আশাভঙ্গ উপক্রমে
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

শুন  শুন অয়ে ভাই,  যবে আমি কিছুচাই,
যদি দিতে পার তবে, কর অঙ্গীকার হে !
না পার স্পষ্ট কও,    কেন দেখে মৌনী হও,
তুমিত আমার কিছু.  ধারনাকো ধার হে ?
দেই দিচ্ছি বলে বোলে, কতদিন ছলে ছোলে,
শেষ কালে টেলেটুলে,  কোরনা নিরাশ হে |
আশাঙাঙ্গা আশা দিয়ে,  এর মত পাপ-ক্রিয়ে,
নাই--- নাই পৃথিবীতে, নির্য্যাস --- নির্য্যাস হে |
বরঞ্চ নাকর দান,   তাহে না কাঁদিবে প্রাণ,
আশা দিয়া নাহি দিলে, বড় প্রাণে বাজে হে,
হতাশ্বাস হলে পরে,  প্রাণ মান যে কি করে,
করে যার সেই জানে,  লোকালয়-মাঝে হে
কবি কহিতেছে সার,  যত ক্লেশ নিরাশার,
জেনেছি জেনেছি তাহা, আমি বিলক্ষণ হে
শত বজ্র বুকে হানে,  বরঞ্চ তা সহে প্রাণে,
তবু নিরাশার ক্লেশ, নাযায় সহন রে |

.             ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
কবি হরিশচন্দ্র মিত্রর কবিতা
*
প্রভুর দুব্যবহারে ব্যথিত হইয়া
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

কাননে তুরঙ্গগণ,      করি তৃণমূলাসন,
স্বাধীনে জীবিতকাল,  অনায়াসে কাটিছে,
ধনি-পাশে নাহি যায়   ধম্ কানি নাহি খায়
তার আজ্ঞামাত্র নাহি,  প্রাণপণে খাটিছে |
সর্ব্বদা স্বাধীন আছে,  চাহেনা কাহার কাছে,
শ্রম করি যাহা পায়, তাহে সন্তোষিত যে !
আ মরি কি সুবিচার ! শুনে লাগে চমত্কার,
ওরা নাকি পশু আর, আমরা পন্ডিত রে !!!

.                    ----------

ধন্য ধন্য মৃগ গণ !                ভয়ানক–দরশন
.      ধনীদের মুখ সদা নাহি তাকো সভয়ে,
সতত স্বাধিনে রও,             চাটুবাক্য নাহি  কও
.      পোড়া পেট পূরাবার     আশয়েতে বিষয়ে,
ধনীদের সাহুঙ্কার,               বাক্যগুলা বারবার,
.       তোমাদের কর্ণমূল করেনা ব্যথিত হে !
যে আজ্ঞার ভার বয়ে,          আশায় অধীন হয়ে,
.       বাতাতপে জল,  ঝড়ে না হও ধাবিত হে |
নিদ্রা এলে নিদ্রা যাও,            ক্ষুধা পেলে তৃণ খাও,
    প্রভু-কার্য্য-অনুরোধে  বাধা নাই তার হে
কহ আমি পায়ে ধরি            কোথা কোন্ তপ করি,
.      এমন সুখের দশা লভিলে সবার হে !!!

.                  ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কোন স্কুল ডিপুটী ইনেস্পেক্টরের দুর্ব্ব্যবহারে
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

কত রাত জেগে জুগে,  কত মত ক্লেশ ভুগে,
এর ওর চুরি করে,      গ্রন্থ এক লিখিলাম |
আশা উহা ছাপাইয়া,   গুণগ্রাম জাঁকাইয়া,
পাইব বিস্তর টাকা --- মস্ত ধনী হইলাম !
হাতে কিছু টাকা নাই, কিসে এ গ্রন্থ ছাপাই,
ধার করে কিছু টাকা, কত যত্নে লইলাম,
বেড়ে গেল আশা বাই,  যন্ত্রালয়ে নিত্য যাই,
তাগাদা করিয়া কত,   গ্রন্থখানা ছাপালাম |
পুস্তক হইল বাঁধা,     বাড়িল বিক্রীর ধাঁদা ,
কেমনে বিক্রয় করি,  এই চিন্তা উঠিল ;
আমার পুস্তকচয়,  বিদ্যালয়ের পাঠ্য হয়,
কিরূপেতে মন তার,  চেষ্টা পক্ষে ছুটিল |
স্কুল তত্ত্বাবধায়ক , পাঠ্য-গ্রন্থ-নির্ণায়ক
তিনি দেন পাঠ্যগ্রন্থ, নির্ব্বাচন করিয়ে |
হলে কৃপাদৃষ্টি তাঁর, অকর্মণ্য গ্রন্থকার,
বিরচিত গ্রন্থ যার,   বিদেশেতে চলিয়া |
শুনে বারন্ত আশাবাই,  তাঁহার নিকটে যাই,
কহিলাম তাঁরে কত, খোসামুদী করিয়ে|
কৃপাদৃষ্টি হল তাঁর,   আহ্লাদে বাঁচি না আর
আমার রচিত গ্রন্থ,   পাঠ্য -----
তত্ত্বাবধায়ক যিনি,  পুস্তক চেলেন তিনি,
দিনু সব তারে নিয়ে,  নিজে শিরে বাহিরে |
আশা টাকা পাব কত, পুনঃ গ্রন্থ নানামত,
লিখিব এ আশে গেল, মাস কত বহিয়ে |
শেষেতে ঋণের টান,  পড়িল, না থাকে মান,
তত্ত্বাবধায়ক –পাশে ,  ধাত্তায়াধায়ী ধাইলাম |
কত দিন ঘুরে ঘুরে, কত স্থান ঢুঁরে ঢুঁরে ,
শেষে দরবার তাঁর,  কত পুণ্যে পাইলাম |
যখন চেলাম টাকা,  তখনই মুখ বাঁকা,
আর সেই স্নেহ মাখা কথা নাহি শুনিলাম |
কত করি ‘উমেদারী’  প্রাপ্য টাকা পেতে নারি ,
পেয়ে ক্লেশ অবশেষে,  শূন্য লাভ গণিলাম |
সেকালে নিরাশ দুখে,  যে শেল বাজল বুকে,
কে বুঝিবে কারে কব,  এই ঘোর যাতনা !!
ঘৃতকুম্ভ –বাহী মত,  ফুরাইল আশা যত,
কেবল হইল সার,  মনে মনে কল্পনা |
দূরে যাক লাভ করা,  ঋণের চিন্তায় জ্বরা ,
হইলাম লাভে হল,  “পরম্ গোবধ রে !!”
হরিশ বিভুর কাছে,   কাতরে বিনয়ে যাচে,
কার যেন নাহি ঘটে,  এরূপ বিপদ রে |

.             ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কবির স্বাধীন বাক্যের উপলক্ষে
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

বসন্তের আগমণে,   সহকারে ফুল্ল-মনে,
গায় যবে পিক তার,  তাক্ত কেহ কোর না |
ভাব রসে মগ্ন হয়ে,   সুগায়ক বীণা লয়ে,
গায় যবে বীণা তার,  সে সময় হোর না |
এসব বা প্রাণে সয়,   এতে দুঃখ তত নয়,
কিন্তু দেখো কেহ হেন,  নিষ্ঠুরতা কোরো না |
বাণী-কন্ঠ-কবি সবে,   মুক্ত কন্ঠে বর্ণে যবে,
সেসময় কেহ যেন,   কন্ঠ চেপে ধোরো না |

.              ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ক্ষমার-গ্রাহীদিগের দুঃস্বভাব উপলক্ষে
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

ওহে নিধি !  ছি ছি ছি !  তোমায় বা কব কি !!
অচেতন কুলাখানা,  সার গ্রাহী গড়েছ |
সচেতন সুগঠন,    এমন মনুষ্যগণ,
তাদেরে ও গুণে কেন,  প্রবঞ্চিত করেছ ;
বিনয়ে এ ভিক্ষা চাহি,  না করিয়া সারগ্রাহী,
ভাবীকালে একটিও,    মানুষ গড়ো না হে |
একেইত কবিচয়,  অরি ভয় শূন্য নয়,
সে সংখ্যার বৃদ্ধি আর, করো না করো না হে |

.              ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*

কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

ওহে অহে হংস ধীর ?  নীরসহ দিলে ক্ষীর,
নীর ত্যজে ক্ষীর তুমি, করহ গ্রহণ হে ;
পিপীলিকা তুমি ধন্য,  সারগ্রাহী অগ্রগণ্য
বালি, চিনি বেছে চিনি,  কর আহরণ হে |
জন্মি পক্ষীকীটকুলে,  অসারে না মজ ভুলে,
কি আশ্চর্য্য নরবংশে, লভিয়া জনম হে |
যারা নাহি সার বোঝে, কেবল অসার খোঁজে,
তাহাদের চিত্তবৃত্তি,  নাজানি কেমন হে !
যাদের স্বভাব হেন,  তোমরা তাদিগে কেন,
সার গ্রহণের রীতি,  দাও না শিখিয়ে হে !
শিখিলে এ সাধু রীত,  সমাজের হবে হিত,
তাই বলি তোমা দোঁহে, বিনয় করিয়ে হে |

.              ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দরিদ্রের প্রার্থনা
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

রে মুরখ চতুর্মুখ !   যা  দিবার দিলি দুখ |
এ দুঃখে অসুখী আমি,  একটুকী নই রে |
এজন্মে যা হবে, হবে, কিন্তু মোরে পুনঃ ভবে,
জন্মিতে যদ্যপি হয়,  শুন তবে কই রে----
যেই লোকালয় মাঝে,  অর্থবই কোন কাজে,
কাহারে না পাওয়া যায়, সেই লোকালয় রে,
ওরে তোর পায় ধরি, কাতরে এ ভিক্ষা করি,
দেখ দেখ যেন মোরে, জন্মিতে না হয় রে !!
যদি বা জন্মিতে হয়, তবে যেন নাহি রয়,
দরিদ্রতা দেহ মাঝে, করি অধিকার রে !!
যদিও দরিদ্র হই,  কৃতাঞ্জলিপুটে কই,
যেন নাহি থাকে, দারাপুত্র পরিবার রে !!
দারাপুত্র পরিবার,  পালনে না বলে ভার,
আপনি দরিদ্র হতে,  একটুকু ডরিনে |
হরিশ কহিছে ধাতা,  না শুনত খাও মাথা,
নিজের লাগিয়া তোরে, খোসামুদী করিনে |

.              ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কবির দৈন্যে  ( প্রশ্নোত্তর )     
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

কুমার-কুমার ভাই      সত্য বল যা সুধাই,
কোন প্রতিমার যত্নে,  “তারা ভুরু”  আঁকিছ ?
কমলার চক্ষু আঁকি,     তুমি ইহা চিন না কি,
যেনে শুনে ফিরে কেন,  আমারে হে কহিছ ?
কেমন আঁকিছ ভাই,      দেখি তবে দেখে যাই,
ওহু ওহু হয় নাই,         ত্রুটী কিছু হয়েছে,
“তারা” মাঝে দিতে “ফুল” তোমার হয়েছে ভুল,
দেও দেও “চিতে” দাও বাকী কেন রয়েছে ?
চক্ষেতে চিতিলে ফুল,  কাণী বলে করে তুল,
গাহাক বাঁধাবে গোল,   তাহা কিহে গণেছ ?
কমলার চক্ষু আছে,     এ কথাটি কার কাছে,
অবোধ কুমার ভাই,     কবে বল শুনেছ !
কমলবাসিনী লক্ষ্মী,       কমল জিনিয়া অক্ষি,
কেন এ কথাত শুনি,        ধনিগণ কয় হে :
মিথ্যা সেটা যত কোক্,  কমলার রৈলে চোখ
স্বভাব-সুকবিগণ,         দরিদ্র কি হয় হে !!

.               ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কবিতার অনাদরে    
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
"কবি-রহস্য" কাব্যগ্রন্থ থেকে      

হে কবিতে |  আদরিবে কে আর তোমায় ?
হয়েছে হৃদয়শূন্য প্রায় লোকসমুদায় |
হৃদয় থাকিলে পরে, তোমার যে অনাদরে
কে এমন এ ভুপরে শিলাময়-কার ?

হা ! মাধবীলতা,  যারে প্রেমাদর সহকারে
রাখিত হৃদয়াগারে,  যত্নে সহকারে,
এ দুঃখ কহিব কায় !  এখন সে লতিকায়
অসার আকন্দ কায়, স্থান নাহি পায় !

ললিতা-কবিতাভাবে, রসে, গুণে হবে ভাবে
নব নব ভাবে ভাবে   কারে না ভুলায় ?
হায় কি পুরুষ যত,   হল পুরুষত্ব হত !!
তাই ত্যজে ক্লীব মত,  নব নায়িকার |

হে কবিত্বে ! প্রাণেশ্বরে  ( ১ ) হারায়ে দুঃখসাগরে
ডুবিয়াছ কে বিতরে,  আশ্রয় তোমায় |
দুঃখসিন্ধু-নিমগনা,  যে বিধবা বঙ্গাঙ্গনা ( ২ )
তার প্রতি কৃপাকণা, অর্পিতে কে চায় ?

হে কবিতে !  না জান কি, সুপবিত্রা যে জানকী ( ৩ )
সদ্ গুণে সতীত্ব যার,    তুল্য  মেলা দায় |
ভ্রমেও না গুণ স্বরে, বিনা দোষে দূষী করে
অবোধ নিকরে, তার, অপবাদ গায় !!

হে কবিতে !  যদি এবে,লোকে তোমা নাহি জেনে
ভগ্নোত্সাহে তাই ভেবে, হওনা দুঃখিত |
সতত সভাবে থাক, বিভু প্রতি প্রীতি রাখ,
যাইবে দুর্দ্দশা তব, তাঁহারি কৃপায় |

.             ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   

( ১ ) প্রাণেশ্বরে--- প্রাণকান্তে অথবা প্রাণ স্বরূপ ঈশ্বরে
অর্থাৎ ঈশ্বর গুপ্ত |
( ২ )  বিধবাবঙ্গাঙ্গনা---- বঙ্গদেশীয় বিধবাঙ্গন | অথবা
এতৎ কাব্যকারের রচিত “বিধবাবঙ্গাঙ্গনা” নামক কাব্য |

মিলনসাগর
*
বড় কে    
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র
বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় সংকলিত ও সম্পাদিত, শিশু সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত "কিশোর
কবিতা সঞ্চয়ন" (১৯৯৫) কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া।      

আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।

.             ******************     
.                                                                                
সূচিতে . . .   



মিলনসাগর
*