আষাঢ় শেষে
হেমচন্দ্র বাগচী
এই কবিতাটি দ্বীপান্বিতা (১৯২৮) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

তরুণ আষাঢ় আজ ফিরে যায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ভগ্ন প্রাণে পুঞ্জ মেঘ-উপহার ল’য়ে।
শুধু হায় এনেছিল ব’য়ে
নবীন আশার বাণী, তাই গেল নীরবে কহিয়া
রজনী-গন্ধার কাণে, যূথিকার মৃদু পরিমলে,
কণ্টকিত কেয়া-বনে, পল্লবিত ভূঁই-চাঁপা-দলে।

আর কা’র লাগি’
এনেছিলো কোন্ অর্ঘ্য সুদূরের মায়াপুরী হ’তে
সুপিঙ্গল ঘন কেশে তীব্র হেসে ব্যাকুল মরতে,
কেহ নাহি জানে। তাই সে বিরাগী
বঞ্চিত বেদনা তা’র দিলো মেঘে, দিলো বরিষণে,
পুষ্পিত কদম্বতলে, পরিম্লান রেণু-পরশনে।

আজি তার যাত্রাপথে ঘন ঘন বাজিছে মাদল ;
বিরহীর দল
দাদুরীর উচ্চরোলে ব্যথাঘন বরষা-নিশীথে
বিদায়-পথিকে দিলো ঘন অশ্রু-বাষ্প-উপহার।
আজি তাই বিষণ্ণ আষাঢ়
বিদায়-বেদনা-ভরে সকরুণ গীতে,
শ্রাবণ-সখারে তা’র ডাকি’ দিলো সজ্জিত সভায়।
তারপরে ধীরে ধীরে মাগি’ নিলো প্রশান্ত বিদায়।

কোথায় সে কতদূর শুভ্রশীর্ষ হিমাদ্রির শিরে,
উত্তরের পথে,---
সঙ্গহীন দীর্ঘশ্বাসে কামচারী পুঞ্জ মেঘরথে,
আষাঢ় চলিলো ফিরে নয়নাশ্রুনীরে
পুঞ্জিত বেদনা বহি’ রিক্ত দীন বিরহীর বেশে,
আজি তার বাদায়ের আয়োজন-শেষে,
কেহ নাই শুধা’বার!
হে বিরহী, তরুণ আষাঢ়,
আজি মোরে কহ’ ধীরে,
কা’র লাগি’ চলিয়াছ ফিরে
তপস্যার আয়োজনে, বিদ্যুতের বহ্নিজ্বালা বহি’---
হে কিশোর মিত্র মোর, যাও মোরে কহি’!

কোথায় সে প্রিয়া তব, যা’র লাগি’ চলিয়াছ খুঁজি’
দেশ হ’তে দেশান্তরে নদী-গিরি-কন্দর লঙ্ঘিয়া
অশ্রু-বাষ্পে শূন্যতল ভরি’!
আতুর বনজ-বায়ু নব পুষ্প-সৌরভ আহরি’
তোমার ধূসর কেশে ম্লান হেসে দিলো সুরভিয়া!
বিমুগ্ধা প্রিয়ার লাগি’ চলিয়াছ আজি তাই বুঝি---
দূরে দূরে ঘুরে মরি’ ক্লান্ত কায়ে আঁখি-জল-ধারে,
প্লাবিয়া পর্ব্বত-নদী, তবু হায়, দেখা হ’ল না রে!

হে চিরন্তন বন্ধু, আজি তব বিদায়ের দিনে,
চাহি’ দূর ছায়া-ম্লান শ্যামল বিপিনে,
বিরহ ছায়ায় মোর ভরি’ নদ-কান্তার-প্রান্তর,
দিশে দিশে কলরোল তুলি’।
নীপশাখা নীরবে আকুলি’
আজিকে চলিলে তুমি বারিসিক্ত বনবীথি দিয়া
মন্থর গমনে,
বহি’ মনে মনে
ব্যাকুল চিন্তার ভার, রহি’ রহি’ কাঁদিয়া কাঁদিয়,
বেদনার দীর্ঘশ্বাসে নিখিলের চিত্ত আকুলিয়া
স্বল্প-পরিচয়ে,
নিষ্ঠুর দয়িতা লাগি’ নব প্রেম নব বাণী ল’য়ে।

.              ******************     
.                                                                                  
সুচিতে...   


মিলনসাগর
কবি হেমচন্দ্র বাগচীর কবিতা
যে কোন গানের উপর ক্লিক করলেই সেই গানটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
বিরহিণী
হেমচন্দ্র বাগচী
এই কবিতাটি দ্বীপান্বিতা (১৯২৮) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

বিরহিণী মেয়ে রহিয়াছে চেয়ে পথের ’পরে।
প্রিয়তম তা’র আসিবে ফিরিয়া তাহার তরে।
.        সে যে কতদিন কতকাল আগে
.        গিয়াছে চলিয়া মনে নাহি জাগে ;
আজো সে তাহার আশার বাণীটি হৃদয়ে ধ’রে,
চেয়ে আছে দু’টি আঁখি-তারা তুলি’ পখের ’পরে।

আকুলিত তা’র কেশপাশ সে যে বাসিত ভালো।
আজো সে যে হায়, তোমনি চিকণ নিকষ-কালো।
.        মিলন-দিনের যত আভরণ
.        ল’য়ে সে করেছে দেহার বাঁধন ;
বিধুর হৃদয়ে বাঁধন কোথায় ? নাহি যে আলো।
বিফল বাসনা ; আসে না সে আর, বাসে না ভালো।

রাজপথে কত ফিরিছে পথিক কাজের শেষে ;
মিলন-আশায় চলিছে তাহারা সুদূর দেশে।
.        শুধু কি তাহারি বিফল পরাণ ?
.        হৃদয়ে জাগিছে বৃথা অভিমান ;
সমেঘ আকাশে শশী ভেসে যায় মলিন হেসে,
গগন চুমিছে শ্যামলা ধরণী বিরহ-শেষে।

কোথায় কে যেন গাহে গান দূরে, করুণ সুরে!
গোপন ব্যথার দহনে দহনে পরাণ পুড়ে।
.        একাকিনী হায় কত র’বে আর ?
.        প্রিয় যে নিলো না বেদনার ভার ;
বেদন আজিকে রোদন জাগায় বুকটি জুড়ে।
কোথা’ প্রিয়তম, তা’রি আশে মন মরিছে ঘুরে।

যদি নাহি আসে, তথাপি সে হায় রহিবে চেয়ে।
শ্বেতবাস পরি’ দিবস কাটা’বে মলিনা মেয়ে।
.        হৃদয় জুড়িয়া আছে আশা তা’র
.        আসিবে আসিবে প্রিয় সুকুমার,
মরণের বেশে চিরমিলনের গানটি গেয়ে।
যদি নাহি আসে, তথাপি সে হায় রহিবে চেয়ে।

শীত-শেষে আজি পাতা ঝ’রে যায় পথের ’পরে ;
ধরণী ধরেছে বিরহের বেশ বিরাগ-ভরে!
.        কালো কেশ হ’ বে শুক্লবরণ ;
.        মলিন বয়ান, শিথিল চরণ ;
তথাপি বসিয়া বাতায়ন-পাশে প্রণয়-ভরে,
জাগিবে রজনী চিরবিরহিণী আঁধার ঘরে।

.              ******************     
.                                                                                  
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
বিরহী
হেমচন্দ্র বাগচী
এই কবিতাটি দ্বীপান্বিতা (১৯২৮) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

আজিকার বরষায় মন যেন কা’রে চায়,---
হায় সে যে নাই, সে যে নাই!
অবিরাম জলধারে, হৃদয় চাহিছে যা’রে,
ভেবে মরি তাহারি কথাই।
স্পর্শ তা’র যেন আজ পবনে পবনে,
দেহে-মনে কি মদির অধীর স্পন্দনে
অপূর্ব্ব হিল্লোল তুলি’ আনে ধীরে তা’র ভাবনাই।
হায়, সে যে নাই, সে যে নাই।

আজি আষাঢ়ের বাণী ধীরে করে কানাকানি
রজনী-গন্ধার কুঞ্জ-তলে।
কিশোর বয়স তা’র, সে সঁপিছে উপহার
সুমন্থর সন্ধ্যার অঞ্চলে!
যূথিকার পরিমলে অশ্রু-অর্ঘ্য দিয়া
বিষন্ন আষাঢ় আজি ফিরিছে কাঁদিয়া।
মাটির গোপন ব্যথা প্রকাশিছে নয়নের জলে---
রজনী-গন্ধার কুঞ্জ-তলে।

তা’র স্মৃতি-চিহ্নটিরে খুঁজি আমি ফিরে ফিরে ;
সে যে মোর মরমের মাঝে।
প্রত্যহের মালিকায় সে যে গেঁথেছিল তায়---
বাহিরে তাহারে পাই না যে।
বিচ্ছেদের রিক্ত রাত্রি নীরবে আহরি’
স্মৃতির সে মাল্যটিরে চিত্ততলে ধরি’
আসে ধীরে মোর পাশে, কৃষ্ণবেশে, মৌন, ম্লান সাজে।
ব্যথা বাজে মরমের মাঝে।

চিরন্তন অভিশাপে বিরহী রজনী যাপে ;
দাদুরী ডাকিয়া মরে দূরে।
ঝিল্লী-মন্দ্রে আজি হায়, বিষাদ নীরবে ছায়
পরাণের অভিরাম সুরে।
জানি না মিলন কোথা’ শান্ত প্রতীক্ষায়,
গোপনে যাপিছে পল কি মন্ত্র-দীক্ষায় ?
পথেরে সহজ করি’ অশ্রু জলে মরি ঘুরে ঘুরে।
দাদুরী ডাকিয়া মরে দূরে।

.              ******************     
.                                                                                  
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
কদম-কুসুমে আজি
হেমচন্দ্র বাগচী
এই কবিতাটি দ্বীপান্বিতা (১৯২৮) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কদম-কুসুমে আজি প্রিয়ারে সাজায়ে দাও বাদল-দিনে।
শ্রাবণ-মেঘের মতো হারানো হৃদয় তা’র লওগো জিনে।
কত রাতি কত দিন চলিছে বিরামহীন বিফল কাজে ;
আজি এ মিলন-দিন বিরহে বিবশ-করা আর না সাজে ;
.        আঁধার গগনতল ঝরিছে নয়ন-জল ;
.        বেদনা বিধুর হিয়া সদা করে টলমল।
বিফল জীবন আজি সফল করিয়া লও প্রিয়ারে চিনে।
কদম-কুসুমে আজি প্রিয়ারে সাজায়ে দাও বাদল-দিনে।

সুদূর অগম পথঅচল জীবন-রথ কিসের লাগি’ ?
পথিকজনের হিয়া আজি ফিরে সচকিয়া কাহারে মাগি’
জানো না জানো না হায়, দিনগুলি চলি’ যায় দিনের পিছে
ভাবনা-সাধনা সব কিসের লাগিয়া যেন হইল মিছে!
.        আজি কেন অকারণে মনের গহন বনে,
.        একেলা কাটাও দিন ব্যাকুল বিষাদ-সনে!
কেতকী-সুবাসে তা’র সুরভিত করো কেশ রজনী জাগি’
সুদূর অগম পথ অচল জীবন-রথ কিসের লাগি’!

আজি পাশে বসি’ তা’র বাহুডোরে পড়ো বাঁধা শ্রাবণ-রাতে!
অবিদিত-গত-যাম রজনী চলিবে কিরে ঘুমের সাথে!
প্রিয়ার মরম-পাখী মরম-কুলায়ে তব পশিবে ধীরে।
কানে-কানে কহ’ তা’র পরশি’ কপোল দু’টি চাহ’গো ফিরে!
.        সরম-জড়িত সুর ভরিবে পরাণ-পুর ;
.        সুদূর হইতে কানে মিলন-বাঁশীর সুর
পশিবে পশিবে ধীরে আঁধারে বুক চিরে হরষ-সাথে।
প্রিয়ারে লওগো চিনে আজি পাশে বসি’ তা’র শ্রাবণ-রাতে!

বহুদিন হ’ল হায়, চলোছ জীবন-পথে ; চাহ’নি ফিরে!
কতনা মিলন-ক্ষণ বৃথাই চলিয়া যায় গোপনে ধীরে!
আজি এ বরষা-রাত যাপ’ যাপ’ প্রিয়া-সাথ সকল ভুলি’।
এ কাল-সাগর-তটে নাহি নাহি মিলনের মুকুতাগুলি!
.        তাহারা অতল তলে নীরবে রহিয়া জ্বলে
.        গভীর গাহন করি’ আপন মানস-জলে,
যে জন পায় গো তা’রে, সে জন পরম ধনী সাগর-তীরে।
আজি সে মিলন-দিন ; প্রিয়ারে সাজায়ে দাও চাহ’ গো ফিরে।

.                        ******************     
.                                                                                  
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
পথ-মায়া
হেমচন্দ্র বাগচী
এই কবিতাটি দ্বীপান্বিতা (১৯২৮) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

পথিক-হৃদয় ধীরে ধীরে কয়, যোজন পথের শেষে
.                ফেরো কা’র উদ্দেশে ?
শীত-নির্ঝর গীত গেয়ে যায় ; রৌদ্র মলি হেসে
শুধায় আমায়, কা’র তরে ফেরো এমন উদাস-বেশে!
.                খুঁজে নাহি পাই কথা ;
.        ভাবি মনে, একি অকারণ আকুলতা!
.        গোপন মরমে ক্ষীণ বাণী রহে জাগি’---
পথ চলি হায়,---উদাসী বিধুর প্রেয়সী নারীর লাগি’।

প্রতিটি দিনের বেদনা শুধায়---জীবন আধার হ’লে
.                কা’রে চাও পলে-পলে ?
নীরব গহন বনতলে চলি ; মন যে চলে না আর ;
সবে ডাকি’ কয়, পরাণ ভরিয়া কেন এত হাহাকার!
.                যা’রে চাও, তা’রে লহ’---
.        নিঠুর বেদনা কেন বা এমনে বহ’ ?
সারাটি হৃদয়ে এক বাণী রহে জাগি’---
পথ চলা মোর সুদূর মধুর প্রেয়সী নারীর লাগি’।

চারিপাশে জাগে মহাকলরোল ; জীবন-তটিনী ঘিরে
.                কালের নটিনী ফিরে।
মৃদুভাষে তা’র ব্যথা ভোলে প্রাণ, তবু যেন সে কি চায়
ঘরের উদাসী ঝড়ের দোলায় পথে পথে বাহিরায়।
.                কাঁপে দেহ-হিন্দোল ;
.        অন্তর আজি উতরোল উতরোল!
.        ধ্রুবতারকার প্রভা তবু রহে জাগি’---
শত বন্ধন-ক্রন্দন মাঝে প্রেয়সী নারীর লাগি’!

আতুর হৃদয় ধীরে ধীরে কয়, আজি বেলা হ’ল শেষ ;
.                বিফল সুরের রেশ।
গগনে গগনে জ্বালা নাহি র’বে ; সন্ধ্যা ধূসর-দিন।
ঊষর মরুর শেষের সীমায় বাজিবে জীবন-বীণ ;
.                শূন্য সে পথ ’পরে
.        দীর্ণ হিয়ার বেদনা ঘুরিয়া মরে!
.        মধ্যমণি সে বাসনা রহিলো জাগি’।
পথ চলি’ হায় উদাসী বিধুর প্রেয়সী নারীর লাগি’।

.                        ******************     
.                                                                                  
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*