আপনি যা বলবেন আমি ঠিক তাই কোরবো তাই খাবো তাই পরবো তাই গায়ে মেখে ব্যাড়াতে যাবো কথাটি না বলে বললে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকবো সারা রাত তাই থাকবো পরদিন যখন বলবেন এবার নেমে এসো তখন কিন্তু লোক লাগবে আমাকে নামাতে একা একা নামতো পারবো না ও টুকু পারি নি বলে অপরাধ নেবেন না যেন
********************
এই কবিতাটি ৮ই ডিসেম্বর ২০০৬ সালে 'তারা নিউজ চ্যানেলে' সর্বপ্রথম কবি পাঠ করেন | কবিতাটি শুনে লেখা তাই ভুল থাকলে মার্জনা করবেন |
১ দলে দলে মোটর বাইকে ঢুকে পড়ে কারা ঢুকে পড়ে ভোর বেলা কারা ঢুকে পড়ে জানা যায় না কিন্তু তারই পরে এ গ্রামে, ও গ্রামে, ঘরে ঘরে অবাধে কৃষক-রক্ত ঝরে জাগ্রত কৃষক রক্ত ঝরে
২ অস্ত্র প্রয়োগের অধিকারী তুমি আর তোমার ক্যাডার আমরা শুধু খুন হতে পারি মুখ বুজে খুন হতে পারি এই একমাত্র অধিকার
বৃদ্ধা বললেন: 'আমার এক ছেলে গেছে, আরেক ছেলে কে নিয়ে যাক জমি আমি দেব না ওদের | এই যে হাত দু'টো দেখছো বাবা...' ব'লে তাঁর কাঁপা কাঁপা শিরা ওঠা হাত দু'টি উঠিয়ে দেখালেন: 'এ দু'টো হাতে ক্ষেতের সমস্ত কাজ এতদিন করেছি, এবার এই হাত দু'টো দিয়েই জমি কেড়ে নেওয়া আটকাবো|'
মাসীমা, আপনার নেই ইটভাটার অস্ত্রভাণ্ডার মাসীমা, আপনার নেই সশস্ত্র পুলিশ মাসীমা, আপনার নেই পুলিশ-পোষাক পরা চটি পায়ে হাজার ক্যাডার তা সত্বেও এত শক্তি কোথা থেকে পান?
তা আমরা জানি না--- শুধু এইটুকু জানি
কৃষকজননী হ'য়ে মাঝে মাঝে দেবী দুর্গা আমাদের দেখা দিয়ে যান |
********************
এই কবিতাটি বিজল্প প্রকাশিত কবি জয় গোস্বামীর 'শাসকের প্রতি' বই থেকে নেওয়া | দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সৌজন্যে |
চিনতে পেরে গেছে বলে যার জিভ কেটে নিল ধর্ষণের পরে দু'হাতে দু'টো পা ধরে ছিঁড়ে ফেললো যার শিশুটিকে ঘাড়ে দু'টো কোপ মেরে যার স্বামীকে ফেলে রাখলো উঠোনের পাশে মরা অবধি মুখে জল দিতে দিল না সেই সব মেয়েদের ভেতরে যে-শোকাগ্নি জ্বলছে সেই আগুনের পাশে এনে রাখো গুলির অর্ডার দেওয়া শাসকের দু'ঘন্টা বিষাদ তারপর মেপে দ্যাখো কে বেশি কে কম তারপর ভেবে দেখ কারা বলেছিল জীবন নরক করব, প্রয়োজনে প্রাণে মারব, প্রাণে!
এই ব'লে ময়ূর আজ মুখে রক্ত তুলে নেচে যায় শ্মশানে শ্মশানে
আর সেই নৃত্য থেকে দিকে দিকে ছিটকে পড়ে জ্বলন্ত পেখম |
********************
এই কবিতাটি বিজল্প প্রকাশিত কবি জয় গোস্বামীর 'শাসকের প্রতি' বই থেকে নেওয়া | দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সৌজন্যে |
('কার কী ক্ষমতা আছে দেখি এবার | ওরা মাঠে নামছে | আমরাও নামব | ...কার কী ক্ষমতা দেখি...অতীতেও এমন অবস্থা হয়েছে | তবে এখন আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি' রবিবার ১১ মার্চ ২০০৭, কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষকসভার সমাবেশে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী-প্রদত্ত ভাষণের অংশ | )
গুলি লেগে পড়ে গেল | তুলে ধরতে যাচ্ছে তার বউ | বন্দুক উঁচিয়ে ধরো | বলো--- 'না, তুলবি না---' বলো--- 'যা সরে যা বলছি---' তাও যদি না শোনে তাহলে স্বামীর সাহায্যকারী হাতদুটোয় সোজা গুলি করো | যে-নারী ধর্ষণ করতে বাধা দিচ্ছে তার যৌনাঙ্গে লাঠির মাথা সোজা ভরে দাও যন্ত্রণায় সে যখন দয়া চায়, গালাগালি করে তার সামনে তার শিশুটিকে দু'পা ধরে দুই দিকে টানো, টানো, যতক্ষণ না সোজাসুজি ছিঁড়ে যাচ্ছে টানো! একে বলে সোজা কথা | এরই নাম ক্ষমতা দেখানো!
********************
কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র এবং দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সৌজন্যে |
বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, রক্ত গড়িয়ে পড়ছে... কেউ ছুটে গেল খালের ওদিকে বুক ফাটা গলায় কার মা ডাকল : "রবি রে..." উত্তরের পরিবর্তে, অনেকের স্বর মিলে একটি প্রকাণ্ড হাহাকার ঘুরে উঠল...
কে রবি? কে পুষ্পেন্দু? ভরত? কাকে খুঁজে পাওয়া গেছে? কাকে আর পাওয়া যায় নি? কাকে শেশ দেখা গেছে ঠেলাঠেলি জনতাগভীরে?
রবি তো পাচার হচ্ছে লাশ হয়ে আরও সর লাশেদের ভিড়ে...
২ ...বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে...
পিছনে কুকুর ছুটছে ধর্, ধর্... পিছনে শেয়াল
তার পিছু পিছু আসছে ভাণ্ড হাতে রাজ অনুচর
এই রক্ত ধরে রাখতে হবে
এই রক্ত মাখা হবে সিমেন্টে বালিতে গড়ে উঠবে সারি সারি কারখানা ঘর তারপর চারবেলা ভোঁ লাগিয়ে সাইরেন বাজবে
এ কাজ না যদি পার, রাজা তাহলে বণিক এসে তোমার গা থেকে শেষ লজ্জাবস্ত্রটুকু খুলে নিয়ে যাবে
৩ আমার গুরুত্ব ছিল মেঘে প্রাণচিহ্নময় জনপদে আমার গুরুত্ব ছিল... গা ভরা নতুন শস্য নিয়ে রাস্তার দুপশ থেকে চেয়ে থাকা আদিগন্ত ক্ষেতে আর মাঠে আমার গুরুত্ব ছিল... আজ আমার গুরুত্ব শুধু রক্তস্নানরত হাড়িকাঠে!
৪ অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে সূর্য উঠে আসে
বন্ধ থাকা ইশ্কুলের গায়ে ও মাথায় রোদ পড়ে
রোদ পড়ে মাটি খুড়ে চলা কোদালে, বেলচায়
রোদ পড়ে নিখোঁজ বাচ্চার রক্তমাখা স্কুলের পোশাকে...
৫ ...না, না, না, না, না--- না বলে চিত্কার করছে গাছ না বলে চিত্কার করছে এই গ্রীষ্ম দুপুরের হাওয়া না বলে চিত্কার করছে পিঠে লাশ বয়ে নিয়ে চলা ভ্যান গাড়ি
আর আমরা শহরের কয়েকজন গম্ভীর মানুষ ভেবে দেখছি না বলার ভাষারীতি ঠিক ছিল কিনা তাই নিয়ে আমরা কি বিচারে বসতে পারি?
৬ তুমি কি খেজুরি? তুমি ভাঙাবেড়া? সোনাচূড়া তুমি? বার বার প্রশ্ন করি | শেষে মুখে রক্ত উঠে আসে |
আমার প্রেমের মতো ছাড়খার হয়ে আছে আজ গোটা দেশ ঘোর লালবর্ণ অবিশ্বাসে |
৭ আমরা পালিয়ে আছি আমরা লুকিয়ে আছি দল বেঁধে এই ইটভাটায় মাথায় কাপড় ঢেকে সন্ধ্যেয় বেরোই মন্টুর আড়তে--- মল্লিকের বাইকের পিছন-সিটে বসে আমরা এক জেলা থেকে অপর জেলায় চলে যাই, যখন যেখানে যাই কাজ তো একটাই | লোক মারতে হবে | আপাতত ইটভাঁটায় লুকিয়ে রয়েছি... অস্ত্র নিয়ে... কখন অর্ডার আসে, দেখি |
৮ পিছু ফিরে দেখেছি পতাকা | সেখানে রক্তের চিহ্ন, লাল |
ক'বছর আগে যারা তোমাকে সাহায্য করবে বলে ক'বছর আগে যারা তোমার সাহায্য পাবে বলে রক্তিম পতাকটিকে নিজের পতাকা ভেবে কাঁধে নিয়েছিল
তাঁদের সবাইকে মুচড়ে দলে পিষে ভেঙে দখল করেছ মুক্তাঞ্চল
পতাকাটি সেই রক্তবক্ষ পেতে ধারণ করলেন |
তোমার কি মনে পড়ছে রাজা শেষ রাত্রে ট্যাঙ্কের আওয়াজ? মনে পড়ছে আঠারো বছর আগে তিয়েন-আন-মেন?
৯ ভাসছে উপুর হয়ে | মুণ্ডু নেই | গেঞ্জি পড়া কালো প্যান্ট | কোন বাড়ির ছেলে? নব জানে | যারা ওকে কাল বিকেলে বাজারে ধরেছে তার মধ্যে নবই তো মাথা |
একদিন নব-র মাথাও গড়াবে খালের জলে, ডাঙায় কাদার মধ্যে উলটে পড়ে থাকবে স্কন্ধকাটা এ এক পুরনো চক্র | এই চক্র চালাচ্ছেন যে-সেনাপতিরা তাঁদের কি হবে?
উজ্জ্বল আসনে বসে মালা ও মুকুট পরবে সেসব গর্দান আর মাথা
এও তো পুরনো চক্র | কিন্তু তুমি ফিরে দেখ আজ সে চক্র ভাঙার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে গ্রাম--- ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে কলকাতা |
১০ অপূর্ব বিকেল নামছে | রোদ্দুর নরম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা মাঠে | রোদ্দুর, আমগাছের ফাঁক দিয়ে নেমেছে দাওয়ায় | শোকাহত বাড়িটিতে শুধু এক কাক এসে বসে | ডাকতে সাহস হয় না তারও |
অনেক কান্নার পর পুত্রহারা মা বুঝি এক্ষুনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন | যদি ঘুম ভেভে যায় তাঁর!
******************* কলকাতার দেশ পত্রিকার ২রা মে ২০০৭ এর সংখ্যায় এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে |
...অনামিকা কই? কাজল কোনদিকে গেল? সায়ন কোথায়? পিছনে তাকিয়ে দেখি সঙ্গে কেউ নেই প্রান্তরের মধ্যে এক যূপকাষ্ঠ---অর্ধেক প্রোথিত--- ধারে কাছে কোনও ধড় নেই মুণ্ডুরা উধাও | ধুলোয় শোওয়ানো আছে খাঁড়া | চেনে চেনে লাগে বড় | ইতি পূর্বে দেখা হয়েছে কি? সত্তর - একাত্তর - বাহাত্তর সালে এঁদের দেখেছি বটে | তারপর কি কোখাও দেখিনি? হ্যাঁ মনে পড়েছে | লালাবাজারে এই খাঁড়া ঝোলানো রয়েছে | যূপকাষ্ঠ আছে মহাকরণের বুদ্ধিঘরে |
********************
কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র এবং দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সৌজন্যে |
('নন্দীগ্রামে, আইনশৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য, আজ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে |' ১৪ মার্চ বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলনে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর বক্তব্যের অংশ | )
কপালে স্টিকার আঁটা : সুকুমার গিরি | বুকে মস্ত ছ্যাঁদা নিয়ে চিত হয়ে আছে তমলুক হাস্পাতালে | ঢাক্তার বুঝেছেন এ লোকটাকে বেডে তুলতে গেলেই এক্ষুনি মরে যাবে | ঠিক | গেল তাই | কিন্তু, ছেলে তার বুঝছে না এখনো | বলছে, 'বাবু, পায়ে পড়ি, বাবাকে বাঁচান' | ডাক্তার কি করবে আর! ওর ছেলে জানেও না লিডারের কয়েকটি কথায় নির্দেশিত আমাদের শোয়া বসা হাঁটা চলা মরা আর বাঁচা--- আমাদের কাজ শুধু মর্গা আর হাসপাতালে পুলিশের গুলি খাওয়া মৃতদেহ হয়ে 'আইনশৃঙ্খলা' রক্ষা করা |
********************
কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র এবং দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সৌজন্যে |
ডুমাডুম টাক ডুমাডুম বাড়ী এল বুদ্ধুভূতুম। ওরে তোরা নামলি কোথা, মুড়িঘাট, হুমনিপোতা। সে আবার কোনখানেরে, গেলে আর কেউ কি ফেরে ? এই তো আমরা গেলাম কত ভালোমন্দ খেলাম। খেয়ে খেয়ে পেট ফুললো চলে আসি বাদকুল্লো। সেখানে পাড়ায় পাড়ায়, ইঁদুরে বেড়াল তাড়ায়। তাই দেখে ভয়েই মরি, তাড়াতাড়ি বিমান ধরি। বেলা যেই তিনটে হলো বিমানের তেল ফুরালো। নামলাম সান্তাক্রুজে তারপর অনে খুঁজে এই সবে পৌঁছেছি ভাই, এবারে বিশ্রাম চাই। ডুমাডুম টাক ডুমাডুম শুতে যাও বুদ্ধুভূতুম
********************
এই ছড়াটি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও এখলাসউদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় এবং অশোককুমার মিত্রর সহসম্পাদনায় 'দুই বাংলার ছড়া' বইটিতে ১৯৯৩ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল |