কাল রাত্রে ঝড় এসে ঢুকেছিল পরিচিত ঘরে। লোকেন ছিল না। তার জার্নালের পাতা কটি উড়ছে হাওয়ায় ; সেলফে যে সব বই ব্যবহৃত, ব্যবহার হবে বলে এসেছিল --- সব ; দেয়ালে যৌবন : তিনটি পেরেকের মাতন দেখেছে ; চিবুকের কাছে এসে কম্পিক অধর যেন শঙ্কিত নীরব।
লোকেন ছিল না। তার স্বলিপি লেখা খাতাখানি রবীন্দ্রনাথের দিকে চোখ চেয়ে খাঁ-খাঁ শূণ্যতাকে ঢাকবার ব্যর্থতায় একবার শুধু কেঁপেছিল। ধূর্ত টিরটিকি তার বান্ধবীর কাছাকাছি গিয়ে জ্যোত্স্নার আলোয় কিছু ভয় পেয়ে দূরত্বে পালাল। পর্দার কাঁপন দেখে মনে হয় যেন কেউ এই মাত্র আসবে এই ঘরে : মহাশ্বেতা কিংবা আরো অনায়াস, পরিচিত নাম।
লোকেন ছিল না। তার এক পাটি জুতো, কিংবা পাঞ্জাবির ঝুল একপাশে বেশা কাত হয়ে--- স্থির থেকে স্থিরতর হয়ে--- সময়ের কাছে গিয়ে অবশেষে নির্জনতা হল।
গায়ের চাদর ফেলে পা-টিপে পা-টিপে মন্দিরের গদি থেকে একটি গঙীর পাপ আস্তে উঠে এল। . *************** . উপরে
অবনত বারুদের ধাক্কা এখন আমাকে প্রতিহত করে। নিজের মধ্যে আমি দেখতে পাই নিজের আদল। আর পারম্পর্য রেখে স্বস্তিহীন ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে এক-একদিন চমকে উঠি।
এক-একদিন ঘুমের মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য মা আমার সদ্য চাল-ধোয়া হেসেলের হাতে চোখের জল মুছিয়ে দেন।
এক-দিন স্বপ্নের মধ্যে আমার দুই জাগরুক হাত ক্ষিপ্র প্রতিবেশীর মত আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়।
নিজের মধ্যে আমি দেখতে পাই নিজের আদল। আর স্থবিরতা থেকে ঝলসানো বিদ্যুতের মত উঠতে-উঠতে টের পাই--- আমার সমস্ত জুড়ে অবনত বারুদ ; নিশ্বাসে দগ্ধ কার্তুজের গন্ধ, আর ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ!
দেয়ালে আমার বড় ছেলের ছবি বছরের পর বছর ধ’রে দেখিয়ে যাচ্ছে সেই একই একুশ বছরের হাসি।
দেখতে দেখতে আমার ছোট ছেলেও পেরিয়ে গেল ওই বয়স। তার চুল আঁচড়ানোর চিরুনিতে তার জামায় তার হাটাচলা আর কথা বলার ভঙ্গিতে তার নিরুদ্বেগ হাসি আর মুঠোয়-ধরা ক্যালকুলেটরের অঙ্কে আমি দেখতে পাই সদর্পে এগিয়ে আসছে একবিংশ শতাব্দী।
মাঝখানে স্তব্ধতা সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই।
আমি জানি না কেন আমার নিঃশব্দ ভরদুপুরে কড়া নড়ে ওঠে রাতের দরজায়! কেন আমার নিঃশ্বাস যখন-তখন উথলে ওঠে অন্ধকার আর বারুদের গন্ধে, আর আকাশ চিরচে-চিরতে মিলিয়ে যাওয়া পর পর বিস্ফোরণের শব্দে!
আমি জানি না কেন আমার ছোট ছেলের বাড়ি ফেরা আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমাদের সচকিত জেগে ওঠা ; আর সেই ব্যস্ত কণ্ঠস্বর, ‘মা, কিছু খেতে দাও, এক্ষুনি আবার যেতে হবে। যদি না ফিরি, ভেবো না--- দেখো, ঠিকই ফিরে আসবো।’
মাঝখানের স্তব্ধতা আমাকে এর বেশী দেয় না।
আমার ছোট ছেলে জানে কার হাত ধ’রে সে এগিয়ে যাচ্ছে কোনদিকে। তার খিদে পায় না, তার রাতগুলোও সাজানো মঞ্চের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকে বোতাম-টেপা আলোয়।
এখন আমি অনেক বেশী নির্ভয় ; এখন আমি অনের কিছুই ভুলে গেছি।
রাতের অবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তার মধ্যে শুধু ওই প্রতিশ্রুতিই হঠাৎ-হঠাৎ জাগিয়ে দেয় আমাকে--- দেখো, ঠিকই ফিরে আসবো।