জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর কবিতা
*
যযাতি কাল
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।    

অনেক উজ্জীবন-পথের শেষে কালসীমা পেরবার আগে
হঠাৎ নিশ্ছদ্র অন্ধকার আসে, অনিবার্য রাত্রির
নিষেধ কালো পাথরের ভাস্কর্যের প্রমিতি প্রাচীর |
উপনিষদের সেই একাকিত্বের ভয়-----
অসঙ্গ গভীর !
এর কোন শে, নেই, অথচ সে শেষ হয়
খন্ডকাল সীমান্তের পারে |
এই সব অতলস্পর্শী অনুভব, ক্ষয়ে ক্ষয়ে সহজ কথার
তীরে এসে পড়ে উত্সবের মতো,
একান্ত আনন্দ-শিশু -কোলাহল নিয়ে |
এখন সে মেঘচেরা রৌদ্রের জানালা দিয়ে
সোনালি মাছির মতো উদ্ গ্রীব ছোটে-----
ছোট্ট ছবির গ্রাম রৌদ্রের সৌরভ মাখে
মৃত্যুহীন অন্তহীন সৃষ্টির যৌবনে----
অবিশাপ আশীর্বাদ মৃত্যু রোগ জীবনের অমেয় আধারে
যযাতি এ কাল |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
বাংলা দেশের গান
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।   

বাংলার গান আজ আকাশে, আগুনরাঙা মেঘে |
বাংলার গান শুনি মুক্ত প্রাণের সুরে,
পদ্মার মেঘনার প্রবল প্রবাহে, ধায় বেগে ||

সোনার বাংলা তুমি শৃঙ্খল ছিঁড়েছ,
.        অটুট ঐক্যে গড়ে তুলেছ
সহ-মন সহ-প্রাণ সহ-চিত্তের জয়দুর্গ |
সোনার বাংলা তুমি আগুনের রক্তে নেয়ে
.        স্বাধীন !    স্বাধীন !  এক দুর্গ ||

এপারে-ওপারে এক সেতুবন্ধনে মোরা নেমেছি |
দানবের কারাগার চূর্ণ হয়েছে এক হুঙ্কারে-----
বাংলা ! বাংলা ! বাংলাদেশের ঝঙ্কারে |
আমরা তোমার সব ভাইবোন একসাথে মিলেছি ||

আমরা তোমার সহ-মন সহ-প্রাণ সহ-চিত্তে,
সংগ্রামী বাংলা আমাদেরই বাংলা
উজ্জ্বল ঐক্যের বিত্তে ||
যে ভাষায় আজ তুমি কাছে
এসে জানাতে পেরেছ------
এ মানুষ একদা ছিল
আদিম হিংস্রতা নিয়ে
আরণ্যকে সমাধিস্থ,
শিলাস্তৃত জীবাশ্ম আবেগে
অযুত আলোকবর্ষে স্তরে স্তরে
হয়ে গেছে ইতিহাস-নির্মোক-লিপি,
সেভাষা আমাকে দিও,
আমার এ নির্বাসন অনেক দূরের পথে
নিয়ে যাব সাথে |
কারণ,
এ নষ্ট-ভ্রূণ জীবনের অনেক দেখেছি,
শুধু এ অবক্ষয়ে প্রতি দিন একান্ত নায়ক
যে-কোন নগরে আজ নিরঙ্কুশ ত্রাটকে আসীন
শবাচারী কাপালিক,
তাল-বেতালের কানে বীভৎসার মন্ত্র হানে------
( এখনই যেয়ো না ফিরে,
কাছে থাকো, নৃশংস সহরে---- ) |
এদের প্রাচীন সেই স্বর-বর্ণ ভুলে গেছে ----
মানুষের ভাষা |
প্রেম যেন বিক্ষিপ্ত প্রয়োগ,
পশুর মেদের নিচে মৈথুনের আনন্দ-হুঙ্কার
যে-কোন মুহূর্তে তুমি-----
নিরীহ হয়েও
হত্যার প্রতিবেশী হবে,
পৃথিবীর যে-কোন রাস্তার মোড়ে
রক্ত-মাংস পিন্ড হয়ে মাটি হয়ে যাবে |
( কাচে থেকো,
এখনই যেয়ো না ফিরে নৃশংস শহরে----)
জমিতে মৃত্যুর সার, প্রাণের ফসল |
কেন, কেন, কেন এই ভাষাহীন ছন্দহীন
মরে-যাওয়া আততায়ী বিপ্লবের হাতে ?
এর প্রতিবাদ আছে,
আমার গানের কলি তোমার ভাষায় |
এর প্রতিবাদ আছে----
যে-কোন পাখির গানে-----
সবুজ সবুজ মাঠে সোনা-গলা ধানের প্লাবনে-----
সারিগান নৌকা নদী উদ্দাম প্রান্তরে |
প্রতিবাদ আছে,
কোন নিবিড় রাত্রির নীড়ে
তোমার চুম্বনঘন আমোঘ আশ্লেষে |
এর প্রতিবাদ ঐ লক্ষ-লক্ষ আলোর শিশুরা |
হাততালি---- কোলাহল সম্মেলক মাঠের খেলায়
প্রতিবাদ আছে কোন্ অতল গভীরে,
উজ্জীবন আনন্দের আণবিক বিস্ফোরণে |
আপাতত কাছে থাকো,
এখনই যেয়ো না ফিরে,
নৃশংস  শহরে |
সমস্ত প্রাণের ঋণ একদিন শোধ করা যাবে
আমরা অপেক্ষা করব ---- হাতে হাত দিয়ে----
অন্য কোন অস্ত্র নিয়ে
আলোকের অজস্র বিপ্লবে,
সূর্যোদয়-মুকুট পরা উঠে আসবে
পরিপূর্ণ প্রচন্ড মানুষ |
আমরা অপেক্ষা করব
আর্তনাদ হত্যা রক্ত জিঘাংসার
প্রতিবাদ হয়ে |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
প্রথম সামগানের মতো
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।   

প্রথম সাম-গানের মতো এ সকাল,
শৈশব হারিয়ে মাংসাশী হয়ে উঠেছে |
দ্বিপ্রহর প্রহর নখর-------
ছিঁড়ে নেবে শকুনের উদ্গ্রীর থাবায়
স্নেহসিক্ত জীবনের নরম দেহকে |
সন্ধ্যা নামে বিচ্ছেদের ষড়যন্ত্র নিয়ে |
আজকে এরই মধ্যে কাজ করে যেতে হবে,
বঞ্চনা আর শোষণের শীতে জমা মানুষের
প্রাসঙ্গিক দ্বন্দ্বের ভিড়ে------
মত ও পথের, শরীর ও সত্তার,
বিস্ফোরিত হাত-বোমা
উদ্যত, ব্যক্তির কিংবা রাস্ট্রের দিকে |
ওদিকে, গ্রামের দীঘি,
অনেক জন্মান্তর নিয়ে অবাধ্য শিশুর মতো
কুমুদ কহ্লার পদ্ম নীরবে ফোটায় |
অথবা বশির মিঞা, নিকারির জালে
মাছ ধরে-ধরে, হুঁকা নিয়ে বসে-----
ভূমিদাস হরিদাস জমি -দখলের দলে,
মশালের মিছিলে শামিল |
অথবা ক্রুদ্ধ এক,
ছিন্নমুন্ড নায়কের শহিদ-দিবস,
মৃত্যুতীর্থে উজ্জীবন, শতধা নেতার হাতে,
প্রতিবাদে হত্যাপুষ্ট প্রাণ
হুঙ্কারে বিদীর্ণ করে স্বপ্নের আকাশ |
এ সবও হওয়ার পরে, অনেক অনেক কাজ
নিশ্চিন্ত পয়ার ভেঙে জীবনের ছন্দ এনে দেবে |
এবার আসুক সেই দু-হাজার বছরের
যৌবনের দুরন্ত মিছিল |
নূতন কালের মূর্তি দলে-দলে,
ইতিহাস-ভাস্করের বিপ্লবী শিল্পের হাতে,
এনে দেবে নবতম ছন্দের মিল |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
রাতগুলো নরম মোলায়েম ঘাসের মতো
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

অনেক দিন বেঁচে থাকতে-থাকতে ক্লান্ত,
অনেক দিন |  আবার নূতন আয়ু হয়তো, মৃত্যুর মতো,
নূতন সূর্যকে নিয়ে আসবে | ওদিকে,
আত্মার বুলি-কপচানো ড্রয়িংরুমে বসে
কেবল যন্ত্রণার কথা আর উত্তপ্ত বিপ্লব নিয়ে
রান্না করতে ভুলে-যাওয়া, কোণায় পড়ে-থাকা
আধ-পচা আলুর মতো মন নিয়ে
অভ্রংলিহ মননের আত্মপ্রসাদকে স্তোকবাক্যে
উঁচু করে রাখি | অথচ
একই ভাবে বাঁচতে-বাঁচতে বাঁচাটা ফুরিয়ে যায় একদিন
নিরর্থক অবসাদ স্তূপে | তখন হয়তো সব ইঁট-কাঠ
পাথরের সভ্য-সভ্য লোক, কেরোসিন, জল , দুধ
চিনির সারিতে গিয়ে
অবক্ষয় সংগ্রহ করে |
বিপ্লব তার বানান ভুলে যায় |
এ ভাবে তো বাঁচা নয় | মধ্যবিত্ত আকাঙ্খার
শেষ সারি তোমার আমার |  সেখানেও দেখবে
রাতগুলো নরম মোলায়েম ঘাসের মতো রুগ্ ণ গরুর
খাদ্য হয়ে রয়েছে |  আর বিপ্লব  তোমার
হাতের মুঠোয় ছিল----এখন নানা রঙের গল্প আর
কবিতা হয়ে গেছে | এখন কেরোসিনের কথা ভাবো-----
অন্ধকার ঘরগুলো বুড়োদের মতো ঘাড় গুঁজে ফিসফাস করে
কথা কয় | চাল আর বিপ্লব | কাপড় আর বিপ্লব |
এখন মড়া শবের গন্ধে আনন্দিত হতে হবে---- তাই
একটা গানের কলি নিয়ে ভাবতে থাকি---  কখন
বেঁচে থাকতে-থাকতে ইতিহাস হয়ে উঠব
পরের বোঝা বইতে-বইতে কখন একেবারে আয়ুর
শেষ দিনের চূড়ায় জ্বলে উঠব |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
এসো মুক্ত কর
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

এসো মুক্ত কর, মুক্ত কর, অন্ধকারের এই দ্বার,
এসো শিল্পী,  এসো বিশ্বকর্মা,  এসো শ্রষ্টা
.                         রসরূপ মন্ত্র দ্রষ্টা,
ছিন্ন কর,  ছিন্ন কর বন্ধনের এ অন্ধকার ||

দিকে দিকে ভেঙেছে যে শৃঙ্খল,
দুর্গত দলিতেরা পায় বল |
এ শুভ লগ্নে তাই তোমারে স্মরণ করি
.                              রূপকার
.           এসো মুক্ত কর হে এই দ্বার ||

উঠেছে যে জীবনের লক্ষ্ণী মৃত্যু সাগর মন্থনে,
নূতন পৃথিবী চায় শিল্পীর বরাভয় নব সৃষ্টির
.                                  শুভক্ষণে |

এসো সমিতির সাম্যে ও ঐক্যে,
এসো জনতার মুখরিত সখ্যে,
এসো দুঃখ-তিমির ভেদি দুর্গম ধ্বংসের
নিষ্ঠুর ভয় করি চূর্ণ
.                ( এসো ) প্রাণের ভবন কর পূর্ণ  ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
নিবুচন্দ্রের কাহিনী
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

কুট্টুস কট্টাস মট্টর ভাজী,
খাচ্ছেন নিবুচন্দ্র রাজা |
তার যে ঢিবুচন্দ্র মন্ত্রী,
নিয়ে ফেরেন শতেক যন্ত্রী |
কোতোয়াল সে ডালিম চোখে,
তালিম দিয়ে বিড়ি ফোঁকে |
সেই রাজারই জেলখানাতে,
উল্লুক ভল্লুক আড়ি পাতে |
চামচিকেরা চিম্ টি মাড়ে
বাদুড় ঝোলে সারে সারে |
কয়দীরা সব ফোঁসে ফাঁসে
নিবুচন্দ্র মুচকি হাসে |
বাঘকে রাখি লোহার খাঁচায়,
মানুষ রাখি ইঁটের পাঁজায় |
মন্ত্রীর গোঁফে চাড়া দিয়ে,
তারিফ করে মায়ে ঝিয়ে |
বললেন নিবুচন্দের মেসো,
বিষ্যুৎবারে তিনবার কোশো |
নইলে তোমার ইঁটের  পাঁজা,
হবেই সাড়ে বত্রিশ ভাজা |
কোতোয়ালের মুখটি চূণ |
রাজার বাজ্যি ভাজার |      
                  
(
মূল ছড়ার যে লাইনের সামান্য বদল হয়ছে
গানে :  “ নিবুচন্দ্রের মেসো”
)

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
লাল পিঁপড়ের গান
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

পিঁপড়েকে বলে পিঁপড়েনী
আলুনি চুল বেঁধেনি |
সেই বিনুনির ডগায় ফুল
কালো মেঘে বাজের দুল  |
হঠাৎ এল ধেয়ে-------
দুড় দুড়াদুড়
গুড় গুড়াগুড়
দস্যি পাড়ার ডেঁয়ে |
ধাই খটাখট চরকি ভোঁ
বাজ শকুনির ঝটতি ছোঁ |
লক্ষ ধড়ের মুন্ডু নেই
লাল পিঁপড়ের কামড়েই |
আয়রে পিঁপড়ে ঘরে যাই
চিনির দানা কিনে খাই,
আসবে না আর ডেঁয়ের পো
ভ্যাঁপ্পোর ভোঁপ্পোর ভোঁপ্পো পোঁ  |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
আমাকে তোমার দিকে
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

আমাকে একটা স্বপ্নও পাঠাতে পারলে না ?-----
আমার ঘুম কে নিয়ে
মিছিমিছি খেলা শুধু করলে |
যে-সব প্রচন্ড আর তুচ্ছ কথার টুকরোগুলো
ফেলে চলে গেছ---
কোন্ সংসারে তাকে গুছিয়ে তুলি ?
যেখানে সহস্র টানে মর্ত্যলোক টেনে
চলে নিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে,
আমার নামগোত্রহীন এ যাত্রার
শেষ প্রান্তে, তোমার স্বপ্নের সব নীল
নীল ফুলগুলি লোকোত্তর হাওয়াতে কাঁপে |
আমাকে মায়ের মতো, মৃত্যুর অজস্র তোরণ
পেরিয়ে সত্তার যুগ্ম-তীর্থে
অন্য সৌরলোকে----- নিয়ে চলো
আমাকে তোমার দিকে |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
বন্ধুবর জ্যোতিষ দত্ত গুপ্তকে---
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

দিনের মধ্যে এক অন্তর্লীন রাত্রির তপস্যা থাকে,
তাকে খুঁজে নিতে হলে,
নিজেকে সম্বৃত করে একেবারে চলে যেতে হবে
নামহীন উপাধিহীন অখন্ড সময়ের
অন্তঃপুরে | তারপর সম্বোধন অধুনাতন
ভাষায় আর সম্ভব হবে না |
দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের ভাষা----কর্তা-কর্ম-অধিকরণের
অধিকারের বাইরে-----
কেবল ফিরসবের যন্ত্রণায় আবৃত, আস্তৃত
না না রং, নানা শব্দ----প্রেমহীন
আঘাতে-আঘাতে অখ্যাত পান্থশালায়
এক রাত্রির অতিথি |
আমাকে নিদ্রার শব্দহীন স্বপ্নহীন
নিঃশব্দ তিমিরে ডুবিয়ে দাও ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ : কয়েকটি চিন্তা
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

যে--কেন কথা যে-কোন কীর্তি
একটা কোন প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হলে
এক পা এগিয়ে যাই বিপ্লবের দিকে
মানুষকে কেন্দ্র করেই বিপ্লব, দলকে নয়------
বিজ্ঞান যন্ত্র বিদ্যুৎ অনুভূতির কেন্দ্রে
পৌঁছে যাওয়া চাই |

সেখানে দেখবে সুবিন্যস্ত সাজানো রয়েছে
মানবিক প্রয়াসের বিভিন্ন কারুশিল্প |
সংগর্ষের সংবাদে সাহিত্য রচিত
শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্নসফল-----
নির্লোভ সত্যভাষণে
লাভক্ষতির ঊর্ধ্বেপেশল কর্মসাধনে
অনলস আত্মসমীক্ষায় |
যেখানে প্রতিরোধ, সেখানে ক্ষমা নেই |
যেখানে প্রতিবাদ, সেখানে আপস নেই |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
শ্রাবণে বর্ষণই শ্রেষ্ঠ
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

শ্রাবণে বর্ষণই শ্রেষ্ঠ অগণন মাটির স্থায়ীতে |
মানুষ ভিজেছে বৃন্তে, অন্তরায় শিকড়ে শাখায় এক
.                  আদিগ্রাম উদ্বাহু স্বপ্নের
বাস্তুহারা শস্যের, খাদ্যাখাদ্য জীবনের ছকে |
শ্রমিক গ্রন্থিল হাত,  অনুভবপুষ্ট পেশী,
চৈতন্যের গোবর্ধন ধরে রাখে অনায়াসে
স্মৃতির বৈভবে |



.                        অভ্যস্থ নদীর পাড় এখানে কোথায় ?  শাল
.                        সেগুন অথবা ঘন অজেয় শিমুল, দীর্ঘ
.                        কন্টকিত আরণ্যক প্রত্যয়ে প্রবীণ |
.                        ওদিকে অজস্র  হাতে
.                        কর্ষণের বীজ নিয়ে সমাধিস্থ চাষি,
.                        যুগান্তরে লোকায়ত আদিম শ্রেণীর পণ্যে,
.                        আনন্দের ধানে |


.                                                অথচ সংহত সব, নির্লোভ ক্ষত্রিয় গানে
.                                                শত্রুঘ্ন শিবিরে | তাই শ্রাবণে বর্ষণই শ্রেষ্ঠ
.                                                আরোগ্যের স্নানে,
.                                                রক্ত ক্লেদ গ্লানির বিদ্রোহে |
.                                                ঋতায়ত চিত্ত মধ্বী অরণ্য সংসারে,
.                                                সুবিন্যস্ত বিপ্লবের হাতে ছন্দ পায়,
.                                                মৃদঙ্গ বাদিত্রে মগ্ন গভীর মল্লারে |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
নীলকন্ঠ পাখির ঝরা পালকের মতো
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

শুঁড়তোলা শামুকচলা দেখতে গিয়ে একটা পুরো
শৈশব কেটে গেছে
পদ্মপুকুরের ধার, ওধারে নদীর মতো চলন্ত পথের স্রোত |
গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের তনুশ্রী পেয়েছে,
বুনো চারাগাছ শাল পিয়াশাল
মহুয়া নয়নতারার বন |
অথচ এ সব কথারা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে
পুরনো দালানটার কাঁধে হাত রেখে-রেখে |
এখন নতুন-নতুন সব ইমারত
নতুন ভাবে ভেঙে যাবার সম্ভাবনায়
উল্লসিত |
মানুষের শ্রম যে-আকৃতি নিয়ে
শহর হয়েছে
শেখানে অনেক বাগান আর ঐতিহাসিক সত্তায়
প্রতিষ্ঠিত অবকাশ-চৈত্যের যক্ষ-যক্ষী
প্রস্তর-স্নেহের নীড় |
তা-ও  ভেঙে যাবে দেখো
একদিন একটা নীলকন্ঠ পাখি
ভেঙে-ভেঙে যেমন পালক হয়ে
বনে ছড়িয়ে গিয়েছিল |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
আধুনিক  ভাস্কর--- প্রতীকে
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     

এ জীবন ভেঙেচুরে মূল্যায়িত বোধের আকাশে,
নদীবাঁক অথবা শহর নিয়ে নানা ইতিবৃত্তে ঘুরে
সম্পন্ন সংবাদ পায় ভাষা |
অথচ কালের ছেনি সর্বদাই উচ্চবাচ আঘাতে-আঘাতে
প্রতিমাই গড়ে | প্রতিমার
আদিগন্ত ব্যাপ্ত চোখ ভূগোলে-ভূগোলে খোঁজে
প্রয়াসের মূর্ত রূপ মানুষের ঊর্ধ্ববাহু দেহে |
এই সব অমোঘ শিল্পে বার বার কেটে-কেটে গড়া
বিশীর্ণ গ্রামের শরীর আর অফুরাণ বনজ উল্লাস----
পোড়ো ভিটে কাঁটাবন, পোকা-লাগা ফলের বাগান----
অমৃত পাখির গান দূর থেকে দূরান্তরে এখনও অঢেল-----
মজা নদী ভাঙা বাঁধ, রৌদ্রের রন্ধনে তপ্ত ফুটিফাটা মাঠ
অথবা নির্জন পাহাড়ি বাংলো---- উঁকি-মারা পাহাড়ের
চূড়াটা কী নীল !
জানালাভাঙা ঘরে-ঘরে প্রয়াত কাহিনীছায়া
কবুতরী আলাপে বিভোর |
অথবা হঠাৎ বন্যা প্লাবনে বিপ্লবে রক্তে ক্ষয়ে অবক্ষয়ে,
মূল্যবান যোগে বা বিয়োগে,
সর্বদাই মগ্ন সেই শিল্পপ্রতিভাসে |
তাই তো এ জীবন, দেশ, মানুষের চিত্রপরিবেশ
এ কালে চালচিত্রে শিল্পে রঙে ব্যাপ্ত দিকে-দিকে,
আধুনিক ভাস্কর-প্রতীকে |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
বন্ধুও বিষণ্ণ হবে প্রাণের ক্লান্তিতে
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র    

বন্ধুও বিষণ্ণ হবে প্রাণের ক্লান্তিতে |
অথচ, সেবক সেব্য ভাবে ঠিক নয়,
অন্য় ভাবে, স্বাভাবিক বৃত্তির চেতনা,
ইতিহাস, কাল, মানে একই বিকীরণ  কেন্দ্রে |

নতুবা শুধুই এক সাহিত্যিক বিপ্লবেই
প্রাণকে খুঁজতে হয় অলিতে গলিতে, কিংবা
তবু, ঘটনা ঘটেই যায় নিরপেক্ষ ভাবেই বুঝি বা,
হাতভরা বোমা আর হাতভরা ফুলের মধ্যে,
সেতু সামগানে |
মৃত্যুর সে পুরস্কার জীবনও পায় না | তাই,

অনেক জীবন ঘেঁটে মন্থিত আবেগে মৃত্যু
বেছে নিতে হয়, সমিতি মিটিং ছাড়া
অন্যান্য মাঠেও |

আর একটা কথা, ভায়া, ধ্রুবপদই ভাবো -----,
যে যার মেজাজে থেকে একটি উচ্চারণে আসা
কঠিন ব্যাপার | আর, এটা ঠিক জেনো-----
হীনম্মন্যতাও এক বুর্জোয়া বৈক্লব্য, যা
রাতের আঁধারে ছদ্ম সৈরিন্ধ্রীর খোঁপা
খুঁজে ফেরে
তারপর বৃকোদর আসে রুদ্র ইতিহাস হয়ে----
যক্ষস্বামী দ্রৌপদীর,
এবং গ্রামের যাত্রা-হুঙ্কার, কীচক বধ |

দেশে-দেশে গ্রামে-গ্রামে সার্থক এ অভিনয়ে মরে
হীনম্মন্য কামুক কীচক |
( সব কথা কাগজে রটে না )
আসল কথাটা ওই-----
এক উচ্চারণে আসা সমচেতনার কেন্দ্রে |
অজ্ঞাতবাসের শেষে একটি বিরাট পর্বে
একই ব্যারিকেডে ট্রেঞ্চে কাঁধ কাঁধ দিয়ে
বীরম্মন্য কোরাস মরণে,
একই উচ্চারণে |
পায়ের তলায় মাটি জীবনের চাপে ধরে রাখো |
চিত্তের সততায় ফিরে এসো |
বিপ্লবই সাহিত্য, দেখবে | জীবন ধারণ !
প্রাণদিগন্তে স্থির সূর্যের কাছে বর চাও-----
এক সত্তা, এক বৃত্তি, এক উচ্চারণ |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
এখন আর ক্লান্তি নেই
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।   

এখন আর ক্লান্তি নেই |
অনেক গানের পালা পার্বণের বাজনা বাজিয়ে |
এখন আর ক্লান্ত নই |
বার বার তেহাইএ বা সমে
এখন আর ক্লান্তি নেই |
শ্লথনীবি সান্নিধ্যের যৌবনের গান
অনেকের মুখে মুখে অন্তরঙ্গ শরীরের পরিধি ছাড়িয়ে
সমুদ্রের মত সব
ছড়িয়ে পড়েছে দূর দেশে দেশান্তরে |
এখন এ কথা ভাবি,
নতুন সুরের রাষ্ট্রে মঞ্চাধীশ জীবনের কথা |
বিদ্রোহের ভগ্নস্তুপে সৃষ্টির কুশীলব
সংখ্যাতীত ব্যঞ্জনার বীজ নিয়ে ঘোরে
নূতন ফসল, মাঠ ---- সারি সারি ঢাক ঢোল,
নবনাট্যসূত্রে সব অভিনায়ন, নান্দীমুখ পাঠ |
পরিপূর্ণ মানুষের জীবনের ফসলের গান
বিপুল প্রয়াসে-------
সমস্ত রাত্রির শেষে স্বর্ণ-গর্ভ ঊষার কোরাস ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
কোতোয়াল
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।   

নীল অন্ধকার ঠুক্ রে বেড়িয়ে পড়েছিলাম একদিন ঝাপ্ সা আলোর
দেশে। আরও ছোট ছোট জীবনের টুক্ রো আমার আশে পাশে
উস্ খুস্ করতো।
উষ্ণ স্নেহের উত্তাপ, নরম পালকে ঢাকা বুকের চাপ, অত্যন্ত সন্তর্পণে
হাঁ করা মুখে খাবার পড়ত। অনুভব করতাম।
হঠাৎ একদিন আলোর বন্যা এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিল। দেখলাম বাবা---
মাকে। বনের গান আর রোদ্দুর-লাগা ডানার গন্ধ।
দূরে অরণ্যানীর সবুজ-হল্ দে-নীল-লাল।
যখন আমার কালো দুটো ডানা সূর্য্যের আলো ঠিকরে পড়ার মত পিছলে
আর চক্ চকে হয়ে উঠেছে তখন একদিন আমার বাবা-মা-রা আমার
মুখে সুস্বাদু মাংসল একটা ফড়িং গুঁজে দিয়ে আমার পিঠের পালকে
আশ্বাস আর উৎসাহের একটা মৃদু টোকা দিয়ে অন্যমনস্ক উড়ে চলে
গেলেন, অন্য বন অন্য আকাশের দিকে।
বনের অনেক শব্দ অনেক কাকলির মধ্যে তাঁদের স্বর চিরদিনের মত
হারিয়ে গেল।
একলা মন-মরা বনে আমার ভয় করতে লাগল। বুক দুরু দুরু---- ডানা
দুটো ফ়ড়্--ফড়িয়ে উঠ্ ল---- চল্লাম উড়ে নদী পেরিয়ে, পাহাড় পেরিয়ে।
----- অনু ------- ও অনু খাবারটা খেয়ে যা, লক্ষ্ণী মানিক আমার------
দুষ্টু ছেলেটা পালিয়ে বেড়ায়।
কী সুন্দর ফুটফুটে একমুখো দুষ্টুমী । ভারি ভাল লেগে গেল অনুকে।
ছোট্ট পাহাড়টা পেরিয়েই গ্রামটি,----- নিকোনো উঠোন অনুদের বাড়ীর।
পাশেই উঁচু শিমুল গাছের সব চেয়ে উঁচু ডালে বসে ক্লান্ত ডানা দুটো
থামিয়ে দেখেছিলুম উৎসুক হয়ে নিচে।
অদ্ভুত লাগে এই মানুষদের।
ছেলেটি হঠাৎ দৌড়ে এসে মার হাত থেকে মুড়ির বাটিটা কেড়ে নিয়ে
উল্টে ফেল্ লো ---- মুড়িগুলো সারা উঠোনটায় মুক্তোর টুক্ রোর মত
ছড়িয়ে গেল।
----- শুধু শুধু মুড়ি বুঝি কেউ খায়।  বল্লুম কালকের রাখা সন্দেশটা দাও
এর সঙ্গে তা না------- , আমি খাবো না------
রাগ করে দুম্ দুম্ করে পা ফেলে বাড়ীর বাইরে দৌড়ে পালালো।----
ও অনু ----- শোন্ শোন ---- দেখলে, কী বজ্জাত ছেলেরে বাবাঃ--- আচ্ছা
ফিরে এসো------ মজা দেখাব----।
ছেলেটি রাগ করে আমারই গাছের নিচে দাঁড়ালো।
হঠাৎ ওপরের দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে একটা ঢিল কুড়িয়ে
আমার দিকে তাগ্ করে ছুঁড়লো। ছোট্ট কচি হাতের ঢিল, আমার
কাছ অবধি পৌঁছল না।
আমার ভাষায় অনুকে মিষ্টি করে ডাক দিলাম---- তার মায়ের মতন।
ও অনু , অনু, ভাই লক্ষ্মীটি-------
ছেলেটি কি বুঝল জানি না, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে,
প্রকান্ড, / বড় বড় চোখ আর টুকটুকে ফলের মত ঠোঁট নিয়ে।
ইতিমধ্যে ওর এক সঙ্গী এসে জুটলো------
------এই হাঁ করে গাছের দিকে কী দেখছিস রে অনু-----?   ওই ফিঙেটা
বুঝি।  দাঁড়া------
------ অনু কোমর থেকে গুলতি বের করল। খট্ করে একটা পাথরের
টুক্ রো এসে লাগ্ ল ডালে----- বেগতিক বুঝে টুক্ করে অন্য ডালে উড়ে
বসেছিলাম, না হলে কী যে হত বলা যায় না।------
বা রে, তুই আমার পাখীটাকে মিছি মিছি মারলি কেন-----
----- যাঃ যাঃ বুনো পাখী-----, আবার তোর পাখী হল কবে থেকে-------।
তারপর আমাকে নিয়ে অনুর ঝগড়া আর হাতাহাতির দৃশ্য। আরও
নিচু ডালে নেমে এলাম। ভারী মজা লাগল।
বুকের ভেতরে নতুন আবেগের আন্দোলন অনুভব করলাম। আমার
আর অন্য বনে যাওয়া হল না, যেখানে অনেক কচি কচি সবুজ ফড়িং
লাফ দিয়ে বেড়ায়, পাকা ফলের গন্ধে বাতাস ম-ম করে।
রয়ে গেলাম অনুদের গ্রামে, তাদের বাড়ীর আশে পাশে।
একটা বিজাতীয় স্নেহ পেয়ে বসল আমাকে।
একবার মনে হয়েছিল অবশ্য চলে যাই যেখানে আমাদের স্বজাতীয়
একটি তন্বী কিশোরীকে দেখেছিলাম আমার শৈশবের বনে।
মনে পড়ে দুজনে একটি উড়ুক্কু ফড়িং এর পেছনে ধাওয়া করেছিলাম।
দুটি হৃদয় দুজোড়া ডানায় ভর করে উড়ে চলেছিল অসীম উল্লাসে।
যৌবনের উত্তাপ আর সান্নিধ্যে রাত কেটেছিল। তার শিহরণ এখনও
একটু একটু নাড়া দিয়ে যায় নীল স্বপ্নের মত।
কিন্তু এ আমার কী হল ! অনুকে রোজ দেখতে ইচ্ছা করে, কাছে
থাকতে ইচ্ছে করে।
শ্লেট আর বই নিয়ে স্কুলে যায় অনু। আমি কিসের অমোঘ আকর্ষণে
উড়ে যাই তার সঙ্গে। তাদের স্কুলের কাছেই একটা উঁচু গাছে ডেরা
বাঁধি।
স্কুলের ছেলেদের কল-কোলাহল আর মাঝে মাঝে অনুর উল্লাসের
চীৎকার সঙ্গীতের মত কানে লাগে।
-------  জানিস এ আমার পোষা পাখী-------
আমাকে দেখিয়ে অনু বলে।  তোরা কেউ গুলতি ছুঁড়ে মারবি না----।
খবরদার----- !
বুঝতে পারি, আমরা দুজনে একটা সূক্ষ্ম সূত্রে বাঁধা পড়ে গেছি।  ক্রমে
ক্রমে ওদের ভাষাও  আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে আসল।  কতদিন
কাটল এইভাবে। বন্ধন হল গভীরতম।
অনু আজকাল তার খাবার থেকে ছোট ছোট টুকরো আমার দিকে
ফেলে দেয়। আমি উড়ন্ত অবস্থায় টুক্ করে ধরে ফেলি ঠোঁটে।
এও একটা নিত্যকার খেলা হয়ে দাঁড়ালো আমাদের।
ওদের খাবার সাধারণতঃ আমাদের রোচে না। কিন্তু অনু কিছু দিলে
আমি একটু একটু করে চেখে দেখি---- বিস্কুটের টুক্ রো, সন্দেশের টুক্ রো
আরও কত কি সব মানুষের খাবার।   ক্রমে অভ্যাস হয়ে গেল সবই।
একদিন এক বিপদ হল।
অনু বসেছিল শিমূল গাছটার নিচে। হাতে খাবারের ঠোঙা।
আমার দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছিল।
এমন সময় তার পিছনের দিককার এক পুরানো ইটের পাঁজা থেকে
বেড়িয়ে এলো মূর্ত্তিমান সর্পিল মৃত্যু, হল্ দে হল্ দে কালো কালো ডোড়া
কাটা। এঁকে বেঁকে এগিয়ে চললো অন্যমনস্ক অনুর দিকে।
আমি চীৎকার করে তাকে সাবধান করে দেবার চেষ্টা করলাম, বেচারী
অনু বুঝতে পারল না।
আমি আর থাকতে না পেরে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বিষাক্ত
সাপটার গায়ে, শানানো শক্ত ঠোঁট্ দিয়ে তার মাথাটাকে দিলাম চিড়ে
দুফাঁক করে।
অনু চম্ কে ফিরে লাফ দিয়ে সরে দাঁড়াল। তারপর সেই মরা
সাপটাকে দেখে তার কী উল্লাস আর হাততালি-----
----- সাবাস ----- কালো মানিক ---- দাঁড়া তোর আজ থেকে নাম দিলাম
কোতোয়াল------ বুঝলি ------ কোতোয়াল। ছাই বুঝলি------
তারপর থেকে ও কোতোয়াল বলে ডাক দিতেই আমি সাড়া দিতাম।
আমাদের এই অসম্ভব অবাস্তব প্রেমকে গ্রামের লোকেরা খুব কৌতুকের
চোখে দেখত------- বিশেষতঃ অনুর সমবয়সীরা।
অনুর বাবাকে দেখতাম -------- বেশ রাসভারী লোক।
কেমন যেন রাগী রাগী চেহারা।
আমার তাকে দেখে ভয় করতো ।
অনুর মা আবার তেমন ভাল মানুষ----- নরম গোলগাল---- ভারী ভাল
লাগত তাকে----- ভয় করতো না।
অনুর বাবা পাটের দালালী করতে দূর দূর গঞ্জে যেতো। এক একদিন
সন্ধ্যায় চোখ লাল করে টল্ তে টল্ তে বাড়ী ফিরত।
সেদিন শুনতাম মারামারি শব্দ, অনুর পরিত্রাহি চীত্কার, আর অনুর
মায়ের কান্না।
বড় নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর লাগত অনুর বাপ্ টাকে। আমারও এক একদিন
রাগ হয়ে যেত----- দিই বদ্ মাইস বুড়োটার টাক ঠোঁটের খোঁচায় ফুটো
করে------- !  মনে হত।
অনুর জীবনের এইরকম ছোট খাট অনের ঘটনায় নিজেকে জড়িয়ে
নিতুম। আমার রক্তে ওদের জীবনের ছন্দের দোলা নেশার মত
আবিষ্ট করে রাখত।
তবু মাঝে মাঝে চলে যেতাম দূরের পাহাড়টা পেরিয়ে বিচিত্র অরণ্য-
স্বরের রাজ্যে, সবুজ ফরিং , রামদনু প্রজাপতি আর কালো-নীল-মেদ-রং
বুনো জামের রাজ্যে।
অনুর ------- “ কোতোয়াল” ----- ডাকের দূর প্রতিধ্বনি, যাদুকরের  বাঁশীর মত
আমাকে আবার ফিরিয়ে আন্ তো তাদের গ্রামে।
একদিন সকালে উঠে অনুকে দেখতে পেলাম না। কোথায় গেল
ছেলেটা----- ! না স্কুলে না মাঠে, না গ্রামের কোথাও।
নানান্ ডাকে অনুকে ডাক্ তে ডাক্ তে এদিক ওদিক উড়ে বেড়ালাম।
সন্ধ্যার ছায়া গ্রামটাকে ঘিরে ধরল তবু  তার দেখা নেই।
মনটা খাঁ খাঁ করতে লাগল।
বিষন্ন চাঁদের দিকে চেয়ে সমস্ত রাত কত গান গেয়ে কাটালাম।
ভোর হতেই আশা হল, হয়ত আজ অনুকে দেখতে পাব।
অনুর মা নিঃসঙ্গ নিরুদ্দেশ অবস্থায় আমাকে দেখে ডাক দিলেন----কিরে
কোতোয়াল, অনুকে খুঁজছিস বুঝি ?  সে স্কুলের পড়া শেষ করে
শহরে কলেজে পড়তে গেছে-----। বেচারী ----- আয় আয় আয় এটা খা-----
টুক্ করে খাবারটাকে মাটির থেকে কুড়িয়ে নিয়ে উড়ে পালালাম অন্য
গ্রামের দিকে।  এখানে আর ভাল লাগে না। উধাও দিগন্তের দিকে
উড়ে চলি অন্যমনস্ক হয়ে, আবার ফিরে আসি।
ইতিমধ্যে হঠাৎ অনুর দেখা---- হাতে ছোট্ট ব্যাগ, আসছে ষ্টেশন থেকে
হেঁটে, হাসি-হাসি মুখ।
বুকের রক্ত উঠল চল্ কে। চীৎকার করে ডাক দিতে দিতে ওর দিকে
উড়ে চল্লাম।
অনু একটু হেসে ওপরের দিকে তাকিয়ে আবার চলতে লাগল, যেন
কিছুই হয়নি।
একটু দূরে যেন সরে গেছে ছেলেটা আমাকে ছাড়িয়ে অন্য কোথাও।
অভিমান এসে আমার ওড়বার আকাশটাকে ছায়াছন্ন করে দিল।
মানুষের মন ঝাপসা রহস্য ঠেকে। কী যে হয় এই মানুষগুলোর।
সেদিন বিকালে অবশ্য আমার আশায় সে সেই শিমূল গাছটার নীচে
বসেছিল খাবার নিয়ে। তবু ভাল একেবারে ভোলেনি আমাকে।
অনু শহরে যায় আর আসে----- এই টানা---- পোড়েন তাঁত বোনা।
দিনগুলি কেটে যায়। অভ্যস্ত গ্রামটিকে ঘিরে আমার আবেগটা ধীরে
ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। বেশ বড় আর সুন্দর হয়ে উঠ্ ছে ও।
আজকাল ষ্টেশনের দিকে চলে যাই।
একটা টেলিগ্রামের তারের ওপর বসে সূর্যাস্ত আর বিরাট ধূম্রলোচন
চলিঞ্চু ট্রেনের ইন্ জিন্ টাকে দেখি। দূর সহরের দিকে সন্ধ্যার ট্রেন
চলে যায়------- অনুর দিকে।
একটা প্রতীক্ষার সুর খুঁজে পেয়েছি----- এখন থেকে প্রান্তর সবুজ ধান
ক্ষেত পাহাড় নদী ডিঙিয়ে শহরের দিকে চলে যায় তার রেশ। শিস
দিয়ে ভাঁজি সেই সুর, আর একেবারে  নির্জ্জন হয়ে যায় মন আদিম অরণ্যের মত।
এরই মধ্যে একদিন অনেক লোকের ভীড় আর আনন্দ-কোলাহল অনুর
বাড়ীর কাছেই।
কৌতূহল হল।
উড়ে গিয়ে সেই শিমূল গাছটার চূড়ায় বসলাম ! আনন্দ কোলাহলটা
অনুকে ঘিরেই। অনু ফিরছে। খুব উত্তেজিত আর ব্যস্ত দেখলাম
অনুকে।
ভাবলাম আমাকে খুঁজে কিছু একটা আনন্দ সংবাদ দেবে সে। কিন্তু
কই---- সেই পরিচিত গাছটার দিকে ফিরেও তাকালো না।
আমি ভিখারীর মত ঘুরে বেড়াই শুধু এক টুকরো কথা, এক টুকরো
দৃষ্টির জন্যে।
অনুর মায়ের স্বর কানে---------
------- সোনার চাঁদ ছেলে ------ পরীক্ষায় ভালভাবে পাশ করে একটা সওদাগিরি
অপিসে চাকরীও জুটিয়ে এসেছে-------
------- বেশ বেশ ---- এবার সন্দেশ খাওয়া-------
------  ও ভট্টাচার্য্য, মশায়, এবার একটা টুকটুকে বৌ নিয়ে আসুন অনুর
জন্যে-----
------ বিয়েটা লেগে যাক কী বল-----
কে একজন এসে ওর নরম চিবুকটা নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সুন্দর মুথটা
লজ্জায় সিঁদুরের মত লাল হয়ে উঠল। লজ্জা পেলে অনুর মুখটা
এত সুন্দর দেখায় কী বলব !
তবু ঐ------- “বিয়েটা লেগে”------  এক বিয়োগান্ত গানের ধূয়ার মত মনের
ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে।
অনু স্নেহের ভীড় তেকে সরে এসে শিমূল গাচের নিচে আশ্রয় নিল আর
অনেক দিন বাদে আমাকে কোতোয়াল বলে ডাক দিল।
মনটা এমনিতেই ভেঙ্গে পড়েছিল তবু সাড়া দিলাম। চলল অনু
স্কুল-বাড়ীর মাঠ পেড়িয়ে নদীর ধার পর্যন্ত।
চল্ লাম আমিও ডাকতে ডাকতে। সন্ধ্যায় আকাশ ম্লান লজ্জার মত
পশ্চিমে মিলিয়ে যায়।
বিয়োগ-পুরবীর গভীর কোমল রেখা-------- মনে বাজতে থাকে।   আমি
আর অনু শেষবারের মত পরস্পরকে দেখি------- নির্ব্বাক তাকিয়ে থাকি
স্মৃতি ভারাক্রান্ত দূর পাহাড়ের দিকে।
সমস্ত গ্রামটা তোলপাড় ক’রে অনুর বিয়ে একদিন এসেই পড়ল।
গ্রামের উৎসবের চূড়ায় অনুর সলজ্জ মুখটা ভেসে ওঠে। তারপর
বর-বধূকে ঘিরে আনন্দ-হাস্যোচ্ছল দিনগুলি আমাকে আস্তে আস্তে
একেবারে দূরে সরিয়ে দিল।
আজ অনুর বৌ নিয়ে যাবার দিন।
সমস্ত দিন সানাই আর ঢোল বেজে চলছে।  আমি এ গ্রাম থেকে
নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলবার আগে শেষবারের মত অনুকে দেখে
এলাম----- সেই গাছ থেকে।
একজনের মিলনের রাগিনী ---- আর একজনের মুক্তি অনন্ত আকাশের                  
নিচে দূর অরণ্যের দিকে।
সন্ধ্যার ট্রেনটা আসবার অনেক আগেই ষ্টেশনে গ্রামের লোক ভেঙ্গে
পড়েছে অনুদের বিদায় দেবার জন্যে।
অবশেষে ট্রেন এলো নিশ্চিত মৃত্যুর অনিবার্যতায়।
আমি সেই পরিচিত টেলিগ্রাফের তারে ওপর থেকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে
চেয়ে রয়েছি।
মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করে------ কোলাহল হাতছানি সানাই--এর দ্রুত পিলু ---
গার্ডের হুউস্ন------- ট্রেনের আওয়াজ সমস্ত মিলেমিশে একাকার।
আমার শেষ “অনু” ডাকটা শোনা গেল না বোধহয় ----- ট্রেনের বাঁশীর
আওয়াজ।
ক্রমশঃ দূর থেকে দূরতর হয়ে যায় ট্রেন।
ষ্টেশন ফাঁকা হয়ে যায়।
সম্পূর্ণ মুক্ত আজ আমি।
এখুনি ডানা দুটো মেলে ধরবো।
অনেক দূরের বনের দিকে ----- ঘন সবুজ পাতার বন---- অসংখ্য বর্ণালী
ঘেরা আকাশ পাহাড় আর মাটি।
এবার নিশ্চিহ্ন হয়ে ডুবে যাবো আদ্মি অরণ্য-সমুদ্রে---- যেখানে
মানুষেরা থাকে না, অনুরা থাকে না।

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
হো চি মিন
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।   

সমস্ত পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে, তোমার প্রতিজ্ঞা
সমস্ত মানুষের প্রতিভু, তোমার ইচ্ছা-----
স্থির জ্যোতি বিদ্যুতের আলোক ছড়িয়ে গেছে-----
সমগ্র এশিয়ার স্বদেশ ------- মানসে।
মেকং নদীর জলে তোমার ছায়াটা আজ সরে গেছে,------
স্থির প্রাজ্ঞ দধিচি-অটল সেই দীর্ঘ মূর্ত্তি ছায়া------
মিশে গেছে এশিয়ার,------ পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে।
মেকং তো সাক্ষী আছে, ইতিহাস------- বিপ্লবের
হাতে গড়া তোমার কীর্তির।
জানি আমি মৃত্যু নেই ------ অমর তোমার নাম।
মৃত্যুই প্রাণের বীজ,------ ছড়িয়ে পড়েছে সব
ভিয়েত্ নাম নিয়ে মুক্তিকামী মনের মিছিলে,
জীবনের মুক্তির অপর উজ্জ্বল নাম তাই---- হো চি মিন।
তোমাকেই মন্ত্র করে অনমনীয় গোরিলা বাহিনী
ছিন্নভিন্ন করে দেয়, নৃশংসতম মানুষের শত্রুদের।
কী সুন্দর !  কী কমনীয় কান্তি পাই, শান্ত সমাহিত,
তোমার প্রচন্ডতম বিপ্লবের মুখে-------
পরিপূর্ণ মহা-মানবের।
সংগ্রামের আগুন-রাঙা অক্ষর দিয়ে তাই,
মানবিক মমতায় কাব্য লিখে গেছ----- পদ্মফুল গোলাপ আর
পাহাড়, ধানের ক্ষেত, অগাধ আকাশ নীল সমুদ্রের তীরে।
তোমার প্রাণের স্পর্শে-------
দুর্ভেদ্য দুর্গের মত অজেয় গর্বের মাথা তোলে ইন্দোচিন ।
তোমার জীবন নিয়ে মৃত্যুহীন ইতিহাস, তুমি হো চি মিন॥

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
যে ভাষায় আজ তুমি কাছে---
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।   

যে ভাষায় আজ তুমি কাছে
এসে জানাতে পেরেছে-----
এ মানুষ একদা ছিল
আদিম হিংস্রতা নিয়ে
আরণ্যকে সমাধিস্থ,
শিলাস্তৃত জীবাশ্ম আবেগে
অযুত আলোক-বর্ষে স্তরে স্তরে
হয়ে গেছে ইতিহাস-নির্মোক-লিপি,
সে ভাষা আমাকে দিও,
আমার এ নির্বাসনে অনেক দূরের পথে
নিয়ে যাবো সাথে।
কারণ,
এ নষ্ট ভ্রূণ জীবনের অনেক দেখেছি,
শুধু এ অবক্ষয়ে প্রতিদিন একান্ত নায়ক
যে কোন নগরে আজ নিরঙ্কুশ ত্রাটকে আসীন
শবাচারী কাপালিক,
তাল-বেতালের কানে বীভত্সতার মন্ত্র হানে------
( এখনই যেয়ো না ফিরে,
কাছে থেকো, নৃশংস শহরে----- ) ।
এদের প্রাচীন সেই স্বর-বর্ণ ভুলে গেছে,-----
মানুষের ভাষা।
প্রেম, যেন বিক্ষিপ্ত প্রয়োগ,
পশুর মেদের নিচে মৈথুনের আনন্দ-হুংকার
যে কোনো মুহূর্তে তুমি------
নিরীহ হয়েও
হত্যার প্রতিবেশী হবে,
পৃথিবীর যে কোনও রাস্তার মোড়ে
রক্ত-মাংস পিন্ড হয়ে মাটি হয়ে যাবে।
( কাছে থাকো,
এখনই যেয়ো না ফিরে নৃশংস শহরে----- )
জমিতে মৃত্যুর সার, প্রাণের ফসল।
কেন, কেন, কেন এই ভাষাহীন ছন্দহীন
মরে যাওয়া আততায়ী বিপ্লবের হাতে ?
এর প্রতিবাদ আছে,
আমার গানের কলি তোমার ভাষায়।
এর প্রতিবাদ আছে----
সহজ ফুলের এক অমিত আলোর বীর্যে-----
অজস্র উত্ক্ষিপ্ত হাতে, আলোর মশালে।
এর প্রতিবাদ আছে------
যে কোনো পাখির গানে,-----
সবুজ সবুজ মাঠে সোনা গলা ধানের প্লাবনে-------
সারি গান নৌকা নদী উদ্দাম প্রান্তরে।
প্রতিবাদ আছে,
কোনও নিবিড় রাত্রির নীড়ে
তোমার চুম্বন ঘন অমোঘ আশ্লেষে।
এর প্রতিবাদ ঐ লক্ষ লক্ষ আলোর শিশুরা।
হাততালি----- কোলাহল সম্মেলক মাঠের খেলায়
প্রতিবাদ আছে কোন্ অতল গভীরে,
উজ্ জীবন আনন্দের আণবিক বিস্ফোরণে।
আপাততঃ কাছে থাকো,
এখনই যেয়ো না ফিরে,
নৃশংস শহরে।
সমস্ত প্রাণের ঋণ একদিন শোধ করা যাবে
আমরা অপেক্ষা করবো-----হাতে হাত দিয়ে-----
অন্য কোনও অস্ত্র নিয়ে
আলোকের অজস্র বিপ্লবে,
সূর্যোদয়-মুকুট পরা উঠে আসবে
পরিপূর্ণ প্রচন্ড মানুষ।
আমরা অপেক্ষা করবো।
আর্তনাদ হত্যা রক্ত জিঘাংসার
প্রতিবাদ হয়ে॥

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
বিকালের পিঠ থেকে সকালের অলিন্দকে
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।    

বিকালের পিঠ থেকে সকালের অলিন্দকে দেখতে পাওয়া যায় একটা
অস্পষ্ট কিশোরের মত। সামনে এক যাত্রীশালায় রাত্রি।
তারপর এক রাত্রির জন্য মাতলামী আর স্খলিত উচ্চারণ,
তারপর ঘুম-----অন্ধকার ঘুম। আবার ভোরে আলো আকাশকে
সুড়সুড়ি দিয়ে দিনকে জাগিয়ে তোলে। স্পষ্ট তরুণ---- দিন বলিষ্ট-----
কিশোরের মত আমার প্রৌঢ়ত্ব নিয়ে কিছু কিছু বক্রোক্তি করে।
কিন্তু তোমাকে স্পষ্টভাবেই জানাই,---- আমি অনন্তকাল ধরে,
বুড়ো হতে থাকবো----- এক হাতে দিন আর অন্য এক হাতে রাত্রিকে
ধরে।  এক হাতে কাজ আর অন্য এক হাতে শ্লথগতি মায়ের মুঠি
ধরে।  অনন্তকাল।
সর্বত্রগতি হয়ে আমি দেখেছি শহরের সব দেয়াল হয়ে
গেছে, শ্লোগানে শ্লোগানে ভর্তি। লেনিন সরণী দিয়ে হাঁটতে
আরম্ভ করে দেখি এর শেষ নেই। গ্রামে গেলে অন্য রূপ।
অন্য কথা। একটা বিপ্লবের বিস্ফোরণে দিন আরম্ভ হয়ে গেছে।
রক্তের সারে জমির মাটি সহস্রবাহু --- উত্কর্ণ আর প্রস্তুত। শাস্ত্র-
পানি মানুষের মনের কথা মুক্ত জীবনের ভবিষ্যৎকে ধর্ম-----
গোলার গান শেখায়।
সহস্রধা মতকে এক করবার আকাশ একটা মাথার উপর
ঝুলছে। সেদিকে কারো চোখ পড়বার সময় এখন কম।  তবু
একটা গভীর নীল আকাশ আছে সকলের মাথার উপর
ইতিহাসকে অনন্তকাল ধরে বুড়ো করে করে নতুন কৈশোরের
দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
একটা পারিবারিক খন্ড--- সত্যে এখন আমার বিকাল। আমি
সেই বিকালের গায়ে পিঠ এলিয়ে দিয়ে সদ্যোজাত
সকালের অলিন্দকে দেখতে পাচ্ছি অস্পষ্ট কিশোরের মত॥

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
যে পথেই যাও
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
“যে পথেই যাও” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

যে পথেই যাও----
মিলবে এসে এই মেলায়।
যে পথে নোংরা মানুষগুলো অবমানিত
আত্মা নিয়ে জ্বলে উঠ্ ছে বারুদের মত।
সেই পথ দিয়ে নতুন জীবন নিয়ে।
খেলা করছে ছেলেমেয়ের দল,
পথে ঝড়ে-ভেঙ্গে পড়া গাছগুলো তাদের
পা আটকে ধরে।
তবু কিছু ছেঁড়া ফুল, কিছু ছেঁড়া সূর্যের আলো নিয়ে
তারা আসে দেশান্তরী পাখীদের মত।
তারপর বড় বড় লিমুসনের রাস্তা-----
লরী বাস ষ্টেশন ওয়াগনের রাস্তা ।
এর দুধারে ভুরিভোজের ভুক্তাবশেষের নীচে
দুর্ভিক্ষের বীজে মৃত্যুর শস্য লক্ লকিয়ে ওঠে।
সে পথ দৃপ্ত পায়ে মাড়িয়ে
চলে আসে লক্ষ মিছিল।
এই পথ দিয়ে মিলতে হবে মেলায় ।

অন্য পাড়ায় শহরের পোষাকী আন্তর্জাতিক কেন্দ্র।
উদ্দাম ফোয়ারা আর ফুলঝুরিগুলির ভন্ড
আলোটাকে এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিয়ে চলে এসো-----
স্তব্ধ ইতিহাস তাকিয়ে থাকা এই ক্লিষ্ট
আর্তনাদপুষ্ট শহর থেকে বেরিয়ে
রুক্ষ উট-চলা প্রান্তরের দিকে।
চলে এসো এই পথে,----
দেখবে, তীব্র প্রতিবাদ আর শপথগুলি
ফুল হয়ে, গান হয়ে
কল-কোলাহলের উচ্ছ চূড়ায়
হাহাকারগুলোকে জীবনের উদ্দাম হাসিতে
পরিণত করে------,
সহস্রবাহু হয়ে ডাকছে তোমাকে এই মেলায়,
যে পথ দিয়েই যাও॥

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর