হিঁদুসমাজ এবং সামাজিকগণ কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র "বিধবা বঙ্গাঙ্গনা" কাব্যগ্রন্থ থেকে ১ পতন-উন্মুখ রম্য রাজনিকেতন, জনশূন্য, শোভাশূন্য, জাঙ্গললতায় পূর্ণ, হেরিলে যেমন হয় পরিতপ্ত-মন, সেরূপ হিঁদুসমাজ, নিরখিলে মনোমাঝ, মহাক্ষোভ জন্মে, বুকে বাজে যেন বাজ! কি ছিল কি হল,---হায়! হিঁদুর সমাজ! ২ হায়! --- যে সমাজমাঝে করিত বিরাজ, ন্যায়, ধর্ম্ম, সদাচার, অকৃত্রিম-ব্যবহার, একতা, শীলতা, আর কুলমান, লাজ, নির্ম্মল-দাম্পত্যপ্রেম, যার বিনিময়ে, হেম, হীরা, মণি, বসুধার আধিপত্য আর, বাঞ্ছনীয় নহে, এসকল অতি ছার। ৩ হায়! ---এই সমাজের কুলকন্যাগণ, স্বয়ম্বরা প্রথামতে, নিজ নিজ অভিমতে করিত না নায়কেতে আত্ম সমর্পণ ? একুলের কন্যারা, না, করিয়া কৌশল নানা, আগে পরিক্ষিয়া নায়কের প্রেয়, মন, পরেতে করিত তাঁরে পতিত্বে বরণ ? ৪ একালের কন্যারা, না, স্বাধীনার মত, হয়ে স্বামী-সহচরী, নানারূপ যানে চড়ি, নগর, নগরী, দেশ ভ্রমিয়াছে কত ? একুলের কন্যারা, না, সুবিখ্যাত পতিপ্রাণা, ইহাদের সতীত্বের সৌরভ বর্ণন, কতরূপে কাব্যে না করেছে কবিগণ! ৫ একুলের কন্যারা, না, করে বিদ্যাভাস, কত কত কবিসনে, নানাশাস্ত্র আলাপনে, অসামান্য বুদ্ধিমত্তা করেছে প্রকাশ ? প্রবীণ পণ্ডিত মত, রচিয়াছে গ্রন্থ কত, আজিও সে গ্রন্থচয় থাকি বর্ত্তমান, কত শতজনে করিতেছে জ্ঞানদান! ৬ হায়রে! ---কোথায় গেল সেসকল দিন! কোথায় সে হিঁদুচয়, একদা ভারতময়, যাঁহাদের কীর্ত্তিকেতু আছিল উড্ডিন ? কোথা সে কুমারীচয়, ইতিহাস পরিচয় দেয়, যাহাদের গুণগ্রামের এখন ? ভারতের ছিল যাঁরা অমূল্য ভূষণ! ৭ কিছু নাই, কিছু নাই, কিছু নাই তার!! স্বাধীনতা সহ, --- হায়! হারায়েছে সমুদায়, হিঁদুগণ, শৌর্য্য, বীর্য্য, সাধু ব্যবহার, দুর্ব্বল শরীর, মন, এবে যত হিঁদুগণ, অবরুদ্ধ দাসত্ব-শৃঙ্খলে অনুক্ষণ, নাহি পায় স্বাধীনতা-সুধা-আস্বাদন! ৮ প্রাচীন কালের যদি হিঁদু একজন, হইয়া পুনর্জ্জীবিত, হন আসি উপস্থিত, এবে হিঁদু সমাজে, করিয়া নিরীক্ষণ, এর শোচনীয় দশ, জানিতে কভু সহসা নারিবেন, এই কিনা সে হিঁদু সমাজ, এমনি বিকৃত ইহা হইয়াছে আজ! ৯ এখন কেবল হিঁদু সমাজের মাঝ, দ্বেষ, হিংসা, অহংকার, দলাদলী, ব্যভিচার, কদাচার, অত্যাচার করিছে বিরাজ। পরস্পর রিষারিষি, করে সবে দিবানিশি, খনিছে আপনাদের সুখ-তরুমূল। হায়রে! কি পরিতাপ! স্থলেতেই ভূল! ১০ কতনা কুপ্রথা-নিশাচরী আজকাল, প্রসারি প্রবল গ্রাস, হিঁদুদের সর্ব্বনাশ করিতেছে, বিস্তারিয়া, কুসংস্কার জাল! ইন্দ্রজাল যে প্রকার, রোধ করে জ্ঞানদ্বার, কুপ্রথাকুহকে ভুলে, হিঁদুরা তেমন, দেখিতে না পায় কিছু থাকিতে নয়ন! ১১ পূর্ব্ব পুরুষের মত হিঁদুদের আর, নাই বল, বীর্য্য, শান্তি, দয়া ধর্ম্ম একক্রান্তী, কি ভ্রান্তি! --- তথাপি করে, ফাঁপা অহঙ্কার! আপনিই আপনায়, বড় ভাবে একি দায়, বিষ নাই, দন্ত নাই, সুধু আছে “ফস্”। গুণ না থাকিলে হয় আপনি কি যশ ? ১২ হায়! হিঁদু সমাজের কি দশা ঘটিল! বলিতে হৃদয়ে বাজে, সুধাসাগরের মাঝে, তীব্রহলাহলস্রোত আসিয়া মিশিল! কোথা সদ্ ব্যবহার ? হায়! পরিবর্ত্তে তার, হল সার, কৃত্রিম ধর্ম্মের অনুষ্ঠান! প্রকৃত হিঁদুর ধর্ম্ম করিল প্রস্থান! ১৩ অহে অহে হিঁদুদলপতিসমুদয়! সমাজের আর্ত্তবর, নাহি করি অনুভব, বধির হইয়া থাকা আর বিধি নয়! শোন সমাজের দুঃখ, হইওনা পরাঙ্মুখ, রুধ না হে দুইকরে শ্রবণযুগল, শ্রোতা না শুনিলে বক্তায় কি বা ফল ? ১৪ সবদিগে তোমরাই হয়েছ প্রধান, যা ইচ্ছা করিতে পার ; অন্যথা করিতে কার, শক্তি নাই, তোমাদের শাসন, বিধান ; প্রাধান্য পাইয়া হেন, নিশ্চেষ্ট রয়েছ কেন ? নাহি কর সমাজের দোষ সংশোধন ? নাহি কর স্বজাতির উন্নতি সাধন ? ১৫ দূরে থাক্ সমাজের দোষ সংশোধন, সমাজ আরো যাহায়, “চুলোর দুয়ারে” যায়, যাতে হয় স্বজাতির অধোতে পতন, সেই চেষ্টা করিতেছ, দ্বেষ জ্বরে জ্বরিতেছ, দলাদলি ঢলাঢলি লয়ে অনিবার। হানিতেছ মূলধর্ম্ম-মূলেতে কুঠার। ১৬ দলপতি হয়ে আপনারা ছলে বলে, কারে “একঘরে” কর, কাহার মর্য্যাদা হর, কার দণ্ড করি অর্থ লও বেঁটে ছলে। অন্য কাজে করি ক্রোধ, সামাজিকে লও শোধ, কার প্রতি এইরূপ অন্যায় বিচার। আপনার বেলা ধর অন্ধ-ব্যবহার! ১৭ করিতে দেশের ভাল, সমাজের হিত, অবহিত হতেছ না, ন্যায় যুক্তি লতেছ না, কুসংস্কারে আছ হয়ে নিয়ত মোহিত, ধরি দেশাচার ব্যাজ, --- ধরি উপধর্ম্ম ল্যাজ, সমাজশোধন পথে দিতেছ কণ্ঠক, সমাজের পতি হয়ে সমাজঘাতক ? ১৮ যদি কোন কুপ্রথার করিতে উচ্ছেদ, সচেষ্টিত হয়ে কেহ, তারে নানা ক্লেশ দেহ, সে সময় আন কত শাস্ত্র মাস্ত্র বেদ ; কিন্তু, নিজে নানা কাজে, ধর্ম্মশাস্ত্র বক্ষ মাঝে, হানিতেছ, অধর্ম্মের নিদারুণ বাজ। তিলেক তথাপি মনে নাহি বাস লাজ! ১৯ কোন্ শাস্ত্রে আছে বল লিখিত এমন ? লয়ে আশামত ধন, করিবেক সমর্পণ, কাণ খঞ্জ, কুব্জবরে তনয়ারতন। যেমন নিষাদগণে, পরিতুষ্ট হয়ে পণে, পোষিতপশুকে বেচে যার তার ঠাঁই, ভালমন্দ কিছু আর বিবেচনা নাই! ২০ কোন্ শাস্ত্রে লেখে, এক বালিকার সনে, তেকেলে বরের বিয়া, দিবে সুধু কুলনিয়া ধুয়ে কি খাইবে ?--- যদি সে বালা যৌবনে, বৈধব্য দশায় পড়ে, তবে কি হইবে পরে, একবার তাহার না করহ বিচার, তোমাদের কৌলীন্যের পদে নমস্কার! ২১ কোন্ শাস্ত্রে আছে বল বিধি এপ্রকার ? পণে পণে অবলারে, একবর একবারে, করিবেক বিবাহ, তাদিকে পুন আর, কটাক্ষেতে হেরিবে না, তত্ত্বটাও করিবে না, সতীত্বরক্ষণ, হয় তাদের কেমনে ? বারেক বিচারি তাহা নাহি দেখ মনে! ২২ কোন্ ধর্ম্মশাস্ত্রে হেন বিধি পাওয়া যায় ? গর্ব্ভ হলে বিধবার, অবাধে করিবে তার ভ্রূণহত্যা সংগোপনে,--- কি কুকাণ্ড হায়! তাতে পাপ হইবে না, কুলধর্ম্ম যাইবে না, অথচ শাস্ত্র-সম্মত, ন্যায়ানুমোদিত, বিধবাবিবাহপ্রথা হইল দূষিত! ২৩ গোপনে করিলে নানা পাপ অনুষ্ঠান, তাহাতে না হয় দোষ, নাহি জন্মে অসন্তোষ তোমাদের, ধর্ম্মশাস্ত্রে এই কি বিধান ? প্রকাশ করিলে পর, সেই কাজ পাপাকর হয়, কুলধর্ম্ম ডুবে কলঙ্কসাগরে, হায় হায়! কি আশ্চর্য্য আছে এর পরে!!! ২৪ যা হবার হইয়াছে, কেন মিছে আর, সত্কর্ম্মে পাষণ্ড প্রায়, প্রতিকূল হয়ে,--- হায়! আপনারা হইতেছ ঘৃণিত সবার ? চল চল ন্যায়পথে, চল ধর্ম্মশাস্ত্রমতে, দেশাচার অনুরোধ ছাড়হ অচির, স্বজাতির স্ব সমাজের, উচু কর শির। . ****************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
কবি হরিশচন্দ্র মিত্রর কবিতা |
কুন্তীর প্রতি কর্ণ “বীরবাক্যাবলী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র পাণডবদিগের অজ্ঞাত বনবাস নিঃশেষিত হইলে যুধিষ্ঠির পৈতৃক রাজ্য দুর্য্যোধনের নিকট প্রার্থনা করিলেন, তিনি বিনাযুদ্ধে সূচাগ্রভূমিও প্রদান করিতে সম্মত হইলেন না। পরিশেষে কুরুপাণ্ডবের সংগ্রামই স্থির হইল। এতত্সংবাদ শ্রবণে পুত্রবত্সলা কুন্তী আপনার কানীনপুত্র কৌরবসেনানায়ক কর্ণের নিকট একান্তে উপনীতা হইয়া মধুরবচনে কহিলেন “বত্স কর্ণ! তুমি আমার কানীনপুত্র, আমি তোমার গর্ভধারিণী মাতা, আমার অনুরোধ তোমার অবশ্য প্রতিপালা সন্দেহ নাই। অতএব আমি তোমাকে অনুরোধ করি, তুমি এক্ষণে কৌরবপক্ষ পরিত্যাগ করিয়া পাণ্ডবদের পক্ষ অবলম্বন কর। বত্স! দুর্ম্মতিদুর্য্যোধন তোমার বাহুবলেই দর্পিত হইয়া পাণ্ডবদের সহিত সংগ্রাম করিতে সাহসী হইয়াছে। তুমি এক্ষণে পাণ্ডবপক্ষ আশ্রয় করিলে সে ভগ্ন সাহস হইবে। বিশেষতঃ তোমার দুর্য্যোধনের অনুবৃত্তি করিবার প্রয়োজন কি ? তুমি কৌরবপক্ষ পরিত্যাগ করিয়া আপনার ভাতৃগণের সহিত সদ্ভাব কর, কৌরবহৃত পৈত্রিকরাজ্য উদ্ধার করিয়া স্বয়ং তাহার অধীশ্বর হও, পঞ্চপাণ্ডব তোমার অনুগত হইয়া থাকিবে, ইহা অপেক্ষা তোমার আর কি প্রার্থয়িতব্য হইতে পারে ?” কুন্তভোজদুহিতা এইরূপ কহিয়া নীরব হইলে শ্বর-চূড়ামণি কর্ণ পশ্চাল্লিখিত বাক্যে আপনার আপনার অভিপ্রায় প্রকাশ করিতে লাগিলেন। *********** একি কথা কহ অম্ব! যদিও আমার, প্রসূতী বটহ, তবু করেছ বর্জ্জন, বর্জিত বস্তুতে আর, থাকে কিবা অধিকার ? কেমনে তদীয় আজ্ঞা করিব পালন ? অসঙ্গত কার্য্য কর্ণ করে কি প্রকার ? ১ কে না জানে কর্ণবীর কৌরব-সাহস ; কে না জানে কৌরবের সৈন্য সমুদয়, কর্ণের রক্ষিত, তবে, বল সে কেমনে হবে, পাণ্ডবের পক্ষ, এবে, এমন কি হয় ? নাই কর্ণহৃদয়ে কি কৃতজ্ঞতা-রস ? ২ কুরুকাজ দুর্য্যোধন-রাজ্যেতে রাজত্ব, করে কর্ণ ; করি কুরুরাজ অন্নাসন, কর্ণের শরীরে বল ; কুরুরাজ বাপীজল, কর্ণের পিপাসানল করে নিবারণ, কর্ণে কুরুরাজে মাত্র দেহে বিভিন্নত্ব। ৩ অয়ি অম্ব! আপনার আত্মা অনুরূপ, যতনিয়া কর্ণে আসিতেছে এতদিন যে, আজি বিপক্ষেতে তার, দাঁড়াইব কি প্রকার ? এরূপে কি পরিশোধ উপকার ঋণ করে ? কৃতজ্ঞতা হতে পারে কি এরূপ ? ৪ না হয় শুনিয়া মাতঃ, তদীয় বচন, দুর্য্যোধন বিপক্ষে হলেম সমুত্থিত ; কিন্তু কুরুরাজে বাণে, ব্যথিব মা কোন্ প্রাণে, সন্ধানিয়া শর কহ ? অমনি স্খলিত, হবে শর, ধনুতে না করিতে যোজন। ৫ কৃতজ্ঞসজ্জনশূর-ব্যবহার এই, তিলমাত্র উপকার করে যেই জন, প্রণপণ করি তারে, তোষয়ে প্রত্যুপকারে, যতদিন দেহ মাঝে বিরাজে জীবন, কর্ণে কি এ নীতিবাক্য সুবিদিত নেই ? ৬ ধণুতূণ ভার সেই করিছে বহন ; রণক্ষেত্রে শূর বলি দেয় পরিচয় ; কৃতজ্ঞতা-রত্নহার, কি প্রকারে পরিহার, করে সেই, সেত কিছু কাপুরুষ নয়। উপকারে অপকার অকৃতজ্ঞজন। ৭ পশুজাতি কুক্কুর, কত বা জ্ঞান তার! তবু সে কৃতজ্ঞ কত দেখহ জননী! স্বীয় প্রভু উপকারে, প্রাণব্যয় অঙ্গীকারে, হায় কৃতজ্ঞতা গুণ অমূল্য এমনি! কৃতঘ্নে বুঝেনা বহুমূল্যতা ইহার! ৮ যদিবা রণিয়া রাজ্য অর্জ্জিতে আমার, আছে শক্তি তবু, কুরুরাজ অধীনতা, স্বীকার করেছি আমি, কুরুপতি মম স্বামী তাঁর আজ্ঞা কেমনেতে করিব অন্যথা ? অধীনের সাধ্য প্রভু আজ্ঞা লঙ্ঘিবারে ? ৯ সময়েতে উপকার করিবে সাধন, পালে প্রভু অধীনে করিয়া এই আশা, কৃতঘ্ন পামর সেই, ভর্ত্তৃ-পিণ্ডহারী নেই, তার তুল্য ; সেকালে যে করয় নিরাশা, ভর্ত্তৃকার্য্য না সাধিয়া, করি প্রাণপণ। ১০ সকলই ত্যজ্য মাতঃ, পারয় মানব, উপযুক্ত বুঝিলে, সকল ত্যজিবারে, নীতিশাস্ত্রে এই কহে, “ধর্ম্ম পরিত্যজ্য নহে, কখন, যাবত প্রাণ বঞ্চে দেহাগারে। ধর্ম্ম কি ত্যজিব আজি অনুজ্ঞায় তব ?” ১১ এবে কৌরবের পক্ষ করিলে বর্জ্জন, রৌরব সিন্ধুতে হবে মগন হইতে, আয়াসি সে ধর্ম্মধন, করিয়াছি উপার্জ্জন, পারিব না সেই ধন কভু উপেক্ষিতে প্রকাশিবে লোকে যে অধর্ম্ম আচরণ! ১২ একেত এ মহাক্ষতি --- যার তুল্য নাই, হানি আর, তারপর করে রাজগণ, এতদিন আশা দিয়া, আপনার প্রাণ নিয়া যুদ্ধভয়ে কর্ণবার লইল এখন, পাণ্ডবের পক্ষ, ইথে বড় লজ্জা পাই! ১৩ এত আর্য্যে, সাধারণ অপবাদ নহে, যে শরণেলকে ভীরু অপবাদ, দেয়, জীবনেতে তার, কিবা প্রয়োজন আর, তাহার মরণে কার উপজে বিষাদ ? কর্ণ ভীরু, হেন কথা কার সাধ্য কহে ? ১৪ “ভীরু” এই অপবাদ করিয়া গ্রহণ, সসাগরা-সদ্বীপা-ধরার ঈশ্বরত, নাহি বাঞ্ছে কর্ণবীর, সত্য জান, এই স্থির, প্রতিজ্ঞা আমার কৌরবের সপক্ষতা, করিব---করিব দেহে যাবত জীবন। ১৫ বরং শ্লাঘ্য গণি মাতা মৃত্তিকা আসন স্বহস্তে স্বশিরে, ধরি ছত্র পল্লবের, তবু বর্জ্জি ধর্ম্মধন, হৈমাসন---নৃপাসন, রাজছত্রদণ্ড নহে বাঞ্ছিত কর্ণের, ঐশ্বর্য্যেতে ভুলেমাত্র অজ্ঞজন-মন। ১৬ আমি কুরুরাজের ভরসা আশাস্থল, মম বলে গর্ব্বিত যথার্থ দুর্য্যোধন, যাবত জীবনামার, সে গর্ব্ব চূর্ণিত কার শক্তি,---হে শক্তিমান আছে কোন্ জন ? কি কাজে আমার তবে বাহুযুগ-বল ? ১৭ দৈরথসমর মাত্র ফাল্গুণী সহিত, করিতে সমর্থ আমি, আমা বিনা আর, কৌরব দলেতে নাই, আমি বিরুপেতে যাই, কুরুরাজ আশালত সমূলে সংহার, করি পাণ্ডবের পক্ষে, এই কি উচিত ? ১৮ যদি চাহ জননী কর্ণের অক্ষিদ্বয়, এখনই তূণ হতে খরশান বাণ, নিস্তুণিয়া খুলি অক্ষি, তদীয় সন্তোষ লক্ষি, প্রদানিব তাহে না করিব ক্লেশ জ্ঞান, হবেনা তাহাতে দুঃখে অধীর হৃদয়। ১৯ যদি বাঞ্ছ পাণিদ্বয়, তুলি অসী চর্ম্ম, তব অনুরোধ মাত্র করিতে পালন, বাহুদ্বয় করিছেদ, দানিব তাহে কি খেদ ? কখনই অশ্রু নাহি ক্ষেপিবে নয়ন। সত্যব্রতজনের এ কি দুরূহ কর্ম্ম ? ২০ অঙ্গ প্রত্যাঙ্গাদি এত করি ছার জ্ঞান, যদি বাঞ্ছ লহ মাতঃ হব না বিমুখ, অমূল্য জীবনধন, সুখে করি সমর্পণ, অসুখী তাহাতে না হইব একটুক, ধর্ম্মাপেক্ষা প্রাণে না আদরে শূরগণ। ২১ যদিও সমরে মম ছেদে কোন বীর, হস্ত, পদ, নাসা কর্ণ, কবন্ধ মতন, থাকি পড়ি রণক্ষেত্রে, তবু মাতঃ এই নেত্রে, বাঞ্ছিব, নিয়ত করিবারে নিরীক্ষণ, দুর্য্যোধন জয়শ্রীরে এই জ্ঞান স্থিরষ ২২ যদি নেত্র বায়সেতে করে উত্পাটন, দরশন শক্তি যায় বিলুপ্ত হইয়া, তবু ও কর্ণের মন, প্রাথনিবে প্রতিক্ষণ, বিভু পাশে, অশ্রুতে অবনী আর্দ্রাইয়া, “যেন জয়ী হন কুরুরাজ দুর্য্যোধন।” ২৩ ক্ষত্রকু চূড়ামণি রাজা দুর্য্যোধন, সখ্যতা আমার সনে,---সূতজাতি আমি! নীচ বলে অভিমান, নাই আত্মসম জ্ঞান, করেন আমারে সদা কুরুকুল স্বামী। তাঁর একি সাধারণ কৃপা বিতরণ ? ২৪ বিপদেতে সহায়তা করে যেই জন, সে মিত্রেই মিত্র কহে নীতিজ্ঞ সকলে, দুর্য্যোধন-মিত্র তাঁর, পরিশোধ মিত্রতার, এরূপে কি দিব মিশি পাণ্ডবের দলে ? হবেনা কি এপাতকে নিরয়ে গমন ? ২৫ একটি পাতক ভয়ে কম্পে সাধুজন, পাপাত্মার শত পাপে ভয় নাহি হয়। পাণ্ডবের পক্ষাশ্রয়, করিলে আমারে হয়, মজিতে অসংখ্য পাপে, অমনি স্পর্শয়, রাশি২ পাতক, এক একটী ভীষণ। ২৬ মিত্রঘ্নতা, কৃতঘ্নতা উঃ কি ভয়ানক পাতক। বিশ্বাসঘাতকতা পাপ আর। এসকল পাপার্ণবে, মজিলে কেমনে হবে, পরিণামে জননি এজনের উদ্ধার ? কে আমার অংশী হবে লইতে পাতক ? ২৭ পরলোকে পাপের যে শাস্তি ভোগ হয়, করিতে, পাপীই তাহা আপনি সম্ভোগে, অপ্রমেয় রত্নধন, প্রাণোপমবন্ধুজন, অবনীর আধিপত্য অতুলবিভোগে, ভোগে না সে ক্লেশ এসকলে সে সময়। ২৮ কর্ণ পাশে প্রার্থনা করিয়া কোন জন, ভগ্নাশ হইয়া নাহি গমন করিল, কি করিব হায় হায়! কিন্তু আজি মা, তোমায় নিরাশ হইয়া ফিরে যাইতে হইল। অশক্ত তদীয় আশা করিতে পূরণ। ২৯ প্রতিজ্ঞা ত করি নাই, করিলেও আমি, নারিতাম কৌরবে করিতে পরিহার, সে প্রতিজ্ঞা রক্ষ হতে, শ্লাঘ্যগণি মম মতে, যদি নরকেতে হয় সুচির আগার, ---যদি হই, উত্তর উত্তর অধোগামী। ৩০ তবে এই মাত্র আমি করিতেছি পণ, হয় রণে ফাল্গুণীরে করিব নিধন, কিম্বা শরানলে তার, মম দেহ, দেহসার হবে ত্যজি তারে প্রাণ করিবে গমন, রণক্ষেত্রশায়ী হব মুদিয়া নয়ন। ৩১ অর্জ্জুন ব্যতীত আর পঞ্চসহোদরে, সমরে জীবনে বধ কভু করিবনা, তাদের কোমল কায়, কেমনে সহিবে হায়, মম বাণাঘাত, সেযে কালাগ্নির কণা! অশক্তজনেরে শূর না প্রহারে শরে। ৩২ তাহে কি বীরত্ব মম ? অযশ বিস্তর। করি-শির বিদারিত করি পঞ্চানন, কোপ ক্ষুধা শান্তি করে, তবু ফেরুপরিকরে ভ্রমেও নখাগ্র দিয়া করেনা স্পর্শন, বীরসিংহ বীরে সনে যাচ্ ঞে সমর। ৩৩ আপাতকষায় বটে আমার বচন, কিন্তু এর পরিণাম সুধার সময়, পুত্র-স্নেহ পরিহরি, দেখুন বিচার করি, কোন্ কথা জননি, আমার নয় নয়। অন্যায়পথ অতিক্রমে নরাধমজন। ৩৪ জননি, করুন এবে ঈশ্বরে নির্ভর, ভবিতব্যতার দ্বার কার সাধ্য রোধে ? ধর্ম্মবল আছে যার, জয়লাভ হবে তার মনস্থির করুন এ অমূল্য প্রবোধে। নমি পায় বিদায় হউন অতঃপর। ইতি বীর-বাক্যাবলী কাব্যে কর্ণবাক্য নাম তৃতীয় সর্গ . ****************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |