কবি দিনেশ দাসের কবিতা
কাস্তে
কবি দিনেশ দাস

বেয়নেট হোক যত ধারালো---
কাস্তেটা ধার দিয়ো, বন্ধু!
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শান দিয়ো, বন্ধু।

নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে ?
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ-যুগের চাঁদ হ'লো কাস্তে!

ইস্পাতে কামানেতে দুনিয়া
কাল যারা করেছিল পূর্ণ,
কামানে-কামানে ঠোকাঠুকিতে
আজ তারা চূর্ণবিচূর্ণ :

চূর্ণ এ-লৌহের পৃথিবী
তোমাদের রক্ত-সমুদ্রে
গ'লে পরিণত হয় মাটিতে,
মাটির---মাটির যুগ ঊর্ধ্বে!

দিগন্তে মৃত্তিকা ঘনায়ে
আসে ওই! চেয়ে দ্যাখো বন্ধু!
কাস্তেটা রেখেছো কি শানায়ে
এ-মাটির কাস্তেটা, বন্ধু!

.        ****************               
.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ডাস্টবিন
কবি দিনেশ দাস

মানুষ এবং কুত্তাতে
আজ সকালে অন্ন চাটি একসাথে
আজকে মহাদুর্দিনে
আমরা বৃথা খাদ্য খুঁজি ডাস্টবিনে।

এই যে খুনে সভ্যতা
অনেকজনের অন্ন মেরে কয়েকজনের ভব্যতা,
এগোয় নাকো পেছোয় নাকো অচল গতি ত্রিশঙ্কুর---
হোটেলখানার পাশেই এরা বানিয়ে চলে আস্তাকুঁড়।

পুঁজির প্রভু! মহাপ্রভু! তোমার কৃপা অনন্ত---
জলের ফোঁটা ঘিয়ের কড়ায় ফুটন্ত,
পিঁপড়ে পেল মানুষ-গলা শর্করা,
তোমার কৃপা বুঝবে কি আর মূর্খরা ?

আজ যে পথে আবর্জনার স্বৈরিতা
মহাপ্রভু! সবই তোমার তৈরি তা।
দেখছি বসে দূরবীনে
তোমায় শেষে আসতে হবো তোমার গড়া ডাস্টবিনে।

.          ****************               
.                                                                                
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
নববর্ষের ভোজ
কবি দিনেশ দাস

বণিক প্রভু! মহাপ্রভু!
নতুন বছর আসল তবু
নেইকো ঘরে খুদের গুঁড়ো, নেইকো কড়ি,
কেমন করে তোমায় রাজা তোয়াজ করি ?

না হয় হলাম দীন ভিখারি,
শূন্যহাতে তোমার কাছে আসতে পারি ?
এনেছি তাই তোমার ঘরেই তৈরি নাড়ু নতুন ভাবে
মহাপ্রভু, গরম বোমার লাড্ডু খাবে ?

গরুর হাড়ে মানুষ হাড়েও অবিকৃত
তোমার মাড়ি কঠিন হল কঠিনতর,
এনেছি তাই বারুদ-রুটি রাশীকৃত
মহাপ্রভু আহার করো, আহার করো!

.          ****************               
.                                                                                
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মৌমাছি
কবি দিনেশ দাস

জীবন্ত ফুলের ঘ্রাণে
দুপুরের মিহি স্বপ্ন ছিঁড়ে-খুঁড়ে গেলো
জেগে দেখি আমি,
এসেছে আমার ঘরে ছোটো এক বুনো মৌমাছি,
ডানায়-ডানায় যার অর্ণ্য-ফুলের কাঁচা ঘ্রাণ
পাঁশুটে শরীরের যার সোঁদা গন্ধ অজানা বনের।
কেমন সুন্দর ওই উড়ন্ত মৌমাছি।
অশ্রান্ত করুণ ওর গুনগুনানিতে
কেঁপে ওঠে মাটির মসৃণতম গান,
আরে দূরে পাহাড়ের বন্ধুর বিষণ্ণ প্রতিধ্বনি।
যেন আজ বাহিরের সমস্ত পৃথিবী আর সমস্ত আকাশ
আমার ঘরের মাঝে তুলে নিয়ে এলো
কোথাকার ছোট্ট এক বুনো মৌমাছি।

.          ****************               
.                                                                            
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ভারতবর্ষ
কবি দিনেশ দাস

চোখভরা জল আর বুকভরা অভিমান নিয়ে
কোলের ছেলের মতো তোমার কোলেই
ঘুরে ফিরে আসি বারবার
হে ভারত, জননী আমার।

তোমার উত্সুক ডালে
কখন ফুটেছি কচিপাতার আড়ালে,
আমার কস্তুরী-রেণু উড়ে গেছে কত পথে
দিগন্তে আকাশে ছায়াপথে,
তবুও আমার ছায়া পড়েছে তোমার বুকে কত শত ছেলে
তুমি বাঁকা ঝিরঝিরে নদী ছলছলে
বাজাও স্নেহের ঝুমঝমি,
জননী জন্মভূমি তুমি!

তোমার আকাশে আমি প্রথম ভোরের
পেয়েছি আলোর সাড়া,
দপদপে হীরে-শুকতারা
অস্ফুট কাকলি,
জলে ফোটে হীরকের কলি
মধ্যাহ্নে হীরের রোদ---
হে ভারত, হীরক-ভারত!

কোন্ এক ঢেউছোঁয়া দিনে
বঙ্গোপসাগর থেকে পথ চিনে চিনে
কখন এসেছি আমি ঝিনুকের মতো,
তোমার ঘাসের হ্রদে ঝিলের সবুজে
খেলা করি একা অবিরত!
আমি তো রেখেছি মুখ
তোমার গঙ্গোত্রী-স্তনে অধীর উন্মুখ,
মিটাল আগ্নেয় ক্ষুধা তোমার অক্ষয় বটফলে
দিনান্তে সুডৌল জানু মালাবার করোমণ্ডলে
দিয়েছ আমাকে কোল ;
কত জলতরঙ্গের রাত্রি উতরোল
ভরে দিলে ঘুমের কাজলে ;
মিশে গেছি শিকড়ের তন্ময়তা নিয়ে
তোমার মাটির নাড়ি হাওয়া আর জলে
গ্রীষ্ম বর্ষা হেমন্ত শরৎ ---
হে ভারত, হীরক-ভারত!

আজ গৌরীশঙ্করের শিখরে শিখরে
জমে কালো মেঘ
বৈশাখী পাখির ডানা ছড়ায় উদ্বেগ ;
তবু এই আকাশ সমুদ্র থেকে কাল
লাফ দেবে একমুখো হীরের সকাল
চকচকে মাছের মতন---
হে ভারত, হীরক-ভারত পুরাতন!

.          ****************               
.                                                                                
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
প্রণমি
কবি দিনেশ দাস
(পঁচিশে বৈশাখ )

দেখেছি তোমার নামে সবার প্রথমে
শ্রাবণে ধানের শিসে দুধটুকু জমে,
তোমারি তো নামে
বৈশাখে আখের খেতে যত মধু নামে |
তবুও হাজার হাতে হাওয়া দেয় ডাক,
কোথায় মাটির স্বপ্নে শিলীভূত পঁচিশে বৈশাখ |
কোথায় আকাশে বাজে সোনার সরোদ
পঁচিশে বৈশাখী ভোর গলে হয় গিনিসোনা-রোদ |

তুমি তো বনস্পতি তোমার পায়েতে থরে থরে
অজস্র শব্দের রং কৃষ্ণচূড়ার মতো ঝরে
তুমি এক অবাক মৌচাক
কথাগুলি চারপাশে ঘোরে যেন গুন্ গুন্ সুর এক ঝাঁক |

তোমার ছন্দের নদী জমা হত যদি
পৃথিবীতে হত মহাসমুদ্র-বলয়,
ঝুরঝুরে গানের মাটি জ’মে জ’মে হ’ত
আর-এক নতুন হিমালয় !

আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয়নাম,
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা----
কোনখানে রাখব প্রণাম !

.          ****************               
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
পনেরই আগস্ট : ১৯৪৭
কবি দিনেশ দাস
বাপ্পাদিত্য জানা সম্পাদিত, ২০১৭ সালে প্রকাশিত, “আন্দোলন ঘটনা ও কবিতা, বঙ্গভঙ্গ
থেকে সাম্প্রতিক ১৯০৫-২০১১” কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া।


আমার দু’চোখে আজ করে ছলোছল
পদ্মার অজস্র জল
মেঘনার ডাক,
মেঘের স্রোতের মতো স্তম্ভিত অবাক।

ডাক আসে ধূসর শহরে
রুক্ষ দ্বিপ্রহরে
বাতাস ছড়ায় অবসাদ,
ছিন্নমস্তা করে শুধু রক্তের আস্বাদ।
শুকনো পাতার মতন উড়ে এল স্বাধীন সনদ,
এখানে আমার চোখে ঢেউ তোলে

বুকজোড়া পদ্মা হ’তে দূর সিন্ধু নদ,
তবুো মুক্তির স্রোত ওঠে ফুলে ফুলে
করোমণ্ডলের ধারে শ্যাম মালাবার উপকূলে
ভারত-সাগর গর্জায়,
ইতিহাসে শুরু হবে নতুন পর্যায়।

এখানে তো শাঁখের করাতে
দিনগুলি কেটে যায় করাতের দাঁতে
সীমানার দাগে দাগে জমাট রক্তের দাগ---
কালনেমী করে লঙ্কাভাগ।

তবু এল স্বাধীনতা দিন
উজ্জ্বল রঙিন
প্রাণের আবেগে অস্থির---
ডাক দেয় মাতা পদ্মা, পিতা সিন্ধু-তীর।

.          ****************               
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*