কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের কবিতা
*
পরশমণি  
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন

না গো না ! এ চক্ষু নয় সে অতুল মণি !
প্রেমই পরশমণি, যাদুকর স্পর্শে যার
হয়েছে অমরাবতী মাটির ধরণী !
ইহারে পরশবলে অতুল রূপসী-সাজে
দাঁড়ায় যুবার পার্শ্বে শ্যামাঙ্গী রমণী !
ইহারি পরশবলে কৃষ্ণ ভৃঙ্গে ক্রোড়ে লয়ে
মদন-লাঞ্ছন মুখ নেহারে জননী !
ইহারি পরশ পেয়ে ত্রিভঙ্গের শ্যাম অঙ্গে
হেরে ত্রৈলোক্যের রূপ ব্রজবিহারিণী !
হে কবি, ইহারি বলে হেরিয়াছ বঙ্গ-ঘরে
ডেসি-লেসি---ড্যফোডিল-কুসুম-লাঞ্ছন
বঙ্গনারী-পুষ্পরাজি বিশ্বে অতুলন !

.             ***************  
.                                                                          
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
মিরেণ্ডা   
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন

দেখিনু অদ্ভুত স্বপ্ন | পূর্ণিমা শর্বরী ;
নিথর শান্তির রাজ্যে সুধাকর হাসে !
সহসা উঠিল ঝড় তোলপাড় করি
স্বর্গ, মর্ত্ত্য ; ম্লান শশী কাঁপিল তরাসে |
ব্যোম-যাদুকর কিন্ত করিয়া ভ্রূকুটি---
থামাইল ভীম বাত্যা ; মেঘ-নাট্যশালে
অদ্ভুত-অপ্সর বাদ্য বাজে তালে তালে |
কি অদ্ভুত ! অন্তরীক্ষে নাচে নটনটী !
থামাগো স্বপ্নের কায়া ব্যোম-যাদুকর
দিল কি বদলি ? এ কি চমত্কার হেরি !
চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেল চন্দ্র কলেবর ;
দেখা দিল রঙ্গভূমে এ কোন কিন্নরী ?
তুমি কি মিরেণ্ডা ? কিম্বা আকাশের শশী ?
বুঝিব কি ? দৃশ্যে আঁখি গেল যে ঝলসি !


.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
রাক্ষসী  
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন


বসন্তের ঊষা আসি, রঞ্জি দিল যুগল কপোলে ;
তাই ও ফুলের বাস, ফুল-হাসি, আননে প্রিয়ার !
নিদাঘের রৌদ্র আসি, বিলসিল ললাট নিটোলে,
তাই গো প্রিয়ার ভালে জ্যোতি খেলে মহিমা-ছটার !
ঘন-ঘোর বর্ষা-রাত্রি বিহরিল অলক-নিচোলে ;
তাই গো প্রিয়ার পিঠ কেশ-মেঘে সদা মেঘাকার !
নাচিল শরত শশী রূপ-হ্রদে, হিল্লোলে, হিল্লোলে ;
তাই গো প্রিয়ার দেহ কূলে কূলে চন্দ্রে চন্দ্রাকার !
রাহু কেতু দুই ঋতু---শীত ও হেমন্ত শুধু হায়
প্রিয়ার হৃদয়ে পশি ছড়াইল কঠিন তুষার !
তাই প্রিয়ে, তাই বুঝি, সুকঠিন হৃদয় তোমার ?
উপাসনা, আরাধনা সকলি ঠেলিয়া দাও পায় !
আমি গো বুঝিতে নারি দেবী তুমি, অথবা রাক্ষসী !
পূর্ণিমার জ্যোত্স্না তুমি, কিম্বা ঘোর কৃষ্ণা চতুর্দ্দশী !


.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
চিরযৌবনা   
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন


আমার প্রতিভা আজি কাঙালিনী, হে শ্যামসুন্দর
কবিতা মালঞ্চ তার ভরপুর সৌরভে ও রূপে
নহে আর ; মাধবী-মণ্ডপ তার, মধুপে, মধুপে,
নহে আর ঝঙ্কৃত ও অলঙ্কৃত ! শুষ্ক সরোবর ;
ফোটে না, ফোটে না তথা একটিও পদ্ম মনোহর
উপমার ! ঝরি' গেছে লতা পাতা ; ওই দীন স্তূপে
ক্রোটনের পাতা কাঁতা কাঁপে ( হায় তারে কে করে আদর? )
কম্বল-সম্বল-হারা দরবেশ কাঁপে যথা চুপে !
হে বঁধু, হে প্রাণেশ্বর ! নাহি খেদ, নাহি তাহে লাজ !
তুমি যবে আসিয়াছ, কি গো কাজ গোলাপী ভূষণে ?
যুগান্তে পতিরে পেয়ে, বিরহিণী, ভুলি তুচ্ছ সাজ,
আলু-থালু কেশ-পাশ, পড়ে নাকি রাতুল চরণে ?
জানি আমি, হে স্বামিন্, তুমি মোরে করিবে না ঘৃণা
পতি-চক্ষে, প্রাণনাথ, প্রবীণা যে সুচির -নবীনা !

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বৈশাখ   
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন

কপালে কঙ্কন হানি, মুক্ত করি চুল,
বাসন্তী যামিনী আহা কাঁদিয়া আকুল !
স্বামী তার "চৈত্রমাস", অনঙ্গের মত,
দক্ষিণে ঈষত্ হেলি জানু করি নত,
কার তপ ভাঙ্গিবারে করিছে প্রয়াস ?
রুদ্রের মূরতি ওযে ! এ কি সর্বনাশ !

ললাটে অনল, হের, ধক্ ধক্ জ্বলে !
সর্বাঙ্গে বিভূতি-ভস্ম মাখি কুতূহলে,
তপে মগ্ন,---চিনিলে না বৈশাখ দেবেরে ?
হে চৈত্র এ নিশি-শেষে, নিয়তির ফেরে,
হারাইলে প্রাণ আহা ! নাশিতে জীবন,
রোষান্ধ বৈশাখ ওই, মেলিল নয়ন |

দিগঙ্গনা হাঁকি ডাকে "কি কর কি কর,"---
নব ঊষা বলে---"ক্রোধ সম্বর, সম্বর|"
কোকিল ডাকিল মুহু, করিয়া মিনতি ;
সম্ভ্রমে অশোক-পুষ্প করিল প্রণতি |
বৃথা ! বৃথা ! ---বৈশাখের দু-চক্ষু হইতে,
নিঃসরিল অগ্নিকণা বেগে আতম্বিতে ||

ভস্ম হ'ল চৈত্রমাস | হয়ে অনাথিনী,
মুছিল সিন্দুরবিন্দু, বাসন্তী যামিনী |
শাল্মলীর পুষ্পরাশি পড়িল ঝড়িয়া |
পাপিয়া বসন্ত রাজ্যে গেল পলাইয়া |
প্জাপতি লুকাইল করবীর শিরে,---
ভিজিল শিরীষ-পুষ্প নয়নের নীরে |

লতিকা পড়িল লুটি তরুর চরণে ;
বনস্থলী পতিহীনা নবীন যৌবনে !
দিন বলে, "এবে আমি খেটে হব সারা,"
রাত্রি বলে,---"হায় আমি এবে আয়ুহারা |"


.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রথম চুম্বন  
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন


( ১ )
না জানি কি নিধি দিয়া গড়িল চতুর বিধি,
প্রথম চুম্বন !
কুহরিয়া উঠে পিক,
শিহরিয়া উঠে দিক,
ভরে যায় ফল ফুলে শ্যামল যৌবন ;
বনতুলসীর গন্ধে,
বায়ু হয় মাতোয়ারা ;
বিটপির গায়ে গায়ে চাঁদের কিরণ !

( ২ )
অজানা সুরভি ঘ্রাণে,
কি জানি কি জাগে প্রাণে,---
কোকিলা ঝঙ্কার ছাড়ে মাতায় ভূবন !
কি জানি কি মেঘ হেরি,
চঞ্চলা ময়ুরী নাচে,---
আবেশে প্যাখম তুলি অঙ্গের দোলন !
অজানা সুরভি ঘ্রাণে,
কি জানি কি বা সে প্রাণে,---
আগ্রহে দম্পতি করে প্রথম চুম্বন !

( ৩ )
কে আনিল আলোরাশি হৃদয়-আঁধারে ?
অধরের ফাঁক দিয়া ;
জ্যোত্স্না পড়ে উছলিয়া,
দম্পতির শয্যার আগারে !
রঙ্গীন বারনীস্ পেয়ে খাটপালা হেসে উঠে !
কে রে এ চতুর কারিগর ?
দেয়ালের চিত্রগুলি আবার নূতন হ'ল !
কে রে সুনিপুণ চিত্রকর ?
কনক-পারদ লেগে, মলিন দর্পণ খানি
ধরিল কি অপরূপ শোভা মনোহর !

( ৪ )
নব বক্ষে নব সুখ,
নব ধর্ম, নব যুগ
নব শশী হেসে সারা প্লাবিয়া ভূবন !
জ্যোত্স্নার আবছায়ে যৌবন-নেশার ঝোঁকে,
মধুর মধুর এই প্রথম চুম্বন !


.             ***************              
.                                                                                         
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
শেষ চুম্বন  
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন

( ১ )
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
জীবনের রত্নাগার একেবারে করি খালি,
অভাগারে ফাঁকি দিয়ে মরণে দিতেছ ডালি !
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
লয়ে ও হীরার কুচি, চক্ষের সলিল মুছি,
দরিদ্রা করিবে, সখি, জীবন-যাপন |
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !

( ২ )
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
এ হেমন্তে দাও সখী, ফুল্ল মালতীর মালা ;
পৌষের দুরন্ত শীতে রৌদ্ররাশি দাও বালা !
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
সবাই কাঁদিছে তাই, তব মুখ পানে চাই,---
মোর নাই অবসর করিতে ক্রন্দন,
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !

( ৩ )
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
ঘন-ঘোর বর্ষা রাতে, কোথা পাব জ্যোত্স্নারাশি ?
এ জলদে ছাড়ি দাও বিকট বিদ্যুত্-হাসি !
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
পুলিনে দাঁড়ায়ে হায়, শীতে থর থর কায়,
সলিলে নামিব সখী মুদিয়া নয়ন !
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !

( ৪ )
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
কে বলিল, গোধুলিতে, রবি গেল অস্তাচলে,
প্রভাতে ভাস্কর হয় অরুণ উদয়াচলে ?
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
সূর্যকান্ত মণি সম অধর প্রবালে মম,
ভরি লব একরাশি কাঞ্চন কিরণ !
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
দাও চিত্ত-মণিবন্ধে রাখির বন্ধন বাঁধি !
চির বিরহের দিনে, বিরহের চির সাথী,
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !

( ৫ )
দাও, দাও, বিদায়-চুম্বন !
একি ! একি ! একি গোল ! একি রোদনের রোল !
সব শেষ ; তারি সমাচার ?---
দাও তবে প্রাণ-ভরা শেষ উপহার,
সুধা-হলাহল ওই চুম্বন তোমার !

.             ***************              
.                                                                                       
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
দাও দাও একটি চুম্বন  
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন

দাও, দাও, একটি চুম্বন |
বিছাইয়া দুটি ওষ্ঠে সোহাগের কচি পাখা
দাও দাও প্রাণময়ী, ত্রিদিব এমিয় মাখা,
একটি চুম্বন ;
আকুল ব্যাকুল হ'য়ে আত্মা মোর বাহিরিয়ে,
করুক তোমার করে সর্ব্বস্ব-অর্পণ,
দাও, দাও, একটি চুম্বন |
পশে যবে রবিকর পদ্মের উরসে,
তরল কনক সেই শিশির পরশে,
লাজ-রক্ত শতদল, প্রাণবৃন্তে ঢল ঢল,
সর্ব্বস্ব বিলায়ে ফেলে চিত্তের হরষে |
তেমতি, তেমতি তুমি, বৈশাখী চুম্বনে চুমি,
লও, লও, ( আঁখি মোর আসিছে মুদিয়া, )
প্রাণের মদিরা মম গণ্ডূষে শুষিয়া |
দাও, দাও, একটি চুম্বন---
মিলনের উপকূলে, সাগর-সঙ্গমে,
দুর্জ্জয় বানের মুখে, দিব ভাসাইয়া সুখে,
দেহের রহস্যে বাঁধা অদ্ভুত জীবন,
দাও, দাও, একটি চুম্বন |
আর এক,---একটি চুম্বন |
তোমার ও ওষ্ঠ দুটি, বাসন্তী যামিনী জাগি,
পাতিয়াছে ফুল-শয্যা বল গো কাহার লাগি ?
দাও, দাও, একটি চুম্বন |
নববধু আত্মা মোর, লাজুক, লাজুক ঘোর,
চক্ষু বুজি মাথা গুঁজি করিবে শয়ন !
দাও সখী ! মদির চুম্বন |
দাও, দাও, একটি চুম্বন |
পুষ্পময়, স্বপ্নময়, তোমার ও ভালবাসা,
কবিতা-রহস্যময় নীরব তাহার ভাষা,
তোমার ও মদির চুম্বন |
কপোত ও কপোতী সনে
মগ্ন মৃদু কুহরণে
থাকে যথা, সেইরূপে পরামর্শ করি,
তব ওষ্ঠ মম ওষ্ঠ উঠুক কুহরি !

.             ***************            
.                                                                                     
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নব তপস্বিনী
কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন
(সাহিত্য পত্রিকা, আষাঢ় ১২৯৮ সংখ্যা। কবি সরোজকুমারী দেবী এবং কবি প্রমীলা বসু(নাগ)-এর খেদোক্তিময় কবিতার
জন্য তাঁদের সম্বোধন করে লেখা কবিতা!)

নিবাও নিবাও শীঘ্র, এত কি আমোদ ?
জ্বালিছ সাঁঝের দীপ হয়ে কুতুহলী!
দেখিছ না! এখনো যে এক ছাদ রোদ!
উচিত এ উদ্বোধন আইলে গোধূলি।
নুপূরে কি বাজে সখি ঝিল্লীর নুপূর ?
তুমি কি ভেবেছ ওই বৈকালী যুথিকা
ফুটিয়াছে ? হায় হায় ক্রূর পিপীলিকা
কুসুমের মর্ম্মে পশি করেছে আতুর।
কল্পনার শিল্পশালা নিরালায় বসি
মধ্যাহ্নে ধরেছ কেন পূরবী রাগিণী ?
থাম থাম, চিত্রগুলি পড়ে খসি খসি!
রঙে রঙে মেশামেশি আপনা আপনি।
কোথায় চিত্রিব আমি অনঙ্গ মোহিনী।
হ্যাদে দেখ, চিত্রিয়াছি শঙ্কর ঘরণী।

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*