিনি আপনাকে | মার্জনা করবেন |
আদেশ করুণ, আপনার কোন প্রিয় কর্ম আমার সম্পাদ্য ?
আমি অধিরথের পুত্র, কর্ণ , রাধা আমার মাতা |


কুন্তী

( মুগ্ধ চোখে কর্ণের দিকে তাকিয়ে )
কর্ণ, আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে না ?


কর্ণ

পরিচয় অনাবশ্যক | অতিথিমাত্রেই অর্চনীয় |
আমি প্রত্যহ দ্বিপ্রহরে কিছু দান করি
যেদিন যাঁর দেখা পাই তাঁকেই |  কিন্তু আপনাকে দেখে


( কুন্তীর মুখের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে )
মনে হচ্ছে কোনো রাজ্ঞী --- মহীয়সী ---- বীরাঙ্গনা |
ইচ্ছে হয় তো আপনার পরিচয় বলুন |



কুন্তী

আর্যাবর্তে ও দক্ষিণাত্যে
যবদ্বীপ থেকে যবনদ্বীপ পর্যন্ত
অনেকেই আমার নাম জানে |


( ক্ষণকাল পরে )
আমি কুন্তী  |


কর্ণ
( সবিস্ময়ে )

কুন্তী! অর্জুনের মাতা !


কুন্তী

যুধীষ্ঠির, ভীম, অর্জুনের আমি জননী---
এবং অন্য একজনের |


কর্ণ

অন্য একজনের  ?


কুন্তী

জ্যেষ্ঠ সে, শ্রেষ্ঠ সে অতুলনীয় |
অর্জুনের মতো বীর, যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মাত্মা |


কর্ণ

আমার     
  
  


   

   
    
    
   
   
   
   
   
   


   
     
    
অর্জুন  -- আর এই তেজস্বী পুরুষ, যাঁর নাম এখনো
জানি না |


কুন্তী

তোমার সঙ্গে অচিরে তার দেখা হবে কর্ণ,
দেখবে কেমন অবিকল সে প্রতিদ্বন্দ্বী তোমার :
তোমারই মতো দীর্ঘকায়, আয়তাক্ষ,
তোমারই মতো শক্তিমান, হৃদয়বান,
মহত্তম বন্ধু, শত্রুর পক্ষে অসহন ---
ভরতবংশের সেই প্রথম পার্থ, যার নাম--

( হঠাৎ থেমে, উচ্ছ্বসিত স্বরে )
কর্ণ,  পুত্র আমার !


[
কুন্তী হাত বাড়িয়ে কর্ণকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হলেন, কিন্তু কর্ণ স’রে গেলেন পিছনে | ]


কর্ণ
( কোমল স্বরে )
আপনার পুত্রসম্বোধনে কৃতার্থ আমি, দেবী---
আমি, অধিরথপুত্র বৈকর্তন, রাধার সন্তান |


কুন্তী

( কোমল স্বরে )
না--- না--- না !
আর অন্ধ থেকো না , কর্ণ,  চিনতে শেখো নিজেকে,
আমার কাছে জেনে নাও তোমার আত্মপরিচয়--
এই আমি :
যার গর্ভ ছিলো তোমার প্রথম মর্ত্যলোক,
যার ভুক্ত অন্ন প্রথম পথ্য ছিল তোমার,
যার প্রাণবায়ুতে তুমি প্রথম নিশ্বাস নিয়েছিলে--
শোনো আজ তার মুখ থেকে, বিদ্ধ ক’রে নাও হৃদয়ে :
তুমি কুন্তীপুত্র, তুমি সূর্যের সন্তান  |

[
কর্ণ কুন্তীর চোখে চোখ রাখলেন, কিছু বললেন না |  ]


নীরব কেন, কর্ণ  ?  ভাবছো এ-কথা অবিশ্বাস্য ?
না কি বিস্ময়ে রুদ্ধ তোমার কন্ঠস্বর ?

কর্ণ

( উন্মনভাবে, স্বগতোক্তির ধরনে )
কবে, তা মনে পড়ে না,
কার মুখ থেকে, মনে পড়ে না,
কোনো কল্পনার কম্পন হয়তো, কোনো দূরশ্রুত প্রবাদ,
কোনো গহন স্বপ্নে অতর্কিতে যা ভেসে ওঠে,
জন্মান্তরের স্মৃতির মতো অস্পষ্ট---
আমি শুনেছিলাম, ভুলেছিলাম, ভেবেছিলাম,
ভুলে যেতে-যেতে ভুলতে পারিনি
মেনে নিতে-নিতে মানতে পারিনি
রাজকন্যা কুন্তী আমার জন্মদাত্রী,
আমার পিতা সূর্যদেব |
.                         --- কিন্তু এ কি সত্য হ’তে পারে ?


কুন্তী

( ব্যগ্র স্বরে )
তুমি জানতে ? তুমি আগেই জানতে ? তাহ’লে দূরে ছিলে কেন
এতদিন ?
যদি স্বপ্নে তোমাকে ধরা দিয়েছিলো সত্য, তাহ’লে স্বগৃহে কেন
ফিরে আসোনি ?


কর্ণ

আমার স্বগৃহ ?  তা কোথায়  ?
( ক্ষণকাল পরে, ভিন্ন সুরে )
.                               ---- কিন্তু কে নয়,
কে নয় সূর্যের সন্তান এই জগতে ? যা-কিছু আছে সপ্রাণ,
তৃণ, বৃক্ষ, জন্তু, মানুষ -- যারা পরস্পরকে আহার ক’রে
বংশপরম্পর বেঁচে থাকে, জন্ম-জন্মান্তরে ঘূর্ণিত হয়--
সূর্য তাদের সকলেরই পিতা, সকলেরই প্রতিপালক |
পশুর মলজাত যে-কীট, সেও তো সূর্যের সন্তান |

( ক্ষীণ হেসে )
হয়তে সেই অর্থেই ---- আমি |


কুন্তী

একমাত্র মা জানেন তাঁর সন্তান কে,
একমাত্র মা জানেন তাঁর সন্তানের পিতা কে,
তাই মাতৃবাক্য অবশ্যমান্য | এ-কথা মূর্খেও বোঝে |
আর, কর্ণ, তুমি বিদ্বান |


কর্ণ

( কয়েক মুহূর্ত চিন্তা ক’রে )

.                     না --- আমি বিশ্বাস করি না !
এ কি সম্ভব যে সূর্যের তেজঃপুঞ্জকে
কখনো সহ্য করতে পেরেছিলেন কোনো মানবী--
এমনকি দীপ্তিময়ী কুন্তী  ?


কুন্তী

  
   
  
   
   
   
   
   
    
    
‘       
       
       
        
            
         
              
              
             
          
              
            
          
          
          
           
            
         
তখন আদিত্য, পূষণ, দিনমণি,
তরুণ সম্রাটের মতো সূর্যদেব
প্রেরণ করলেন আমার অন্তস্থলে তাঁর দৃষ্টি-- একটি
.  কোমলতম রশ্মিরেখা--
অন্তত আমার তা-ই মনে হ’লো  | নামলো গভীর নিদ্রা আমার
.  চেতনায় |
জেগে উঠে বুঝলাম, আমি অন্তঃসত্ত্বা |
আমার সেই পুত্র ---তুমি !


*************                
.                                                               
পরবর্তী অংশ পড়তে. . .   
.                                                                
প্রখম পার্থর সূচিতে . . .   
.                                               
বুদ্ধদেব বসুর কবিতার মূল সূচিতে . . .   
.                                                          
এই পাতার উপরে ফেরত . . .  




মিলনসাগর