কবি জীবনাথ রায়চৌধুরীর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
.                গান
( গ্রামের হাতে -লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত শৈশবের লেখা কবিতা )


কে রচিল তোরে গান                সৃষ্টির মহান দান
.               আকুল করিতে মন হিয়া |

ভাব ও ছন্দের তালে                মনকথা সাজাইলে
.               কাব্য হয় কে দেখালে রচিয়া |

সুরে সুরে বেঁধে তারে                কে প্রথম মিষ্ট স্বরে
.                প্রাণ খোলা গেয়ে গেল গান |

অজ্ঞাত সে শিল্পী তরে                কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে
.                 আনন্দে নাচিয়া উঠি প্রাণ |

গান তুই কোথা হোতে                এলি হেথা কার সাথে
.                 কোথা তোর আদি জন্মভূমি |

কাহার সুমিষ্ট গলে                     প্রথম আশ্রয় নিলে
.                কে আদরে নিল তোরে চুমি | |


                             

.                ****************                                                             
উপরে   



মিলনসাগর
*
পয়লা বৈশাখ

পয়লা বৈশাখ ! পয়লা বৈশাখ !
আজ পড়েছ এ কি পোষাক !
প্রভাত-ফেরির গান কৈ ?
ফুটি, তরমুজ, ছাতু খৈ ?
দিন এখন পালটে গেছে !
খৃষ্টাব্দ জাল ফেলেছে !
জগৎ জুড়ে তারই দাপট |
বাংলা তারিখ দে চম্পট |
Happy New Year এখন বলি |
বদলে গেছে মুখের বুলি |
মাতৃ-ভাষা ভুলে গিয়ে
বিশ্বপ্রেমের দোহাই দিয়ে
হয়েছি সব নব্য যুবা |
গেঁয়ো মোদের বলবে কেবা ?
ধুতি চাদর ছেড়ে দিচ্ছি |
দেখতে কেমন বিতি কিচ্ছি|
কোট প্যান্ট তাইতো পড়ি
গলায় মোদের কন্ঠ-দড়ি |
ময়ুর-পুচ্ছ দাঁড়কাক
এখনো কিছু আছে ফারাক |
মাছ ভাত মোদের প্রিয় |
ছানার মিষ্টি পাও তো দিয়ো
ময়র-পুচ্ছ যখন হব
তখন প্যাটিস্ কেক্ খাব |
মুখে মুখে ইংরাজী কব
পুরো-পুরি সাহেব হব |


.                ****************                                                             
উপরে   



মিলনসাগর
*
শীতল

রৌদ্র তাপে শীতল ছায়া বড়ই মধুময় |
শ্রান্ত দেহ শীতল পাটির শয্যা নিতে চায় |
ঘর্মাক্ত দেহ বলে “শীতল পাখা আনতো”
মায়ের শীতল কোলে শিশু কান্না ছেড়ে শান্ত |
শীতল তাকে থাকে থাকে মন্ডা মিঠাই সাজায় |
গাছের শীতল ছায়ায় বসে রাখাল বাঁশী বাজায় |
শীতল জলে স্নানে পাই গ্রীষ্ম কালে আরাম |
ঘরের হাওয়া শীতল করে ধনবানের বিরাম |
আপনজনের শীতল স্পর্শ চাহে দেহ ক্লান্ত |
শীতল মরণ করতে পারে মনের জ্বালা শান্ত |
তাইতো তোমায় ডাকি মরণ বন্ধুরূপে এসো,
শীতল দেহের পাশে এসে একটু খানি বসো ||


.                ****************                                                             
উপরে   



মিলনসাগর
*
সাথী

যাদের আমি দিলাম সবই
.                  তারাই করে বঞ্চনা |
যাদের থেকে মুখ ফিরানু
.                  তারাই আমার সান্ত্বনা |
যাদের উপর ভরসা করে
ভাসাই তরী নদীর পরে
ডুবলে তরী আমার কাছে সে তো আর রইল না |


হারিয়ে সব রিক্ত আমি
.                    মন যেন রয় শক্ত অতি |
ঝড়ের রাতে সাবধানেতে
.                    নিবতে যেন না দেই বাতি |
নূতন করে স্বপ্ন মাখা
শান্তি দূত দেবে দেখা |
সেই তো হবে এ জীবনের নূতন চেনা মোর সাথী |


.                ****************                                                             
উপরে   



মিলনসাগর
*
মূল্য বিচার

মূল্য নিয়ে মারামারি মূল্য কোথায় আছে ?
মূল্য আছে টাকার মাপে বৈষয়িকের কাছে |
শিশুর কাছে দুই পয়সার পুতুল মূল্যবান |
গবেষকের টেষ্ট টিউব, অনেক তার দাম |
ছাত্র বলে কলেজ নোট অনেক দাম ভাই |
বই তো তবু কিনতে পারি, নোটটি কোথায় পাই !
পুরুত ভাবে দামী পুঁথি হারিয়ে ফেলি পাছে |
দাঁড়ি-পাল্লার অনেক মূল্য দোকানদারের কাছে |
দুটি আনার ডেইলি নিউজ’ সামান্য তো জিনিস |
রাজনীতিক বলবে এসে “ওর কত দাম জানিস” ?
প্রাচীন টেরাকোটার মূল্য ঐতিহাসিক দেয় |
ময়লা কাগজ দামী বলে তাও কুড়িয়ে নেয় |
আসল দামী বলব আমি অনেক ভেবে চিনতে
চিরকালের বাঞ্ছিত ধন যায়না পাওয়া কিনতে |
স্নেহ প্রীতি ভালবাসা সবাই পেতে চাই |
টাকার মূল্যে পাইনা এসব, অমূল্য যে তাই ||


.                ****************                                                             
উপরে   



মিলনসাগর
*
আমার দেখা রূপা

আনন্দমাখা উচ্ছল প্রাণ এনেছিলে সাথে করে |
স্বল্প আয়ুর জীবনে তা তুমি বিলায়েছ ঘরে ঘরে |
তোমার আলয়ে আসন পেতেছে জ্ঞানী, গুনি, প্রিয়জন,
দিয়েছ তাদের হৃদয় সিক্ত সৌম্য আপ্যায়ন |
সঙ্গীতময় ছিলে তুমি নিজে, সঙ্গীতে ভরা গৃহ |
আত্মীয়জনে বেঁধেছ সে সুরে, পিছে পড়ে নাই কেহ |
মা-হারা শিশু মাকে খুঁজে পেল তোমার কোলের মাঝে,
নির্ভয় স্থান স্বামী-হারা পেল তোমার বুকের কাছে |
সুরুচি সভার তুমি একজন সদস্য ছিলে তাই,
গৃহ-শোভা আর পুষ্প কাননে তার স্পর্শ যে পাই |
আত্মীয়সম দেখেছ সবারে তব প্রতিবেশী যত,
সবাকারে নিয়ে উত্সব সভা করেছ যে তুমি কত |
পাবনা তোমায় বর্ষামঙ্গলে, নববর্ষের দিনে
বাণীবন্দনা ম্লান হয়ে রবে তোমার স্পর্শ বিনে,
প্রেমের বাঁধনে বেঁধেছ যাহারে সেই সে জীবন সাথী,
স্মৃতির মাঝারে খুঁজিছে তোমারে জেগে বিনিদ্র রাতি,
মরদেহে আর পাবনা তোমায়, ধন্য স্বর্গভূমি
ছবির মাঝারে অমরতা লভি স্থির হয়ে রবে তুমি | |


.                ****************                                                             
উপরে   



মিলনসাগর
*
আমার মন

আমার দেহের পাঁচটি ইন্দ্রিয়
প্রকাশ্য থেকে আমার সেবা করছে
আজ্ঞাবহ ভৃত্যের মত |
এছাড়া আরও একটি ইন্দ্রিয় আছে
আমার দেহের মধ্যে লুকিয়ে
সে আমার মন |
তাকে চোখে দেখা যায়না,
স্পর্শে অনুভব করা যায়না |
আধুনিক যন্ত্র তার অস্তিত্ব সন্ধানে ব্যর্থ |
তবু সে আছে এই দেহের মধ্যে |

মনের জোর বলে লোকে যাকে চেনে
তাতে জানতে পারি
এই মনের শক্তি নাকি প্রচন্ড |
প্রচন্ড এই শক্তি দিয়ে অসাধ্য সাধন সম্ভব |
মনকে সুস্থ সজীব রাখলে নাকি,
অসুখবিসুখ থেকে পাওয়া যায় পরিত্রাণ----
নইলে,
আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় হয় বিকল |
নানা ব্যাধি অধিকার করে দেহটিকে |

কিন্তু বড় অবাধ্য আমার মন |
ছেলেবেলায় কতবার ভেবেছি
ভাল করে পড়াশুনা করব,
সবার থেকে ভাল রেজাল্ট করব |
কথা শোনেনি আমার মন |
বই থেকে উঠে পালিয়ে গেছে খেলার মাঠে |
কতবার প্রতিজ্ঞা করেছি
কারো সঙ্গে বিবাদ করবনা |
মন সে কথাও রাখেনি |
অসুস্থ হলে ডাক্তার বলেছেন----
মনকে শান্ত রাখবেন |
কিন্তু অস্থির হয়ে ওঠে আমার মন,
কারণে, অকারণে |

মাঝে মাঝে তাই প্রশ্ন জাগে,
আমার দেহের মধ্যে বাস করলেও
এই মনটি কি সত্যি আমার ?


.                ****************                                                             
উপরে    



মিলনসাগর
*
স্বাধীনতা দিবস

নেমেছে পাষান উড়িছে নিশান শৃঙ্খল গেছে ছিঁড়ে |
হাসি কলতান বন্দনা গান করিছে মায়েরে ঘিরে |
মুক্ত আকাশ মুক্ত বাতাস, মুক্ত মোদের মন
মুক্তির বাঁশী বাজায়েছে আজ মুক্ত বৃন্দাবন |
মার অভিষেকে আসি একে একে মিলিল যে সব প্রাণ,
তাহাদের স্মরি প্রাণমন ভরি গাহি আজ জয়গান |
স্বাধীন আকাশ দেখ হে সুভাষ কদম কদম বাড়ায়ে |
ত্রিরঙ্গা পতাকা আকাশেতে আঁকা মেঘের নিশান ছাড়ায়ে |
দেখ সূর্য্যসেন সমুদ্র সফেন লহরী তুলিয়া নাচে
মায়ের চরণ করিয়া বরণ রাখিল বক্ষ মাঝে |
অলক্ষ্যে দাঁড়ায়ে লাজপত রায়, তিলক, ভগৎ সিং,
বিনয়, বাদল, দিনেশের দল দাঁড়ায়েছে কায়াহীন |
ক্ষুদিরাম আজ পরি নব সাজ গাহিতেছে জয়গান,
ফাঁসির মঞ্চ যেন মালঞ্চ কোকিল ধরিছে তান |
টিপু সুলতান হয়ে আগুয়ান বাঁচাতে পারেনি যারে,
সেই স্বাধীনতা আজ হাসে হেথা এস তুমি ত্বরা করে |
বৃক্ষ কান্ডে মঙ্গল পান্ডে দিল প্রাণ খুসি মনে |
স্বাধীন সিপাই গর্বিত সবাই ডাকে তোমা জনে জনে |
বিশ্ব কবি সনে বিদ্রোহী কবি রচিল কাব্য গাথা |
বড় সাধ মনে এই শুভক্ষণে একবার দাও দেখা |
প্রাণ মন ভরি সকলেরে স্মরি আজ এই শুভ ক্ষণে
আনন্দ গান হবে ম্রিয়মান তোমা সবাকার বিনে |


.                ****************                                                             
উপরে    



মিলনসাগর
*
ছোট্ট শিশু রেখার মৃত্যুতে

মরণ তোকে ডাক দিয়েছে পরপারের আকাশ থেকে |
আধার কালো তাই নামিল ঘন গভীর বজ্র হেঁকে |
বাতাস বুঝি থেমে গেছে নাইকো পাতার শিহরণ |
মেঘের কোলে কে করিছে রক্তচোখে বিচরণ |
দিনের রবি ভয় পেয়েছে, উঠল না তো মাথার পর,
নিঠুর মরণ করছে হরণ ধরার ছোট্ট কোমল কর |

ঝন ঝন ঝন ছিঁড়ে গেল ঐ ধরার যত স্নেহের টান
শৃঙ্খল তার ব্যর্থ এবার রাখিতে সরল শিশুর প্রাণ |

রাত ভোর হল কেটে গেল নিশি ছিঁড়ে গেল যত মায়ার ডোর
পিছে রেখে দিয়ে স্নেহ চুম্বন কল্পনা মাখা স্বপন ঘোর |
কল্ কল্ কল্ ছল্ ছল্ ছল্ বৈতরণী জলে টল্ মল্
হেলিয়া দুলিয়া লহরী ভাঙিয়া ছাড়ি যায় তরী এই ধরাতল |
তরী ধীরে চলে দাঁড়ী গান গাহে পিছে পিছে তার ‘রেখা’ |
ঢেউএর আঘাতে ক্রমে যায় মুছে আর যাবে নাকো দেখা |


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
আমাদের আশুদা

সবার মাঝে যখন তুমি
.                স্বভাবসিদ্ধ তোমার ভাবে
খুশীর হাওয়া ছড়িয়ে দিয়ে
.                নিজেও ভাস খুশীর ভাবে |


কৃষ্ণচুড়ার ছাযার নীচে
.                তাইতো দেখি রোজ প্রভাতে
হাসিমুখে আস তুমি
.                আনন্দেরই এই সভাতে |


তোমায় আর পাব নাকো
.                এ কথা ভাবতে নারি
একি কখন হ’তে পারে
.                সবার সঙ্গে দেবে আড়ি ?


আশ্বিনেতে কাশের বন
.                তোমার হাসি নিয়ে হাসে |
শিউলি ফুলের গন্ধ যেমন
.                ভেসে বেড়ায় সাঁঝ বাতাসে |


ঢাকের বাদ্যি মোদের মনে
.                খুশীর ঝিলিক ছড়ায় যখন
সেই খুশীতে আমরা দেখি
.                মোদের মাঝে তোমার আসন |
এ অঘটন হয় কি কখন
.                আশুদা নেই পূজার মাঝে,
নিত্য যাকে পাই আমরা
.                আনন্দেরই সকাল সাঁঝে |


মায়ের পায়ের তলায় নিলে
.                চিরকালের আসনটিরে |
সবার কাছে বিদায় নিলে
.                যাদের দেক আপন করে |


“কাউকে কষ্ট দিই না যেন”
.                এই তো ছিল তোমার সাধ
যাবার আগে মিটিয়ে গেলে
.                মনের কোণে সে আহ্লাদ |


আশুতোষ দত্ত , জি--১৩৯৮ চিত্তরঞ্জন পার্ক, মর্নিং ক্লাবের অন্যতম সদস্য | গত ২৪-৯-৯৫ মহালয়ার দিন মর্নিং
ক্লাবের সদস্যদের আপ্যায়ণ কালে মায়ের মন্দিরের নীচে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন |


.                ****************                                                             উপরে     



মিলনসাগর
*
আমাদের বর্ষা

বর্ষা  বর্ষা  বর্ষা
আমার বর্ষা গীতবিতানের প্রাচীর ঘেরা বর্ষামঙ্গলের ব্যঞ্জনা নয় |
কিম্বা, বৃষ্টির ছন্দে মনের আনন্দে মেঘ আকাশ ও বনানীর বন্দনা নয় |

আমার বর্ষা মধুর স্মৃতির মোড়কে ঝঞ্ঝা, তান্ডব ও প্রলয়ের বর্ষা |
নিঝুম রাতে জল পড়া পাতা নড়ার শব্দে কম্পিত হৃদয়ের বর্ষা |
আমার বর্ষা টিনের চালে দামাল ছেলের অবিরাম নাচের ছন্দ |
আউষ ডাঁটা, চিংড়ি মাছ, কাঁঠাল বিচি আর খিচুরির গন্ধ |
কাঁথা গায়ে শুয়ে ফুটো ছাদ থেকে টিনের পাত্রে জল পড়ার স্মৃতি |
আর অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে গোয়াল ঘরে বন্দী ধবলির করুণ মিনতি |
আমার বর্ষাঅনাহার, অর্দ্ধাহার, রোগক্লিষ্ট দেহে ম্যালেরিয়ার কম্পন |
ভরা গাঙ্গের স্রোত, ঝুপ্ ঝাপ্ শব্দ আর স্বজন হারানোর ক্রন্দন |

তবু চিরতরে হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার স্মৃতি মনকে দেয় নাড়া |
বিদ্যুতের ঝিলিক মিশিয়ে হৃদয়ের চোখে নেমে আসে শ্রাবণের ধারা ||

.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
তুমি দেশবন্ধু

কলি যুগের হরিশচন্দ্র চিত্তরঞ্জন দাশ,
স্বদেশের তুমি প্রকৃত বন্ধু, জনতার আশ্বাস |
পেশার জগতে ছিলে সম্রাট, লভিলে রাজার ধন,
দেশহিত তরে সে সব বিলাল উচ্চ তোমার মন |
পিতৃবন্ধুর ঋণভার নিলে স্বেচ্ছায় নিজ শিরে |
দেশের সেবায় হ’লে আগুয়ান, দেখনি পিছনে ফিরে |
মুক্ত করিলে অরবিন্দে আলিপুর মামলায়,
পাশে ছিলে তুমি তাহাদের যারা দেশপ্রেমে নির্ভয় |
‘স্বরাজ দল’ ‘অনুশীলন’ ‘পার্টি’ মাসিক ‘বন্দেমাতরম্’
সবার মাঝারে তোমাকে দেখেছি ‘দেশবন্ধু’ তাই নাম |
স্বদেশ আত্মার বাণীমূর্তি তুমি, কে করে অস্বীকার !
কবিগুরু তাই তোমাকে জানাল তাঁহার নমস্কার |
সাহিত্যমন তোমার আপন রচিলে কাব্য গাথা,
বিষাদের দিনে আপনার মনে নীরবে জানালে ব্যথা |
দেশের আঙ্গিনা জানিনা জানিনা কেন এত ধোঁয়াময় |
নেতৃবিহীন এই দুর্দিন  তোমাপানে চেয়ে রয় |


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
মর্ণিং ক্লাব

জগৎ যখন ঘুমের  থেকে প্রথম জেগে চায়,
আঁধার যখন হাল্কা হয়ে আলোতে মিলায় |

পাখী যখন কুলায় জেগে কিচির মিচির ডাকে,
কুঁড়ি থেকে ফুলগুলি সব ফুটতে যখন থাকে |

কিসের টানে প্রবীণ মনে খুশীর ঝলক লাগে
শেষ বয়সে আনন্দ স্রোত সবার মনে জাগে |

একে একে আসেন তাঁরা গুটি গুটি পায়ে
মিলেমিশে বসেন সবাই কৃষ্ণচূড়ার ছায়ে |

ভুলে গিয়ে জাতের গরব ভুলে পেশার মান
ছোট বড় সবাই যেন এক আত্মা এক প্রাণ |

সূর্যোদয়ে নবারুণকে প্রণাম করেন তাঁরা |
মৌন হয়ে ধ্যানে বসেন ! কি আনন্দ ধারা !

সে আনন্দ বন্যা হয়ে ভাসায় সবার মন
গানে গানে কাব্য পাঠে রসের বিতরণ |

ঝেড়ে ফেলে মনের ব্যথা ভুলে জরা ব্যধি
আনন্দেরই সাগর জলে ভাসেন নিরবধি |

মন সাগরে তলিয়ে যাওয়া মণি মুক্তা যত
একে একে ভেসে ওঠে যেন মন্ত্রপুত |

ফিরে আসেন কালিদাস, আসেন ভবভূতি |
কোকিল-কন্ঠ মধুর স্বরে করেন দেবস্তুতি |

স্মৃতিরত্নের স্মরণশক্তি সবাই দেখে খুশী |
সুরের লহর তুলে মাতান ভীমসেন যোশী |

রবি-রশ্মি শোনান তাঁদের রবির কাব্যধারা
স্ব-রচিত কাব্য বিলান হয়ে আত্মহারা |

সদস্যদের জীবন-চরিত রচেন চারণ কবি
অভিনব কাব্যছন্দে গাঁথা জীবন-ছবি |

কালীমন্দির প্রাঙ্গণ তখন শুধুই মধুময় |
‘মর্ণিংক্লাব’ নামে হল এদের পরিচয় |


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
খুঁজে ফিরি তাকে

আমি খুঁজে ফিরি তাকে যে এসেছিল আমার স্বপ্নে |
তার পরনে সবুজ শাড়ী, আঁচলে সোনালি ফসল |
সিঁথির রেখায় ছিল বিজয়িনীর রক্তাক্ত সিঁদুর |
কপালে তার মমতার পূর্ণিমার চাঁদ |

আজো খুঁজি তাকে শহরে গঞ্জে গ্রামে |
খুঁজেছি রেল লাইনে পাশের সেই বস্তিতে,
রাজধানী এক্সপ্রেসের দিকে তাকিয়ে থাকা
পেটমোটা ল্যাংটা ছেলের অবাক চাহনীতে |

আমি খুঁজতে গেছি তাকে দিনের শেষে হাটের পথে
দুর্মূল্যের সাথে লড়াই করে ঘরে ফেরা লোকের ভীড়ে |
গেছি গ্রীষ্মের দুপুরে মাঠের পথে
মধ্যাহ্ন ভোজন মাথায় সেই চাষী বধূর কাছে |

খুঁজেছি আমি তাকে আলো ঝলমল উত্সবে
স্বার্থের ধোঁয়ায় অন্ধকার দেশসেবকের দরবারে |
গেছি দাঙ্গা বিধ্বস্ত পল্লীগ্রামের কাছে
পড়ে থাকা নির্দোষ বিকৃত লাশের পাশে |

আমি খুঁজে ফিরি আজও ক্লান্ত উত্সুক চোখে,
যদি পাই তাকে ঐ নির্বাচনী সভায়
হাঁ করে থাকা নিস্ফল আশ্বাস শুনতে মগ্ন
নিরক্ষর বুভুক্ষু জন-সমুদ্রের মাঝে |

তোমরা কেউ কি দেখনি আমার প্রেয়সীকে ?
হয়তো দেখেছ ! তবু মুখ তোমাদের বন্ধ |
কিংবা তাকে লুকিয়ে রেখেছ প্রাসাদের কুঠুরীতে
কেবল নিজের লালসার আহুতি দেবার জন্য |

আমি কত খুঁজব আর তাকে শহরে গঞ্জে গ্রামে !
তোমরাও এসো আমার সঙ্গে এই উন্মুক্ত প্রান্তরে |
একবার সকলে মিলে সমস্বরে চিত্কার করে ডাকি
তুমি কোথায় ? স্বপ্নে দেখা সেই স্বাধীনতা |


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
পঁচিশে বৈশাখ

নিশীথের-নীরবতা ভেদ করি বেজে ওঠে শাঁখ |
বাঙালীর চিত্ত ভরে বিশ্ব মাঝে জন্ম নিল পঁচিশে বৈশাখ ||
ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে
ভরে দিল স্তরে স্তরে
সাহিত্যের পত্রশূণ্য যত শাখাগুলি
বিচিত্র বর্ণময় হাতে লয়ে বসন্তের তুলি |
তুমি এলে, আজি তাই
নৃত্যে গানে আনন্দে তরঙ্গে মোরা ভেসে যাই |
মনের গহন বনে যত সুর নীরবে তোলে তার তান
তোমার সঙ্গীত মাঝে তারা সবে লভিয়াছে প্রাণ |
কাব্য কানন মাঝে হে বিশ্বকবি,
রোপন করেছ যত্নে পৃথিবীর যত প্রিয় ছবি |
মানুষের সব অনুভূতি হৃদয়ে করিয়া মন্থন
সাজায়েছ গল্পে গানে কাব্যে উপন্যাসে অকৃপণ |
তবু কেন আক্ষেপের বাণী শুনি কানে,
বর্ণালী কবিতা মাঝে শূণ্যতা দেখিলে কোনখানে ?
অমলিন কাব্যের সাম্রাজ্য রচি কেন দ্বিধাভরে
শুধাইছে ‘কে তুমি পড়িছ বসি শতবর্ষপরে’ |
সহস্র বত্সর পরে অকম্পিত তব দীপশিখা
রাঙাইবে সাতরঙে আমাদের যত কাব্য-লিখা |
তুমি আজ নাই |
খন্ডিত হল মাতৃভূমি তাই |
হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী রক্ত নিয়ে হোলি খেলা খেলে,
এখনো রাজার হস্ত কেড়ে নেয় গরিবের ধন সুকৌশলে |
বীরের রক্তস্রোত মিশে যায় মাতার অশ্রুধারা সনে |
স্বার্থোদ্ধত অবিচার, প্রতিকার কেহ নাহি জানে |
আমাদের আশাভরা রাজদরবারে
শ্মশান-কুকুরদল স্বার্থ নিয়ে কাড়াকাড়ি করে |
তাই ওগো জগতের কবি,
স্বর্গ হতে নিয়ে এসো বিশ্বাসের ছবি |
স্রষ্টাপদে তাই এ মিনতি থাক
আর একবার জন্ম নিক পঁচিশে বৈশাখ ||


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
মন কেমন করে

গ্রীষ্মে

আগুনের হল্কার মধ্যে বদ্ধ ঘরে থেকে
মন ছুটে যায় সেই ছেড়ে আসা দেশের কোলে |
নয়ন মুদে দেখতে পাই সেই উঁচু গাছটার পিছনে
দুপুরের পর থেকে যে কালো দৈত্যটা লুকিয়ে থেকে
রাগে ফুলছিল আর ঘন মিশে কালো হচ্ছিল,
সে এখন হামাগুঢ়ি দিয়ে আস্তে আস্তে
মাথার উপর নীল চাঁদোয়াটাকে গিলে ফেলেছে |
গাছের পাতারা নিঃশব্দে প্রতীক্ষা করছে
একটা প্রলয়ের জন্য |
মুহূর্ত পরে গাছের শাখা বেঁকিয়ে
নারকেল পাতাকে একদিকে দুমড়ে দিয়ে
সুপারির মাথা নুইয়ে
বাঁশবনকে ঝাঁকুনি দিয়ে
আছড়ে পড়ল সেই কালো দৈত্যটা |
সাথে সাথে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া ছড়িয়ে দিল |
তখন আমার হারিয়ে যাওয়া দেশের জন্য
মন কেমন করে |--------

বর্ষায়

রাতে যখন মেঘ ডাকে বিদ্যুতের চমক মিশিয়ে,
বৃষ্টির শব্দ কুলারের শব্দকে ছাপিয়ে যায় |
চোখ না খুলে বেশ দেখতে পাই
জলের ফোয়ারা উঠান ছাপিয়ে
আউশ ডাঁটার খেত ভাসিয়ে
পাশের পুকুরে গিয়ে আছড়ে পড়ছে |
আর একে একে গিলে খাচ্ছে
পুকুরের সিঁড়িগুলোকে |
টিনের চালে বৃষ্টির নাচের তালে তালে
আতঙ্ক হামাগুড়ি দিচ্ছে শিশুমনে |
এখন দিল্লীর পাকাছাদের নিচে থেকে
মন ছুটে যায় বৃষ্টি ভেজা গ্রামের পথে |

শরতে

সাজান বাগানে রজনীগন্ধার ঝাড়ে ঝাড়ে
সবুজ কাটির মাথা যখন ভরে যায় সাদা ফুলে,
দোপাটির পাতার ফাঁকে ফাঁকে নানা রঙ উঁকি মারে,
শিউলির তলায় সাদা চাদর বিছিয়ে দেয় |
সন্ধ্যায় চিত্তরঞ্জন পার্কে হাঁটতে হাঁটতে
শরতের পরিচিত ফুলের গন্ধ সঙ্গ ছাড়তে চায়না |
আকাশে নীল রঙে চাঁদোয়ায় যখন
সাদা মেঘেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলা করে,
তখন জলে ভরা বিলে সাদা সাদা শাপলার
মিষ্টি হাসি দেখতে আর কচুরিপানার নীল ফুলের সঙ্গে
বিলের পাড়ে সাদা পাটকাঠির বাক্যালাপ শুনতে,
জলে ভরা রাস্তায় পা ডুবিয়ে হাঁটতে বড়ই ইচ্ছা হয় | |

হেমন্তে

সোনালী ধানের পথ বেয়ে হেমন্ত আসে |
আঙ্গিনায় থরে থরে জমে পাকা ধানের আঁটি |
গাছের পাতারা একটি দুটি করে ঝরে পড়ে মাটিতে |
বাতাসে কীর্তনের সুরে ভেসে আসে নিঃশব্দ রাতে
কিম্বা ধান মাড়াইয়ের হ্যাট হ্যাট শব্দ |
গায়ে মিষ্টিআমেজ মেখে মিঠে কড়া রোদ ওঠে !
ঘরে ঘরে নবান্ন উত্সবে আনন্দের ফোয়ারা |
এই শুষ্ক দেশে বসে ভাবি,
কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালী হেমন্ত
আর সেই সঙ্গে মধুর শৈশব |

শীতে

রাতে বদ্ধঘরে গায়ে গরম জামার বোঝা নিয়ে
টি.ভি. তে তাপাঙ্কর দিকে চোখ রেখে কেঁপে কেঁপে উঠি |
তখন ভাবতে ভাল লাগে সেই ছেলেবেলার শীতের দিন |
রাতে পাট কাঠি দিয়ে খেজুর রস চুরি আর
সকালে হলুদ রোদে বসে বাসি পিঠে খাওয়া,
পরন্ত রোদে দল বেঁধে গোল্লাছুট খেলা |
চুসি পিঠে পুলি পিঠে চিতই পিঠে আর সঙ্গে
নবেন গুড়ের গন্ধ মিলেমিশে কেমন
খুশির আমেজ ছড়িয়ে দিত সবার মনে |
সেই খুশী দিন ফিরে পেতে মন কেমন করে |

বসন্তে

দখিণা হাওয়ায় দুয়ার খুলে দিয়ে বসন্ত আসে |
শিরীষ বকুল আর অশোকের ডালি সাজিয়ে
মনে আগুন জ্বালে শিমুল পলাশের নেশা |
প্রকৃতি নিজেকে রমনীয় করে তোলে
নতুন পাতার সবুজ সাজি সাজিয়ে |
আমের মুকুলে মৌমাছির ভীড়,
বেলি চামেলীর গন্ধ মেখে বসন্ত হাসে |
ঋতুরাজের আগমনে মন কেমন করলেও
জানি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে আমার দেশ
যেমন হারিয়ে গেছে আমার যৌবন, মধুর শৈশব |

.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
চির যুবা চিরজীবী

বিশ্ব আজিকে নিঃশ্ব হয়েছে মানুষ হয়েছে ক্লীব
স্বার্থের ধোঁয়া গগন ছেয়েছে মরিছে নিরীহ জীব |
এই দুর্দিনে কোথায় সুভাষ এসো এসো তুমি ঘরে |
তোমায় চিনিতে ভুল হয়েছিল তাই রয়েছ দূরে ?
সারা ভারতের নেতাজী যে তুমি পরম সাহসী বীর |
এই ক্লীবত্ব ধ্বংস কর গো, দেশ আজি অস্থির |

বিবেকানন্দের বিবেক শিষ্য, রবির আশিষ ধারা
অরবিন্দের দেশ-প্রেম তোমাতে যে আছে ভরা !
মেধার খেলায় অবাক করিলে, ত্যাজিলে তা দেশতরে |
দেশবন্ধুর চরণে সঁপিলে সারা প্রাণ মন ভরে |
দেশের রাজনীতি তোমায় চেনেনি দেয়নি প্রকৃত স্থান |
ভিক্ষালব্ধ  এ স্বাধীনতায় দেশ ভেঙে খান খান |

দেশের মাটিতে প্রথম পুঁতিলে স্বাধীন পতাকা তুমি |
সে গরিমা ভুলেছে এ দেশ কৃতঘ্ন ভারত ভূমি |
শত্রুর দলে তোমার নামটি লিখিল সব শয়তান |
তারাই বাজায় আপন ডঙ্কা কাঁপায়ে এ আসমান |
দেশের জনতা চাহে না তাদের, তোমা পানে আছে চেয়ে |
ফিরে এস তুমি আদর্শ যুবা আশার বাণীটি নিয়ে |

দেশ-প্রেমের শিক্ষা দাও আজ ভারত নেতৃগণে
শিখাও তাদের ত্যাগের মহিমা নির্ভীকতার সনে |
সত্যের পথে অবিচল থাকা, কর্মের পথে দৃঢ়,
দেখাও প্রকৃত লক্ষের পথ আছে যত সব মূঢ় |
অভিমান করে থেকো না কো আর চিরযুবা চিরজীবী |
দেখাও আবার আশার আলোক রঙিন প্রেমের ছবি |


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
চিলেকুঠি

বাড়ি করার সময় ছাতে করেছিলাম চিলেকুঠি
সবসময় থাকত অবাঞ্ছিত জিনিষে ভরা |
আর শুকনো ঘাসের জঞ্জালে ভরা পাখির বাসা,
চড়াই ও শালিকের নির্ভয় আশ্রয়স্থল |
মগ ডালের চিল কখনই বাসা বাঁধেনি এখানে
তবুও ঘরটার পরিচয় চিলেকুঠি |


.        প্রথম ঘরটিতে থাকত কয়েকটা দড়ির খাটিয়া,
.        থরে থরে থাকত বিছানা, চাদর, বালিশ---
      গ্রীষ্মের রাতে জলে ভেজা ছাদের সুসজ্জিত শয্যা |
.        আরও কিছু উদ্বৃত্ত লোহা, কাঠ ও পাথর দানার বস্তা |
.        তাদের প্রয়োজন হয়নি কোনদিনই,
.        তবুও ধুলো মেখে বসে ছিলো আশঙ্কায় |


উন্মুক্ত আকাশের নিচে শয়ন গেল বন্ধ হয়ে |
রুমকুলারের যুগ দাঁড়ি টানল ছাতে শুয়ে গল্প করা |
চিলেকুঠি তখন ভরে উঠল, অবাঞ্ছিত আসবাবে,
হাতলভাঙা চেয়ার, পায়াহীন জলচৌকি, নড়বড়ে টুল |
বাড়িতে তারা নূতন আসবাবের সাথে বেমানান |
কেবল পুরাতনের প্রতি মমতাবোধই পরিত্যাগে বাধা |


.        আমাদের কাল হল শেষ |  এল নতুন যুগ নতুন প্রজন্ম |
.        ঘরে ঘরে এ. সি.-র ঠান্ডা হাওয়ার স্নিগ্ধ পরিবেশ,
.        ল্যাম্প শেডের মৃদু আলোয় রঙিন পানীয় |
.        রান্নাঘরে বাবুর্চি, ও.টি.জি, মাইক্রোওয়েভ, পিত্জা, রোষ্ট |
.        সাহিত্য-চর্চা, রাজনীতির বাগড়া, চুটিয়ে আড্ডা গেল থেমে,
.        সর্বত্রই এখন এই নূতন প্রজন্মের নিয়ম মেনে |


চিলেকুঠিতে নাড়া দিল পরিবর্তনের ঢেউ,
ছাতের কোল ঘেঁসে লাগলো নূতন দরজা জানালা |
বিদায় নিল ভাঙা টেবিল চেয়ার ধুলোমাখা বস্তা,
চূনকাম করা ঘরে এল খাট, টেবিল, চেয়ার জলের কুঁজো |
আর সঙ্গে এলাম আমি, সেকেলে বাহাত্তুরে বুড়ো,
কারণ আমি এখন অশোভন, তাই অবাঞ্ছিত জঞ্জাল ||


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
কবি প্রণাম
( ‘১৪০০ সাল’ কবিতার জবাব---কবির কথায় ও ছন্দে )

.        আজি হতে শত বর্ষ আগে
কে তুমি রচিলে বসি মধুর কবিতা রাজি
.                বহু অনুরাগে
.        আজি হতে শতবর্ষ আগে |
সেদিনের বসন্তের প্রভাতের আনন্দের
.                পরিপূর্ণ ভাগ
সেদিনের বনফুল বিহঙ্গের গীতি গান
.        সেদিনের যত রক্তরাগ----
অনুরাগে সিক্ত করি পাঠাইলে তুমি কবি,
.                আমাদের তরে
.        আজি হতে শতবর্ষ পরে |



তুমি যবে একবার             খুলিয়া দক্ষিণ দ্বার
.                বসি বাতায়ণে
সুদুর দিগন্তে চাহি             কল্পনায় অবগাহি
.                ভেবেছিলে মনে
.                একদিন শতবর্ষ পরে
সেদিনের কোন বাণী                পল্লবিত কাব্যখানি
.                অম্লান ধ্বনিবে মর্ম পরে |
তাই তুমি রাত্রি দিন                সকল বন্ধন হীন
.                    অক্লান্ত অধীর
রচিলে মনের কথা                পুষ্পরেণু গন্ধমাখা
.                   কাব্যসূধা নীর |
সে ভাষা জিনিয়া জরা                ধ্বনিছে আজিও ধরা
.                   আমাদের তরে
.                আজি এই শতবর্ষ পরে |
সেদিনের উতলা প্রাণ                হৃদয় মথিত গান
.                আজো প্রাণে জাগে
বনছায়া পুষ্পরাগ                হাসি কান্না অনুরাগ
.                  পরিপূর্ণ ভাবে
.                রচিলে যা শতবর্ষ আগে |


.        আজি এই শত বর্ষ পরে
.   এখন করিছে গান অনেক নতুন কবি
.                আমাদের ঘরে
.    তোমার অভিবাদন আনন্দে করি বরণ
.                কন্ঠে পরে বহু যত্ন ভরে
.    তোমার বসন্ত গান ছন্দবাণী লয়তান
.                আজো ধ্বনিছে মর্ম পরে |
.       হে কবি প্রিয়তম মুগ্ধ এ হৃদি মম
.                ভক্তি নম্র শিরে
.               প্রণমিছে শতবর্ষ পরে |


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
বিশ শতক

আরো এক সহস্রাব্দ পরে
আমাদের এই সাজান ঘরে
.        থাকবে কারা ?
ভেবে ভেবে হচ্ছি দিশাহারা |
বিশ সতকের শেষ প্রান্তে এসে
কি পেয়েছি এই শতকে ভাবছি অবশেষে----
উড়োজাহাজ, এটমবম্ , কম্পুটারে খেলা,
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে গেছে মোদের ভেলা |
সব দিকেতেই আবিষ্কারের ছড়াছড়ি,
খেতাব আর প্রাইজ নিয়ে কাড়াকাড়ি |
ঘরে আজ রোগ দমনের হরেক রকম হাতিয়ার |
তবু ভাবি কাদের তরে আমাদের এই আবিষ্কার?


বিশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে
.        বলছি সবাই হেসে |
কত রকম মারনাস্ত্র এই শতকের দান,
চোখ রাঙিয়ে বলছি সবাই নেবো তোমার প্রাণ |
হারিয়ে গেল বেড়ার ফাঁকে দোয়েল পাখি,
গাছের ডালে ফিঙের নাচন আর কেন না দেখি ?
ঝুটি বাঁধা কাকাতুয়া বিরল প্রাণী আজ |
প্রহর গোনা হুক্কাহুয়ার ফুরিয়ে গেছে কাজ |
এদের সব বিদায় দিয়ে
আছি মোরা কাদের নিয়ে
কাদের তরে মোদের ঘরে এত আয়োজন ?
বাঁচবে কি আর সন্তানেরা কিম্বা পরিজন ?
একটু খানি প্রাণ জুরান মুক্ত হাওয়া,
একটু খানি বনের শীতল ছাওয়া,
শয়ন কালে শান্ত পরিবেশ আমাদেরই তরে
রেখেছ কি বিশ শতক তোমার আবিষ্কারের ঘরে ?


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
জীবন ট্রেন

অনেক স্টেশন পেরিয়ে এলাম জীবন ট্রেনে চড়ে |
পরিচিত মুখগুলি সব যাচ্ছে পিছে সরে |
দুষ্টুমিতে ভরা জীবন যাদের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম,
ফেলে আসা স্টেশনেতে তাদের আমি নামিয়ে এলাম |
হঠাৎ যদি দেখা হল কোনখানে কারও সনে,
নামটি যেন চেনা চেনা, বাকী সবই বিস্মরণে |
দুচার কথার পরে হল ঠিকানার বিনিময় |
তাও আবার হারিয়ে গেল, হয়তো সবার এমনি হয় |
নূতন নূতন স্টেশনে যারা চড়ল এসে মোর কামরায়
গল্পগুজব খেলাধুলায় অনেকটা পথ পেরিয়ে যায় |
সুবোধ, সুদেব, পারুল, বকুল, শ্যামল আর মধুময়
লেখাপড়া হাসিঠাট্টা কিম্বা প্রেমের অভিনয় |
তারাও আবার নেমে গেল ধীরে ধীরে অগোচরে|
দত্তবাবু সেনদা এসে তাদের আসন দিল ভরে |
মেশামেশি রেশারেশি প্রমোশন আর পোস্টিং
এমনিভাবে তাদের সাথে কাটিয়ে দিলাম ক’টা দিন |
তারাও পরে নেমে গেল ঠিকানাটা লেখা আছে |
কারও কারও খবর পাই দেখা হলে কারও কাছে |
এখন আমার জীবনভরে শুধুই আছে অবসর
প্রাতঃভ্রমন সান্ধ্য আসর নাতিনাতনী ভর ঘর |
পাঠ্য কিতাব অফিস ফাইল সবার থেকে এখন ছুটি |
কোন খানে সভা হলে সবার সাথে সেথায় জুটি
চিন্তা ভাবনা দায়িত্বভার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে
নাতিপুতির সঙ্গে কাটে মাসিক পত্র হাতে নিয়ে |
শেষ স্টেশনে নামতে গিয়ে হোঁচট যেন না খাই আমি
সুস্থ দেহে নামতে পারি, এই প্রার্থনা বিশ্বস্বামী |


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর
*
চিঠি


.                                শ্রী শ্রী দুর্গা

.                                                        বি-১৬২, চিত্তরঞ্জন পার্ক
.                                                        নয়া দিল্লী- ১১০০১৯
.                                                        ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০০

অগ্রজ বন্ধুবরেষু,

পরম বন্ধু লোকেশ রঞ্জন কোথায় হারিয়ে গেলে ?
প্রভাতি মিলন তীর্থে তোমার দেখা কেন নাহি মেলে ?
এই তো সেদিন স্বাধীনতা দিনে স্মরিণু শ্রী অরবিন্দে,
শোনাতে এলেনা তাঁর মধুকথা তুমি তা কাব্যছন্দে |
নব-বর্ষের প্রভাতী মিলনে জানালেনা প্রীতি বাণী,
তোমার জ্ঞানের স্পর্শ সেদিন পাইনি একটুখানি |
চিকিত্সকরূপে জীবন গড়েছ, দিলে কতজনে সেবা |
কবিতা ও গানে সমান দক্ষ, সে কথা ভুলিবে কেবা |
হিন্দু দর্শন, সেখানেও তুমি দিলে নিজ পরিচয় |
বেদ উপনিষদের তত্ত্ব সভায় তুমি যে গো বিস্ময় !
শিশুকালে  শেখা কবিতা ও গানে শোনায়েছ কতবার,
অটুট স্মৃতির অধিকারী তুমি, কন্ঠ পরিষ্কার,
মর্ণিংক্লাবের তুমি ছিলে প্রাণ, ক্লাব ছিল তব প্রাণে |
প্রতি প্রভাতে পেয়েছি তোমায় শ্রাবণে ও অঘ্রাণে
আজ কেন তুমি ছেড়ে দিলে ক্লাব, কোন অভিমান ভরে ?
নাকি কৌতুক আমাদের সাথে, বলনা সত্যি করে |

.                                                 ইতি
.                                                 সুহৃদ্
.                                            জীবনাথ রায়চৌধুরী

প্রেরিত----
লোকেশ রঞ্জন দাশগুপ্ত
বি-২১৯ চিত্তরঞ্জন পার্ক
নয়াদিল্লী- ১১০০১৯


.                ****************                                                             
উপরে     



মিলনসাগর