কাব্যের দোষ গুণ উপলক্ষে কবির প্রতি   
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

দল বাঁধি লক্ষ কাকে,             যদিও আহ্লাদে ডাকে,
কর্ণ ব্যথা বই তার,               চিত্তসুখ হয় না |
একমাত্র পিকরব,                 যদি করে কুহু স্বর,
শ্রবণে জনমে প্রীতি,              কর্ণ-ক্লেশ রয় না,
করি কাব্য-আলোচন,             নিহৃর্দয় শয়তান,
ধন্যবাদ দিলে তাও               ভাল মনে লয় না,
রসজ্ঞ অভিজ্ঞ একে,             কাব্যখানি পড়ে দেখে,
ভাল কৈলে তাই ভালো,         শ্রম-দুঃখ রয় না |
করি তব কাব্য দেখে,           অল্পজ্ঞ সহস্রে ডেকে,
দূষিনে সে কথা কাণে ভরো     না হে ভরো না |
বিজ্ঞ অনেকের বাক্,            একে নয় ভাবো লাক্,
সেই শ্লাঘ্য-পুরস্কার,              আর আশঃ করো না |

.                    ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
কবি হরিশচন্দ্র মিত্রর কবিতা
*
খোসামুদী উপলক্ষে প্রশ্নোত্তর   
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

“অহে অহে কবি ভাই !           কোথা যাও বলো তাই ?”
“ধনীর নিকটে যাই,”               “কেন হে কি কারণে ?”
“কি আর কহিব ভাই,             সাধে কি সেখানে ধাই ,
দেখি যদি কিছু পাই,              পরিবার পালনে |”
“ধনীর কাছে পাবে ধন,            বিনা ভিক্ষা কি এমন.
সম্বল তোমার দল,                 বল শুনি শ্রবণে ?
কেন লব ভিক্ষুকতা,               জানি না কি কাব্য-কথা,
আর্দ্র কি হবে না ধনী,              কাব্যরস শ্রবণে |”
ফের ফের যেওনা কো,            কাব্যকথা তুলে রাখো,
তরসে ধনীর মন,                   গলাইতে নারিবে |
“ যে আজ্ঞের” ভার বোতে,        উচুনীচু, কোতে,
পার যদি তবে যাও,               তাকি তুমি পারিবে ?”
ছিছি ছি ছি রাম রাম !             তা নয় কবির কাম,
“উপোসে” “উপোসে”                নয়, পরিবার মারিব |
প্রাণ চিরস্থায়ী নয়,                  যায় যায় রয় রয়,
তবু কারো “খোসামুদী”             করিবারে পারিব |

.                    ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কাব্য ব্যবসায় উপলক্ষে প্রশ্নোত্তর      
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

“অহে অহে কবিবর !         কোন্ ব্যবসা কর ?”
“---কাব্য-ব্যবসায়ী আমি,      কাব্য বেচে খাই হে |”
“একালে ও ব্যবসার,          আদর কোথায় আর,
ওতে লাভ কিছুমাত্র,          নাই----নাই----নাই -----হে |”
“কিসে লাভ আশু আর,       বল দেখি শুনি সার,
পোড়াপেট পূরাবার,           উপায়ত চাই হে |”
আশু লাভ পাবে যার,         শুন সার সে উপায়,
সময় যেমন  -----হও,         মদ্য-ব্যবসায়ী হে |
কাব্যের গ্রাহক কত !         পাইবে সে অবিরত,
“লেনে আলা” শত শত,        বড় বড় জন্ কে,
মদ্য-পানে হয়ে মস্ত,            হেন তারা মুক্ত হস্ত,
ফুয়ে ফুকে দিতে                পারে কুবেরের ধনকে |
আসিতে কাব্যের দাম,         “ছিঁড়িবে জুতার চাম”
পড়িবে মাথার ঘাম             পার তব বহিয়ে |
মদের টাকার ভাই              কিছুই ঝঞ্ঝাট নাই,
ঝন্ ঝন্ আমদানি,              দোকানে রহিরে |
“সত্য কহিয়াছ ভাই,           প্রমাণ দেখিতে পাই,
স্বচক্ষেতে অহরহ                যথায় তথায় হে |
কিন্তু মানে দিয়ে ছাই,           হতে মদ্যব্যবসায়ী,
পারি কই ওরে ভাই            তোমার কথায় হে ?”
“যদি সাধ মান রাখা,             তবে চেওনাকো টাকা
মান রেখে টাকা লাভ            এরে বড় দায় হে |”
দিয়ে মান বিসর্জ্জন,              যারা মাত্র চাহে ধন,
নমস্কার করি আমি               তাহাদের পায় হে |

.                    ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সে দেশকে নমস্কার      
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

যে দেশের                  কবি প্রতি অনাদরে,
পরমুখে কাব্যরস           করি আস্বাদন রে |
যে দেশের ধনীগণে,         ব্যসনে উড়ায় ধনে,
কবিকে কড়াটী দিতে       হয় সুকৃপণ রে |
যে দেশের অধিবাসী,       পরভাষা ভালবাসি,
মাতৃকল্পা মাতৃভাষা,         পানে নাহি চায় রে |
বিদ্যানেরা যে দেশের       প্রায় কবি বিশেষের,
পক্ষপাতী, গুণগ্রাম            বিশেষি না চায় রে
রোক্ না রউক সার,         তার কার কে বিচার ,
সুস্বর “টাইটেলে” কারা      যেদেশে বিকায় রে
যে দেশে প্রকৃত-কবি,        অর্থ ভেবে দীনছবি,
কোটি কোটি নমস্কার        সে দেশের পায় রে |

.                    ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কবির দীনতা উপলক্ষে      
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

ওহে ওহে বিধাতা,             সুখ দুঃখ ফলদাতা,
সুধাই একটী কথা,              বল সত্য করিয়ে |
মিত্র হয়ে কি কারণ,            কর এত বিভগন,
তুমি আমি মিতে দুয়ে,        দেখ মনে স্মরিয়ে |
জগতের রীতি এই,             নামে নামে মিলিলেই
মিত্র হয় পরস্পর,               উপকার করে যে |
তোমার কেমন রীত,            কর তার বিপরীত
মিত্রদ্রোহী মহাপাপ,             তোমায় যে হে |
যদি বিধি হেন কও,            তুমি কি সে নির কও,
উভয়ের একান্ত নাম,            হল কই রে
ভেঙ্গে আর কিবা কব,          কবিনাম বটে তব,
আমারও কবি নাম,             তাই মিতে কই হে |

.                    ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দৈন্যে
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

ওরে ওরে দরিদ্রতা               শোন বলি সার কথা,
হরিতে আমার তুই,               সকলই পারবি,
মনোহর বাড়ী ঘর,                গাড়ী ঘোড়া নরোবর,
ধনজন গোধানাদি,                বরঞ্চ না ছাড়বি,
না হয় দংশনে তোর,            পরাণ যাইবে মোর |
এসব করিতে তুই,                পারবি রে পারবি |
কবিত্ব অমিয়া রসে,              জীবিত যে রব যশে,
সে জীবন হরিবারে,               নারবি রে নারবি |

.                    ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কবির বেশ উপলক্ষে প্রশ্মোত্তর   
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

কেন কই কবিবর,         হেন বিশ্রী কলেবর,
তৈলবিনে গায় যেন,       উড়িতেছে খড়ী হে |
পরা মোটা “মারকিন”     তাও হেরি সুমলিন,
দো ছোট “মলমল” ছেঁড়া   তাও হেরি ধড়ি হে
ছেঁড়া  চটী  জুতা পায়,    চলে যেতে খসেযায়,
যেন আছে কত দায়,      কাঙ্গালের গ্রাস হে |
কেন  হেন দীনবেশ,       বল বল সবিশেষ,
মিত্র ভেবে লজ্জা কিছু,    কোরনা আমায় হে |
“তোমারে কহিতে ভাই,    কণামাত্র লজ্জা নাই,
পরম আত্মীয় তুমি,        সুধাইলে তাই হে |
বাঙ্গলার যত কবি,         প্রায় তাহাদের ছবি,
এইমত ইহা হতে,          ভাল বড় নাই হে |”
এখন সুসভ্য যাঁরা,         লক্ষ্মীছাড়া বেশে তারা,
অনাদর করিবে যে,        তা কি মনে ভাল না
“লক্ষ্মীছাড়া বেশে যারা,     ঘৃণা করে দেয় তাড়া .
সরস্বতী-ছাড়া তাঁরা,        ওদলেতে যাব না  |”

.                  ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দুর্জ্জনের গুণগ্রহণ উপলক্ষে     
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

নিজে গুণধাম যাঁরা,       সরল স্বভাবে তাঁরা,
অপরের গুণমালা,         করেন গ্রহণ রে |
গুণহীন ঠেকে দায়,         যদি কারো গুণগায় ,
করে না সরল ভাবে,       সে গুণ বর্ণন রে |
রসজ্ঞ কোকিলকুল,         রসাল-মুকুল ফুল,
কুহু রবে ধন্য দিয়া,         করব ধারণ রে |
সুভোজ্য পেলেও কাক,    ত্যজে না কর্কশ ডাক,
খায়, তবু জনমায়,           কর্ণের বেদন রে |
আছে আর একদল,          শুদ্ধ তারা চায় ছল,
গুণী গুণ পূর্ণ তারা,          করে না বর্ণন রে |
কবি কষ না করুক ,         হউক ওদের মুখ
“ণকার”  বিহীন গুণ,         শব্দের সদন রে !

.                  ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অল্পজ্ঞের কাব্যালোচনা উপলক্ষে
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

গুমটের রজনীতে,  শুই বিনা মশারিতে,
লাখে লাখে মশা যদি,  সব গায় খায় যে ;
প্রভাতে জাগিয়া উঠি, হেরি দেহে গুটী গুটী,
জল-বসন্তের মত,  নাহি দুঃখ তার রে ;
ঠিক্ দুপুরের রোদ,  তাও করি তুচ্ছ বোধ,
দাঁত আলা জুতো পায়, চলা নয় দায় রে ;
কাঁকোর তাহার মাঝে, ঢুকিলে বা কত বাজে
তাও সয়ে কোনমতে,  পথে চলা যায় রে ;
চরণ হইবে ক্ষত, তাহে বা যাতনা কত ?
মাছি সব ভোঁ ভোঁ করে   পড়ুক না তার রে ;
এসকলে একটুক,     মনে না ভাবিব দুখ
স্থির চিত্তে সহিবারে  পারি সমুদায় রে |
কিন্তু কাব্য কয় কারে, যারা তা বুঝিতে নারে
ভারতী–ভান্ডারে যারা,    কখনই যায়নি,
কেবল দুয়ারে থেকে, উকি ঝুকি মেরে দেখে,
পর-মুখে মাত্র চেকে,  নিজে স্বাদ পায়নি ;
হেন  ---- হেন মূঢ়গণে  সুকাব্যের আলোচনে
দোষ কহে না লুকিয়ে,  ঘাড় মুড় নাড়িয়া
মরি মরি আহা আহা ! সহিতে না পারি তাহ
শুনে ইচ্ছা হয় দেই      সভাহতে তাড়িয়া
আছে কই তার পথ,  ইহাদেরি মত----মত,
গুণান্ধ কাব্যান্ধ যত,  বিজ্ঞমন্য কাছে রে
ক্ষিপ্ত কুকুরেতে খায়, তাহে বরং বাঁচাযায়,
নিন্দুকের বিষ দাঁতে , কবি কোথা বাঁচে রে !!!

.                ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কোন দায়িক ধনীর টালমটাল উপলক্ষে
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে

কোন এক ধনীর কাছে, কিছু মোর প্রাপ্য আছে,
আদায় করিতে তাহা,   তার কাছে যাইলাম ;
প্রকাশিয়া কাতরতা,    করে কত মিষ্ট কথা,
ভিক্ষুকের ভাব ধরি,    টাকাকটি চাইলাম ||
গত হল কতক্ষণ,        বাবুজী না কথা কন,
আমিও বসিয়া আছি,   যেন ধন্না পাড়িয়ে ;
ঘরেতে খাবার নাই,    মনেতে ভাবনা তাই,
টাকা পেলে বেঁচে যাই, যেতে নারি ছাড়িয়ে |
আবার চাহিনু টাকা,    বাবুজীর মুখ বাঁকা,
কহিলেন কটা টাকা,     তুমিই বা পাইবে ?
সময় গময় নাই,         এসে তুমি চাইবে ?
তোমার টাকা না দিয়ে,  যাবনা হে পালাইয়ে,
হাতে টাকা নাই তাই,   দিতে তোমা পারি না |
টাকা হাতে এলে পরে,   দিব তোমা খোঁজ করে,
নয় শ পঞ্চাশ টাকা,      তোমার ত ধারি না ||
ওদিকে বাবুর কাছে,     বাক্সের উপরে আছে,
শতাধিক টাকা আনি,    দুট বই পাবনা |
শুনি বাবুজীর বাক্,      অমনি লাগিল তাক্,
কি বলে উত্তর করি,     হল তাই ভাবনা ||
খোসামুদে ছিল যারা,   কহিয়া উঠিল তারা
বাবুর মেজাজ আজ,   ভাল নাই জানিবে ;
মোরা জানি গন্ডা পাই,  তহবিলে টাকা নাই,
আইলে কদিন পর,      অবশ্যই পাইবে ||
শুনিয়ে তা মনে মনে,  কহিলাম যে কারণে,
আমি চাহিতেছি টাকা,  কেহই না বুঝিল |
ঘরে যে খাবার নাই,   সাধে কি কাতরে চাই,
এ কথাটা একবার,      কেহ নাহি ভাবিল |
প্রাপ্য টাকা চাইলাম,    মুখ ঝামটা খাইলাম,
হরিশ কহিছে খেদে,     দুঃখ বলি কায়রে |
ধনীর সকলি সাজে,      কেবল ধরণীমাঝে,
দরিদ্রেরা অনুপায়,     হায় হায় হায় রে !!!

.                ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*