সে
কবি দীপক দে

তেতাল্লিশের মন্বন্তরে গ্রাম শহরে দেখেছি তাকে
ছেচল্লিশের ভ্রাতৃঘাতী হানাহানিতে
বিপন্নদের পাশে দাঁড়িয়ে চিনেছি তাকে
গণনাট্য নবান্নের দিনগুলিতে
পথ হেঁটেছি একসাথে
ছেচল্লিশ নম্বর ধর্মতলায় দেখা হয়েছে অনেকবার
সাতচল্লিশে দেশভাগ বিদ্ধ করেও পারেনি ভাঙতে
তেভাগার মাঠে প্রান্তরে দেখেছি তাকে আবার
তিপ্পান্ন – ঊনষাট – ছেষট্টির
ট্রাম –খাদ্য – আন্দোলনে  সে-ই তো ছিল
প্রথম সারে
আর
সত্তরের সন্ত্রাসের কালো সময়ে
দেখেছি তার চোখে
অন্ধকার ছিঁড়ে সূর্যের প্রতীক্ষা
আজও তাকে দেখি
মেদিনীপুর  বাঁকুড়া  পুরুলিয়ার  ঘরে  ঘরে
বাতি জ্বালানোর দুর্জয় শপথে বলীয়ান
সে-ই  তো  জানিয়ে দিয়ে গেলো
মানুষের উপর বিশ্বাস হারিওনা
তাকে সংগে নিয়ে এগিয়ে চলো, কেননা
শেষ  কথা মানুষই বলে ||

.            ******************     
.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
কবি দীপক দে-র কবিতা
*
হলদি নদী
কবি দীপক দে

আমার সামনে হলদি নদী
ভোরের ঠান্ডা মিষ্টি বাতাসের
হাল্কা চাদর জড়িয়ে নিজের মত বয়ে চলেছে
চরাচরে এই মুহূর্তে এক অনাবিল প্রশান্তি |

কাল মধুমাস গত এখন
শিমুল – পলাশের আগুনের হল্কা নেই আর
তবে আগুন-ঝরা বান নিয়ে কৃষ্ণচূড়া হাজির
শিমুল–পলাশের লালের বদলে কৃষ্ণচূড়ার লাল
যেন    লাল অগ্নিশিখা মাথায় নিয়ে
গাছগুলো দাঁড়িয়ে আগুনের আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে
তার ওপর পূর্বকোণে অপূর্ব লাল অগ্নিবলয়
তার ছিটে লেগেছে হলদির জলে
যেন কোন বিজয়-বার্তা নিয়ে এগিয়ে চলেছে
সাগর থেকে সুদূর মহাসাগরে |

.             লালের কাল শেষ হ’য়েছে কি করে বলি !
.             প্রকৃতি এখন আবার নতুন ক’রে লালে লাল
.             সেই অনন্ত লালিমা জলে স্থলে অন্তরীক্ষে অরণ্যে
.                                                  মানুষের মনে  |

ও পারে নন্দীগ্রাম ------ সন্ত্রাস,  রক্ত,  লাশ
স্বজনহারা,  গৃহহারা   মানুষের হাহাকার ও সংগ্রাম
আমরা কবে মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে শিখব !
এ সবেরই সাক্ষী এই নদি
ভাবলেশহীন বয়ে চলেছে আপন মর্জিতে
হয়তো তার অন্তর উথালপাথাল করে প্রতিক্রিয়ায়
.                   আমরা জানতে পারি না |

বিস্তীর্ণ দু’পাড়ের অগনণ মানুষের ভালবাসা,
.       সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা
.                   কতখানি তাকে ছুঁয়ে যায়
.                               নদীই জানে |

নদী-মাতৃক দেশে নদী-মানুষের সম্পর্ক বড় নিবিড়
.             নদীকে মানুষ যেমন বোঝে
.             নদীও তেমনি বোঝে মানুষকে
নদী-মানুষের বোঝাবুঝির
.              এই সম্পর্ক বুঝি চিরন্তন |


নদী    মানেই  দু’পাড়ের অজস্র ব্যস্ততা
.                নৌকো লঞ্চে যাত্রী পারাপার
ব্যপারীর মালপত্র ওঠানো নামানো
.                সবজীর বস্তা, আষ্টে পৃষ্ঠে বাঁধা বড় ঝুঁড়ি
.                          ভ্যানে তোলার হুড়োহুড়ি
বাসে,  বড়  গাড়িতে অন্য শহরের বাজারে
.                          পৌঁছানো চাই তাড়াতাড়ি
এ’সবকিছুই    আসে  ওপার থেকে |

.         একটু পরেই নদীর মাছ এসে পড়বে
.         তখন শুরু হবে আর এক ব্যস্ততা
.         রাশি রাশি ছোট বড় নানা মাছ
.                           নিলাম হবে যে
নগদ কড়িতে নিলামী মাছ কিনে
.      ব্যাপারী ব’সে পড়ে পলিথিন বিছিয়ে
কিছু সময় বেচাকেনার পর বাকি মাছ নিয়ে
.            ব্যাপারী হাঁটা দেয় শহরের বাজারে |

.         হাঁকা হাঁকি  ডাকা ডাকি
.                       বাংলাভাষাতেই  কতরকম কথা
.         সকালবেলার এই চলমান চনমনে ব্যস্ততার
.                 দু’চোখ ভরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়যোগ্য |

নদীর একটা মস্ত বড় দুঃখ আছে
মানুষ জানে সেই দুঃখের কথা
কিন্তু কোন প্রতিকার নেই
এটাই   নদী-মানুষের সম্পর্কের বড় ট্যাজেডি !
.         নদীর বুকে পলি জমে জমে
.         নদীর  নাভিশ্বাস উঠেছে
.         দম নিতে বড় কষ্ট
ড্রেজিং  না  কি হয় নামমাত্র
.         ‘লোকদেখানো’  ‘লোকঠকানো’
কার যেন অদৃশ্য ইশারায় ড্রেজার চলে যায়
.          অন্য কোন বন্দরে
আজকাল ভেড়ে না এখানে কোন বড় জাহাজ
.          ঠিকানা সবার এখন পারাদীপ
হলদি বন্দর ধীরে ধীরে তাই
.          শেষের দিন গুনছে ----
নদীর বুকচাঁপা ‘দীর্ঘশ্বাস’ বাড়ে
.           হলদি বন্দরের কাল বুঝি হলো শে’ষ |


নদীর বড় কষ্ট !   বলে ----
.            আমাকে নিয়ে কারা যেন
.                    বড় একটা চক্রান্তের জাল বুনছে
যাদের হাতে আমার জীবন
তারাই এখন মৃত্যুর পরোয়ানা দেখাচ্ছে আমাকে |
আমার বুকে ‘সুনামি’ নামে না কেন ?
একটা প্রবল ভয়ংকর ঝড় উঠুক
প্রলয়ংকর জলোচ্ছাসে চক্রান্তকারীর জাল
ছিন্ন ভিন্ন ক’রে কুচক্রী দুশমনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাই –
প্রকৃতির প্রতিশোধ সমাসন্ন দেখি
বড় নিষ্ঠুর বড় নির্দয় সে প্রতিশোধ
রেয়াত করে না কাউকে |

অথচ দেখো, নদীর পাড় সাজানো হচ্ছে
সন্ধ্যায় ত্রিফলার আলো মনে করিয়ে দেয়
.                            কেলেঙ্কারির কথা |

নদীর কথা কেউ ভাবে না
বুক ভ’রে নিঃশ্বাস নিতে পারি না
আমিই যদি না থাকি
.              কী হবে আলো দিয়ে ?
আমার বিশ্বাস অনেক মানুষই আজ
আগের মত বুক ভ’রে নিশ্বাস নিতে পারছেনা |

মানুষ কবে বুঝবে---
নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে !
মানুষ বাঁচলে নদী বাঁচবে কি না
এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে ||

.        ******************     
.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
খরবায়ু
কবি দীপক দে

এখন বায়ু বইছে খর
নৌকা তোমার জলদি তর
গগন  ছায়  কালো  মেঘে
আসছে তুফান ভীষণ বেগে
নদীর জলে লেগেছে টান
ওই দেখা যায় দারুণ বান
শক্ত হাতে হালটি ধর
নৌকা তোমার জলদি তর |

.       বজ্রকঠিন শপফে তাই
.       এগিয়ে যাবার এই লড়াই
.       পথের বাধা পথে ঠেলে
.       অযুত সাহস বুকে ভর
.       মরণ-বাঁচন তুচ্ছ ক’রে
.       শক্ত হাতে হালটি ধর
.       নৌকা তোমার জলদি তর ||

.           ******************     
.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
নিবারণ পণ্ডিত
কবি দীপক দে

তোমাকে আমাদের আজ বড় প্রয়োজন
পন্ডিত নিবারণ |
নতুন করে তোমার প্রিয় কিসান ভাই
উত্খাত নিজের জমি থেকে
তার রক্তে রোয়া ফসল
ছিনিয়ে নিচ্ছে গায়ের জোরে নয়া বর্গীর দল
তার এত বছরের অর্জিত অধিকার থেকে
বঞ্চিত করা হচ্ছে তাকে----
তুমি একবার ফিরে এসো
তোমার প্রতিবাদী সরল গ্রাম্যভাষার
কবিতা ছড়া নিয়ে
হে গণকবি পন্ডিত নিবারণ
তোমাকে আজ বড় প্রয়োজন |

.         সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের কাছে
.         তুমি প্রজ্জ্বলিত ধ্রুবতারা
.         শ্রমজীবী মানুষ তোমায় দেখে ঠিক করে তার নিশানা
.         নিশ্চিন্ত করে তার গন্তব্যের নির্ভুল ঠিকানা |

বিদ্রোহ বিপ্লব সংগ্রাম লড়াই আন্দোলন
শিখিয়েছ তুমি নিজের জীবন দিয়ে
নিজে পুড়ে খাক হয়ে সারাজীবন
সংগ্রামী চেতনার আলোক জ্বালিয়েছ
নিপীড়িত শোষিত বঞ্চিত সর্বহারা দেশবাসীর অন্তরে |

সরল গ্রাম্যভাষায় লেখা
তোমার কবিতা গান ছড়া দিয়ে জাগিয়েছ মানুষকে
তাদের মুখে দিয়েছ প্রতিবাদের নতুন ভাষা
শিখিয়েছ লড়াই করে আপন অধিকার
ছিনিয়ে নেবার মন্ত্র----
.              অধিকার কেউ কাউকে দেয়না
.              অধিকার কেড়ে নিতে হয় |

দেশকে বেচে দিতে তৈরী সরকার বাহাদুর
দেশের সমস্ত সম্পদ নিয়ে তাই সে আজ
নতজানু মার্কিন প্রভুর |

আর তোমার সাধের বাংলা !
গণতন্ত্রহীন নির্লজ্জ দলতন্ত্রের শিকার
ফ্যাসিবদী সন্ত্রাসের হিংস্র বর্বর আক্রমণে
আজ  জর্জরিত,  রক্তাক্ত,  লুন্ঠিত
সব অর্থেই তোমার প্রিয় বাংলা আজ জ্বলছে |

এখানে তেইশের তাজা রক্তে ভিজছে মাটি
এ’তো রক্ত নয়  এ যে বিপ্লব খাঁটি
সেই খাঁটি বিপ্লবের ধ্বজা উড়াও হে নিবারণ ---
.            সময় হয়েছে নিকট
.            আজ ছিঁড়তে হবে বাঁধন
.            তাই আর একবার এসো ফিরে
.            এই শোষিত দগ্ধ সবহারাদের ভিরে
.            কন্ঠে নিয়ে দিনবদলের স্লোগান
.            আর চেতনায় বিপ্লবের অগ্নিবাণ

তোমাকে আজ সত্যিই বড় প্রয়োজন
হে পণ্ডিত নিবারণ ||

.           ******************     
.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*