দীনের পঙ্ ক্তি থেকে ("ভাঙা ছন্দ পঙ্ ক্তি পদ" থেকে, ১লা জানুয়ারী ২০০৯ সালে প্রকাশিত)
তোমার পায়ের কাছে প্রতিমা লুটিয়ে আছে, গম্বুজ, সবুজ, গোপুরম, গাভী, রক্তপাত, রাজনীতি, আদিগন্ত দাঁত, হাস্যহীন সকল নবাবী |
সর্ব ক্ষুদ্রতারে দহ, তুমি, সর্ব মঙ্গলেরে লহ, তুমি, তোমার পায়ের কাছে হাতগুলি লুটিয়েই আছে ছন্দের বন্ধন ভেঙে ছড়িয়ে নানান দিকে ভারতবর্ষের মাটি, শিলালেখে, পাহাড়ে পাহাড়ে আমার সুরগুলি ক্ষুধায় কাতর, আমি দেখি কিন্তু পাই না তোমারে |
হা রে একী ছিন্ন, একী ভিন্ন সুর, দরবেশ, মসজিদ, তারা নাকি ভারতবর্ষ নয়, তারা নাকি উদাস, হতাশ, বাতাসে বাতাসে সর্বনাশ, বলো, এই পরবাসে রবে কে ?
অববাহিকায় দাঁড়িয়ে একটি ছোট, যার নাম আয়েষা রেখেছি তার ভবিষ্যৎও তোমার পায়েই নত, টপ্পা বা ইমন নামে সাত ভাই চম্পার দল ঘিরে তাকে ব্যক্তিগত হাসে, খেলে, নদী, ঝর্ণা সবই অনর্গল, তবে, পাব কবে তোমার যে চরণের কাছে, মন্দির, মসজিদ, চাষা-বৌ, হিমপ্লাবী মুকুটপাহাড়, সাইরেন, শঙ্খ, গির্জা, বৈজ্ঞানিক চুল্লীগুলি, লুটিয়েই আছে ?
শাসক ও শোষিতের বিষাক্ত বা বিষক্লিষ্ট শতকোটি মাটির প্রতিমা, এদেশের মাটিতেই এসে এদেশের মাটিতেই মেশে | তারপর মাটি ভেদ করে জাগো একদিন শুদ্ধ ও মলিন নম্র মুখশ্রীতে | চরণধুলার চিহ্ন চোখে লেগে আছে, বিহ্বল সেই চোখে গান
আমার সমস্ত বাক্ ভূলুন্ঠিত মাটির প্রতিমা মাটি মেখে পড়ে থাকে, তোমাকেই চায় ; তুমি, কত হাজার বছর ধরে মানুষের শ্রী এবং শ্রীহীনতা, তুমি মহানির্মাণের শ্রম, তুমি লৌকিক, আলোকিত ভূমি মরু-আলো, অন্ধকার জল, তুষার ও নব্বইকোটিদল পদ্মে গড়া আজ যার চরণের বেদী সেই তুমি কোথায় চলেছ ?
আমার জীবন ("ভাঙা ছন্দ পঙ্ ক্তি পদ" থেকে, ১লা জানুয়ারী ২০০৯ সালে প্রকাশিত)
অল্প ও সামান্য ধান্য, প্রণাম তোমাকে | প্রণাম আকাশ আর এই মৃত্তিকাকে ||
জন্মস্থান, সেই কাল কবেই ছেড়েছি ; এখনের হাসাহাসি, কান্নার নই কাছাকাছি | জন্মদাগ লেগে আছে শুধু , শকুনের মৃত্যুদাগ এসে যাচ্ছে নীলাকাশে | মৃদঙ্গের খোল, বোল ভাসে সমুদ্রে, বাতাসে, তাই নিয়ে চলে যাচ্ছে তালেগোলে দিন | শিশুর হাততালি |
একমাত্র পা-ছাপ যা ফুটে ওঠে একবেলার ফুল যেন |
কোনো নতুন বিপ্লব, কোনো সংগঠন দুঃখমোচনের , বিজ্ঞানের নব অগ্রগতি অনায়ত্ত না-শোনা রূপকথা | কত নয়া শাস্ত্রাভ্যাস, গ্রস্থ শস্ত্রসম পরীক্ষা-আগারে, অপরিচয়ই রইল যে-সব দুঃখীর সাথে, বীর পুরুষ-স্ত্রীয়ের সাথে তাদের মতন |
চাঁদ জ্যালজেলে হাসে, বৃহস্পতি গুঁড়া-উল্কা নিয়ে ফেরা-মুখে সংঘর্ষে আকাশে কত গল্প বলে, আমার পৃথিবী তাতে কাঁপে, ভাঙে, গুঁড়ো হয় কিনা জানি না | কাব্য, শিল্প, মানুষকেন্দ্রিক বিশ্ব, ইত্যাদির যথার্থতা জানি না, যেমন বাংলায় ভাগ, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতবর্ষে ভূমিখন্ডে নিচুতলে ঠোকাঠুকি মহাকালে কেমন তাত্পর্যময় জানি না, জানি না |
মানুষের নির্মিত ঈশ্বর, অতীতের ডাইনোসর, একচেটিয়া পুঁজির শেয়াল কীভাবে শিকার খোঁজে, আদরে বা অনাদরে কারা আজ কীভাবে চোখ বোঁজে , এ সমস্ত বাসে করে কর্মস্থলেযেতে ব্যস্ত মনেও পড়ে না |
ঝরে না ফুল বিকালে পায়ে বাতাস লাগে না আদুল এ-গায়ে, লাগে না হাড়ে ;
শুধু মানুষের দুঃখই বাড়ে |
এবং ছন্দবিহীন জীবন এবং, ছন্দ না-চাওয়া জীবন পাওয়া, না-পাওয়ার অতীত জীবন বাড়তেই থাকে,
এত আমার গানের ডানা লুকিয়ে রাখা, এতদিনের মানা, কোন্ অভিমান, কাদের উপর, ছিঃ ! কেন আমি আকাশ-আলো-তারার ওপর রাগ করেছি ?
২ প্রলাপের মধ্যে যেন প্রলয় সঙ্কেত থাকে, গোলাপের, সেই শৈশবের গোলাপের গাছ ক’টি থাকে, যেন আমার মুখের রেখা আঁকে |
৩ ভোর ছুটছে পূর্ণতার দিকে মেঘ ছুটছে তার পিছে গরগর গর্জনে এই আলো-ছায়া নিয়ে আমাদের দিন শুরু হয় |
কৃষকেরা মাঠে কাজ করে, গাছে গাছে যত্ন করে ফুলগুলি কে যেন সাজায়, সংকীর্তন-করতালে কে যে কী বাজায় শুনতে পাই, সে কি শুধু আশা, নাকি পৃথিবীরই ভাষা ?
৪ দেখ দিকি, কেমন সুন্দর মানুষের ঘর | টোম্যাটোরা লাল, ফুলকপির হলদে সুশ্রী মুখ | যদিও ইরাক আছে, ব্যারাক সর্বত্র আছে, রক্ষা করতে বাজারের বাইরে দামী কিছু বেঁচে আছে এক সূর্যরশ্মির চাবুক |
নেরুদার টোম্যাটোরা লাল, আর লাল প্রিয়তার ঠোঁট, মানুষের চুম্বিত কপাল |
৫ আরও একবার বলি, নমো নমো জ্ঞানদাস, রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র প্রিয়তম, মুকুন্দরামের, কৃত্তিবাসের খড়ম ঘনরাম, বিজয়গুপ্তের ত্যক্ত চাদরেতে বেঁধে দাঁড়াও সে মোহনার পাশে এক বালুকাবেলায় যেখানে অপূর্ব আলো রোজ ক্লান্ত ঝরে যায়, চৌকি দেয় দুই জোড়া অপরূপ চোখ রবীন্দ্র-জীবনানন্দ দুটি মানুষের |
কবিতাবিহীন ("ভাঙা ছন্দ পঙ্ ক্তি পদ" থেকে, ১লা জানুয়ারী ২০০৯ সালে প্রকাশিত)
১ রাত নিভলে দিন জ্বলে এসব তো জানা কথা, দেখা যায় না রাত আর দিনের তফাৎ ; যারা দ্যাখে , জাগে সারা রাত, দিনে পেঁচাদের মতো ঘুমায় ও দিন পুড়ে যায়, কবিতালেখকদের এই সার্থকতা !
নিরন্নরা মিছিলে দোলে না, অভবের সাপে গলা বেঁধে দুলতে থাকে, হাসে, বাংলার মধ্য-উচ্চবিত্ত কবিদের চোখে চোখ ; বাঁশের ছাউনি-দেয়া চাঁদমাখা ভূত হয়ে হাসছে দিব্যোক |
২ আমার গান তোমাকে চায়, তুমি আমার ব্যক্তিগত আমি কেমন আত্মরত ক্ষুধা যাক্ চুলোয়, যাক্ চুলোয় ক্ষুধা, সেখানে থাক্,
আমার গান গ্যাসে প্রস্তুত আমার গান সুগন্ধ দ্যায়--- আমার গান আমারই গান রূপে ভোলায় না, ভালবাসা নেই, আমার গান পোস্ট-মডার্ন |
৩ এসব সহজ কথাকে কবিতা বলে না, এসব নিয়ম নেই এগুলো বাজারে একেবারে আজ চলে না, এগুলো গলায় দড়ি বেঁধে দুলবেই |
ইদানীং চলাচল ("ভাঙা ছন্দ পঙ্ ক্তি পদ" থেকে, ১লা জানুয়ারী ২০০৯ সালে প্রকাশিত)
প্রসাদ নিই না তো কোনোদিন , তাই চলছি, খাচ্ছি রাস্তার মিঠাই | তেলেভাজা | যখন কেউ ‘হরিবোল’ বলছে, তা-ই বলছি, কেউ ক্ষমতা দেখালে বলছি, তার নামে ‘জয় রাজা’ | এন্মি দিন কাটছে, মন্দও না, চালটি সহনীয়, কেউ নমস্কার করলে, আমার মাথা নত করাকে বানাই গ্রহণীয় |
এই রকম কষ্টকর মিল দিয়ে খিলখিল হাসি অতৃপ্তির, না তৃপ্তির তা-ও বুঝি না, কিন্তু বোলো না আমি খুঁজি না |
শুরু-শেষের গল্প ("ভাঙা ছন্দ পঙ্ ক্তি পদ" থেকে, ১লা জানুয়ারী ২০০৯ সালে প্রকাশিত)
তোমার সঙ্গে বসিয়েছিলাম গানের মেলা, দিন কাটলো, সাঙ্গ হ’ল সেসব খেলা | এখন শুধু মাটির ঘ্রাণে জীবন কাটে এখন শুধু অচেনা লোক কোথায় হাঁটে মনে হয় তা আলপথ সব দূরের মাঠে, নয়ত’ তারা মেশিন দিয়ে কীসব কাটে, এসব ভেবেই কেটে যাচ্ছে ধূসর বেলা |
আমি আছি এক জায়গায়, থেকেও নেই, চারপাশে সব এমন বাতাস, পাই না খেই | যে মানুষকে চিনি না তার কথাই ভাবি, ডাক শুনেছি, ‘আয়না তবে, কোথায় যাবি ? অবাস্তবের পর্দাঘেরা ঘর সাজাবি’| এই সমস্ত নানারকম হাবিজাবি মুগ্ধ কানে শুনে যাচ্ছি, ----আহ্বান সেই !
এমনি করে ঘুমপাড়ানি গানের মতো শুনে কাটছে যেমন তেমন দিন যে কত ! তাই বোঝাচ্ছি নিজেকে আজ কেমন হবে চৈতন্যের মতন যদি ঝাঁপাই তবে নীল জলে বা অন্য ঢেউয়ের আন্দোলনে ? বাঁচছি না তো, বাঁচছি কেবল মনে মনে | একরকম টিঁকে থাকার নতুন খেলা এমনি খেলি সকাল, বিকেল, সন্ধেবেলা |
১ অন্ধকারের আয়না দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে অনেক মুখ বিরাটবিশ্বে দীর্ণ গলায় সমস্বরে ভাঙা স্বপ্নের জবাব চায়, এমনি করে বেঁচেও যায় |
এত বিশ্বের এক আয়না ঠাসাঠাসি হয়, হতে চায় না এক রূপসীর বিদ্যুৎনথে যেটুকু উপোসী মুখ দেখা যায় সুর বদলায়, তাল বদলায় |
স্তব্ধ চোখের জল, জীবন চঞ্চল, ছক কাটা হয়, ধরা যায় না, হায় |
২ স্বপ্নের কোন সঙ্গতি নেই, মঞ্চসফল হয়েও এখন তেত্রিশ কোটি দল, উপদল ; লড়াই তাদের বড়াই হয়েছে, খঞ্জ তাই, অন্ধও বটে, গান গেয়ে হেঁটে চলে উৎরাই |
সে যে কী আঁধার পথের ধাঁধায় শুধু চলাফেরা সে যে কী ‘লক্ষ অভিশাপ’ দিয়ে হাততালি ঘেরা বৃত্তে আলোয় ভৌতিক নাচ মৃত্যুমঞ্চে, পাশে কে ক্ষীণ কন্ঠে কান্ ছে--------
৩ এবার, অবগুন্ঠন খোলো |
‘অবগুন্ঠন’ অতীতের ছায়া, কবেই তো তার লুন্ঠন হোলো |
এখন সারস, বকের সারিতে, জলায় জলায়, মাছ-মাছরাঙা মেশানো মাটিতে ছেঁড়া শাড়ি শুধু পড়ে থাকে তার, পরিত্যক্ত |
৪ কীর্তনীয়ার বুকে জবাগাছ, শ্যামে ও রক্তে সেই মেশামিশি ;
বৃষ্টি হ’লেই তোমার মনে পড়ে বৃষ্টি হ’লে ধানেও ছিট পড়ে কোনো বৃষ্টি ভালই ধান গড়ে বৃষ্টি হ’লে কেঁচো কোথাও হাঁটে ;
এককালে সব কবির রাজ্যপাটে বর্ষা নেই, তবুও তুমি মনে ক্ষণে ক্ষণে, অশুভ সব ক্ষণেও মানুষ যখন মরছে কিছু চেয়ে---- হ’তেও পারে সেটা ফ্যান বা ভাত হ’তেও পারে সেটা স্বাধীন দেশ ; আজও তারা হয়নি নিঃশেষ, বরং তাদের বাড়বার সংবাদ |
মানবীভোগ, মানবভোগ খেয়ে পুষ্টি পায়, কুস্তি লড়ে তারা ; সন্তুষ্টি বেচাল মেডাল পেয়ে শ্রেষ্ঠ কবির অগ্রাসন চেয়ে |
এরই মধ্যে বৃষ্টি পড়ে যায় শুধু এক, একই ভরসায় তুমি এসো, এসো আমার ঘরে সকল ক্ষুধা অতিক্রম করে |
পীড়া, দহন, মানব-অসম্মান সবই তুমি পিছনে ফেলে আসো---- আমার চোখে হানো নয়নবাণ, আমাকে শুধু একটু সম্ভাষো |