কবি হাসিরাশি দেবীর কবিতা
*
দূরদর্শী
হাসিরাশি দেবী
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও সরল দে সম্পাদিত "পাঁচশো বছরের কিশোর কবিতা" সংকলন
থেকে।


পাকাঠিলাল ঠুনঠুনিয়া,
বললে সেদিন হাত গুনিয়া
বাজার এবার মন্দা ভারি,
আভাষ যেন পাচ্ছি তারই ;
জাভার থেকে জাহাজ এসে,
চড়ায় ঠেকে আটকেছে সে ;
মাস্তুলটাও গেছে বেঁকে,
এলোমেলো বাতাস লেগে ;
উচ্ছে-পটল কড়াইশুঁটি,
কুমড়ো-ঝিঙে কাঁকুড়-ফুটি
মন-দরুনে যাচ্ছে পাওয়া,
বদলে চলে কালের হাওয়া!

পাকাঠিলাল ঠুনঠুনিয়া,
বললে সেদিন হাত গুনিয়া
জাঞ্জিবারের প্লেনটা উড়ে,
মিলিয়ে গেছে অনেক দূরে ;
লবঙ্গ আর যায় না পাওয়া,
ডাল্-চিনি তো বেবাক হাওয়া!
জিরে জোয়ান বস্তা ক’রে,
আসতে পথে নিল চোরে!
ছোট এলাচ আনতে গিয়ে,
ডাকাত প’ল বর্শা নিয়ে!
বাজার চলে মন্দা বড়,
কেউবা ফাঁপর, কেউ বা দড়।

পাকাঠিলাল ঠুনঠুনিয়া,
বললে সেদিন হাত গুনিয়া
এই যে হাতের সামনে রেখা,
এদিক থেকে যাচ্ছে দেখা,
এর মানেটা নয়কো যা-তা,
ঘুরিয়ে দেবে অনেক মাথা।
পাউণ্ড শিলং পেন্স ও ডলার,
পয়সা টাকার নানান কালার
জগত্টাকে সরসে-ফুলে
ভরিয়ে দেবে শিকেয় তুলে।
বাজার তবু মন্দা ভারি,
আভাষ যেন পাচ্ছি তারই॥

.      *****************

.                                                                              
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
হাতে কলমে
হাসিরাশি দেবী
শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও এখলাসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত "দুই বাংলার ছড়া",
১৯৯৩, সংকলন থেকে।


সইয়ের বইয়ের কভারে যেই এঁকেছি কই মাছ,
তড়বড়িয়ে উঠলো গিয়ে সামনে দেখে ওই গাছ।
সেই গাছে সে ডিম পেড়েছে দুটো
একটা ভালো, একটা আবার ফুটো।
সেই ফুটো দে’ কই ছানা গে সটান দিলে লাফ
এক্কেবারে সমুদ্দুরে, সক্কলে আবাক।

দেখেননি সেই দৈনিকে যে লিখলো মেছো দাদা,
সেই থেকে রোজ ভরিয়ে শুধু আঁকছি কেবল খাতা।
কত যে মাছ চুনো-পোনা নাম কি জানি তার,
ভাবছি মনে একদিনে ঠিক মিলবে পুরস্কার।
বলো তো ভাই সবাই মিলে এ কথা ঠিক কি না ?
এর বেশি আর বলবো কি তার কিছুই জানি না।

.                *****************

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
নমস্কার
হাসিরাশি দেবী


বঙ্গবাণীরে পুজে যে ভক্তগণ,
তাহাদের মাঝে তুমিও যে একজন ;
বাংলার ভাষা মন্ত্রের হে পুজারী ;
নিয়ে এলে নব কল্যাণময়ী বারি ;
তব জীবনের সুদূর অতীত প্রাতে,
যে পূজা-প্রদীপ তুলে নিয়েছিলে হাতে,
সে-দীপ রাখোনি, আরতি হয়নি শেষ,
আজিও বাজিছে সুরের কম্প্ররেশ ;
জীবন বীণায় বাজিছে যে গানখানি,
কণ্ঠ তোমার তাহারে দিল যে বাণী,---
তার ভাবধারা ভাষার গুঞ্জরণ
যবে করেছিল বিভোর মোর এ-মন---
আজি শুভদিনে দিনু তোমা উপহার,
তাহারি স্মরণে একটি নমস্কার!

.         *****************

.                                                                           
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
চাঁদের ভেতর চরকা কাটা বুড়ি
হাসিরাশি দেবী
জীবনের শেষ পর্যায়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটান খাটিরার হাই স্কুল চত্তরে একটি মাত্র ঘরে।
তারই প্রতিধ্বনি তুলে ১৯৯১তে রচিত তাঁর এই কবিতাটি আমরা পেয়েছি সুবোধচন্দ্র
সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত সংসদ বাংলা চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড ২০১০, থেকে।


চাঁদের ভেতর চরকা কাটা বুড়ি
আজো হাঁটে দিয়েই হামাগুড়ি
সেও কি, আমার মতো থরথুরিয়ে হাঁটে
আর, বসে বসে কেবল চরকা কাটে।

.         *****************

.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দুঃখের রাতি এল
কবি হাসিরাশি দেবী
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত দেশ পত্রিকার ২৫শে কার্তিক ১৩৪৫ (নভেম্বর ১৯৩৯) সংখ্যা
থেকে।


দুঃখের রাতি এলো বক্ষের আঙ্গিনায়
.        বন্ধু হে, ঐ পদধ্বনি তার,---
অন্তর মন্দিরে ঐ বুঝি শোনা যায়---
.        চঞ্চল মঞ্জির ঝঙ্কার ;
.                জীর্ণ দুয়ার ঘর, বন্ধ এ বাতায়ন,
.                শঙ্কায় কেঁরে ওঠে আজি শুধু ক্ষণে ক্ষণ
.                রুদ্ধ আঁধার ভরা অতীতের ক্রন্দন
.                        মুক্তি মাগিয়া ফেরে বার বার,
কোন উন্মনা আছে ছেদি বাধা বন্ধন
.        বাহিরিতে চাহে খুলি এ দুয়ার!


বাহির আকাশ আজ ঘন মেঘ মন্থর
.        মদির স্বপন নাহি অঙ্কে,---
চকিত চপলা চলে ছুটিয়া নিরন্তর
.        ভ্রকুটি কুটিলা নানারঙ্গে!
.                দীর্ঘ দিবস মাস, দীর্ঘ নিশীথ দিন,
.                উত্সবানন্দিত ছন্দিত হৃদিবীণ,
.                আজি অবসাদ ভরা, সুরহারা গীতহীন
.                        মিশে যেতে চায় ওরি সঙ্গে---
চির যবনিকাতলে,---পথে, পথে হয় লীন
.        যেথা শত লীলা নানারঙ্গে!


বন্ধুহেস ঐ মহাযাত্রার সঙ্গীত
.        ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে বক্ষে,
দিগন্তে জাগে তার অজানিত ইঙ্গিত,
.        ভেসে ওঠে মোহময় চক্ষে।
.                রক্তিম শিখা ঐ রচে নব লিপিকা,
.                জ্বলে ওঠে শক্তির অর্চ্চনা-দীপিকা,
.                দুঃখের রাত্রির সাথে চিরযাত্রী
.                        মুক্তি আসিবে কারাকক্ষে
আনন্দ হাসি গান, অবসাদে হ’লো ম্লান,
.        দুঃখ-সুখ বাঁধা প’লো সখ্যে।

.       
          *****************

.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
যে গেছে সে চলে যাক্
কবি হাসিরাশি দেবী
রায় জলধর সেন বাহাদুর সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫২ (ফেব্রুয়ারী ১৯৪৬)
সংখ্যা থেকে।

অস্ফুট নক্ষত্রালোকে তোমার লিখিয়া যাওয়া নাম,---
.                আজিকে প্রথম হেরিলাম।

ফাল্গুনের ফুলবনে বসন্তের শেষ বেলা মোর,---
পাণ্ডুর চাঁদেরে চাহি নিঃশব্দে ফেলিছে আঁখি লোর

.                 *****************

.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
. . . ধূসর ধূলায় ঢাকা রবে . . .
কবি হাসিরাশি দেবী
রায় জলধর সেন বাহাদুর সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার পৌষ ১৩৪৯ (ডিসেম্বর ১৯৪২)
সংখ্যা থেকে।


বন্ধু আমার! দূর স্বপনের স্বর্ণশিখর দেশে,
.        উদয়-ঊষার প্রথম আলোক যদি না দেখিতে পাও,
.                        অনন্ত অন্তরে
রক্ত রবির রাগ লিপি যদি হারায় নিরুদ্দেশে,
.        তারেই আবার বারে বারে কেন ফিরে ফিরে পেতে চাও?

.                কবে চলে গেছে কার কোন্ রথ!
.                কঙ্কর ভরা ধূলিময় পথ
.                চক্র চিহ্নে ক্ষত বিক্ষত---জীর্ণ বুকের মাঝে
.                        শীর্ণ বাহু বন্ধনে যদি বিদায়ের ব্যথা কাঁদে,---
গুঞ্জন-হীন কুঞ্জে তাহ’লে এসো না প্রাতে কি সাঁঝে
.        পূর্ণ ক’রো না জীবন তোমার আশাহীন অবসাদে॥


সম্মুখে তব বিস্তৃত ঐ অদূর ভবিষ্যৎ---
.        দিগন্তে তার আলিপনা আঁকে আলো ছায়া মিশাইয়া,---
.                        ---হাসি আর ক্রন্দনে,---
সুর হ’তে শেষে মিশে মিশে গেছে সেই দূর বন্ধুর পথ
.        অন্তর আর বাহির মিশেছে যা কিছু গোপন নিয়া---
.                        মুক্তি ও বন্ধনে।

.                        যেটুকু লজ্জা, যেটুকু বা ভয়,
.                        তারি এতটুকু ক্ষীণ সংশয়
এ পথে চলিতে ফেলে চলে যেও আবর্জ্জনার মাঝে,
.                        যেমন সকলে যায়---
বহু পদরেখা অঙ্কিত পথ আবার প্রাতে কি সাঁঝে
.                ধূসর ধূলায় ঢাকা রবে পুনরায়॥

.                 *****************

.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমার খেয়ার নেয়ে
কথা - কবি হাসিরাশি দেবী
সুর ও স্বরলিপি - অনিলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
রায় জলধর সেন বাহাদুর সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার আষাঢ় ১৩৪১ (জুন ১৯৩৪)
সংখ্যা থেকে।
গানটির স্বরলিপির জন্যে এখানে ক্লিক করুন . . .       

.        গান
॥ বাউল, দাদরা॥

আমার খেয়ার নেয়ে!
এ বোঝা মোর সারাজীবন
কেমন ক’রে চলবে বেয়ে!
পাথেয় মোর নাইকো কিছু
তীরের মায়া টানছে পিছু
বাউল বাতাস বিশ্ব-বীণায়
কি গানখানি যাচ্ছে গেয়ে!
কেমন ক’রে চ’লবো আমি
আমরাই সেই অচীন দেশে,
প্রদীপ আমার নিভু নিভু
আজকে দুখ রাতের শেষে ;
কোথায় যাব নেইকো জানা,
খুঁজিনি তার ঠিক ঠিকানা,
চলতে যদি হবেই পথে
চলব আমার সে গান গেয়ে!

.                 *****************

.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বৈশাখ বিদায়
কবি হাসিরাশি দেবী
রায় জলধর সেন বাহাদুর সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার বৈশাখ ১৩৪১ (এপ্রিল ১৯৩৮)
সংখ্যা থেকে।


.                        বিদায় বৈশাখ
শুভ---নব বরষের বিদ্যুজ্জ্বল-নয়ন-নির্ব্বাক
তুলিয়া ইঙ্গিত করি অনাগত সময়ের পানে
.                        ছুটে চল প্রলয়াভিযানে

.                 *****************

.                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর