পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতা |
. ************************* . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
কবর এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। |
তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দু হাতে জড়ায়ে ধরি, তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিন-মান ভরি। গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে, ফাল্গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো মাঠখানি ভরে। পথ দিয়ে যেতে গেঁয়ো-পথিকেরা মুছিয়া যাইতো চোখ, চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক। আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি, হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি। গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা, চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ। উদাসিনী সেই পল্লীবালার নয়নের জল বুঝি, কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি। তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ, হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বীষের তাজ। মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, 'বাছারে যাই, বড় ব্যথা রল দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই; দুলাল আমার, দাদু রে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে, কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।' ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গণ্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে, কি জানি আশিস্ করি গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে। ক্ষণ পরে মোরে ডাকিয়া কহিল, 'আমার কবর গায়, স্বামীর মাথার 'মাথাল' খানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।' সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে, পরানের ব্যথা মরে না কো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। জোড়-মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়, গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়ে। জোনাকি মেয়েরা সারা রাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো, ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নুপুর কত যেন বেসে ভাল। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,'রহমান খোদা, আয়, ভেস্ত নাজেল করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়ে।' এইখানে তোর বু-জীর কবর, পরীর মতন মেয়ে, বিয়ে দিয়েছিনু কাজীদের ঘরে বনিয়াদী ঘর পেয়ে। এত আদরের বু-জীরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে। হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে। খবরের পর খবর পাঠাত, 'দাদু যেন কাল এসে, দু দিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে। শ্বশুর তাহার কসাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে, অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে। সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে, ফোটে না সেথায় হাসি, কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিত ভাসি। বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন, কে জানিত হায়, তাহারও পরানে বাজিবে মরণ-বীণ! কি জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে, এইখানে তারে কবর দিয়াছি দেখে যাও দাদু ধীরে। ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেউ ভাল, কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো। বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন, পাতায় পাতায় কেঁপে ওঠে যেন তারি বেদনার বীণ। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,'আয় খোদা দয়াময়!। আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়।' হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু সাত বছরের মেয়ে, রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে। ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কি জানি ভাবিত সদা, অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা। ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে, তোমার দাদীর মুখখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে। বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা, রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা। একদিন গেনু গজ্নার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে, ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে। সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে, |