মিলনসাগরে কবি বুদ্ধদেব বসুর "প্রথম পার্থ" কাব্যনাট্যের দ্বিতীয় পাতার পর . . .
প্রথম বৃদ্ধ
ছায়া দীর্ঘতর, রৌদ্রে লাগে অপরাহ্নের হলুদ, এখনো মীমাংসা হ’লো না | কুন্তী আকে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ ক’রে গেছেন, নয়তো আমি --- এই বৃদ্ধ চরণে যতদূর সম্ভব সত্বর ছুটে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলতাম, ‘কর্ণ আপনার সহোদর, আপনার . অগ্রজ |’ বার্তা
প্রথম বৃদ্ধ
আমি দেখতে পাচ্ছি সেই অলোকলক্ষণাকে--- কৃশা নন, স্থূলাঙ্গী নন, নন অতিকৃষা বা রক্তবর্ণা, তেজস্বিনী সুভাষিণী রমণীরত্ন, যাঁকে অর্জন করেছিলেন অর্জুন, আর ধর্মরাজ পণ রেখেছিলেন-- সেই আমাদের দুঃখের আরম্ভ |
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
কিন্তু এর অর্থ কী ? যাজ্ঞসেনী কেন এখানে ?
প্রথম বৃদ্ধ
অপেক্ষা করা যাক | হয়তো তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন |
[ দ্রৌপদীর প্রবেশ ]
দ্রৌপদী
বৃদ্ধেরা, আমি শুনেছি কর্ণ এখানে অধিগম্য | তা কি সত্য ?
প্রথম বৃদ্ধ
মনস্বিনী পাঞ্চালী, আপনি যথাস্থানে এসেছেন |
দ্রৌপদী
আপনারা দেখেছেন তাঁকে ? তিনি একা আছেন, না সঙ্গীপরিবৃত ?
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
এ-মুহূর্তে একা | আপনি কি তাঁর সাক্ষাৎ চান ?
দ্রৌপদী
আপ
প্রথম বৃদ্ধ
দীনেরা তাঁর ভক্ত, আর্তের তিনি বন্ধু |
দ্রৌপদী ( তীব্র স্বরে )
কিন্তু আপনারা কি শোনেননি যে দ্যুতসভায় আমার সেই অকথ্য, অকল্পনীয় অপমানের মুহূর্তে আমার ক্রন্দনময় বিলাপ শুনে কর্ণ হেসে উঠে বলেছিলো, ‘যে-নারীকে পঞ্চস্বামীও রক্ষা করতে . পারে না, সে দাসী ছাড়া আর কী ?’
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
দ্রুপদকন্যা, যদি অপরাধ না নেন বলি, অন্য এক কাহিনীও আমরা শুনেছি | আপনার স্বয়ংবরসভায় কর্ণের প্রত্যাখান | যজ্ঞভূমি থেকে কুক্কুরের মতো প্রত্যাখান | অযোগ্য ব’লে নয়, অন্ত্যজ ব’লে | অন্যায় থেকে অন্যায়ের জন্ম--- আশাতীত নয় |
দ্রৌপদী ( তীব্র স্বরে )
আপনারা ব্রাহ্মণ হ’য়ে বলবেন য়ে রাজকন্যার প্রার্থী হ’তে পারে কোনো সূতপুত্র !
প্রথম বৃদ্ধ
কত অদ্ভুত জন্ম হয়, পান্ডবজায়া : আপনার যেমন যজ্ঞাগ্নি থেকে, যেমন শরবনে দেবসেনাপতির | তেমনি হয়তো ----
[ দ্বিতীয় বৃদ্ধ ইঙ্গিত করলেন | প্রথম বৃদ্ধ কথা শেষ করলেন না | ]
দ্রৌপদী
মনে হয় আরো কিছু বক্তব্য ছিলো আপনার ?
প্রথম বৃদ্ধ
আমার বক্তব্য সরল | বর্ণভেদ যদি ব্রহ্মার বিধান, দ্রোণ তবু ক্ষত্রিয়, বিশ্বামত্র ব্রাহ্মণ | কর্ণের বংশপরিচয় যা-ই হোক, ব্যবহারে তিনি বীর |
কিন্তু দ্যূতসভায় আপনাকে যারা নির্জিত করেন তাঁরা ধার্তরাষ্ট্র, বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় | আর সেই দৃশ্য দেখে আচার্য দ্রোণ ছিলেন নিঃশব্দ | ধৃতরাষ্ট্র নতমুখে নিঃশব্দ | আর মহাত্মা ভীষ্ম বলেছিলেন, ‘ধর্মের গতি সূক্ষ্ম’ ! কারো মুখে প্রতিবাদ ফোটেনি | তা-ই শুনেছি আমরা |
দ্রৌপদী
তাঁরা নিঃশব্দ ছিলেন বেদনায় | কর্ণ নির্লজ্জের মতো হেসেছিলো |
প্রথম বৃদ্ধ
জনশ্রুতি এই : ভীমসেন স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের বাহু দগ্ধ করতে চেয়েছিলেন | এ যদি সত্য হয়, কর্ণ কেন দূষ্য ? দেবী, মানুযের মনোভাব অনেক, প্রকাশভঙ্গি স্বল্প | হয়তো আপনার সেই আর্তির মুহূর্তে যখন পান্ডবেরা ছিলেন পুত্তলির মতো নিস্পন্দ, আর প্রাচীনেরা বাক্ শক্তিরহিত, তখন কর্ণই প্রথম ধিক্কারে উন্মুখর হয়েছিলেন |
দ্রৌপদী
কাকে ধিক্কার ? আমার প্রতারিত পঞ্চস্বামীকে ?
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
কে
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
যারা সংকটকালে বিদ্রোহ করে, তারা কি ভালো ? হয়তো রাবণভ্রাতা বিভীষণের উত্তরে ইতিহাসে কর্ণ থাকবেন দৃষ্টান্ত |
দ্রৌপদী
আমারও তা-ই আশঙ্কা |
প্রথম বৃদ্ধ ( ক্ষণকাল পরে )
আপনার শঙ্কার কারণ----- যুদ্ধ ?
দ্রৌপদী
. আশঙ্কার একটিমাত্র কারণ হ’তে পারে : পান্ডবের পরাজয় | তা কি সম্ভব ? আমি জানি দুর্যোধনের মিত্রেরাও তাঁর অমিত্র | ভীষ্ম দ্রোণ যুদ্ধ করবেন কৌরবপক্ষে, কিন্তু শুধু বাহুবলে, অস্ত্রবলে--- মন, প্রাণ, হৃদয় দিয়ে নয় | শুনেছি শল্য যোগ দেবেন কৌরবপক্ষে-- মনে হয় খেলাচ্ছলে, কেননা তিনি সতী মাদ্রীর সহোদর, পান্ডবের বিনাশ তাঁর কাম্য হ’তে পারে না | শুধু কর্ণ আছেন পান্ডবের প্রতিশ্রুত শত্রু, এবং পরাক্রান্ত-- শুধু তিনি সর্বান্তঃকরণে যুদ্ধ করবেন ; শুধু তিনি সম্ভবপর বাধা আমাদের সিদ্ধির | তাঁকে আমার ভয় | আর তাই আমি এসেছি তাঁকে একটি পরামর্শ দিতে যাতে তাঁর কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু হস্তিনাপুর ফিরে পাবে স্বাস্থ্য, জয় হবে সত্যের | আপনারা বিদ্বান, বিচার ক’রে বলুন-- আমি কি সাক্ষাৎ করবো কর্ণের সঙ্গে, না কি অনুচিত হবে ?
দ্বিতীয় বৃদ্ধ
যদি আপনার অভীষ্ট এই রাস্ট্রের কল্যাণ, যদি দ্বন্দ্বের সমাধান আপনার উদ্দেশ্য, তাহ’লে জানবেন লোকাচার তুচ্ছ, সংকোচ অনর্থক |
দ্রৌপদী
আপনাদের কথায় আমি উত্সাহ পেলাম আমার চেষ্টায় | আমি তাহ’লে এগিয়ে যাই | আপনারা অন্তরালে যান |
[ বৃদ্ধেরা অন্তরালে প্রচ্ছন্ন হলেন | পূর্ণ আলোয় উপবিষ্ট কর্ণকে দেখা গেলো | দ্রৌপদী এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে | ]
দ্রৌ
দ্রৌপদী ( সহজ সুরে )
হঠাৎ ইচ্ছে হ’লো তোমাকে আবার দেখি |
কর্ণ
. তোমার ইচ্ছে হ’লো ?
দ্রৌ
কর্ণ
মধুময় তোমার বাক্য, দ্রৌপদী | কিন্তু দুঃখ এই-- শুধু বনভূমি দিয়ে রচিত নয় পৃথিবী , শুধু পতঙ্গের গুঞ্জন দিয়ে নয়, পল্লবের মর্মর দিয়ে নয় | আছে রাজধানী | প্রাসাদ | আছেন রাজন্যেরা | আছে চক্রান্ত, সংঘর্ষ, অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা | মানুষ ভ’রে তোলে তার জগৎ কর্মের গর্জন , ঘটনার কলরোল দিয়ে | নিজেকে সময় দেয় না স্তব্ধতার জন্য , সময় দেয় না হৃদয়কে তার কথা বলতে |
ভালো নয়, পাঞ্চালী, ভালো নয় নতুন ক’রে বেদনা জাগানো, নতুন ক’রে সেই জ্বালা, সেই প্রতিকারহীন অবিচার ! দ্রুপদকন্যা, ফিরে যাও | তোমার রূপের রশ্মি আমার পক্ষে দুঃসহ, তোমার ললিত কন্ঠ আমার পক্ষে উত্পীড়ন |
দ্রৌপদী
এখনো জ্বালা ----- এতদিন পরেও ? দ্যূতসভায় তোমার প্রতিশোধ কি পূর্ণ হয়নি ?
কর্ণ
( আগ্রহের সুরে )
তোমার মনে আছে ? তোমার মনে আছে ? দ্যূতসভায় আমি কী বলেছিলাম ? কী করেছিলাম ?
দ্রৌপদী ( সতর্কভাবে )
আমি ছিলাম আর্ত, উদ্ভ্রান্ত | তোমাকে লক্ষ করিনি |
কর্ণ
আ
দ্রৌপদী ( কোমল স্বরে, কূটভাবে )
থাক, কর্ণ | অতীত আর আলোচ্য নয় এখন, কেননা সব তর্কের মীমাংসা হবে যুদ্ধে | তবু, তোমার কাছে একটি জিজ্ঞাসা আমার : ঐ যাকে অবিচার বললে তুমি, তার দৃষ্টান্ত শুধু কি আমার স্বয়ংবরসভা ? তুমি দুর্যোধনকে বলো তোমার সুহৃদ | কিন্তু তার কাছে কী পেয়েছো তুমি ? একমুঠো রাজত্ব ? কিন্তু তোমার ঐ অঙ্গরাজ পদবি-- তা কি নয় অন্তঃসারহীন অভিধামাত্র ? ক্ষমতা সব দুর্যোধনের, কতৃর্ত্ব সব দুর্যোধনের, তুমি শুধু ব্যবহার্য তার-- যন্ত্র যেমন যন্ত্রীর | বীর তুমি : এই কি তোমার যথাযোগ্য সম্মান ?
কর্ণ ( ঈষৎ হেসে )
তোমার যুক্তি আমি মানতে বাধ্য | কেউ আমাকে রাজা কর্ণ পর্যন্ত বলে না |
দ্রৌপদী ( উত্সাহিত, তবু সতর্ক )
তুমি কি ভাবো-- সম্ভব নয়, বিশ্বাস্য নয়, তবু ধরা যাক দৈবাৎ যদি কৌরবপক্ষ জয়ী হয় যুদ্ধে --- তুমি অংশ পাবে . রাজত্বের ?
কর্ণ ( ঈষৎ হেসে )
ভরতবংশে যার জন্ম নয়, সে পাবে রাজত্বের অংশ !
দ্রৌপদী (তীক্ষ্ণ চোখে কর্ণের দিকে তাকিয়ে )
তুমি মানো এই যুদ্ধে কোনো অংশ নেই তোমার ? যে-পক্ষেরই জয় হোক, তোমার কিছু এসে যায় না ?
কর্ণ
আবার আমার মর্মকথা তোমার মুখে শুনলাম
দ্রৌ
দ্রৌপদী
অন্তত আমি নিশ্চিত জানি কৌরবপক্ষের নেতৃগণের নিপাত | আর তাই বলি যে-যুদ্ধে তোমার কোনো অংশ নেই, স্বার্থ নেই, তাতে যুক্ত হ’য়ে তুমি কেন প্রাণ দেবে, কর্ণ ? যুদ্ধে মৃত্যু হ’লে স্বর্গলাভ হয় ক্ষত্রিয়ের, কিন্তু তুমি তো জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় নও |
কর্ণ
তোমার বাগ্মিতায় আমি মুগ্ধ, পাঞ্চালী |
দ্রৌপদী
. কিন্তু আমার প্রস্তাবে অসন্মত ? তবু, ভেবে দ্যাখো : যদি তুমি রণস্থলে, অস্ত্র হাতে নিয়ে পান্ডবের প্রতিপক্ষ হও--- তাহ’লে নিশ্চিত জেনো, অর্জুন তোমাকে সংহার করবেন, কর্ণ | ঐ তোমার দীপ্ত শির লুটিয়ে পড়বে রক্তময় কর্দমে ; আর তোমার শক্তিপুঞ্জ শরীর শয়ান হবে কবন্ধ, বীভৎসভাবে নিশ্চল | কিন্তু কেন --তাতে কোন তৃপ্তি হবে তোমার আত্মার ? কী সেই মহৎ উদ্দেশ্য, যা সাধন করবে তোমার মৃত্যু ?
( ক্ষণকাল পরে )
আমি সত্য বলবো | আমি চাই কৌরবের পতন | কিন্তু সেইজন্য কর্ণের আত্মহুতি আমার মনে হয় নিতান্তই অনর্থক |
কর্ণ
কিন্তু পান্ডবের জয় যদি নিশ্চিত, তাহ’লে কর্ণবধের গৌরব থেকে অর্জুনকে বঞ্চিত করা কি অন্যায় হবে না ?
দ্রৌপদী
তুমি কি তাহ’লে মৃত্যু-পণ করেছো ? এই সুন্দর পৃথিবীতে, এই রৌদ্রালোকে তুমি কি বাঁচতে চাও না, কর্ণ ? কেউ নেই, যাকে তুমি ভালোবাসো ?
কর্ণ
আমি ভালোবাসার কাঙাল নই, দ্রৌপদী, আমি আয়ুর ভিক্ষুক নই |
দ্রৌপদী
. কিন্তু আমি প্রার্থনা করি তোমার দীর্ঘায়ু | আমি চাই, যুদ্ধের পরে, যখন আর অন্তরাল হ’য়ে দুর্যোধন থাকবে না, তোমার সঙ্গে পঞ্চপান্ডবের মৈত্রী | ভাগ্যদোষে দুঃখ পেয়েছো . তুমি, তাঁদেরও দুঃখ অগণ্য | অবশেষে হোক সুখের সমাপ্তি | হোক স্নিগ্ধ তোমার জীবন তুমি নিশ্চয়ই জানো, আমার স্বামীদের যিনি সুহৃদ, আমিও তাঁকে বন্ধু বলে মানি | --- কর্ণ, আমি তোমার বন্ধুতা চাই |
কর্ণ ( অনেকটা আপন মনে )
আশ্চর্য ! অনেক ধ্বংস, অনেক মৃত্যু, বিপর্যস্ত রাষ্ট্র -- আর তারপর পঞ্চপান্ডবের সঙ্গে মৈত্রী, দ্রৌপদীর সঙ্গে . বন্ধুতা ---
( হঠাৎ থেমে , ক্ষণকাল পরে )
. এই অধিরথপুত্র বৈকর্তনের | পান্ডবেরা আমার কে ? --- কেউ নয় | আমি কি দ্রৌপদীর বন্ধু হ’তে চেয়েছিলাম ? --- শুধু বন্ধু ?
( দ্রৌপদীর দিকে ফিরে )
--- না ! এই আমার উত্তর, পাঞ্চালী : না ! তুমি জেনো আমি পান্ডবের বিপক্ষে আছি প্রতিশ্রুত আমার সব অস্ত্র নিয়ে, আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত-- দুর্যোধনের জন্য নয়, কিন্তু যেহেতু তাতেই আমার সার্থকতা |