কবি দেবব্রত সান্যালের কবিতা
*
সম্প্রদান
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

আলমারি, খাট, বিছানা, ড্রেসিং টেবিলের সাথে দান করা হলো,
তিন হাজার টাকার বেনারসী আর আট ভরি গয়না পরা
বি.এ পাস অপর্নাকে।
তেরোটা প্রনামী আর চল্লিশজন বরযাত্রী - বেশী কিছু নয়।
সারা জীবন হাত পাততে অভ্যস্ত বাবা
আজ জলজ্যান্ত একটা কন্যাকে দান করতে পেরে বিশেষ গর্বিত,
নিশ্চিন্ত ও বটে - কন্যাদায় বলে কথা।
তবে চোখের কোনার জল, ধুয়োর জন্য না
প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় হাত পড়ে যাবার দু:খে,
বলা কঠিন।
অপর্ণার মুখের চন্দনের কারুকার্য
ফিকে হবার আগেই জানা গেল,
খাটটা বক্স হলে ভালো হত,
গয়নার ডিজাইন গুলো কেমন পুরনো পুরনো
প্রনামীগুলো মোটেই দামী নয়,
বরভোজনের মাছটা তেমন টাটকা ছিল না,
আর মেয়ের রঙটাও বেশ চাপা।
কি আর করা - ছেলে যে ব্যাঙ্কের কেরাণী।

আজ দশ বছর পর, অপর্ণার যত্নে
আসবাব, বাসন, শাড়ী এখনো নতুনের মত।
আর রক্তাল্পতার দরুন অপর্নাকে একটু ফরসাই দেখায়।   
অপর্ণার দাতা কর্ণ পিতা এখন পাত্র পক্ষ হয়ে
এক শাঁসালো দাতার সন্ধানে আছেন
ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, তাই দানটাও সেই মাপেরই হবে,
সেটাই তো স্বাভাবিক।

.           *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
ভাগ্যবানের বউ
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

বিশুকাকার একটা বড়' পছন্দসই রসিকতা ছিল,
মাঝে সাঝেই জায়গায় আজায়গায় বলে ফেলতেন ---
কেউ শুনছে কিনা, বিশেষ তোয়াক্কা করতেন না।
"ভাগ্যবানের বউ মরে আর ভাগ্যহীনের ঘোড়া "---
আর নিজের রসিকতায় প্রচুর হাসতেন।

বিশুকাকার ভাগ্যের মরচে ধরা তালা খুলতে একটু দেরী হলো।
রোগভোগা রক্তাল্পতাগ্রস্তা মিনতি কাকিমা যখন
শাঁখা সিন্দুর অক্ষয় রেখে মধ্যবিত্তদের স্বর্গে গেলেন,
বিশুকাকার তখন ভাগ্যের ঘরের চারদিকে মাকড়সার জাল,
আর বয়েসটাও চল্লিশের ভুল দিকে।
তারওপর চাকরীটাও বাঁহাতি রোজগার রহিত কেরানীর।
তাই ওনার হাতে মাকু ধরিয়ে ভ্যা করানোর আগ্রহ,
কোনো শাশুড়ীই দেখালেন না।

সংসার পড়ল মুখ থুবড়ে---
মিনতি কাকিমা যে মন্ত্রে এই অল্প আয়ে সংসারটা চালাতেন,
সেটা শিখে নেওয়া হয়নি বিশুকাকার,
তাই নুন আর পান্তা প্রায়ই একসাথে ফুরোতে শুরু করলো।
বাবা থাকতেও বিশুকাকার সন্তানদের অনাথের মত দেখতে লাগত।
বিশুকাকা বুঝলেন একটু দেরীতে,
তার বউ নয় ঘোড়া মারা গিয়েছে।

.           *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
রক্ত দাও!
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

"হ'য়ে গেছে", বলে একটু হাসলেন।
আমার মুখে ও সে হাসির ছোঁয়াচ লাগলো।
"দুর্বল লাগছে না তো ?"
"দুর্বল? একেবারেই না" আমি উঠে বসলাম।
"ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা করলাম।"
"বাঃ! ভালো। এই আপনার দুটো বিস্কিট , চায়ে দুধ চলে তো?"
"আর আমার স্বাধীনতা? সেটা কখন পাব?"
"স্বাধীনতা! আমরা তো আপনাকে কিছু দেবার অঙ্গীকার করিনি,
আপনি স্বেচ্ছায় এসেছেন।"
"না, করেন নি, তা ঠিক। তবে যে বাচ্চাকাল থেকে শুনে এসেছি ,
রক্ত দিলে স্বাধীনতা পাওয়া যায়,
সেটা কে দেবে ?"

.           *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
রাধারানীর এক ঘেয়ে গল্প
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

আমার নাম রাধারানী, আমিই সেই, যে মাহেশে রথ দেখতে গিয়েছিলো।
সাথী ছিলনা কেউ, সাথে ও ছিল না কেউ,
তবু একলা যেতে আমার ভয় পাবার কোনো কারণ ছিল না ;
বৃষ্টি, অন্ধকার, অচেনা পুরুষ, কিছু থেকেই না।
বঙ্কিমবাবু যে আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন
এক অমোঘ সুরক্ষার চাদর,
আমি বালিকা আর আমার বয়স একাদশ পূর্ণ হয় নি।
বঙ্কিমবাবু, এরা অর্থ না বুঝেও তোমার বন্দেমাতরম শিখে নিল বেশ
কিন্তু শিখলো না এগারো বছরের রাধারানীকে বালিকা বলে মানতে,
শাড়ী পড়লেও সে নারী নয়।
এটুকু পড়েই যারা টক্ শো বা মোমবাতি মিছিলের জন্য তৈরী হচ্ছেন,
তাদের রাধারানী জানাচ্ছে, সে ঠিক আছে
কারণ দু এক বছর আগের থেকেই তার জানা ছিল
একাদশ পূর্ণ না হওয়াটা কোনো কবচ নয়।

.           *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
বাবা - তোমাকে
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

আমি, তোমার একমাত্র ছেলে,
কিন্তু পৌঁছলাম সবার শেষে,
দীর্ঘ প্রতীক্ষা তোমার শরীরের শেষ উত্তাপ টুকুও শুষে নিয়েছে।
তোমার বুকের ওপর তোমার প্রিয় লাল পতাকা,
তোমার শেষ চাদর।
যে শহরের পথে তোমার সাথে , তোমার  হাত ধরে অনেকবার ঘুরেছি,
সেখানে তোমার সাথে শেষবারের মত ঘুরলাম,
তোমাকে ট্রাকে নিয়ে।
এ শহরে তোমার পরিচিত জনের তো শেষ নেই ,
আগের মতই তাই কিছুটা যাওয়া - আর থামা, আবার যাওয়া।
সবাই তোমাকে ফুল দিল
আমি তোমাকে আগুন দিলাম।
সেই আগুনের আলোয় বাবা তোমাকে
সবার হতে দেখলাম।

.           *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
কাটা ঘুড়ি
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

আকাশে তো জায়গার অভাব ছিলনা,
তোমার ঘুড়িটা হাওয়ার সাথে লড়াই করে
বিজয়ী বাজের মত এই ছেঁড়া আকাশের টুকরোটায় ঘুরে চলছিল।
আমার ঘুড়িটা সাদাসিধে, উচ্চতার উচ্চাকাঙ্খা ছিলনা,
ছিলনা আকাশ বিজয়ের দুরাশা।
এক আকাশে নানা রঙের ঘুড়ি,
একদিনের জন্য হলেও রঙিন করে তুলে ছিল আকাশের এ প্রান্ত।
কাঁচের বাক্সে সৌখিন জলচর মাছের মত!
তবে  আমার ঘুড়িটাকে কাটলে কেন?
মেলায় বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানোর ছেলে মানুষী উত্সাহে?
একবার মাটিতে পরে থাকা ঘুড়িটার লজ্জিত পরাজিত চেহারাটা দেখলে
তোমার বিজয়ের উল্লাসে টান পরতো
তোমার সাথে যে আমার লড়াইটা কোনদিনই ছিলনা
হয়ত বুঝতে পারতে।

.           *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
ভালবাসা!
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

আখতারীর "যেতে তোমায় দেবনা" ,
শুনে তুমি  বললে, "ভালো!
আর কিছু নয়!
তবু সেই ভালো একবার শোনবার জন্য
লাল কার্ড দেখল, বোরো ফার্নান্ডিস।
গান লেখার চেষ্টায় দিন কাটালেন সুবোধ সরকার ,
চাঁদের পাহাড় থেকে হিরে ছুঁড়ে ফেলে চলে এলো শংকর।
আরো কিছু বললে, হয়ত গাজায় বন্দুকের বদলে বেজে উঠত গীটার,
মর্টারের শেলে মানি প্ল্যান্ট লাগানো হত।
তিস্তার জল হাসিমুখে ভাগাভাগি করে নিত
হাড়ি ভাগ হওয়া দুই ভাই।
এসব শুনে যদি হেসে ওঠো,
তবে সারা কলকাতার গোমরা মুখে ও
হাসি ফুটে উঠবে,
এক মুহুর্তে থেমে যাবে ট্রাফিকের ঝগড়া,
বাজারের দরাদরি, দৃষ্টির হলদি অসুখ।
আমার সব হতাশা, না পাওয়ার কবিতা
ভালবাসার কবিতা হয়ে উঠবে।
কি ভাবছ? এখনো ভালোতেই থেমে থাকবে?
না একটু এগিয়ে আমার হাত ধরবে?

.           *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
এ কার লেখা রূপকথা?
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

এ কার লেখা রূপকথা ?
রাজকন্যা নাকে মুখে দুটি গুঁজে
সকাল আটটার মধ্যেই অটোর লাইনে ,
রাজপুত্তুর , সদাগরপুত্তুরের কাছ থেকে দুশো টাকা ধার চাইছে ,
'মাস পরলেই দিয়ে দেব' বস 'বলে।
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী চিড়িয়াখানার খাঁচায় ,
লোকের ছুঁড়ে দেওয়া খাবার খুঁটছে।
পক্ষীরাজের ওপর শনিবার আর কেউ বাজি ধরে না।
সোনার কাঠি রূপোর কাঠি বেচে তো হাসপাতালের বিল মেটানো হলো
এর ওপর আবার অনিয়মের চূড়ান্ত
রাক্ষস খোক্কসগুলো পর্যন্ত হাঁউ মাউ খাউ না বলেই
আজকাল দিব্যি মানুষ চিবিয়ে খাচ্ছে !

.          *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
নাগরিক - কলকাতা ৭১
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

সন্ধ্যের দিকে মশার উপদ্রব আশংকায় জানলা দরজা বন্ধ করে,
মশা তাড়ানোর ধূপ জ্বালিয়ে, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায়  
আমি তখন আয়েস করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে
আমার মেয়ের কাছে মশলা মুড়ির
ঝাল লংকা খাবার বীরত্ব দেখাচ্ছিলাম।
একটু চাপা গোলমাল ---
রাস্তা দিয়ে কাকে যেন টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।
কারা? জিগ্গেস করতে নেই।
"ওগো, দরজা খুলো না"
"বাবা ভয় করছে"
"খোকা, তোর্ কি দরকার?"
কিন্তু কাকে নিয়ে যাওয়া হলো,
এই সভ্য শহরের  অঘোষিত বধ্য ভূমির দিকে?
এত তাড়া কিসের?
বাটিতে এখনো মুড়ি বাকি, পেয়ালায় কিছুটা চা।
কাল খবরের কাগজেই তো জানা যাবে।
নাকি অজ্ঞাত পরিচয় লিখবে !

.          *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর   
*
বেচারা
কবি দেবব্রত সান্যাল
“নিজের খেয়াল খুব রাখছি” কাব্যগ্রন্থ থেকে

কি ঠিক করলে?
সব পুড়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে!
তারপর ধুলো আর ছাই মেখে বিবাগী হবে?
দয়ার থালায় বাড়া সহানুভূতির পায়েস
চাটবে আয়েস করে
না কমানো দাড়ি, এলোমেলো বেশ, কবিতা আর সুরা।
ভাবছো এভাবেই দিব্যি কাটাবে, ওই
যার নাম দিয়েছ জীবন?

.       *************************      
.                                                                                        
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর