রেল ধর্মঘট, ১৯৭৪    
চম্পা রায়চৌধুরী, নভেম্বর ২০১১, (
এক অতি সাধারণ ধর্মঘটী গৃহবধুর স্মৃতিচারণ)

কদিন শুনলাম রেল ধর্মঘট হবে, খুব অসহায় লাগল, বাড়ীর ভদ্রলোকেরা নাকি বাড়ীতে থাকবেন না---
আমরা, এই অবলা মহিলারা, সন্তান সন্ততী নিয়ে কি করে থাকব!

সেদিনটার কথা এখনও ভাবলে আশ্চর্য্য লাগে ---- অত শক্তি তখন কে জুগিয়েছিল আমাদের মনে! যেদিন
ধর্মঘট আরম্ভ হলো, ষ্টেশন ফাঁকা ---- গাড়ী সব দাঁড়িয়ে লাইনে, সন্ধ্যে পর্যন্ত আমার স্বামী কাউন্টারে ব’সে
কুপন কাটছেন ---- যে সব অপিসারেরা ধর্মঘটে যোগদান করেন নাই, তাদের খাবার জন্য | ষ্টেশনেই রান্না
হচ্ছে ওখানেই এক এক করে কুপন নিয়ে খাওয়া দাওয়া করছেন | বাড়ীতে খুব কমই যেতেন তারা | সবাই
জানলো রায় চৌধূরী বাবু ধর্মঘটে যোগদান করেন নাই | যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তারা | কিন্তু পরদিন থেকে
আর চৌধূরী সাহেবকে ষ্টেশনে কেউ পেল না | এদিকে ধর্মঘটিরা সবাই  ৭/ ৮ জন ক’রে এক একটি দল করে
শহরের এক এক বাড়ীতে আত্মগোপন করে থাকতেন |  আমাদের মহিলাদের কাজ হলো সংসার সামলানো
--- কলোনী সামলানো--- তার উপর এক এক জন আলাদা ভাবে দুই হাতে টিফিন ক্যারিয়ারে তাঁদের খাবার
নিয়ে সেই আন্ডার গ্রাউন্ডে পৌঁছে দেওয়া | কেবল বাড়ী থেকে বেরিয়েছি --- পুলিশের গাড়ী কলোনী টহল
দিচ্ছে |  চুপ করে অন্য কোয়ার্টারে ঢুকে যেতাম,আবার গাড়ী চলে গেলে দৌড়াতে দৌড়াতে আন্ডার গ্রাউন্ডে
ভাত পৌঁছে দিতাম | এমনি ক’রে দিনের পর দিন চলতে লাগল | তার মধ্যে সব বাড়ী থেকে কিছু কিছু চাল--
ডাল, তেল, নুন জোগার করে যে সব ফ্যামিলির খাওয়া জুটতো না তাদের দিতাম | আর রোজ বিকেলে সব
বাড়ীর মহিলাদের একত্র করে প্রসেশনে বের হতাম---- স্লোগান ছিল --- অফিসারদের নাম ক’রে ক’রে ---
কালোহাত গুঁড়িয়ে দাও, নিপাত যাক, নিপাত যাক, কুশ পুতলি পুড়িয়েছি | রোজ রাতে পুলিশের গাড়ী
কলোনীতে ঢুকতো ---- আমরা মাঝে মাঝে একটা বাড়ীতে গোপন সভা ক’রে সবাইকে বুঝিয়ে দিতাম,
বলতাম --- রাতে যদি পুলিশের গাড়ী দেখ, শঙ্খ বাজাবে, থালা বাজাবে | সবাই এক সাথে জুটে যাব | ওরাই
ভয়ে পালাবে | সুলতান সিং কি সাংঘাতিক পুলিশ অফিসার --- তাকে পর্যন্ত ঘায়েল করেছি আমরা |  
কলোনীতে ঢুকলেই --- সমবেত ভাবে চিত্কার উঠত-- সুলতান সিং নিপাত যাও | আমার স্বামী ও আর
একজন ধর্মঘটি ভদ্রলোক দৃঢ় সাহসে ভর ক’রে টাকা তুলে জলপাইগুড়ির রেল কর্ম্মীদের বৌদের দেবার জন্যে
একদিন বাসস্ট্যান্ডে বসে আছেন --- বাস আসতে দেরী আছে, উনি টাকাটা ঐ ভদ্রলোকের কাছে রেখে
সরকারী বাথরুমে গেছেন--- দুটো ছেলে বাথরুমে ঢুকে ওনাকে ধরে ফেলল--- এই দুটো ছেলে একবার বিনা
টিকিটে কোথায় যাচ্ছিল --- একজন টিকিট কালেকটার তাদের ধরে আমার স্বামীর কাছে নিয়ে যায়---- উনি
ওদের বকা ঝকা করে টিকিটের মূল্য আদায় করে টিকিট দিয়ে গাড়িতে তুলে দেন----- ওরা সেই কথা স্মরণ
করিয়ে দিয়ে বলল --- এবার পুলিশের হাতে আমরা ধরিয়ে দেব |  দিলোও তাই |

পুলিশের গাড়ী এল --- একজন বললেন ---- “আরে আপনি ? আপনি তো ধর্মঘট করেন নাই, আমাদের কুপন
দিলেন সেদিন খাবারের |  উনি বললেন -- আপনারা একটু চোখ বোজেন আমি দৌড়ে পালিয়ে যাই! আমি না
গেলে জলপাইগুড়ির মা-ভাই-বোনেরা না খেয়ে মরবে | পুলিশ অফিসার বোঝালেন তাতেও যদি আপনি ধরা
পরেন তবে কঠিন শাস্তি হবে |  এমন কি চাকুরী চলেও যেতে পারে” | কি আর করা -- ওদের  গাড়ীতে
ষ্টেশনে গেলেন -- ষ্টেশন মাষ্টার তার ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন -- “আরে আপনি তো ধর্মঘট করেন নাই -- কি
জন্যে ওরা ধরল” ? উনি স্বীকার করলেন ধর্মঘট করেছেন --- এটা না করলে তিনি বন্ধুদের কাছে খুব ছোট
হয়ে যেতেন | ষ্টেশন মাষ্টারের ঘরেই দুদিন ছিলেন -- তিনি অনুমতি দিলেন বাড়ীতে রাতে গিয়ে থাকতে
আবার ভোরে ষ্টেশনে চলে আসতে | এরপর তিন দিনের মাথায় ধর্মঘট উঠে গেল -- এটাও হ’ল ফার্ণান্ডেজের
জন্য |

সকলকার এতদিনের কষ্ট, আত্মত্যাগের কোন দাম থাকল না | তবে সেদিন আমার স্বামী ধরা পড়ে যাওয়ায়
তাঁর চাকরীটা গেল না | বরঞ্চ আরও উপরে প্রমোশন পেয়ে তারপর চাকরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন |
আমার একটা গর্ব্ব যে তিনি অসৎ কাজ না করে সৎপথে সারাজীবন কাজ করে সংসার চালিয়েছেন,
উপরওয়ালাদের প্রসংশা পেয়েছেন এবং সবার অসীম শ্রদ্ধা ভালবাসা পেয়েছেন |


আমরা
মিলনসাগরে কবির কবিতা প্রকাশিত করার অনুমতি পেয়ে আনন্দিত।    

কবি চম্পা রায়চৌধুরীর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন


কবির সঙ্গে যোগাযোগ -

দূরভাষ - ৯১৩৩২৫৩৯৫৬৯২  

উত্স : কবি চম্পা রায়চৌধুরীর সঙ্গে ১১.১২.২০১১ তারিখে নেওয়া একটি সাক্ষাত্কার। মিলনসাগরের পক্ষে
সাক্ষাত্কারটি নিয়েছিলেন মানস গুপ্ত।


আমাদের ই-মেল -
srimilansengupta@yahoo.co.in     

...
কবি চম্পা রায়চৌধুরীর পরিচিতির পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন . . .