কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
রাজছত্র খুলে
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

ভালো হোক --- ডাক দিয়ে পাখি উড়ে গেল
দিনকিনারার দিকে |  আজ আমার দান |
লুকোও অশিঙা পশু, জাঠধারী লোক |
খুঁটো পুঁতে পুঁতে রাখি আত্মযশ, ফিরে ফিরে দেখি
ডোরা জ্বলে কি না গায়ে |  যে হও, যা হও,
মরুন্তে লোকের শাপ লাগবে না আজ |

চাঁচা-লেপা-দু-প্রহর !  রাজছত্র খুলে বসে আছি |
ছেঁড়া কানি ভরে ওঠো, ভরা থালা উড়ে এসো হাতে |
গায়ে ফুলে ওঠে ডোরা---সে যেন নরম-ফুল ধানছড়া ;
ষোলো কলা চাঁদ জ্বলে ছাতার পেছনে,
পা-র গোড়ায় সাষ্টাঙ্গ টান হয়ে পড়ে ছায়া |
ডাল নাড়া দিয়ে মজা করে গেল রাতচর মড়া |
বুকে পাখসাট করে করে ওঠে অগতি হুতাশ |

চাতর খলবল করছে |  কত দিককার বা-বাতাস
চালাচালি দান খেলছে পাশা-ছক পেতে |
আপন হাড়মাস চেটেপুটে খেয়ে ছড়খানা বিছিয়ে
ঘুম যায় সাতকেলে জন আমার |   জানে,
সাদা কালো মায়ারেখ গায়ে পুড়ে যায় ?
কড়ি বুড়ি খুলে পড়ে বেসামাল ঘুমে,
জানে ?  ওই গড়ানে ঢালের মাথাসই
না খাওয়ার ধন জমে জমে উঠছে সোনার জাড়িতে ?
ঢাল বেয়ে খসে যাবে ঘুম ভাঙবার আগেভাগে ?

সোনা দিপ্ দিপ্ করে  |  রাজছত্র খুলে বসে আছি |
ওড়া ভরে ওঠো ফুলে, ভরা থালা ভরে ওঠো আরো |
গায়ে ফুলে ওঠে ডোরা --- সে যেন নরম-ফুল ধানছড়া  |
এতখানি সোনা গাঁথা ছাতার চুড়োতে,
দ্বীপ বেড় দিয়ে ফুলে ফুলে ওঠে বীজ, ফল, হতছিন্ন মাস,
ডাল নাড়া দিয়ে মজা করে গেল রাতচর মড়া |
বুকে পাখসাট করে করে ওঠে অগতি হুতাশ---

.                  ****************               
.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ছেলেটা আমায় ডেকে
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছেলেটা আমায় ডেকে শোনালো : দেখ তো,
আমার একমুঠো ফুল ছিল ওরা সবাই যে যার ইচ্ছেমতো
নিয়ে চলে গেছে -- আমি কাউকেউ দেব না বলি নি,
তবু ওরা সমস্ত উজাড় করে নিয়ে গেল ---
ওরই মধ্যে আমার একটিমাত্র বকুলফুল ছিল, ভোররাতে
যখন তুলেছিলাম, মা আমায় তখনই : তোর হাতে
এ ফুল কোথ্বেকে এল !  চমকে বলে উঠেছিল, আমি তো বকুলফুল চিনি,
আমিও চমকে দেখেছিলাম আজান্তে তারই মাঝে
আমার পরানভোমরা ---চুপি চুপি শোনো --- আমি ঠিক
পাপড়ির মধ্যে আমার পরানভোমরা বসে আছে
দেখতে পেয়েছিলাম, অথচ সব নিঃশেষে উজার করে ওরা
আমার হাত থেকে নিয়ে গেল ---- আমি কাউকেউ দেব না বলি নি,
কাউকেউ দেব না বলি নি----
শুধু সেই একটি মাত্র বকুলফুল, সেই আমার
পরানভোমরা-----

হঠাৎ কী দেখে যে ও উঠে গেল, আমার কাছ থেকে----

.                  ****************               
.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কুকুরকে গেলাতে বসব এবার
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

চটপট ব্যাঙ্ক-নোট দলা করে গুঁজে ব্লাউজের ভাঁজে
দোর দি | গেলাতে বসব কুকুরকে এবারে |
তারপর ? আবার সেই ঘুমহারা অপার সফ্ টওয়্যার |
লোভ-টোভ নয়, লভ্য চালাচালি শুধু |
পাদপপ্রকৃতিহারা ঘাটে ঘাটে ঢুঁড়ে
মুম্বই তোকিয়ো প্রাহা ব্যুয়েনাস্ আইরেসে
জিহ্বা-উপড়োনো সাতবর্ণ পাথরের
টুকরো---চক্ষু খুলে আছে কারোয়াঁ-সরাইয়ের মোজেয়িকে  |
ঠান্ডা ঘরে ঘুম আসে না, জগরণও আসে না |  দশ বাঁও
কবজির নশানি দপ্ দপ্ করছে শুধু মুহুর্মুহু |

তবু দ্যাখো, যন্ত্র কেন, আঁতটিও বিগড়োয় ---- মেরামতি
হওয়ারও কঠিন ----তার লোক নেই আজ  |
ঘেসোমেটে দিনটা মনে পড়ে ?
ভুশুন্ডির মাঠে গিয়ে ভূতেদের সঙ্গ করতে ইচ্ছে হয় ? আহা !
আহা কাঁচাখেগো দেবতারা !
হাড়-খটাখটি নৃত্য স্বতঃস্ফূর্ত নিশিরাত জুড়ে |
ঠাঁইটাই কেবল কোথা তল হয়ে গেল |
অগুনতি ব্যাঙ্ক-নোট  ! কত সামোদ ব্লাউজ | শুনতে পাই
মহাফেজখানাতে সবই তোলা হয়ে গিয়েছে | কিন্তু
কুকুরটা কার কাছে রেখে যাব ?

.                  ****************               
.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ইচ্ছাসুখ
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

ফুলসুরভির মতো ইচ্ছাসুখ অক্লেশে ছিঁড়েছ
কুচিকুচি করে দিনদুপহর শরীর আমার----
সমস্ত নতুন যুদ্ধ ভরে গেছ চৈত্রমার্তন্ডের
কুশঘাসে ----স্মৃতি বর্ণচ্ছটা জাদু ----সব
বলয়ের মতো বেঁধে পায়ে পায়ে রক্তছাপ এঁকে
ডুবে গেছ ওড়কলমির দামে --- শতলক্ষ সুখ
এক-এক আঁধার জুড়ে ফুটে পড়ে আনাচেকানাচে----
ঢিবি-দেউলের পিঠে--- কুচিকুচি-ছেঁড়া মৌজা গ্রাম
নিঃস্ব হাটুরের দশ হাত জুড়ে --- ইচ্ছাসুখ, ওগো ইচ্ছাসুখ,
আমিও কখন কার হেম-সেলাইয়ের দক্ষতায়
ফুলসুরভির মতো আস্ত এক ফটিক-চাঁদোয়া
হয়ে শুয়ে আছি --- রাত ভেসে যায়, মানুষজনের
দুঃখসুখ ভেসে যায় পাল তুলে শান্ত নদীপথে---
ওই নিচু থেকে উঠে আসে তার রূপালি গুঞ্জন----

.                  ****************               
.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
একদা কারো
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

একদা কারো ছিল মুখখানি মায়ায় মাখা,
একদা কারো অ-বাঁধা চুলে উথাল রাকা!
দাওয়ার নীচে ছায়ায় ভিজে জঙলা মাটি
শুষতো শুয়ে আকাশ জোড়া সাঁঝবেলাটি।

বৃথাই হলো বেদনা-কালো সেই চারুতা।
আসন ঠেলে কোথায় গেলে হা গিরিসুতা!
বাদুড় ঝোলা ডুমুর ডাল আলুলকোশী,
পালিয়ে গেছে ঘরের লক্ষ্মী সোনার বেজি।

এখন দোর অবাধে ঠেলে বাতাস ঢোকে।
উঠোন ভরা হাটের লোকে বাটের লোকে।
কোথায় ? সব কোথায় ? সব কোথায় ? আজো
আছো কি কেউ কোথাও ? আছো ? কেউ কি আছো ?

.                  ****************               
.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পু---ঝিক ঝিক
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

পু---ঝিক ঝিক পু--- ঝিক ঝিক
যাই হুই দূর---যাই পুব দিক
সাত গাঁ-র পথ, সাত গাঁর রঙ
হাত ঝমঝম গা ঝমঝম . . .
দম ভর ছুট--- দম ভর ছুট---
দিপ দিপ রাত, ভোর ফুট ফুট,
আর কদ্দুর---আর কদ্দুর---
হুই তাজপুর দুবরাজপুর।

.        ****************               
.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সব শূন্য হয়ে যায়
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

সব শূন্য হয়ে যায় জনতার স্বেদাক্ত আশ্লেষে,
সব পূর্ণ হয়ে ওঠে আতপতাপিত দীপ্তিভরে,
সব শূন্য হয়ে যায় সব পূর্ণ হয়ে ওঠে শেষে---
সব পূর্ণ হয়ে ওঠে শেষে।

গত বর্ষে উদযাপিত অন্তিম শব্দটী ওষ্ঠাধরে
এই মুহুর্তে যেন ভীষণ ব্রীড়ায় কেঁপে ওঠে।
যেন সব দাবি সব যাচ্ঞা রোষ বঞ্চনা ও গ্লানি
সূর্যাস্তবিভার মতো অনিবার্য হৃদয়াবলেপে
বেজে উঠে শূন্য হয়ে যায়।
শুধু পড়ে রয় এক খড় ওঠা মাঠের বিস্তার---
জোনাকি-জ্বালানো সন্ধ্যা---মনসার বিস্রুত ব্রয়ানি---
স্মৃতিচারণের অন্ধকার---

আর সারা রাত্রিভোর পথিকভোলানো আলেয়ার
গুপ্ত আলপথগুলি জেগে ওঠে, সঙ্কেতপ্রদীপে
তিনশ মোটরগাড়ি উচ্চকিত, সিক্ত সর্পিলতা
বুকের বন্ধনী খুলে ডাক দেয় পৌরাণিক নীপে।
যারে ডাকে তার সাথে সহস্র পার্ষদ ছুটে যায়---
যারে ডাকে তার সাথে ধায় যত উদ্বাহু ও লোভী---
আর এক দুর্ঘটনা পড়ে থাকে পথের উপরে,
শুধু দুর্ঘটনা এক অবিমিশ্রিত শোণিতসুরভি
কীর্ণ করে দিতে থাকে কপিশ জ্যোত্স্নায়,
শুধু এক দুর্ঘটনা পুঞ্জীভূত কুসুমরাতায়
নিশ্চিন্তে ঘুমায়ে রয় দূর নিশান্তের প্রতীক্ষায়---
শুধু এক সহায়হীনতা।

.            ****************               
.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
রাধা
কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

পরবাস, শূন্য পরবাস।
দুপুরের স্তব্ধ আকাশ
ছায়া ধরে আছে। দূর কোণে
দাঁড়িয়ে রয়েছ, কাকে ভাবো একা একা আনমনে ?
কার মুখ ? হাওয়া হয়ে ওঠে নৃত্যপরা,
হাওয়া ছেড়ে ফুলের পসরা,
ঘনঘোরে ঘিরে আসে ধারাসুখ আঁধার সুবাসী . . .
.        বাঁশি
শুধু বাঁশি জানে তার কথা।
বৃষ্টির ধারায় কাঁদে একটানা বাঁশি---
একটানা---তীব্র তপ্ত সুখ,
কাকে আনমনে ভাবো ? কাজলনিমীল মায়ামুখ . . .
.        ওগো বিফলতা---বিফলতা---
বৃষ্টির ধারায় কাঁদে একটানা বাঁশি---একটানা---
তীব্র তপ্ত জল
বড়ো বড়ো তারার ফোঁটার মতো উতলবিহ্বল।

.                ****************               
.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*