কবি হেমেন্দ্রকুমার রায়-এর কবিতা ও গান যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে। |
বিশ্বপিয়ালার ধারা মাতাল, মাতাল ! ওরে ঢাল্, স্বজনীর অধর-মাখানো, শীতকালে কোকিল-ডাকানো জীবনের ধারা ! প্রাণপণে পান করে আমি হই সারা | ভেসে যাক্ -- তৃষ্ণাতে তাতল মোর বুকের চাতাল- আমি যে মাতাল একি তাপ, একি জ্বালা ! মায়া-ফুলে ঢাকা ওগো কন্ঠকের মালা কন্ঠেতে পরিয়া ইহলোকে কত নর আছে হাহা জীবন্তে মরিয়া ? ছলনা ডাকিনী মোহিনীর রূপ ধরি গায় সদা সোহিনী-রাগিনী ! মুরলী-গুঞ্জনে-ভোলা মৃগ-মত-ছন্দে দোলে অন্তরেতে আনন্দ হিন্দোলা ; অন্ধ হয়ে ছুটে আসে,--- অন্ধকারে বন্ধ হয় শৃঙ্খলের ফাঁদে ; কোথা যায় আকাশ বাতাস--- অসীমের অব্যয় উল্লাস ! কারাগারে হাহাকারে প্রাণ খালি কাঁদে, কাঁদে, কাঁদে ! ( মানবের ভয়ার্ত ক্রন্দন, স্রষ্টা সেও করে না শ্রবণ | ) নিজে কাঁদে, নিজে শোনে ; পিঞ্জরেরর দ্বার, চুর্ণ করে পঞ্জর তাহার | যন্ত্রণার ষড়যন্ত্রে পুনর্বার শৃঙ্খলের ঝঞ্ঝনার ধ্বনিঝঞ্ঝা কী প্রচন্ড করে তিরস্কার ! বিশ্বে তুমি আছ কি ঈশ্বর ? থাকো যদি, নহ গো নিঃস্বর ! ধনী-জনে শিষ্য কর, তব বরে পায় তারা সুখ | তাই তারা তব নামে সতত উত্সুক, তাই তারা তোমাকেই মানে ধ্যানে, জ্ঞানে, প্রাণে | ফোটে ফুল বসন্তের অন্তঃপুরে অন্ধকারে করে দুল দুল---- দরিদ্রের হৃদয়-শোণিত গোলাপের সারা দেহ করেছে লোহিত ! কাঙালের অশ্রুনীর, প্রমত্ত নীরধি গর্ভে বিক্ষোভেতে হয়েছে অস্থির | বজ্র ছাড়ে উন্মত্ত ফুত্কার বুভুক্ষু ভিক্ষুক প্রাণে যত দুঃখ রহি রহি করিছে উদ্ গার ! হিমালয়, দীনের হৃদয় ও যে হয়ে জড় শিলাময় নিবেদিছে অনন্তের প্রতি, বিক্ষুব্ধ চিত্তের যত নিস্তব্ধ মিনতি ! রে হৃদয় কেন কাঁপো---- কেন কর ভয় ? দাহ থেকে চাহ যদি প্রাণ, সুধা পাত্রে কত মুক্তি স্নান ! এ জগৎ ভুলে যাও, নিরালাতে বসে বসে পিয়ালার রাঙা গান গাও আর গাও ! এ পিয়ালা গড়া কিসে নেই তার ঠিক--- মৃত্তি দিয়ে, কাব্য দিয়ে, সঙ্গীত কি রক্তাইবে ---কিম্বা এ স্ফটিক ! ভরে মোর চিত্ত-হ্রদ, শব্দে গন্ধে স্পর্শে ওহো ! টলমল করে খালি মদ আর মদ ! দ্রাক্ষারসে নাই শুধু সুরা ওস্তাদের সুপটু আঙুলে সুরে সুরে ঢালে সুরা তানপুরা ! সুরা ভরা পূর্ণিমার রূপ, সুরা ভরা প্রেয়সীর চুম্বন-প্রয়াসী কেঁপে-ওঠা মধু কন্ঠকূপ | মর্মবধূ হয়েছে অধীরা, রবীন্দ্রের কাব্য গেহে পান করে সুখে-দুখে কবিত্ব মদিরা | চারিভিতে---- বিহঙ্গের গীতে, বনের সবুজ, ছোট তৃণফুলে, গিরি-দরী, নিবারে, সরিতে--- আছে সুরা সুরসিকে মাতাল করিতে | গেলে উপবনে, মনে মনে, গন্ধময়ী সুরা ঝরে অগোচরে মত্ত করে দেয় বিশ্বজনে | পত্র-বীণে কি মর্মর ওঠে শোনো বেজে---- শব্দময়ী সাধু সে যে ! স্পর্শময় মদ্য-ধারা সদ্য করি পান, দেখি যবে, একখানি তনুলতা বুকে মোর নীরবে শয়ান | পিয়ালা ভর দে মুখে হয়ে থাকি আমি মাতোয়াল | মোর পেশা--- নেশা ভাই ! নেশা খালি নেশা ! ভুলে গেছি বিল্ কুল্ ধমনীতে আছে কত শোক, তাপ, জ্বালা ! মরণ সে ডাক দেয় কানে কানে ঘন ঘন ঘন--- ভয় তবু পাই না কখনো ! বোতলের মদে নয় রূপ মদে আমি নব ওমর খৈয়াম মরণে জীবনে দেখি আমি ভাই, ভালো লাগে ভাই ধরাধাম | জাগো রে মরণ-ভীত দুঃস্বপ্নের কোলে শুয়ে কে তোরা নিদ্রিত ? এসো গো গরিব ? জ্বালো ফের প্রাণের প্রদীপ | সন্ধ্যাহল ! মিছে ডাক ‘কোথা তুমি ভগবান |’ কোথা ভগবান্ ? মরণের মহাসাগরের তীরে ফিরে-ফিরে-ফিরে প্রতিধ্বনি চমকিয়া জাগে ঘন ঘোর উথলায় শূন্য তার বান ! আভিজাত্য-জাঁকে স্তব্ধ জগতের চির-অধীশ্বর-- শোনো না সে কাঙালের স্বর ! আমিও গরীব বটে | তবু মোর হৃদি-তটে নিশিদিন সুলীলারে বহে কেন আনন্দের ঢেউ ; জানো তা কি কেউ ? অহরহ করি মাতলামি--- তাই সুখী আমি | ঈশ্বরের নহি মোসাহেব | দেয় নাই ইষ্টমন্ত্র সাধনের গুরু | নরকের ভয়ে হৃদি করেনাকো তবু দুরু-দুরু ! দামাল ছেলের মতো হেসে-খেলে নেচে গেয়ে যায় মোর কাল-- আমি যে মাতাল ! জাগরণে, স্বপনে, শয়নে, মত্ততা যে মাখা দু-নয়নে | আসে যদি অমা, রূপের চাঁদিনী মেঘে বুকে মোর আছে প্রিয়তমা | অধরে সরক--- চুমুকে চুমুকে তাই করি মুখে আনন্দ পরখ | এ সরক গড়া কিসে নেই তার ঠিক, মৃত্তি দিয়ে, কাব্য দিয়ে, সঙ্গীত কি রক্তাধরে কিম্বা এ স্ফটিক ! শিরে তুলি আলক্ষ্মীর পদধূলি, অসম কাঁদুনী-ছন্দে ক্রমাগত কেটে যায় জীবনের তাল ! ওরে-ওরে কে হবি মাতাল ? আয় আয় ! শুষ্ক হয় জীবনের নদ, ঢাল্ ঢাল্ , ওরে ঢাল্ এই বেলা ঢাল তাতে পিরীতির মদ---- দুঃখ শোকে চুবাইয়া কর্ ত্বরা কভু বধ ! শোন্ -শোন্ ডাকে ইহকাল ! ধরণীর প্রাণরস দুই হাতে লুটে, আয়------ আয় ছুটে বিশ্বের যৌবন কুঞ্জে, ছেড়ে তোর তমিস্র পাতাল---- যে হবি মাতাল ! যেথা আছে প্রিয়া, ঢুলুঢুলু দুটি চোখে সুরতের লাল নেশা দিয়া | হেথা আছে সুর, কুসুম-পরাগ-মাখা দখিনার মাদকতা দিয়ে পরিপূর ! হেথা আছে আলো, তপনের সোমরস কন্ঠ ভরে যত পারো ঢালো আর ঢালো ! পাত্রে যদি থাকে রে আসব, ধরা-স্বর্গে আমি যে বাসব | মাতাল ! মাতাল ! আমি তুমি সবাই মাতাল--- পিয়ালা ভর্ দে মুখে হো হো মোরা মদের মরাল--- দুঃখ-শোকে ভাবি না করাল | দে রে, দে রে--- একেবারে মাতাল করে দে --- রূপ দিয়ে সুর দিয়ে পিয়ালা ভরে দে ! . এ পিয়ালা গড়া কিসে নেই তার ঠিক | মৃত্তি দিয়ে, কাব্য দিয়ে, সঙ্গীত কি রক্তাধরে --- কিম্বা এ স্ফটিক ! **************** . উপরে মিলনসাগর |