চারণকবি মুকুন্দদাসের কবিতা ও গান
যে কোন গানের উপর ক্লিক করলেই সেই গানটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
এখনো খোলেনি আঁখি যার
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


.        এখনো খোলেনি আঁখি যার |
.        আমি কি দিয়ে বুঝাব তারে,
.        কোন্ ধর্ম সাধিবারে,
জনম লভিনু কোলে ‘ভারত মাতার’ ||
যদি কারো ভাগ্য গুণে, একটুখানি খোলে আঁখি
তখনি আমরা তারে চশ্ মা দিয়ে ঢেকে রাখি |
আসমানেতে বেঁধে ঘর, ভাবি মোরা কতই বড় |
পরে মোরা পেটের দায়ে ধরা দেখি অন্ধকার ||
বি. এ, এম. এ, পাশ করে নকরি যদি নাহি মিলে,
ভাবনা কেন কিসের ভয় মিশে যাও না চাষার দলে |
খেটে পড়ে খামার কর, শক্ত করে লাঙ্গল ধর ---
দেখতে পাবি দু’দিন পরে ঘুচে গেছে হাহাকার ||
মুকুন্দ বলিছে কেন কাঙ্গাল সেজেছ আজ,
তোমারই পার নাকি পারিতে বীরের সাজ |
দেখাতে পার নাকি বোঝাতে পার নাকি,
এ জগতে ভারতবাসীর কতটুকু অধিকার ||

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কোন্ ফাগুনের হাওয়া এ যে
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


কোন্ ফাগুনের হাওয়া এ যে,
.        কোন্ সাগরের ঢেউ |
.        তা বুঝলে না তো কেউ ||
কোন্ করমীর তূর্যনাদে কাঁপছে ধরাখান,
.        কালের ভেরী বাজছে কেন ?
ভারতবাসীর পরাণ গঙ্গায় ডাকল আবার বান |
.        ভাবলে নাকো কেউ ||
তাই তো বলি এই শ্মশানে অমানিশার রাতে,
বসে যা রে সাধকের দল মায়ের সাধনাতে |
.         সিদ্ধি তোদের হবেই হবে—
.         ভয় করিস্ নে কেউ ||

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আর কারে করি ভয়, মায়ের পেয়েছি অভয়
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


আর কারে করি ভয়, মায়ের পেয়েছি অভয়,
.        জয় মা বলে হও রে আগুয়ান |
জয় শঙ্খ নিনাদে মেদিনী কাঁপিয়ে দে—
.        ফুলিয়া উঠুক মরা প্রাণ ||
আত্মপর যাও রে ভুলি, কর সবে কোলাকুলি,
.        ওরে ভাই হিন্দু মুসলমান |
বাজা রে দামামা কাড়া, জগতে পড়ুক সাড়া,
.        মরেনি ভারত সন্তান ||
তোরা কেন ভাবিস্ এত, বড় কে তোদের মত,
.        তোদের মত কেবা বলীয়ান |
তোদের পূর্ব পুরুষগণে, একদিন এই ত্রিভূবনে,
.        উড়িয়েছিল বিজয় নিশান ||
তাদেরই সন্তান তোরা, জগতে নাই তোদের জোড়া,
.        তাই মা আমার তোদের পূজা চান |
মায়ের পূজার কর আয়োজন রক্তজবা বিল্ব চন্দন.
.        দাস মুকুন্দ দিবে বলিদান ||

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আয় রে বাঙ্গালী আয় সেজে আয়
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


আয় রে বাঙ্গালী আয় সেজে আয়,
.        আয় লেগে যাই দেশের কাজে |
দেখাই জগতে ভেতো বাঙ্গালী,
.        দাঁড়াইতে জানে বীর সমাজে ||
বহুদিন পরে ডাক এসেছে আজ,
.        ওরে বাঙ্গালী সাজ তোরা সাজ |
এখনো নীরবে নাই কিরে লাজ !
.        ধিক্ রে তোদের ক্ষাত্র তেজে ||
কোটী কন্ঠে আজ জয় মা বলিয়া,
.        দ্বেষ হিংসা আদি চরণে দলিয়া ;
দাঁড়া রে বাঙ্গালী আপনা ভুলিয়া,
.        সাজাই বাংলা নূতন সাজে ||
মাভৈঃ ওঠ্ রে ও বাঙ্গালী বীর,
.        কতকাল রবি নত করি শির—
শুনেছি রে জয় বাঙ্গালী জাতির,
.        আনহত শব্দ ভেরীর মাঝে ||
“এখনো নীরব, নাহি কি রে লাজ,
ডুবালি রে ভরা মরণ-সাগরে ||
বীর কখনও কি নত করে শির,
ধার ধারে কি সে হা হতোস্মির,
পারে কি দেখিতে বীর জননীর
উলঙ্গ-মূরতি যুগ-যুগান্তর ধরে ||
লুকাল কোথায় বদনের হাসি
পুঞ্জীভূত কেন ভালে চিন্তারাশি,
মায়ের ছেলে তোরা হাস অট্টহাসি,
রব শশী তারা খসে পড়ুক রে ||”

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অতীত গিয়াছে অতীতে মিলায়ে
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


অতীত গিয়াছে অতীতে মিলায়ে,
.        সম্মুখে মহা ভবিষ্যৎ |
আলোকে পুলকে জ্ঞানে পুণ্যে,
.        দৃপ্ত যেন সে ত্রিদিববৎ ||
শাসন যাহার অস্ত্রে নহে,
.        প্রেমই কেবল মাত্র |
গড়িয়া উঠিবে নূতন তন্ত্র যাহার শাসন আত্মদান,
.        দেখাইবে মহা মুক্তিপথ ||
ত্যাগ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, লভিয়া নূতন প্রাণ,
সমান সূত্রে হইবে মিলিত, হিন্দু মুসলমান |
কামনা হবে মূর্তিমতী আশা হবে ফলবতী,
গিয়াছে সেদিন আসিছে সুদিন,
.        কর সবে তারে দণ্ডবৎ ||

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বাবু বুঝবে কি আর ম’লে
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


বাবু বুঝবে কি আর ম’লে!
কাঁধে সাদা ভূত চেপেছে, একদম দফা সারলে ||
খেতে ভাত সোনার থালে,
.        নাউ সেটিস্ ফাইড্  স্টীলের থালে,
তোদের মত মূর্খ কি আর, দ্বিতীয়টি মেলে |
পমেটম্ লাইক করিলি, দেশী আতর ফেলে—
সাধে কি তোদের দেয় রে গালি,
.        ব্রুট্ ননসেন্স ফুলিশ বলে ||
ছিল ধান গোলা ভরা, শ্বেত ইঁদুরে করল সারা,
চোখের ঐ চশমা জোড়া, দেখ্ না তোরা খুলে |
কূল নিয়েছে, মান নিয়েছে, ধন নিতেছে কলে,
ডু ইউ নো, বাঙ্গালী বাবু---
.        ইওর হেড্ ফিরিঙ্গীর বুটের তলে ||
মুকুন্দের কথা ধর, এখনো সামনে চল,
সাহেবি চালটি ছাড়, যদি সুখ চাও কপালে |
বন্দে মাতরম্ বাজাও ডঙ্কা জাগুক ভাই সকলে,
দেখে মুকুন্দ ডুবে যাক আজ,
.        প্রেমময়ীর প্রেম সলিলে |

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
জাগতে হবে উঠতে হবে লাগতে হবে কাজে
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


জাগতে হবে উঠতে হবে লাগতে হবে কাজে |
জগৎ মাঝে কেউ বসে নেই, মোদের কি ঘুম সাজে ||
যেতে হবে সাগরের পার, ছাড়তে হবে জাতের বিচার,
শুনতে হবে জগৎ বীণা, কোন্ সুরেতে বাজে ||
পরের খেয়ে পরের লয়ে, চলবে না দিন গেছে বয়ে,--
( মোরা ) পা থাকিতে নিছি লাঠি, হাসে লোক সমাজে ||
যাদের মা উপবাসী, তাদের মুখে রঙ্গ হাসি !
দেখে মুকুন্দ মরে যায় আজ ঘৃণা অভিমান লাজে ||

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মাকে ডাক্ দেখি
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


মাকে ডাক্ দেখি---
ডাক্ তোরা আজ সবে বদন ভরে,
দেখি কান খেয়ে বেটী, ক’দিন থাকতে পারে ||
ভক্তি মন্ত্র দিয়ে যদি, ডাক আজ নিরবধি,
ঠিক দাঁড়াবে ক্ষেপী মাগী অসি লয়ে করে ||
ক্ষেপী যদি উঠে দাঁড়ায়---
.        দেখে পাপ ভয়েই পালায় ;
এ মুকুন্দ বগল বাজায় –
.        বম্ বম্ বম্ হরে হরে ||

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
তুই না জাগিলে শ্যামা, কেউ জাগিবে না গো মা
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।


তুই না জাগিলে শ্যামা, কেউ জাগিবে না গো মা,
তুই না নাচালে কারো, নাচিবে না ধমনী ||
ডেকে ডেকে হনু সারা কেউ সাড়া দিলে না মা,
খুঁজে দেখলাম কত প্রাণ, কারো প্রাণ কাঁদে না মা |
তুই না জাগালে প্রাণ, কাঁদিবে কি কারো প্রাণ—
না জাগিলে সবার প্রাণ, পোহাবে কি রজনী ||
নাম ধর দয়াময়ী, দয়া কি মা আছে তের,
দয়া থাকলে মরে কি আজ কোটী কোটী ছেলে তোর |
মরি তাতে ক্ষতি নাই, বাসনা মা দেখে যাই,
ভারতের ভাগ্যাকাশে উঠিছে দিনমণি ||
নিবেদিলাম তব পায়, ঠেল না পায় তারিণী ;
ছেলের কথা চিরকাল রাখে জানি জননী |
মুকুন্দের কথা রাখ, করুণা নয়নে দেখ,
অকূলে পড়েছি মোরা, তার দীন তারিণী ||

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বন্দে মাতরম্ বলে নাচ রে সকলে
চারণকবি মুকুন্দদাস
ডঃ জয়গুরু গোস্বামী সম্পাদিত “চারণকবি মুকুন্দদাস”, ১৯৭২ থেকে নেওয়া।
(
১৯০৫-০৬ সাল। বঙ্গভঙ্গ নিয়ে তখন স্বদেশী আন্দোলনের বান ডেকেছে। জাতি ধর্ম  
নির্বিশেষে সমস্ত শক্তিকে এক করার জন্য বুকের সমস্ত সাহস নিয়ে গর্জে উঠলেন মুকুন্দদাস
– “বন্দেমাতরম্ বলে নাচ রে সকলে কৃপাণ লইয়া হাতে”, ইত্যাদি। মুকুন্দের সেই মূর্তি
দেখলেন মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত। তিনি মুকুন্দকে বললেন--- “স্বদেশী যাত্রার  দল  
তোমাকে করতেই হবে।” অল্প দিনের মধ্যেই বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে “স্বদেশী যাত্রার”  দল
গঠন করলেন এবং মহাত্মার নির্দেশিত পথেই জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ
করলেন।
)


বন্দে মাতরম্ বলে নাচ রে সকলে,
.        কৃপাণ লইয়া হাতে |
দেখুক বিদেশী হাসুক অট্টহাসি,
.        কাঁপুক মেদিনী ভীম পদাঘাতে ||
বাজাও দামামা কাড়া ঘন্টা ঢোল,
.        শঙ্খ করতাল জয়ডঙ্কা খোল ;
নাচুক ধমনি শুনিয়ে সে রোল,
.        হউক নূতন খেলা শুরু এ ভারতে ||
এখনো কি তোদের আছে ঘুমঘোর,
.        গেছে কুল মান, মোছ্ আঁখি লোর |
হও আগুয়ান ভয় কি রে তোর –
.        বিজয় পতাকা তুলে নিয়ে হাতে ||
কবে যে ভারতে আসিবে সেদিন,
.        ভেবে তা মুকুন্দ দিন দিন ক্ষীণ |
আজ কাল বলে কেটে গেল দিন,
.        দিন পেলে লীন হতেম চরণেতে ||

.                    ****************                     
.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর