কবি দীপক দে - এই রবীন্দ্রানুরাগী কবি জন্মগ্রহণ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বার্মার ( ব্রহ্মদেশ, বর্তমান মায়ানমার ) রাজধানী রেঙ্গুন ( বর্তমান ইয়াঙ্গন ) শহরে। পিতা বিনোদবিহারী দে ও মাতা ননীবালা দেবী। কবি দশ ভাই বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।
পিতা সেই সময় কাজ করতেন রেঙ্গুনের এ.জি. অফিসে। তিনি ছিলেন এক অতীব উদ্যোগী মানুষ যিনি “ইকমিক কুকার” নামের এক রকমের কুকার তৈরী করে, তা যথাযতভাবে পেটেণ্ট করিয়ে, তা তৈরীর ব্যবসারও তদারকি করতেন। মাতা ননীবালাই সেই ব্যবসার কর্ণধার ছিলেন। এই কুকারটি সেই সময়ে, রেঙ্গুন সরকারের একটি প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পায়। ব্রিটিশ সরকারের কোনো এক জুবিলি অনুষ্ঠানেই পুরস্কারটি প্রদান করা হয়। সেই কুকারের প্রস্তুতকারক এন.বি.দে এ্যাণ্ড কোম্পানির কর্ণধার, শ্রীমতী ননীবালা দে, গিয়ে ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো-এর কাছ থেকে সেই পুরস্কারটি গ্রহণ করে এসেছিলেন। কোলে ছিল তাঁর ফুটফুটে শিশুকন্যা। অনুষ্ঠানে, ব্রিঠিশ কর্মকর্তারা সেই মেয়ের আদর করে নাম রাখলেন জুবিলি। সেই মেয়ের নামেই সেই ইকমিক কুকারের নাম রাখা হলো জুবিলি কুকার। সেই জুবিলি কুকারের বিভিন্ন অংশের উপর এমবস করা ছিল "Jubilee Cooker" ও "Patent No. 21392"। পুরস্কারের প্লাক্ টির উপরে লেখা ছিল Awarded to Mrs N.B.De of Kamayut for her Jubilee Cooker (Patented). Burma Arts Crafts & Industrial Exhibition 1937। এতেই বোঝা যায় যে সেই বাড়ীর আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা তখন কেমন ছিল।
রেঙ্গুনে, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এ.জি. অফিসে, কবির পিতার সহকর্মী ছিলেন।
সেই সময়টা ছিল বাঙ্গালীদের রেঙ্গুন ছেড়ে বাংলায় ফিরে আসার সময়। জাপানীদের আসন্ন আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যই হোক বা সেখানকার বাঙালী-বিদ্বেষ মনোভাবের জন্যই হোক, তাঁরা দলে দলে পদব্রজে বা জাহাজের জলপথে ফিরতে শুরু করেন। কথাশিল্পী শরত্চন্দ্রর লেখাতেও এই সময়কালের বর্ণনা পাই আমরা।
ব্রিটিশ সরকার, জাপানী সেনার সঙ্গে নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের আগমনের খবরটি, অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে গোপন রাখতে পেরেছিলেন আম জনতার কাছ থেকে। তাই মানুষ জাপানীদের আগমনে ভয় পেয়েছিলেন। বেশিরভাগ মানুষই জানতে পারেন নি যে তাঁদেরই নেতাজী, জাপানীদের সঙ্গে রয়েছেন। কলকাতাতেও একই ভাবে মানুষ জাপানীদের আক্রমনের ভয় পেয়েছিলেন। এই লেখকের শশুরমশাই শ্রী লালমোহন সেন ছিলেন রয়াল এয়ারফোর্সের একজন রেডিও অফিসার (স্কোয়াড্রন লিডার)। তিনি সেই সময় কোহিমার কাছে পোস্টেড ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল তথাকথিত “জাপানী” সৈন্যদের উপরে গিয়ে বোমাবর্ষণ করে আসা। কোনো কোনো দিন তাঁকেও যেতে হোতো বম্বারের “টেল গানার” হিসেবে। টেল গানার এর কাজ ছিল, বিমানের তলায়, পিছন দিকে তাক করা একটি মেশিন-গান চালনা করা। নিচে নেমে বোমা ফেলে, উপরে উঠে যাওয়ার সময়ে যাতে কেউ বিমানের দিকে তাক করে গোলাগুলি না ছুড়তে পারে, তার জন্য বোমা ফেলার পরেই টেলগানার নির্বিচারে মেশিন-গান চালাতে শুরু করতেন। যাই হোক, সেরকম সব সর্টিতে যখন যেতেন সেই টেলগান চালাবার সময় তিনি নীচে, ক্ষণিকের জন্য, জঙ্গলের ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রু-সেনার মাথা দেখতে পেতেন। তিনি স্মৃতিচারণ করে আমাকে বলেছিলেন যে সে সময় তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে জাপানী সৈন্যরা কি পাগড়ি পড়ে ?! পরে, লাল কেল্লায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার চলার সময়, তাঁর কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়েছিল যে আসলে নীচে তিনি যাদের জাপানী বলে ভাবতেন, তাঁরা আজাদহিন্দ ফৌজের সৈন্যই ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিলেন পাঞ্জাবী-শিখ সম্প্রদায়ের, যাঁরা পাগড়ি পড়েই যুদ্ধ করেন। তিনি এই শিখদের পাগড়িই দেখেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের সময়ে তিনি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে জাপানীদের সঙ্গে ছিলেন নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ। এই ব্যাপারটা অনুধাবন করার পর থেকে আমৃত্যু তিনি অনুশোচনায় ভুগেছিলেন।
১৯৪২ সালে বিনোদবিহারীও সপরিবারে বাংলায় ফিরে আসা সমিচীন মনে করেন। সেইমত , পরিবারের বাকিদের জাহাজে পাঠিয়ে দিয়ে, তিনি নিজে যাত্রা করেন পায়ে হেঁটে। তাঁরা কলকাতার বাগবাজারের প্রতাপ মেমোরিয়াল হলে পৌঁছে শরণার্থী হিসেবে নথিভুক্ত হয়ে, প্রথমে গিয়ে ওঠেন পাবনাতে, কবির মামাবাড়ীতে। তারপর তাঁরা চলে আসেন নৈহাটিতে, রিফিউজিদের জবরদখল করা একটি কলোনির একটি ঘরে পান মাথা গোঁজার মত ঠাঁই। যাঁর প্রতিটি সন্তানের নামে নামে একখানা করে গরু বাঁধা থাকতো, তিনি এখন কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায়!
পরে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন যে আজাদ হিন্দ ফৌজ যখন রেঙ্গুনে পৌঁছায়, তখন তাঁরা ক্যাম্প করেছিলেন কবিদের ছেড়ে আসা বাড়ীর কাছেই এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লক্ষ্মী সায়গল সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়ে তাঁদেরই বাড়ীর একটি ঘরে যাবতীয় মিটিং করতেন। তাঁদের পরিত্বক্ত বাড়ীটি হয়ে উঠেছিল রেঙ্গুনে, আজাদ হিন্দ ফৌজের অস্থায়ী অফিস!
কবির বড়দা বারীন দে ছিলেন বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। রেঙ্গুনে কমিউনিস্ট পার্টি করার অপরাধে ১৯৪৩ সালে তাঁকে বর্মার ইনসিন (Insein) জেলে কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু তিনি ও তাঁর সতীর্থরা এক রোমহর্ষক অভিযানের মধ্যে দিয়ে সেই জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হন, বিদ্রোহী কেরেন উপজাতিরদের সাহায্যে। তাঁর নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল বর্মা সরকারের পক্ষ থেকে। পায় হেঁটে ভারতে এসে তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির (CPI) সদস্যতা গ্রহণ করেন এবং তাঁকে পাঠানো হয় জামশেদপুরে টিন- প্লেট শ্রমিকদের সংঘটিত করার জন্য। তিনি সেই ইউনিয়ানের সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি আবার বর্মা ফিরে গিয়েছিলেন যুদ্ধ-পরবর্তী বর্মায় পার্টির কাজের জন্য এবং ১৯৫০ সালে আবার ফিরে আসেন ভারতে। কিন্তু ফিরে এসেই তাঁকে আন্ডার গ্রাউণ্ডে চলে যেতে হয়ে, কারন তখন ভারতেও তাঁর নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল। ১৯৫১তে পার্টির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর তিনি আবার পার্টির তরফে ট্রেড ইউনিয়ানের কাজ শুরু করে দেন। তিনি একাধিক ট্রেড ইউনিয়ান সংগঠিত করেন যাঁর মধ্যে ছিল জামশেদপুর মজদুর ইউনিয়ন ও ঝিঙ্কপানি মজদুর ইউনিয়ন। জামশেদপুরে তিনি বহু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন পরিচালনা করেন যাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৫৮ এর টিসকো (TISCO) স্ট্রাইক, ১৯৬৯ সালের ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কার্স স্ট্রাইক, ১৯৭১ এর কনট্র্যাক্ট লেবার স্ট্রাইক প্রভৃতি। টিসকো (TISCO) স্ট্রাইক চলাকালীন তাঁকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৪ পর্যন্ত সেই মামলা চলে এবং প্রমাণের অভাবে তাঁকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়। তিনি জামশেদপুর মজদুর ইউনিয়ানের সম্পাদকও হয়েছিলেন। নৈহাটির বাড়ীতেও তাঁর খোঁজে বহুবার পুলিসের তল্লালী চালানো হয়। কবির এই দাদা মাত্র ৪৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৫ নভেম্বর ১৯৭২, তারিখে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন জামশেদপুর মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিক সংঘটন AITUC-র জেনারেল কাউনসিলের সদস্য, বিহার CPI এর রাজ্য কাউনসিলের সদস্য এবং পার্টির সিংভূম জেলা কাউনসিলের সদস্য।
কবি দীপক দের পড়াশুনা শুরু হয় নৈহাটিতে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত নৈহাটি মহেন্দ্র হাই স্কুলে। সেখান থেকে তিনি ১৯৫৭ সালে স্কুল ফাইনাল পাশ করেন। এরপর হুগলী মহসীন কলেজ থেকে পাশ করেন আই. এসসি. (ইনটারমিডিয়েট অফ সায়েন্স)। তারপর হুগলী ইন্সটিটিউট অফ টেকনলজি থেকে ১৯৬৩ সালে পাশ করেন এল.সি.ই. ( লাইসেনসিয়েট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার )।
এর পর ১৯৬৪ সালে কবি যোগ দেন কেন্দ্রিয় সরকারী সংস্থা কেন্দ্রিয় লোক নির্মাণ বিভাগে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে। প্রথম পোস্টিং এর সময় বেছে নেন সবচেয়ে দূর ও দুর্গম কর্মস্থল পোর্ট ব্লেয়ার! এরপর কলকাতা, ভূবনেশ্বর, নেপালের বুটওয়াল, পুনরায় পোর্ট ব্লেয়ার, কলকাতা, পাটনা হয়ে শেষপর্যন্ত কলকাতা থেকেই অবসর গ্রহণ করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার বা সহকারী বাস্তুকারের পদে। ১৯৭১ সালে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন ইলা দেবীর সঙ্গে। তাঁদের এক কন্যা ঊর্মি যাঁর বিবাহ হয় সান্তনু সাহার সঙ্গে। তাঁদের এক কন্যা ও এক পুত্র।
নিন্দুকেরা লোক নির্মাণ বিভাগে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ারদের আয়-ব্যায় সম্বন্ধে বহু কুকথা বলে থাকেন। কিন্তু কবি দীপক দের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে যাঁদের জানার সুযোগ হয়েছে তাঁরা বলেন যে এই মানুষটি, তাঁর কর্মক্ষেত্রে নাকি এতই সৎ ছিলেন যে, তাঁর ঘরে তেমন কোনো আসবাবপত্রই ছিলনা। বদলির চাকরির জন্য কয়েকটি প্যাকিং বাক্সকে চাদর দিয়ে ঢেকে তৈরী হতো তাঁর ঘরের বসার চেয়ার টেবিল!
একজন তুখোড় ব্যাডমিনটন ও টেবিল-টেনিস খেলোয়াড় ছাড়াও তিনি কৃতি কণ্ঠশিল্পী। ছোটবেলায় সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় মেজদি বেলা বাগচী ( দে ) এর কাছে। পরে রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখেন সুচিত্রা মিত্রের কাছে, রবিতীর্থে। পোর্টব্লেয়ারে থাকাকালীন, সেখানে তাঁর গান ছাড়া কোনো গানের অনুষ্ঠানই ভাবা যেতো না। পোর্টব্লেয়ারের দুর্গাপূজায়, চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যে তাঁর দৃপ্তকণ্ঠে গাওয়া অর্জুনের গানগুলি উচ্ছ্বসিত প্রসংসা অর্জন করেছিল। তাঁদের মতন মানুষের জন্যই বাংলা থেকে বহু বহু দূরে জন্মানো নবীন বাঙালী প্রজন্ম, বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে।
কবির বামপন্থী ভাবধারা তাঁর কবিতা এবং লেখায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। তিনি গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সদস্যও। দীর্ঘকাল ধরে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর সুগবেষিত প্রবন্ধ, কবিতা প্রভৃতি লেখালেখির মধ্যে নিজেকে নিবিষ্ট করে রেখেছেন। তার কিছু কিছু প্রকাশিত হয়েছে গণশক্তি সহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়। বিভিন্ন সাহিত্য সভায় পাঠ করেছেন নিজের রচনা। আমাদের ওয়েবসাইটে গীতিকার, সঙ্গীতকার ও কবি সলিল চৌধুরীর জীবনীটি তিনিই আমাদের লিখে পাঠিয়েছিলেন। এখানে দেওয়া তাঁর কবিতার মধ্যে রয়েছে লোক-কবি নিবারণ পণ্ডিতের উপর লেখা একটি কবিতাও।