সংকটমোচন মন্দিরে বিস্ফোরণের পর অসুস্থ বৃদ্ধ বিসমিল্লা খান সাহেব বেরিয়ে পড়েছেন মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে হাতে সানাই ছিল কিনা জানি না, জলের ভিস্তি থাকলে হয়ত ভাল হত।
শোনা যায় তানসেন দীপক রাগে আলাপ শুরু করলে তাঁর স্ত্রী যথাসময়ে মল্লার আলাপ করতে ভুলে গিয়েছিলেন আগুন জ্বালানোর মন্ত্র জানা ছিল,নেভানোর নয়।
আজ দেশ জুড়ে চড়া পর্দায় বাঁধা আছে সুর কোমলে এসে লাগছে কড়ি মা এই সময় দীপক বাজছে সারা দেশে দেশ ভুলেছে সা রে মা পা নি সা
বিসমিল্লা খাঁ সন্ধ্যের মুখে দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে আলাপ করছেন মল্লার ধীরে ধীরে আকাশে মেঘ জমেছে মেঘ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে নদীর ঢেউ ধুয়ে যাচ্ছে দ্বেষ, দেশ ও বর্ষার রাগ।
তোমার শরীরের ময়নাতদন্ত করতে দেননি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ – তোমার জাঁদরেল শ্বশুরমশাই পাছে কাটা ছেড়া করলে সত্যটা বেরিয়ে পড়ে- বেরিয়ে পড়ে ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে উপেক্ষিতা নারী আর উপেক্ষিত পুরুষটির ভালবাসার হৃদয়পদ্ম!
ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে বংশ, সম্মান, গাঁই, গোত্র, কৌলীন্য-কিছুতেই মেলে না বিশেষতঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মত অসামান্য নতুন পুরুষটির সঙ্গে লজ্জায় বাড়ি আলোকপ্রাপ্তা জ্ঞানদানন্দিনী তুমি মুখ বুজে পড়ে রইলে নৈরাশ্যের আশ্রয়ে এমন সময় পেলে স্কুল পালানো ছেলেটিকে তোমার সাধের আসন বোনার সেই সুত্রপাত নিজেকে গড়ে নিলে নিজের মাধুর্যের ছাঁচে ছাদে সাহিত্যের পদ্মবনে এলো মধুকর
তোমার লীলাসঙ্গী ভানুসিংহ হয়তো একটা নীড় গড়তে চেয়েছিলে লীলাচ্ছলে সমাজ নষ্ট করে দিলো সেই নীড় পদ্মবনে তখন মদমত্ত হাতির দাপাদাপি জ্যোতিদাদার দিন কাটে থিয়েটারে রাত কাটে বিরজিতলায়- বালিগঞ্জে জোড়াসাঁকোয় অন্ধকার বিষ্ণুপ্রিয়া রাত নামে স্বামীর পকেটে তাড়াতাড়া প্রেমপত্র- নিশ্চয় তোমাকে নয় ফ্লোটিলা জাহাজে সবাই যাবে প্রমোদ ভ্রমণে শুধু তুমি বাদ- সবচেয়ে উপেক্ষিতা, সবচেয়ে নষ্ট মানুষ বোদলেয়ারের কল্পনার মত শুকনো ইচ্ছে শেষে ভানুকে কেড়ে ছিন্ন করে বিলেত পাঠালো ওরা হেমাঙ্গিনী তখন হেকেটি অথবা শুধুই ‘হে’ তবু বিরহী রাধার যন্ত্রনায় পরতে পরতে বিচ্ছেদ – বিপন্নতা অবশেষে ভানু ও ভবতারিনীগত হয়ে শতপাকে জড়িয়ে ক্লিষ্ট হয়ে গেল
কত যন্ত্রনায় মানুষ আত্মহত্যা করে, নতুন বউ তুমি জানতে না। কেটে ছিঁড়ে তোমাকে চিলশকুনের মুখে তুলে দেওয়া হবে! জানতে না, ভিসেরা হবে, পুলিশী কুৎসা হবে। সামাজিক ছিছিক্কার হবে।
ভাগ্যিস মরেছিলে নতুন বউ বেঁচে থাকলে সম্পত্তির মোকদ্দমা লেগে থাকতো ভানুর সঙ্গে বেঁচে থাকতে উপেক্ষিত মেয়ে মানুষ হয়ে। মরণের পরে নারী থেকে মানুষ হলে, হয়ে গেলে জীবন দেবতা।
জানিস শুভম,কাল রাত্তিরে মা আমাকে খেতে দেয়নি, ঋতব্রতর থেকে তিন নম্বর কম পেয়ে আমি সেকেন্ড হয়েছি বলে মার্কশিট নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই মা একচোট নিয়ে নিল, বাঁদরের বাচ্চা,শুয়োরের ঝাড় এবারও সেকেন্ড! মার্কশিট গুটিয়ে মুড়ে বকে বকে ফেলে দিল প্রেসার কুকার গালে ব্লিচ,চোখে মাস্কারা ছিল বলে ভূতের মতো দেখাচ্ছিল আমার ঘুড়িদুটো পটাপট ছিঁড়ে দিয়ে কাঠিদুটো দিয়ে পেটাতে লাগল যতক্ষণ না ভাঙে,
বিকেলে অফিস ফেরত বাবা এলে মা বলল, ছেলেকে নিয়ে তুমিই থাকো এ বাড়িতে আমি বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি আমি ঘুমোনোর ভান করে শুয়ে ওদের কথাগুলো শুনছিলাম
শুভম,রেজাল্ট বেরোনোর দিন আমার যে কি ভয় করে তোকে বোঝাতে পারব না, আরও ভয় করে মা যখন স্কুলে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করে খাতা যাচাই করে ফিরে আসে- ওঃ কীভাবে যে বাড়িতে ঢুকি- শুভম,ওই তিন নম্বরের ফাঁড়া যদি না কাটে আমার সামনে কোনো রাস্তাই খোলা নেই আমাকে নিয়ে বাবা মার মধ্যে সুখ নেই, ওদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ। আমাকে নিয়ে মার সঙ্গে ঝগড়া, মাস্টারমশাই এর সঙ্গে ঝগড়া ও সবের মধ্যে আমিই দোষী
শুভম,তুই জানিস তিন নম্বর বাড়ানোর উপায়? জানিস এই দৌড়ে ফার্স্ট হবার কৌশল? সেই একশো মিটার দৌড়ে ফার্স্ট হওয়ার জন্য সুজয় যেমন বিজনকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিল সেটাই রাস্তা কিনা! শুভম,তোকে বলে দিচ্ছি,এবারও যদি ঋতব্রত আমাকে টপকে যায়, বড়দিনে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে কেক খাওয়াব আর সেই কেকের মধ্যে মিশিয়ে দেব……………….
শুভম,আমি যে ঋতব্রতকে খুব ভালবাসি ওর টিফিন ভাগ করে খাই আমি, ঋতব্রত কি আমাকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবে? পারবি ঋতব্রত? পারবি!
একথা বলতে আজকে আমার লজ্জা নেই, মন প্রাণ দিয়ে চেয়েছি তোমায় মানুষী সাধ একটি মানব একটি মানবী একীভূত এক ‘গুরুদেব’ ঘটিয়ে দিলেন বিসম্বাদ।
তোমাকে চেয়েছি তনুমন দিয়ে হে কবিবর দশার্ণ গ্রামে অলকাপুরীতে দেবগিরি- তোমাকে চেয়েছি কোন একদিন,নিরন্তর- সাগর ছাড়িয়ে লাজুক নদীটি ধানসিঁড়ি।
তুমি দিতে এলে বৃহৎ ঘরের চাবিকাঠি আমি সুফিয়ান আট কুঠুরিতে তৃপ্ত বেশ কে চায় তোমার প্লেটোনিক জ্ঞান হে গুরুদেব আমার তখন নয় দরোজায় মনোনিবেশ। আমি নন্দিনী ভাঙতে চেয়েছি যক্ষপুর তুমি এঁকে দিলে রক্তকরবী দর্শনে হাত রেখেছিলে হাতের পাতায় যক্ষরাজ মেঘ থমথম প্রথম ঋতুর বর্ষণে।
ফিরে এসো কবি বৃথা গুরুদেব হয়ো নাকো ফিরে এসো ভানু- মানুষী কামনা কম্পমান এসো পাণিনির ব্যুহ ছেড়ে ফের মেঘদূতে ভরা ভাদর মাহ বাদরে পূর্ণ স্নান।
(একটি চিঠি। এই সময় চলছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। কৃষ্ণের ভূমিকা যেখানে অনন্যসাধারণ। এমন এক সময়ে বৃন্দাবনে রাধার মনে পড়ে তাঁর প্রিয়তমকে।নানা কর্তব্য কর্মে যিনি ভুলে গেছেন হয়ত বৃন্দাবনের গোপজীবন এবং রাধাকে)।
প্রিয়তম- সম্বোধন কি অন্য কিছু হলে ভালো হতো? যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ কি অন্যের চিঠি পড়ে? প্রয়োজন নেই এমন সম্বোধনে, হয়ত অধিকারও নেই তাহলে সুহৃদ কিংবা বন্ধু লেখা যাক সম্বোধনে কাজ নেই, তোমার জন্য কোন সম্বোধন পৃথিবীর অভিধানে নাই
তুমি আজ যুদ্ধক্ষেত্রে চারিদিকে রক্ত অস্ত্র ক্ষমাহীন মৃত্যুর পাহাড় তুমি সুস্থ থাকো ভালো থাকো আমার পরমায়ু নিয়ে তোমাকে না ছোঁয় যেন যুদ্ধের উষ্ণ বালুকণা অক্রুর যেদিন তোমায় নিতে এসেছিল আমরা অনেক বলেছিলাম, চোখের জলে পিছল করে দিয়েছিলাম তোমার রথের পথ শুয়েছিলাম তোমার যাত্রাপথে তবু তুমি চলে গেলে- বলেছিলে আবার আসবে।কবে কবে কবে পুরুষোত্তম? কবে আবার আসবে রাজা দুখিনির কুটিরে? এবার এলে দেখবে তোমার সেই প্রিয় ধবলীর দুটো দুষ্টু বাছুর, যমুনার সেই কদম গাছটির একটি শিশু চারা সেই তমাল বনে বাসা বেঁধেছে রঙবেরঙের প্রজাপতি আমার প্রতিদিন গাঁথা গুঞ্জমালা শুকিয়ে যাচ্ছে রোদ্দুরে তুমি কি আর কোনদিন পরবে না-
এমন দিনে তোমার কি একবারও মনে পড়ে সেই তমাল বনে বৃষ্টি, সেই মেঘের ডাক কুঞ্জের পথে অন্ধকারে দুজনে পথ হারিয়েছি ছপ ছপ বাদল রাতে দু-ই পথহারা পাগল ওপরে ক্রন্দসী আকাশ তুমি আমায় বলেছিলে, আমার প্রাণ আমার জীবন আমার স্বপ্ন সব তুমি মনে পড়ে না তোমার চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে যাওয়ার জন্য সেই অভিমান সেই তুমি এলে ভৈরবের সাজে জটাজাল রুদ্রাক্ষ ত্রিশুলে লুকিয়ে ছিলে নটবর বেশ আমার মান ভাঙাতে বলেছিল, দেহি পদ পল্লব মুদারম্- সেই তুমি বিশ্বরাজ জগদীশ্বর লুটিয়ে পড়েছিলে এই দাসীর পায়ে- কী লজ্জা কী বোকা ছিলাম তখন আজ মনে হয়, একবার তোমার পায়ে নিবেদন করি আমার সব লজ্জা বলি, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমায়, আমি তোমারই- হয়ত এরই নাম দ্বিচারিতা।স্বামীনিন্দা মহাপাতক- আমার স্বামী আয়ান ঘোষ ,শাশুড়ি জটিলা আর ননদ কুটিলা চারদিকে বিবর্ণ দেওয়াল দুধের হিসাব কষতে গিয়ে কখনো যারা আকাশ দেখেনি তুমিই আমাদের দেখিয়েছিলে সোনার আকাশ পদ্মপাতায় ফলে আছে মুক্তোফল
প্রথম জ্বালিয়ে গেলে প্রদীপ যার আলোয় জানলাম আমি শুধু কারও স্ত্রী কারও পুত্রবধূ নই আমি একজন সম্পূর্ণ মানুষ ষড়ৈশ্বর্যশালিনী আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী অবলা সরলা কুলবালা থেকে আমার নারী হওয়া মানুষ হওয়ার শুরু আর তুমি আমার দর্পণ যাতে নিজেকে দেখেছি
দাসী নই আমি,আমি ব্রজরাজেশ্বরী আমি রুক্মিনীর বেশবাস জানি না- সত্যভামার বীরত্ব জানি না জাম্ববতীর প্রেম জানি না আমি রাধা- আমি সম্পূর্ণা আমি আলোক সামান্যা বিশ্বরাজের প্রেমে আমি সর্বোত্তম তবু বলি, যুদ্ধের শেষে, দিনান্তে যদি পারো একবার এসো আমার ঘরে নিন্দিত আমায় নন্দিত করো পূর্ণ করো দীপান্বিত করো।
১. আমি যখন পুতুল ছিলাম – পুতুলই তো বেহিসেবি কেউ বলত লক্ষ্মী আমায়,কেউ বলত ‘মনসা দেবী’- আধো কথার আধা জগৎ বাবা-মায়ের হাতের খাঁচায় যেমন বাঁচায় তেমনি বাঁচি,তেমনি নাচি যেমন নাচায় নাচতে নাচতে খাঁচার পাখি কিম্বা মাচার আলোকলতা চার দেয়ালের মধ্যে টবে বটবৃক্ষের অনন্যতা আমার মধ্যে নদী এলো, পাহাড় এলো, লাল দোপাটি নিষেধ এবং ‘না’ এর মধ্যে পা পা এবং হাঁটি হাঁটি মা-দিদিমার হাতের পুতুল-এই করোনা,ওইটা নিষেধ দুইটি বই-ই পাঠ্য এখন, অচলায়তন, অথর্ববেদ।
২. অনির্বাণের সঙ্গে যেদিন প্রথম আলাপ কোচিং ক্লাসে গো-বেচারা হাত জড়িয়ে বললে আমায় ভালবাসে। কতরকম পদ্য লিখে পাঠিয়ে দিতো নোটের খাতায় অত ভালবাসার তথ্য ঢুকতো কি আর ছোট্ট মাথায়? লিখত , আমার লাবণ্য, রোজ্ , নন্দিনী বা শৈলবালা সারাজীবন রাখব ধরে স্বর্ণচাঁপার নরম মালায়- তারপর যা হবার হল- হাবুডুবু- পালিয়ে বিয়ে বাপের বাড়ির খাঁচা ছেড়ে ঢুকি বরের খাঁচায় গিয়ে। পদ্যটদ্য উধাও হল ফুলের মালার নেই উপমা দশটা পাঁচটা গদ্য এখন- কত খরচ কত জমা। বিবর্ণ সব, বিপন্ন শব, বিষন্নতার দীর্ণ বিকেল সোনার জলটা ফিকে হয়ে বেরিয়ে পড়ে জীর্ণ নিকেল। স্বামীর হাতে পুতুল ভাঙবে নিষেধ , না- এর কাঁচের চুড়ি! ঠিক তখনই নাভির নিচে জেগে উঠল নতুন কুঁড়ি।
৩. এখন আমি আবার পুতুল যদিও চুলে রূপোর জরি ছেলেমেয়ে দম দিয়ে যায়, দম ফুরোলে বাতিল ঘড়ি পুতুল বাড়ি, -পুতুল বাড়ির মালিক আমি কক্ষনো নই দুধের মত পাত্রগত, কখনো ক্ষীর , কখনো দই। আজও কিন্তু আকাশ দেখি , আজও ওড়ার মকসো করি মৃণাল কিম্বা নোরার মত ভাবছি, যা হোক বেরিয়ে পড়ি।