কবি হুমায়ুন কবীরের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
ভারতবর্ষ
কবি হুমায়ুন কবীর  

ক্ষান্ত করো অতীতের পুরাতন অতীতের কথা ;
সো কাহিনী আরবার শুনিবার নাহি কোনো সাধ |
স্মৃতি তার আজ শুধু চিত্ত ভরি জাগায় তিক্ততা
ক্রূর কণ্ঠে বর্তমান তারে শুধু দেয় অপবাদ |
সুদূর অতীতে যদি আমাদের পূর্বপুরুষেরা
ভূবনে রচিয়া থাকে সভ্যতার নব-ইতিহাস,
বঞ্চিত ক্ষুধিত এই দাসত্বের অপমানে ঘেরা
মোদের জীবনে মেলে স্বপ্নেও কি তাহার আভাস
সে-কাহিনী মিথ্যা আজি | মিথ্যা তারে করেছি আমরা |
যে-ঐশ্বর্য ছিল সেথা তারে মোরা করিয়াছি ক্ষয়
আমাদের জীবনের দৈন্য দিয়া তীব্র ক্ষুধা দিয়া |
আপন পৌরুষ দিয়া যদি পারি করিবারে জয়
সে-গৌরব পুনর্বার অন্তরের অনলে দহিয়া
রচিব ভারতবর্ষ মানবের স্বপ্নের আমরা |

.                    *****************

.                                                                              
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
সনেট ১
কবি হুমায়ুন কবীর

যে শান্তি গৃহের কোণে স্নেহ স্নিগ্ধ ছায়া
মেলি' রচে ধরাতলে অমরার মায়া,
পরিজন প্রীতিপুষ্প অম্লান সৌরভে
ভরি' দেয় এ-জীবন আনন্দ-গৌরবে,
দিন হ'তে দিনান্তের অনাহত গতি
নীরবে তটিনী-সম খোঁজে পরিণতি
অন্তহীন প্রশান্ত সে কোন সিন্ধুবুকে---,
সে নহে আমার লাগি' |
                  নিয়ত সম্মুখে
বৈশাখ ঝটিকা যবে দুর্নিবার বেগে
বারি-বজ্র-অগ্নিগর্ভ ঘনকৃষ্ণ মেঘে
হেলায় ভাসায়ে চলে --- আসন্ন ঝটিকা
বক্ষে করি' তবু জ্বলে যেই দীপশিখা
তারি চিত্তে শঙ্কাকুল সেই শান্তি-সম
শান্তিতে ভরিয়া যাক এ জীবন মম |

.                *****************

.                                                                              
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
সনেট ২
কবি হুমায়ুন কবীর

শুনিনু নিদ্রার ঘোরে অযোধ্যার নাম |
হেরিলাম স্বর্ণপুরী | পথে-পথে তার
শত-শত নরনারী কাঁদে অবিরাম,
আর্তকণ্ঠে নভোতলে ওঠে হাহাকার |
তরুণ দেবতা সম কিশোর কুমার
যৌবনে সন্ন্যাসী সাজি' চলিয়াছে বনে,---
সীতার বিরহ-ভয়ে পুরী অন্ধকার,
গগন শ্বসিয়া ওঠে নিরুদ্ধ ক্রন্দনে |
চমকি' উঠিনু জাগি' | তপ্ত নিদাঘের
মূর্ছিত ভূবন ভরি' রৌদ্রানল জ্বলে |
স্টেশন-অঙ্গনে ডাকে গ্রীষ্মাতুর স্বরে
অযোধ্যার নাম | ধূসর ধূলির 'পরে
বসে আছে বানরের দল | দূরে ঝলে
সূর্যালোকে স্বর্ণচূড়া ভগ্ন মন্দিরের |

.                    *****************

.                                                                              
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
জন্ম  
কবি হুমায়ুন কবীর

কেন জন্ম হলো মম তাই বসি ভাবি আজি মনে |
ফাল্গুন-উতলা-প্রাতে পুষ্প সম কেন অকারণে
উঠেছিনু ফুটি মম জননীর কোলে ? দুঃখে সুখে
দিবস-রজনী শুধু অনিবার চলেছি সম্মুখে |
প্রভাত-আলোক আজি অন্ধকার মেঘের মালায় |
বহিছে উত্তর বায়ু, সঙ্গীহীন এ বন্দীশালায়
কে নিষ্ঠুর ফেলেছিল টানি অসহায় শিশুটিরে টানি
কিসের লাগিয়া ? ধরণী ধূলিতলে শির হানি
শুধাই উত্তর তার | কেহ কিছু কহেনা ক আসি,
কঠিন পাষাণে লাগি ফিরে আসে তিক্ত অশ্রুরাশি,
না বুঝিয়া ব্যথা-ভরে কেঁদে ওঠে সারা দেহমন |
জীবনে আঁধার নামে, নিভে যায় আকাশ-তপন |
কেন জন্ম লভেছিনু নাহি জানি, শুধু জানি মনে
ডন্মিতে চাহিনি কভু | কেন অনাদরে অকারণে
ধরাতলে বিকশিল জীবন আমার ? অর্থ খুঁজি
চিত্ত মম পরিশ্রান্ত | তবু জানি, বুঝি নাহি বুঝি,
আমারে চলিতে হবে দিবানিশি সমুখের পানে |
অনন্ত আঁধার ভেদি কোথা কোন আলোর সন্ধানে |
আলো কি কোথাও আছে ? তাহা নাহি জানে হিয়া মোর |
শুধু জানি চারিদিকে অন্ধকারে বহে অশ্রুলোর,---
দারিদ্র্য যাতনা রাশি, ক্ষুধিতের ক্ষুধার বেদনা,
বঞ্চিতের ক্ষুব্ ধ  রোষ, অন্যায়ের পুঞ্জ-আবর্জনা
জমিয়াছে যুগে-যুগে | এই মৃত্যু নরকের মাঝে
স্বরগ আনিতে হবে, যে স্বপন-স্বরগ বিরাজে
সকল জাগ্রত্-স্বপ্ন | সেই স্বর্গ কভু কি আসিবে
তিমির-রজনী-শেষে পূর্বাচলে অরুণ হাসিবে ?

.                    *****************

.                                                                              
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
সঙ্গিনী  
কবি হুমায়ুন কবীর

রজনী ভরিয়া তোমারে ঘেরিয়া স্বপন গাঁথি
  প্রভাতে যখন নয়ন মেলিয়া উঠিনু আজি
দেখিনু ভূবন ভরিয়া আলোক উঠেছে মাতি
  শিশিরসিক্ত ভূবন কিরণ-বসনে সাজি |
সহসা আমার মুগ্ধ নয়নে লাগিল ভালো
  নবপল্লবে হরিত মাধুরী, সোনার আলো !
তোমার প্রেমের পরশমানিক কেমন করি
  অন্ধ আমার আঁখি পল্লবে ছোঁয়ালে আসি,
নিমিষে আমার পরাণ উঠিল আলোকে ভরি'
  নিমেষে ভূবন নয়নে আমার উঠিল হাসি !
জীবনের যত ঝরা-ছেঁড়া-পাতা শীতের শেষে
  বাহিরে আসিল নবীন আলোকে নবীন বেশে |
যে পথে আঁধারে শিহরি উঠেছি একেলা ডরে
  যে পথে দেখেছি সাঁঝের আড়ালে মরণ নাচে,
সে পথ ভরিয়া তোমার হাসির কিরণ ঝরে
  সে পথের পাশে ঝরে-পড়া ফুল আবার বাঁচে !
মরণ তোমার পরশে উঠিল জীবনে ভরি'
তোমারে লভিয়া নির্ভয় চিতে ভাসানু তরী !
সংসার পথে যত কোলাহল সবারি মাঝে
  নীরব হৃদয় ভরিয়া শুনিব তোমার বাণী
দাঁড়াইবে পাশে বিঘ্ন-বিপদে সকল কাজে
  স্বপনে আমার শয়ন রচিবে মানস-রাণী
সঙ্গিনী মোর, স্বপ্নের সাথী, কাজের ভাগী
দিবস রজনী জীবনে আমার রহিবে জাগি !

.                    *****************

.                                                                              
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
রবীন্দ্রনাথ
কবি হুমায়ুন কবীর

পুরবে পশ্চিমে আজি অগ্নিগর্ভ জলদ নির্ঘোষে
ধ্বনি উঠে সাবধানবাণী | পুঞ্জীভূত অপমান,
যুগান্তসঞ্চিত ব্যথা, অন্যায়, দারিদ্র্য, অকল্যাণ
ভস্ম করিবারে জ্বলে বহ্নিকুন্ড প্রলয়প্রদোষে  |
তবু প্রশ্ন জাগে মনে নির্দোষী সে অপরের দোষে
সহিবে নিষ্ঠুর শাস্তি ? কার হেন অদৃশ্য বিধান
নির্বিচারে মৃত্যু হানে নরনারী মাসুম সন্তান,
পর্বত কেন্দ্রিত পৃথ্বী-টলি উঠে কার অসন্তোষে ?
অন্তর্দ্বন্দ্ব কন্টকিত সংশয়ের দিনে
নবীন আশ্বাসবাণী তব কন্ঠে ধ্বনিবে না আর ?
তোমার নির্দেশ দীর্ঘ সংগ্রামের পথে বারংবার
আনিয়াছে নবীন প্রেরণা | আজি যুগ-সন্ধিক্ষণে
তুমি নাই | বঞ্চিত বুভুক্ষু  রিক্ত-নিঃস্ব ভাগ্যহীনে
কার কন্ঠ দিবে ডাক মুক্তিপথে দুর্বার প্লাবনে ?

.                    *****************

.                                                                              
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
.                                                        তরুন
.                                                                                             কবি হুমায়ুন কবীর

.                                                        আজি দিকে দিকে আগুন উঠেছে জ্বলি’
.                                                                সুখ সভ্যতা পুড়ে হ’ল ছারখার    |
.                                                         নিষ্ঠুর -পদে মানুষের আশা দলি’
.                                                                  অন্ধ আবেগে চলিছে অত্যাচার  |
.                                                         কোথা নির্ভীক সাহসী তরুন মন,
.                                                         নেভাবে আগুন কোথা তব আয়োজন ?

.                                        দুগ্ধ-পোস্য শিশু জননীর কোলে,
.                                              আকাশ হইতে হানিছে মরণ তারে  |
.                                        মহা-সমুদ্রে ক্ষুদ্র তরণী দোলে
.                                               সমাধি খুঁজিছে সে লবন-পারাবারে  ?
.                                        কোথায় তরুণ স্বপ্নে নয়ন ভরা
.                                        হিংসা-নরক হইতে বাঁচাবে ধরা  ?

.                    তিলে-তিলে দহি’ ক্ষুধার অন্ন লাগি’
.                        চাষী সম্পদ রচে অপরের তরে |
.                  ধনীর রজনী বিলাস-লীলায় জাগি’
.                        ক্ষুধিত চাষীর বরষায় ভেজা ঘরে  |
.                   তরুণ  ন্যায়ের দন্ড বহিয়া আনো
.                   অত্যাচারের দানবে মৃত্যু হানো |


.                                         *****************

.                                                                                                   
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
আকবর
কবি হুমায়ুন কবীর

হে সম্রাট বসে আছি তব সমাধির পাশে,
একান্ত বিজন।
দূর হতে অর্ণ্যের অন্ধকার ভেদি’ ভেসে আসে
বিহগ কূজন।

নীরব মধ্যাহ্ন-বেলা, শব্দহীন নিঃসাড় ভূবন,
কেহ কোথা নাই ;
অকস্মাৎ মর্মরিল তরুশাখে মন্থর পবন---
চমকিয়া চাই।

জীবনের গতি হেথা আসিয়াছে মন্দ হ’য়ে ধীরে,
নাহিক স্পন্দন ;
বন্দী হয়ে কেঁদে ফিরে সমাধির পাষাণ প্রাচীরে
স্মৃতির ক্রন্দন।

কত দিবসের ব্যথা, জীবনে আবেগ উত্তাল
গিয়াছে নিভিয়া ;
স্মৃতির কন্দরে-মম শতাব্দীর অন্ধকার জাল
উঠে শিহরিয়া!

তোমার হৃদয় ভরি’ জেগেছিল কি মহা স্পন্দন!---
এ ভারত-ভূমি,
এক ধর্ম, এক রাজ্য, এক জাতি, একনিষ্ঠ মন,---
বেঁধে দিবে তুমি!

সমাজ আচার ভেদ, ধর্মভেদ ভুলে যাবে সবে ;
রহিবে স্মরণ---
এক মহাদেশে বাস, চিরদিন একসাথে হবে
জীবন-মরণ!

হায়! স্বপ্ন টুটে যায় কঠিন ধরার ধূলা লাগি’,
দেখি আঁখি মেলি’---
ক্রূর সর্পসম হিংসা হিয়া-তলে রহিয়াছে জাগি’,
উঠিছে উদ্বেলি’।

বিদ্বেষ সমুদ্রসম আস্ফালিয়া করিছে গর্জন
ছাইয়া হৃদয় ;
নীরব আকাশ-তলে প্রতি পলে বাজিছে ক্রন্দন,
রক্তধারা বয়!

ধরণীর শ্যাম শোভা ক্লিষ্ট আজি রক্তের ধারায়,
ভায়ের শোণিতে ;
আকাশের শান্ত সৌম্য নীরবতা শুধু ভেঙে যায়
সংগ্রাম ধ্বনিতে।

স্বার্থে স্বার্থে দ্বন্দ্ব লাগে, রক্ত ঝরি’ পড়ে অহর্নিশ,
উঠে শূণ্য-পানে
ক্রন্দন গর্জন রোল, অভিশাপ হাহাকার মিশি’,
কাহার সন্ধানে ?

তোমার সমাধি-পাশে বসি’ আজি পড়ে মোর মনে
তোমার কীরিতি ;
নিখিল ভারত ভরি’ উঠেছিল ধ্বনিয়া গগনে
মিলনের গীতি!

তোমার মহৎ হিয়া পুনর্বার আসুক ফিরিয়া
আমাদের মাঝে ;
আত্মদ্বন্দ্ব-সর্বনাশ আমাদের রেখেছে ঘিরিয়া
অপমানে লাজে!

হে মহৎ তব বাণী নিখিল ভারত ভরি’ আজি
জাগুক আবার ;
উঠুক মিলনমন্ত্র সম্যবাদ কম্বুকণ্ঠে বাজি’
টুটিয়া আঁধার!

হিংসা-দ্বেষ-মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতো-শঙ্কাভরে
হোক্ শান্ত হোক্,
আঁধারের প্রাণী যত ফিরে যাক্ আঁধার বিবরে,
নামুক আলোক।

.                    *****************                    

.                                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
একদিন
কবি হুমায়ুন কবীর
আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পাদিত পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা কাব্য সংকলন
(এপ্রিল ১৯৪৬) থেকে নেওয়া।

.                    *****************                    

.                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
আমি যারে ভালোবাসি
কবি হুমায়ুন কবীর
আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পাদিত পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা কাব্য সংকলন
(এপ্রিল ১৯৪৬) থেকে নেওয়া।

.                              *****************                    

.                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর