কবি হেমেন্দ্রকুমার রায়-এর কবিতা ও গান
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
শীত
   
আদ্দিকালের বদ্দিবুড়ি বৃদ্ধ শীতের ধাই
ছেলে  তোমার হিমসাগরে মারছে কেবল ঘাই
.        সাঁতার খেলার হিমের ছিটে
.        দ্যায় ভিজিয়ে পৃথিবীকে,
হিমালয়ের গর্তে শুয়ে তুলছ তুমি হাই,
শীত ব্যাটাকে নাও না ডেকে----নইলে মারা যাই |


দাঁত ঠকঠক বুক শিরশির কনকনানি খুব !
দখিন হাওয়া আজ বিবাগী কোকিলগুলো চুপ !
.        চাঁদামামার মুখখানা চুন
.        সর্দি লেগে হয় বুঝি খুন
প্রাণের কাঁদন শিশির  হয়ে ঝরছে রে টুপটুপ,
আজ কুয়াশার ফানুস-চাকা পূর্ণিমার ঐ রূপ !


বুড়ো শীতের ফোগলা মুখে বরফ-গোলা হাঁপ,
ঝাপটা মেরে দুনিয়াটাকে কবল বুঝি গাপ |
.        কোথ্বকে যে জুটল অবুঝ
.        শুষিয়ে দিলে মনের সবুজ,
ফুলের সাথে হয়নিকো আর মৌমাছি আলাপ,
শিকার রাতের স্বপন দ্যাখে গর্তে ঢুকে সাপ |


বদ্দিবুড়ি ঢুলছে তবু, ঐ তো বুড়ির দোষ
লক্ষ বছর নিদ্রা দিয়েও মিটল না আফশোষ
.        ঠান্ডাতে বুক যায় কালিয়ে
.        পথ থেকে সব আয় পালিয়ে
আংরাটাতে কয়লা দিয়ে, চারপাশে তার বোস,
বন্ধ করে জানালা দুয়ার, আনরে বালাপোশ!


.                 ****************                                                     
উপরে   


মিলনসাগর
*
দুপুরে

চোখ পড়ে ঢুলে গো,  মন পড়ে ঢুলে গো,
.                        তপনের মায়াতে,
চোত্ গেছে পালিয়ে,  তাপ-শিখা জ্বালিয়ে,
.                        স্বপনের ছায়াতে |

ফটিকের ধারা কৈ,  চাতকেরা সারা ঐ,---
.                        বুক হ’ল মরু যে !
সুর-ভোলা পাপিয়া !      মূর্চ্ছিত কাঁপিয়া
.                        বকুলের তরু যে !


কাছে আর সুদূরে,  দুপুরের নূপুরে,
.                        হু-হু তান আগুনের,
শোনা যায় ক্ষিতিতে , সুধু আজ স্মৃতিতে
.                        ‘কুহু’ গান ফাগুনের !


গোলাপের রেণু নাই,   প্রলাপের বেণু তাই
.                        বাতাসেতে গুঞ্জে ,
একি কাল-বেলি এ,     কুঁড়ি তাই এলিয়ে
.                        হুতাশেতে কুঞ্জে !


রাখাল সে ঘুমিয়ে,   বাঁশী-মুখ চুমিয়ে,
.                        ধূপ- শুকো হাওয়া রে !
মহিষেরা কর্দ্দম মাখে শুধু হর্দ্দম !
.                        আর খোঁজে ছাওয়া যে !



ঘু--ঘু--ঘু ঐ ডাকে নির্জ্জনে বৈশাখে
.                        কোথা দূর বনেতে,
রোদ-ভরা  পথ দিয়ে ,   প্রাণ-ভরা ঘুম নিয়ে
.                        আসে সুর মনেতে !


ঘু--ঘু--ঘু ডাকেরে,   মরমের ফাঁকেরে
.                        ছায় মাখা ছন্দে,
যেন সুর নাচেরে,     করুণায় যাচেরে,
.                        ঘুমেরি আনন্দে !


ঘু--ঘু--ঘু আসে গীত, আকাশে ভাসে প্রীত,
.                        সাথে নিয়ে তন্দ্রা,
চোখ পড়ে ঢুলে গো,    মন পড়ে ঢুলে গো,
.                        তাপে আনে চন্দ্রা !


.                 ****************                                                     
উপরে   


মিলনসাগর
*
মাস-পহেলা

মাস-পহেলা আজকে রে ভাই, মাসের প্রথম দিন,
ফুল-শিশুরা সব পরেছে ফাগেরি কৌপিন,
গাছের পাতা সবুজ হ’লো , মন হ’লো নবীন |

দীপ্তি দোলে ফুলের বুকে----দোলে হৃদয়ময়,
মন-মরা যে তাদের তরে আজের এদিন নয়,
বাতাসে আজ সাঁৎরে বেড়ায় ডানপিটেদের জয় |

আজের দিনেই অগস্ত্য তো বাইরে দিলেন পা,
সেই অগস্ত্য গন্ডুষে যে শুষ্ লে সাগর  গা,
আর ফেরেননি---- না-ফেরাটাই মস্ত কথা না |

*        *        *        *        *        *

মাস-পহেলা মাসের প্রথম --- খোস্ করো আজ দিল,
দুপুর রোদের মদ্য পিয়ে ঐ যে চেঁচায় চিল,
বিঁধ্ ছে কানে ?--- তবু দোরে আজ দিও না খিল্ |

খিল দিও না দোরে তোমার--- একটু পাতো কান,
চিলের গানেই বাজ্ চে আজি ঘর-ছাড়াদের গান,
ঐ গানে আজ যোগ দিয়েছে নিখিল ধরার প্রাণ |

দিল্-খোলসা নিখিল আজি---যা পাও তুলে’ নাও,
ক্ষুধা যদি লেগেই থাকে, নাও খেয়ে যা পাও,
নইলে অথির হাওয়ার সাথে মন করো উধাও |

*        *        *        *        *        *

মাস-পহেলা---পয়লা প্রভাত মাস-কাবারের পর,
কার চোখেতে আজও ঝরে অশ্রুরি নির্ঝর ?
নতুন দিনের নিকট হ’তে নিক্ চেয়ে সে বর |

নিটোল রবি---নিতল দুখে সেও তো শুয়েছে,
সারা রাতি তারও চোখে ঝর্ ণা ঝরেছে,
ভোর না হ’তেই তার হাসিতে বানও ডেকেছে |

একটি তারা হারিয়েছে কাল আঁধার দরিয়ায়,
তারই লাগি’ ডুক্ রে কেঁদে কর্ ছে কে হায় হায় ?
মাস-পহেলার মন-ভুলানী ডাক দিয়েছে তায় !

*        *        *        *        *        *

মাস-পহেলা মাসের প্রথম --মন-হারানো সুর
ছড়িয়ে দেছে দিগ্বিদিকে অশান্ত রৌদ্দুর ;
সেই রোদে ঐ জ্বল্ ছে দূরে ময়দানবের পুর |

ময়দানবের জ্বল্ ছে পুরী----সোনার পালঙ্কে,
লুট্ ছে দেহ রাজ-কুমারীর ---অসাড় আতঙ্কে,
জীয়ন-কাঠি তার ললাটে আজ-ছোঁয়ালেন কে ?

রাজ-কুমারীর নিদ্ টুটেছে---চোখ্ মেলে সে চায়,
দু’টো চোখের পাতার তলে কি সুখ শিহরায় !
বে-পরোয়া রাজ-কুমারের জয়-গান সে গায় |

*        *        *        *        *        *

মাস-পহেলা আজকে রে ভাই, মাসের প্রথম দিন,
শিমুল শাখা উঁচিয়েছে আজ বিদ্রোহ সঙ্গীন,
অশোক বনেও ঐ দেখা যায় ঝড়ো-হাওয়ার চিন্ |

ঝড়ো-হাওয়া মনরে মাতায়, পথ পানে দেয় ডাক্,
মাস-পহেলার ঝড়ো-হাওয়া চিত্তে লাগায় তাক্,
গানে গানে ভ’রে ওঠে মনেরি মৌচাক !


.                 ****************                                                     
উপরে   


মিলনসাগর
*
শান্ত ছেলে

দুড়ুম্ দাড়াম্--- ঝন্ ঝনা ঝন্ ! বাপ্ রে, একি ধুম ধাড়াক্কা,---
কাঁপছে বাড়ী, ঝর্ ছে বালি---বুকের ভিতর ঢেঁকির ধাক্কা |
.                ঐ যাঃ ! বুঝি ভাঙ্ লো সার্সি,
.                গুঁড়িয়ে গেল দেয়াল--আর্সি,
কে আছিস্ রে, দেখরে গিয়ে ফাট্ ল বুঝি মাথার খুলি !
শুন্ লুম শেষে হাবু বাবু খেল্ ছেন ঘরে ডান্ডাগুলি |

হাবু বাবু ঠান্ডা ছেলে, বাপের ক্ষুরে পেন্সিল কাটেন,
পুরুত ঠাকুর বস্ লে পূজোর ক্যাঁচ্ করে তাঁর টিকি কাটেন |
.                লম্বা সুতোর বঁড়শী গেঁথে
.                ছাতের ধারে ওৎটি পেতে
হাবু আছেন ঘুপ্ টি মেরে,----পথ দিয়ে যায় ফিরিওলা,
ঝাঁকা থেকে অম্ নি তাহার ফল কি খাবার টেনে তোলা |

হাবু বাবু লক্ষ্ণী  ছেলে ঘরের মেঝেয় গাব্বু খোঁড়েন |
খোকার মাথায় লাট্টু ঘোরান,----খুকীর পিঠে ধনুক ছোঁড়েন |
.                ‘এয়ার গান’টা কাঁধে নিয়ে
.                শিকার কর্ তে সেদিন গিয়ে
জলের কুমীর পেলেন নাকো---দ্যালের গায়ে টিক্ টিকিটে
মার্ তে তাকে, লাগ্ লো আমার চশমাটাতেই গুলির ছিটে |

হাবুর ফুটবল সেদিন গিয়ে পড়্ লো পাশের বাড়ীর ভেতর,
কর্ত্তা তাদের চটে বলেন---“ বল দেব না আজকে রে তোর |
.                ছেলে-পুলের ভাঙ্ বে মাথা
.                ওরে গোঁয়ার, জানিস না তা ?”
হাবু বলে কাঁদো মুখে ----“ভয় কি তোমার ছেলে গেলে ;
একটা মোটে বল যে আমার,---তোমার আছে সাতটা ছেলে |”

হাবু বাবুর ভরসা কত ! চ্যাটালো তার বুকের পাটা !
দিনের বেলায় মার্ তে পারেন ভূতের টাকে দশটা চাঁটা |
.                বোনের পায়ে ল্যাং লাগিয়ে
.                হারিয়ে তারে দ্যান্ ভাগিয়ে,
সন্ধ্যে হলেই চক্ষু বুঁজে---- এক্কেবারে খুলে জামা----
মায়ের বুকে লুকিয়ে বলেন---“ভূতের গল্প শুন্ বো না মা |”


.                 ****************                                                     
উপরে   


মিলনসাগর
*
বিশ্বপিয়ালার ধারা

মাতাল,  মাতাল  !
ওরে ঢাল্,
স্বজনীর অধর-মাখানো,
শীতকালে কোকিল-ডাকানো
জীবনের ধারা !
প্রাণপণে পান করে আমি হই সারা |
ভেসে যাক্ -- তৃষ্ণাতে তাতল মোর বুকের চাতাল-
আমি যে মাতাল
একি তাপ, একি জ্বালা !
মায়া-ফুলে ঢাকা ওগো কন্ঠকের মালা
কন্ঠেতে পরিয়া
ইহলোকে কত নর আছে হাহা জীবন্তে মরিয়া ?
ছলনা ডাকিনী
মোহিনীর রূপ ধরি গায় সদা সোহিনী-রাগিনী !
মুরলী-গুঞ্জনে-ভোলা
মৃগ-মত-ছন্দে দোলে অন্তরেতে আনন্দ হিন্দোলা ;
অন্ধ হয়ে ছুটে আসে,--- অন্ধকারে বন্ধ হয় শৃঙ্খলের ফাঁদে ;
কোথা যায় আকাশ বাতাস---
অসীমের অব্যয় উল্লাস !



কারাগারে হাহাকারে প্রাণ খালি কাঁদে, কাঁদে, কাঁদে !
( মানবের ভয়ার্ত ক্রন্দন,
স্রষ্টা সেও করে না শ্রবণ | )
নিজে কাঁদে, নিজে শোনে ; পিঞ্জরেরর  দ্বার,
চুর্ণ করে পঞ্জর তাহার |
যন্ত্রণার ষড়যন্ত্রে পুনর্বার
শৃঙ্খলের ঝঞ্ঝনার ধ্বনিঝঞ্ঝা কী প্রচন্ড করে তিরস্কার !



বিশ্বে তুমি আছ কি ঈশ্বর ?
থাকো যদি, নহ গো নিঃস্বর !
ধনী-জনে শিষ্য কর, তব বরে পায় তারা সুখ |
তাই তারা তব নামে সতত উত্সুক,
তাই তারা তোমাকেই মানে
ধ্যানে, জ্ঞানে, প্রাণে |
ফোটে ফুল
বসন্তের অন্তঃপুরে অন্ধকারে করে দুল দুল----
দরিদ্রের হৃদয়-শোণিত
গোলাপের সারা দেহ করেছে লোহিত !
কাঙালের অশ্রুনীর,
প্রমত্ত নীরধি গর্ভে বিক্ষোভেতে হয়েছে অস্থির |
বজ্র ছাড়ে উন্মত্ত ফুত্কার
বুভুক্ষু ভিক্ষুক প্রাণে যত দুঃখ রহি রহি করিছে উদ্ গার !
হিমালয়,
দীনের হৃদয় ও যে হয়ে জড় শিলাময়
নিবেদিছে অনন্তের প্রতি,
বিক্ষুব্ধ চিত্তের যত নিস্তব্ধ মিনতি !



রে হৃদয়
কেন কাঁপো---- কেন কর ভয় ?
দাহ থেকে চাহ যদি প্রাণ,
সুধা পাত্রে কত মুক্তি স্নান !
এ জগৎ ভুলে যাও,
নিরালাতে বসে বসে পিয়ালার রাঙা গান গাও আর গাও !
এ পিয়ালা গড়া কিসে নেই তার ঠিক---
মৃত্তি দিয়ে, কাব্য দিয়ে, সঙ্গীত কি রক্তাইবে ---কিম্বা এ স্ফটিক !
ভরে মোর চিত্ত-হ্রদ,
শব্দে গন্ধে স্পর্শে ওহো ! টলমল করে খালি মদ আর মদ !
দ্রাক্ষারসে নাই শুধু সুরা
ওস্তাদের সুপটু আঙুলে সুরে সুরে ঢালে সুরা তানপুরা  !
সুরা ভরা পূর্ণিমার রূপ,
সুরা ভরা প্রেয়সীর চুম্বন-প্রয়াসী কেঁপে-ওঠা মধু কন্ঠকূপ  |
মর্মবধূ হয়েছে অধীরা,
রবীন্দ্রের কাব্য গেহে পান করে সুখে-দুখে কবিত্ব মদিরা |
চারিভিতে----
বিহঙ্গের গীতে,
বনের সবুজ, ছোট তৃণফুলে, গিরি-দরী, নিবারে, সরিতে---
আছে সুরা সুরসিকে মাতাল করিতে |
গেলে উপবনে,
মনে মনে,

গন্ধময়ী সুরা ঝরে অগোচরে মত্ত করে দেয় বিশ্বজনে |
পত্র-বীণে কি মর্মর ওঠে শোনো বেজে----
শব্দময়ী সাধু সে যে !
স্পর্শময় মদ্য-ধারা সদ্য করি পান,
দেখি যবে, একখানি তনুলতা বুকে মোর নীরবে শয়ান |
পিয়ালা ভর দে মুখে হয়ে থাকি আমি মাতোয়াল |
মোর পেশা---
নেশা ভাই !  নেশা খালি নেশা !
ভুলে গেছি বিল্ কুল্ ধমনীতে আছে কত শোক, তাপ, জ্বালা !
মরণ সে ডাক দেয় কানে কানে ঘন ঘন ঘন---
ভয় তবু পাই না কখনো !
বোতলের মদে নয় রূপ মদে আমি নব ওমর খৈয়াম
মরণে জীবনে দেখি আমি ভাই, ভালো লাগে ভাই ধরাধাম |



জাগো রে মরণ-ভীত
দুঃস্বপ্নের কোলে শুয়ে কে তোরা নিদ্রিত ?
এসো গো গরিব ?
জ্বালো ফের প্রাণের প্রদীপ |
সন্ধ্যাহল ! মিছে ডাক ‘কোথা তুমি ভগবান |’
কোথা ভগবান্ ?
মরণের মহাসাগরের তীরে
ফিরে-ফিরে-ফিরে
প্রতিধ্বনি চমকিয়া জাগে ঘন ঘোর উথলায় শূন্য তার বান !
আভিজাত্য-জাঁকে স্তব্ধ জগতের চির-অধীশ্বর--
শোনো না সে কাঙালের স্বর !
আমিও গরীব বটে |
তবু মোর হৃদি-তটে
নিশিদিন সুলীলারে বহে কেন আনন্দের ঢেউ ;
জানো তা কি কেউ ?
অহরহ করি মাতলামি---
তাই সুখী আমি |
ঈশ্বরের নহি মোসাহেব | দেয় নাই ইষ্টমন্ত্র সাধনের গুরু |
নরকের ভয়ে হৃদি করেনাকো তবু দুরু-দুরু !
দামাল ছেলের মতো হেসে-খেলে নেচে গেয়ে যায় মোর কাল--
আমি যে মাতাল !
জাগরণে, স্বপনে, শয়নে,
মত্ততা যে মাখা দু-নয়নে |
আসে যদি অমা,
রূপের চাঁদিনী মেঘে বুকে মোর আছে প্রিয়তমা |
অধরে সরক---
চুমুকে চুমুকে তাই করি মুখে আনন্দ পরখ |
এ সরক গড়া কিসে নেই তার ঠিক,
মৃত্তি দিয়ে, কাব্য দিয়ে, সঙ্গীত কি রক্তাধরে কিম্বা এ স্ফটিক !



শিরে তুলি
আলক্ষ্মীর পদধূলি,
অসম কাঁদুনী-ছন্দে ক্রমাগত কেটে যায় জীবনের তাল !
ওরে-ওরে কে হবি মাতাল  ?
আয় আয় ! শুষ্ক হয় জীবনের নদ,
ঢাল্ ঢাল্ , ওরে ঢাল্ এই বেলা ঢাল তাতে পিরীতির মদ----
দুঃখ শোকে চুবাইয়া কর্ ত্বরা কভু বধ !
শোন্ -শোন্ ডাকে ইহকাল !
ধরণীর প্রাণরস দুই হাতে লুটে,
আয়------ আয় ছুটে
বিশ্বের যৌবন কুঞ্জে, ছেড়ে তোর তমিস্র পাতাল----
যে হবি মাতাল !



যেথা আছে প্রিয়া,
ঢুলুঢুলু দুটি চোখে সুরতের লাল নেশা দিয়া |
হেথা আছে সুর,
কুসুম-পরাগ-মাখা দখিনার মাদকতা দিয়ে পরিপূর !
হেথা আছে আলো,
তপনের সোমরস কন্ঠ ভরে যত পারো ঢালো আর ঢালো !
পাত্রে যদি থাকে রে আসব,
ধরা-স্বর্গে আমি যে বাসব |
মাতাল ! মাতাল !  আমি তুমি সবাই মাতাল---
পিয়ালা ভর্ দে মুখে হো হো মোরা মদের মরাল---
দুঃখ-শোকে ভাবি না করাল |
দে রে, দে রে--- একেবারে মাতাল করে দে ---
রূপ দিয়ে সুর দিয়ে পিয়ালা ভরে দে !
.                           এ পিয়ালা গড়া কিসে নেই তার ঠিক |
মৃত্তি দিয়ে, কাব্য দিয়ে, সঙ্গীত কি রক্তাধরে --- কিম্বা এ স্ফটিক !


****************   
.                                                                                                    
উপরে   


মিলনসাগর
*
.                        শ্যাম্ লা মেয়ে


.        দখিন-পাড়ার শ্যামলা মেয়ের কাজ্ লা চোখে দুষ্টু-চাওয়া |
.        বিকেল হ’লে কল্ সী কাঁকে এই পথে তার নিত্যি যাওয়া !
.                        ভোম্ রা-পেড়ে আঁচলখানি
.                        ফের্ত্তা দিয়ে মাজায় টানি,
.        ‘মাথা-ঘষা’র গন্ধেতে যায় উস্ খুসিয়ে দখিন হাওয়া-----
.                        দুই চোখে তার দুষ্টু-চাওয়া

.        স্যাঙাত্ , ও ভাই স্যাঙাত্ ! আমার আঁতের ভেতর হচ্চে কি যে !
.        কেমন করে বুঝিয়ে বলি, বুঝ্ চি কি ছাই আমিই নিজে !
.                        কলাইসুঁটি-ক্ষেতের কোণে,
.                        লুকিয়ে থাকি বাব্ লা বনে,
.        একদিন তার কামাই হ’লে চোখের জলে যাই যে ভিজে,
.                        আঁতের ভেতর হচ্ছে কি যে !


.        ঢং ক’রে সে যায় চ’লে আর মুচ্ কে হাসে, কয়না কিছু-----
.        আমি কি ভাই নই মনিষ্যি,  আমি কি ভাই এতই নীচু ?
.                        কোমর-ভাঙা চলনে তার,
.                        দ্যায় গুঁড়িয়ে বুকটা আমার,
.        সাধ যায় হায় ধর্ণা দিতে দৌড়ে গিয়ে পিছু-পিছু,
.                        ----মুচ্ কে হাসে, কয়না কিছু !


.        মলয় বাতাস ফুঁ দিয়ে এই প্রাণের ভেতর আগুন জ্বালায়,
.        মৌমাছিরা ফুলের ঠোঁটে চুমু খেয়ে উড়ে পালায় !
.                        ‘বৌ কথা কও’ বল্ চে পাখী,
.                        কাঁদ্ চে তারও আতুর আঁখি,
.        হোলীখেলার আবির জমে সূর্য্যিমামার সোনার থালায়,
.                        ----ফাগুন-বাতাস আগুন জ্বালায় |


.        আজ্ কে আমি গাঁথ্ চি মালা, বুক বেঁধে ভয়-ভাবনা ভুলে !
.        যা-হয় হবে !---- কইব কথা, আস্ বে যখন নদীর কূলে |
.                        মুখ তুলে তার চোখে চেয়ে
.                        বল্ ব আমি-----“শ্যাম্ লা মেয়ে !
.        মোর মালাটি নেবে কি ভাই, রাখ্ বে তোমার খোঁপায় তুলে ?”
.                        গাঁথ্ চি মালা  বনের ফুলে |


.                                    ****************   
.                                                                                                
উপরে   


মিলনসাগর
*
.                কয়েদী


বনের বাঘা, বনের বাঘা !  খাঁচায় পূরে বাঁধলে কে  ?
চিড়িয়াখানায় সঙ্ সাজিয়ে,  সুখেতে বাদ সাধলে কে ?
জুল্ জুলিয়ে দেখচে চেয়ে,  হাততালি দেয় ছেলেমেয়ে,
নল্ খাগ্ ড়ার দোদুল বনে নিঠুর ফাঁদ সে ফাঁদ্ লে কে ?

বাঘা ছিল বনের দুলাল,---------মাথায় ছিল নীলাকাশ,
থাবার তলায় কাঁটাও ছিল,------ছিল নরম দুর্বাঘাস !
রাতদুপুরে নদীর তটে, মরণধ্রুপদ কন্ঠে রটে,
উঠ্ ত পড়্ ত ছুট্ ত উধাও, ফেল্ ত  হু--হু ঝোড়ো শ্বাস !

আজ্ কে দেখি কুলুপ দেওয়া খাঁচাটার ঐ তিন দোরে,
কোটর-গত চক্ষু দুটো,  উদর অস্থি-লীন ওরে !
নেইকো খোলা মাঠের বাতাস, নেই আকাশের অসীম আভাস,
আছে শুধুই অন্ধকার আর  গতির বাধা পিঞ্জরে !

সোঁদর-বনের সবুজ-স্বপন ভোলেনি ও ভোলেনি !
চুপটি ক’রে আছে,--- কারণ খাঁচার দুয়ার খোলেনি |
বনের কথাই মনের কথা, ভাবচে এবং পাচ্ছে ব্যথা,----
দেখচে চেয়ে ,----ঝড়ের ঠাকুর মেঘের নিশান তোলেনি !

উঠ্ বে জ্বলে’ চোখ-দুটো ওর--- যে চোখ এখন ঘোলাটে,
ঝল্ বে যেদিন আগুন-ত্রিশূল কালো মেঘের ললাটে !
খাঁচার মালিক শুন্ বে তখন বাঘার গলায় বাজের বচন |
হাঁকবে যেদিন পাগ্ লা ঝোড়ো,--- ভাঙবে লোহার কবাটে,
--- বনের বাঘা ভুল্ বে দাগা, রইবে না চোখ ঘোলাটে |


.                                    ****************   
.                                                                                                
উপরে   


মিলনসাগর