কবি চিত্রা লাহিড়ীর কবিতা
*
বন্যার পরে
কবি চিত্রা লাহিড়ী

মৃত্তিকায় জাগিয়েছো যে
ভাষা কুহক, তার
স্পন্দন বাঁধবার নয়

আমার রক্তে
তুমি রাঙিয়েছো মুখ
আমার গর্ভে
তোমার মাটির মুখশ্রী

.   **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ভোরবেলাতে ভুল স্বপ্নে
কবি চিত্রা লাহিড়ী

ভোরবেলাতে নগরমাঠে বুদ্ধ তুমি
ভোরবেলাতে অশ্বারোহী মেঘলা ছেলে
ভোরবেলাতে সবুজ ঘাসের চিকন ভূমি
ভোরবেলাতে মুদ্রা ভাঙো শরীর মেলে

ভুল স্বপ্নে সত্যি আমি বোকা হাবা
ভুল স্বপ্নে এখন তুমি অনেক দূরে
ভুল স্বপ্নে যখন তোমার সোহাগ ভাবা
ভুল স্বপ্নে কষ্ট যখন হৃদয় জুড়ে

.       **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
শিমুল বীজ ও বৃষ্টিভেজা মেয়ে
কবি চিত্রা লাহিড়ী

এই শিরশির হিমরাতে দাউ দাউ
পুড়ছি আমি, পুড়ে যাচ্ছে হাত পা বুক
মুক্ত আঙুল, কুঁকড়ে যাচ্ছে তলপেট,
মিছরির ছুরি ঠোঁট হা-অন্ধ প্রবাহে।
কেন ভয় পাও মেয়ে ? ঘুমে কেন হও
সাহসী বালিকা---পুরুষভোগ্যা রমণী ?
এত ভিজে সপসপে ঘর। সাধ হয়।
ভেঙে যায় ঘুম। ইচ্ছে স্বপ্ন ধরো ফাঁদ
পেতে। অসম ইচ্ছে। সোনাবরণ পৃষ্ঠে
যেখানে আমি চাবুক মেরেছি --- ওই অঙ্গে,
সেই চিকণ অঙ্গে আঙুল ছোঁয়াবো আমি।
ওষ্ঠের উত্তাপ দেবো আলোরঙ ক্ষতে।

ইচ্ছের ঝোঁক ছিলো উন্মাদ টলোমলো
পায়ে। কেন আগুন জ্বালাও বোকা মেয়ে,
অন্ধকারে চক্ষুষ্মতী তারা খসা মেয়ে ?
আমি তো সেই পুরুষ, যার বাহু স্পর্শ
করে বলেছিলে আছ,  ভালোবেসে আছ,
হিম হাওয়ায় আছ, সঙ্গী নারী হয়ে।
তবু মুক্তডানা পিঠে কেন লালপেড়ে
নারী ? জানো তো হিসেব রাখি না কান্নার
ঘরকন্না, আকুলতা প্রেম পূণ্যফল।
পুরুষের কারসাজি নষ্ট মায়াজালে।
বহুতা স্রোতের মতো আত্মপ্রিয় আমি,
আমার সম্বিত জুড়ে অঢেল উত্তাপ।
তুমি ছুঁয়ে দিলে হাত আমি ভয় পাই,
মুছে যায় ঘামরঙ, নিবে যায় সব
তাপ কস্তুরীঘ্রাণে। মাতৃবিদ্যা অগ্নির
টানে নারী সনাক্ত করি অষ্টপ্রহর।

কেন আকাশ হলে শিমুলবীজ মেয়ে,
কবির কলমজোড়া বৃষ্টিভেজা মেয়ে
আমি তো সেই পুরুষ যার সাতরঙে
জাগে তোমার শিল্পিত অক্ষর জীবন।

.         **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ভিক্টোরিয়ার পরী ও জীবনচিত্র
কবি চিত্রা লাহিড়ী

তুই ভালো নেই জানিয়ে
করিডোরে জুতোর মৃদু শব্দ তুলে
এগিয়ে গেলো আকাশী পোষাকের সেবিকা
লাউঞ্জে হালকা ভীড়ের
মুখগুলো পড়তে পড়তে কিছুতেই
তোর জন্মদিনটা মনে পড়লো না
সমগ্র স্মৃতিপট ঝুঁকে রইলো জলের ওপর
জলের ভেতর ভিক্টোরিয়া সৌধের পরীর ছায়া

আর কতক্ষণ কতদিন এমন
জীবনচিত্র আগলে বসে থাকা যায়

.         **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
নীলবালি
কবি চিত্রা লাহিড়ী

তখন দুহাতের কবজি থেকে
বেরিয়ে আসতো নীল নীল আভা
আলো দিতো কিন্তু টপ টপ ঝরে পড়তো না
প্রতিমা দেখার ফাঁকে
কত কা যে দেখে নিতো সবাই
ঘুরলে ফিরলেই নীলের উজ্জ্বল ভাব
একদিন সেই ঘোরা ফেরার মধ্যেই
আকাশী শাড়িটা থেকে
চুঁইয়ে পড়লো রঙ, কাঁচা রঙ
শুকোতে শুকোতে ঝুরো ঝুরে বালি

.        **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পরমপুরুষ
কবি চিত্রা লাহিড়ী

মন আগুনে দিই
যে পুড়েছে গ্রীষ্মের শুরুতে

ঝড়ের চিহ্ন নেই
পায়ের নীচে পাতার নিখুঁত মর্মর

জলে মুখ ঢাকা
বৃষ্টি পড়ে না কতদিন কতকাল

গলি থেকে হাই-ওয়ে
মেয়ে তুমি কোথা থেকে আসো রোজ

পরমপুরুষ হাত
ঈশ্বর ছেড়ে কোথায় পালাবে তুমি

.        **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মিলন
কবি চিত্রা লাহিড়ী

গ্রীলের জানলা
একগুচ্ছ সাদা গোলাপের
সন্ধ্যা নামছে দেয়াল বেয়ে
সুপ্রাচীন আঙুলে জল ঝরণার মতো
অবাক ছন্দের টান, ধোঁয়া চাঁদ

নিভৃত মিলনে চুম্বন জ্যোত্স্না হয়

.        **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সেই মেয়েটি
কবি চিত্রা লাহিড়ী

সদর দরোজার পাশে আমার বুকের
মধ্যে তোমার বুক সজোরে চেপে ধরলে
আমিও তোমার বুকের মধ্যে নষ্ট হলাম
নষ্ট হলাম উথালপাথাল বুকের চাপে

এখন আমিও খুব সাদামাটা ভাবেই
একটা নষ্ট মেয়ের গল্প বলতে পারি
বলতেই পারি শিমুলপলাশ দেশের
সেই মেয়েটির খথা যে কবিতা লিখতো
আর নিষিদ্ধ রাজনীতি করা মানুষদের
সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সলিল চৌধিরী গাইতো

একবার এক ঘন আষাঢ়ের প্রথম দিনে
মেয়েটির ঘরে মেঘদূত এলো বাষ্পশরীরে
সারা আষাঢ় মাস ধরে মেঘদূত শুধু
তোমার গাথা শোনালো তাকে ঘুমে জাগরণে

ভোরবেলায় বাগান পরিচর্যার ফুরসতে
দুপুরে কালিদাস রচনাবলীর পাতায়
সন্ধ্যায় কুয়োর জলে শুকতারার ছায়াতে
গভীর রাতে ‘তব শয্যা যে কণ্টকশয্যা’য়
শুধু তোমার কথা শোনালো মেঘদূত
সরল অনুভূতি আর সহজ পদ্ধতিতে

সহজ পদ্ধতিতে গুছোতে গুছোতে আমিও
গুছিয়ে তুলি আমার নষ্ট কাঁধের আঁচল
ভোরের পদ্ম আভা রোদ্দুর রঙ বদলিয়ে
সন্ধ্যায় তীব্র লাল হয় কপালের টিপে

কপালে তুমিও বদলাও পার্বণে উত্সবে
বাকি জীবনচিত্র অপেক্ষা নিপাট নিখুঁত
প্রগাঢ় জন্মমুহুর্ত থেকে বদলে যাই আমিও
ঊষার চাদরে অথবা সায়াহ্নের পরিধানে
নষ্ট প্রসাধনের ঘ্রাণ আর শরীরের বন্ধন
বদলে বদলে অবশেষে নিঙড়ানো শাড়ি

শ্রীমতীর শাড়ি লুটোয় পায়ের তলায়
ণৌন থাকে শিমুল-পলাশের করুণ ছায়া
সামান্য তফাতেই আমার সোহাগের ঘর
ঘরের মধ্যে অন্য ঘর শুধুই তোমার

তোমার ঘরে এখন সেই মেয়েটির ঘ্রাণ
মাঝে মাঝে নীল চিঠি উষ্ণ প্রেমেরও অধিক
ঘরের কোথাও কোনো বিরোধ বিচ্ছেদ নেই
রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে শার্ট আর ব্লাউজ
পুরুষটির গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে মেয়েটি
আলস্যে গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথ সলিল চৌধুরী

.             **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সৃজনের খাতা
কবি চিত্রা লাহিড়ী

ভোররাত পর্যন্ত
ছোট ছোট সংশয়ের নুড়িপাথর
.        ছিলো হৃদয়সন্তাপে

সকালের উচ্ছাসে কেটেকুটে ফেলে রাখা
সৃজনের খাতা ছাড়া আর কিছু নেই
যা আছে
শর্তহীন পড়ে আছে বিনয় আর
.        আয়নার মাঝামাঝি

.          **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আপনাকে
কবি চিত্রা লাহিড়ী

সাথী প্রিয় সহযোদ্ধা
একদিন এই বাংলার মসৃণ পিঠ বেয়ে
গোটা পৃথিবীর সমস্ত জনগণ আপনার ঘরে
পৌঁছে যাবে। একদিন আপনার জন্মদিনে পৃথিবীর
সব মানুষ, টিভি কভারেজ, নিউজ ম্যাগাজিন আর
টাওয়ার থেকে টাওয়ারে পৌঁছে যাবে আপনারই
হাত ধরে। মানুষ আজকে ভালোবাসতে
ভুলে গেছে বড়। ভালোবাসতে ভুলে যাওয়া
মানুষেরা আবার নতুন করে ভালোবাসতে
শিখবে আপনার ফেলে আসা দিনগুলো ঘিরে।
বিগত বছরগুলোতে আপনি অনেক দিয়েছেন
মার্ক্সও দিয়েছিলেন --- কিন্তু এই সমস্ত
জনগণকে আপনি কি ভাবে দেখবেন আপনার
জন্মদিনে। এরা বেশির বাগই তো দিনান্তের
যুটপাথের মতো ধুঁকতে থাকা মানুষ। এদের
রবীন্দ্রনাথ নেই, নন্দন প্রাঙ্গণ নেই,
মাল্টিপ্লেক্স নেই, একটি অতি সাধারণ মাটির
চামচও নেই। পুরনো ঘূণধরা চেয়ারে
এরা গা থেকে জামা খুলে রাখে আর
জিজ্ঞাসিত জীবনের আঙুল ধরে
পা টিপে টিপে ছ্যাতলানো কলঘরে যায়।

সহযোদ্ধ প্রিয় কমরেড।
রোজ কবিতা পড়ুন আর জন্মদিনের কবিতা
শোনান। কারণ কবিদের জন্মদিন পালন
হয় যাপনে জড়ায়ে। কবিতার মধ্যে আপনি
অন্ধকারের শব্দ শুনুন, নিস্তব্ধতার শব্দ শুনুন,
বোবাকান্না আর বাতিল সম্পর্কের শব্দ শুনুন।
এইসব শব্দ শুনতে শুনতে আপনি সতত
পৌঁছে যাবেন সদ্যজাত পরিপূর্ণ শিশুদের
কাছে, আপনার প্রিয় সহযোদ্ধাদের কাছে।
শিশুরা ভারি জেদি আর অবুঝ হয়।
কাঁদলে আপনাকেই সামলাতে হবে, চাইলে
আপনাকেই দিতে হবে। যদিও এখন শিশুরা
আর কাঁদে না, কিছু চায়ও না। হাত বাড়িয়ে
কেড়ে নেয় শুধু এবং ওরাই আপনার
জন্মদিনে পিঠে পিঠ রেখে, শব্দে শব্দ জুড়ে,
গলায় গলা মেলায় --- হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।

কমরেড প্রিয় সাথী,
সেদিন ঐ সমস্ত শিশুদের মধ্যে থেকে মোটা
লেন্সের আড়ালে আপনি ঠিক চিনে
নেবেন আমার শান্ত অথচ দৃপ্ত বন্দিত সন্তানদের।
আমার পুত্রকন্যাদের। আমার এক কন্যা কবিতা
অন্যজন সংস্কৃতি। আমার পুত্রেরা ভাষা ও ভালোবাসা।
আমার সাধ্যে যত্সামান্যে আমি ওদের
লালন করি। প্রিয় মানুষ আপনার জন্মদিনের
জ্বলন্ত মোমবাতিগুলোকে নিভিয়ে দিয়ে আপনি
ওদের হাতে একটু পায়সান্ন দিন, নাথায়
হাত রাখুন প্রত্যয়ের। দেখবেন --- আমার সন্তানেরা
একদিন একরাশ রোদ্দুর মাখানো ঘাসে
লালিত হতে হতে মুক্তপট এই সীমারেখা ধরে
হেঁটে যাচ্ছে ঢের দীর্ঘপথ আপনারই প্রিয়
জনগণকে পাশে নিয়ে আর মাতৃভাষায়
শুভেচ্ছার গান গাইছে আপনারই জন্মদিনে।

.          **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর