জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর কবিতা
*
চতুষ্পদী
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত “পরিচয়” পত্রিকার পৌষ ১৩৪৭ (জানুয়ারী ১৯৪১) সংখ্যায়
প্রকাশিত।

.                (১)
নীল ধোঁয়া যেন হয়েছে মেখলা রেখা
অশ্বারোহীর উদ্ধত মাথা মেঘের বুকে।
স্বর্ণ বিকালে মুলতানী মুখ লেগেছে ভালো।
নিকষ চিকুরে সোনালী রৌদ্রে লেখা
স্বপ্ন কাহিনী । জাগ্রত দিন তোমার মুখে
নিয়ত কি হানে অনাচারী নীল কঠিন আলো।

ঘন ঘন তাই ঘুম ভেঙ্গে যায় পাতাল এ ঘুম,
গভীর, বিরাট আদিম ছায়ারা যেথায় ফেরে,
কর্কশ পারিপাশ্বিকে হয় সমাপ্তি এর
প্রথর সভার আলোকে ত্রস্ত হে দ্রৌপদী।
চিত্রল মন খুঁজে ফের কত অন্ধ হাতে
সামরিক ভিড়ে। জানত যদিও বৃথা এ খোঁজা।

লোহিত তপন ড়ুবেছে
এখন রাত্রি নিঝুম।
মনে হয় ভালো পাশাপাশি থাকা
অনিকেত ছোঁয়া এ সহবাসের ।
যদিচ জৈব রূপায়ণে জানি সমাপ্তি এর।
সমাধি প্রাচীর ভোঙ্গে হয় হোক চুরমার, হোক শেষ
চৈত্রের অবশেষ
জীবনে নামুক। অনুকাঙ্খার বাঙ্ময় অবলেপ
মোদের আকাশে ফুটাক স্নিগ্ধ তারা॥

.                (২)
কভু বুঝি মনে হয় প্রাণ বায়ু আবৃত্তির দাস
নিত্য ঠা পড়া আর প্রাত্যহিক লোভ পরিক্রমা,
দেহ হতে দেহে, আর মন হতে মনে।
ইন্দ্রিয়ের অতিথিরা পরস্পর বিতণ্ডায় ভোর।
তাই বেঁচে চলি
পলে পলে পাণ্ডুতম মুহূর্ত্তেরে পদতলে দলি।
প্রতিদিন একই সুর সাধা
তান্মাত্রিক ঐকতানে দিনের প্রহরগুলি বাঁধা।
নিচের গলিতে শুনি আগন্তুক শিশুদের খর করতালি
নিরাপন্ন প্রাণের কাকলি,
চীনে ফিরিওয়ালা হাঁকে,
ক্যাংস নাদী দ্বিপ্রহরে দূরাগত ট্রেনে সাইরেন।
এই সব শত-গ্রন্থি দিনগুলি নাচে আর ঘোরে
পায়েতে ঘুঙুর বাঁধা ভিখারীর মত।
সে শিঞ্জন-সমাধিতে মনে হয়
এ জীবনে সমাপ্তি কি নেই।
দুর্জ্জয় মানুষ,
হায়, দুর্জ্জয় মানুষ তবে এই!
প্রকৃতির শাপে দেখি ভম্মীভূত
দুর্ব্বল কাগজ।
পরিশ্রমে রক্তমুখ, মস্তকের ঘর্ম্ম ঝরে পায়ে।
অন্ধকারে ভয় হয়, বুঝি পাতা আছে
ইঁদুরের কল।
আর্ত্তনাদ কভু শোনা যায়
কবলে পড়েছে কোনও অসতর্ক প্রাণী।
দুরন্ত রুটির গদ্ধ পুলিশের মত ধরে আনে।

তবু দেখি রৌদ্র নামে,
রৌদ্র ধোয়া বাড়ীগুলি স্বপ্ন দেখে নির্জ্জন চাঁদের।
প্রতিদিন অধ্যুষিত তাম্র দগ্ধ কায়
দিনাস্তের স্বপ্নে দেয় ডুব,
তপ্ত হাতে করে পান রজনীর স্নিগ্ধতম স্নেহ॥

.                (৩)
ক্ষান্ত-বরিষণ সন্ধ্যা
এখানে, অথবা আরও সহস্র নগরে।
কামনার আমন্ত্রণে কুঞ্জে কুঞ্জে দ্রুত পদক্ষেপ
দ্রুততর ধমণীর গতি।
ধর্ষিত নক্ষত্রলোক কোটি ম্লান চক্ষু মেলে দেখে
আততায়ী মূর্ত্তিগুলি স্তব্ধ মোড়ে মোড়ে
সংহত সংহার বেগে---মর্ম্মর সমাধি।
পশ্চিম আকাশে ফোটে রক্ত সরোবর
লাল ফৌজ সারি সারি উদ্যত সঙ্গীন্---
প্রশান্তির বক্ষ-ক্ষতে রক্তিম গোধূলি।

প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের আবির্ভাব হল বুঝি দূরে
মৃতা-ভাও হাতে॥

.                (৪)
কামনায় শ্রান্তি নাই, মুমূর্ষু পোকার ঘুরে মরা
তপ্ত দীপাধার ঘিরে ; হৃদয়ের শুধু ওঠা পড়া---
কামনায় শান্তি নাই। নির্বেদের সাড়া পাই মনে
শ্রমলব্ধ জীবনেরে বৃথা ধরে রাখা প্রাণপণে।
অনুস্মরণের জালে ধূলিসাৎ প্রাসাদ জড়ানো,
অনুর্ব্বর পাহাড়ের শান্তিপাঠে রূঢ় উচ্চারণও

মর্ম্ম পশে,---বসন্তের ধ্বংস অবশেষ।
প্রাণীহীন নগরীতে বিচরণ এই বুঝি শেষ।
ভারী জগতের ভ্রণ রূপায়িত কোন শুভ্র মেঘে
খুঁজে ফিরি, আর ঊর্ধ্বে অহরহ গোপন আবেগে
কাঁপে নীল নিঃশেষের ঘন অবকাশ
নীড়মগ্ন পাখীদের স্তব্ধতায় নিথর আকাশ॥

.             ****************                                                         
সূচীতে    




মিলনসাগর
*
নায়ক
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত “পরিচয়” পত্রিকার পৌষ ১৩৪৮ (জানুয়ারী ১৯৪২) সংখ্যায়
প্রকাশিত।

বলদৃপ্ত তুরঙ্গম অবলুপ্ত। প্রস্তর পথের
বক্রদেহে খুরাগ্নির শেষ আভা জ্বলে।
অশ্বারোহী শিরে
উষ্ণীষের প্রান্তে লাগে ম্লান অস্তরাগ,
মুমূর্ষু দিনের শেষ আরক্তিম স্নেহ।
আসন্ন তাণ্ডবে কাঁপে খাণ্ডব নগরী ।
মত্ততায় টলমল দীপান্বিতা নিশা।
ক্ষণজীবী হাউইএর উৎক্ষিপ্ত উচ্ছ্বাস
আকাশের গায়ে আঁকে পতনের রেখা।
দর্শকের করতালি মৃদু হয়ে মেশে কি মর্ম্মরে
জনতার হৃদয়ের। শাল প্রাংশু পেশী যায় ক্ষয়ে।
তরবারি জগদ্দল, দূরে থাকে আত্মঘাতী ভয়ে।
অগত্যা এ রাসভ বাহন।
আর দেখি এই জনপদে
লঘুপদ পিলীলিকা সারি
বৃত্তাকারে মাঝে মাঝে জমে
মধুবিন্দু ঘিরে।
বেগ নাই, স্তব্ধ মনে পাকস্থলী ভরা
কিংবা শুধু ইতস্ততঃ ঘোরা।
বেতার বিলাসে দেহ ভাসে আর ডোবে,
পঙ্কিল পদ্মার স্রোতে পূতিস্ফীত শব।
দিনান্তের স্তব,
খুব ভাল ঠুংরি গায় কুমারী শোভনা
এ পাড়ায় সে-ই কিন্নরী ;
অন্ততঃ গুর্জ্জন বাই আজও হার মানে।

তার মানে, যেথা যাও অঞ্চলের ভৌগলিক সীমা
মনেরে ধরেছে ঘিরে কর্মনাশা পাশে।
অবসর বুঝে সভা সমিতিতে যাওয়া,
ভদ্র ভীড়ে ভণ্ড ভাবে আড় চোখে চাওয়া
শৃঙ্গার সুষমা ঢাকা বালিকার পানে,
ব্রহ্ম ও আত্মার ‘পোড়ো ক্ষেতে’ হাওয়া খাওয়া
নিষ্প্রদীপ ঘরে মুখে সিগারেট দ্যুতি
জ্বলে আর নেভে। রাজ্য গেল ছারখারে!
এখন পড়িছে ছেদ ভুরি-ভোজনের উদগারে।
তাই আজ কুমারীর কেশে বেশে ক্লিষ্ট আমন্ত্রণে
পিষ্ট অভিলাষ,
শিবনেত্র স্বপ্নসেবী নায়কের বিরক্ত বিলাস॥

মদমত্ত তুরঙ্গম অধুনা ত রেসমৃন্ধ ছোটে
অর্থকরী বল্ গায়, জুয়াড়ীর লোলুপ ইঙ্গিতে।
শ্রমলব্ধ উপার্জ্জন ব্যর্থ হয় বালুকা বেলায়।
মোড়ে মোড়ে ঘোরা ছাড়া কাজ নাই তাই।
মারণ ঝঞ্ঝায় দোলো জানালার মুখ,
বিপ্রলন্ধা, বসন্তের রক্তলেশহীন।
মৃত্তিকার স্পর্শহীন অর্কিড্ কুসুম,
ব্যর্থ তার বর্ণ বিহ্বলতা।
অতঃপর,
বন্ধুবর বিষ্ণু দে-র কাছ থেকে শোনা,
মোদের গ্লুকোস সেবী সুরেশের হয়েছে পতন
হয়েছে অধুনা
অর্ব্বাচীন সুরেশের আত্মদাবদাহ
আত্মার গভীরে।

মনে হয় ফুরায়েছে মৃগয়ার তূণ।
জীবনের বর্ণছত্রে ধরেছেও ঘূণ।
বিবর্ণ আকাশ, মন, নিঃস্বপ্ন প্রান্তর,
ছত্রভঙ্গ মনে নাই, বিজৃম্ভিত নায়িকা বিলাস।
ব্যর্থতার অপরাধে,
জীবিকার স্বর্ণ মৃগ হয়েছে মারীচ।
কামনার তুঙ্গতম শৃঙ্গ পড়ে ঢাকা,
বজ্রগর্ভ মেঘে।
অহিফেনসেবী দিন ছিন্নমূল শিথিল এখন॥

মধ্যরাতে ঝড় আসে।
ম্লায়মান আলোকের স্তম্ভ সারি সারি
পাথে উচ্চ গাঢ় ঘন বাড়ী
প্রতীক্ষায় নিস্তব্ধ মিছিল।
আসুরিক মেঘে মেঘে পদধ্বনি বাজে,
নেমে আসে ভয়ঙ্কর। ভয়ে
স্তব্ধ অন্ধকারের কঙ্কাল।
মধ্য রাতে আসে ঝড়।
মল্লারের ক্রুদ্ধ স্বরগ্রাম
নিষ্পেষিত দন্তে দন্তে বাজে
দুরন্ত মেঘের। ছিন্ন পুষ্পসজ্জা উড়ে যায় ভয়ে।
শৃঙ্গারের অট্টরোল কাঁপে
কত না বাহবাবর্ষী বাবুদের মুখে,
স্খলিত আবেগ,
সংপ্লবের গান।
ত্রাসপিষ্ট অন্ধকারে,
বায়ুছিন্ন রাত্রির শিথিল শিখরে বুঝি ওড়ে
নারীকণ্ঠে বোনা পাড় মিনতির রেশ্ মী রুমাল্‌।

তুমি যাবে? এসো না, কত বা দূরে, ওই মোড়ে---
স্থান হবে---রিক্শর নীড়ে
পাশাপাশি ঠাসাঠাসি এ বাদ্‌লায় মন্দ নয়।
কাল এসো তুমি---। দোকানের ঝাঁপি নামে।
সিক্ত মার্জ্জারের ক্ষেদ জানালার পাশে এসে থামে।
প্রবল ফুৎকারে নিভে গেল বুঝি আলো,
এ চোখের, ও ঘরের, দোকানের, শুভেনের
শয়নের পাশে আর ও দোতালার ফ্ল্যাটে,
গণ্ডগ্রামে কুটিরের, হরিজন বস্তির
নামহীন কত শত মুমূর্ষুর চোখে॥

রাত্রি কাটে ক্ষুরধার
মিনিটের খড়্ গে। জাগে শুক্ল শুকতারা
স্বপ্নক্লান্ত শয়নের পাশে,
শেষ তন্দ্রা প্রহরের স্তিমিত লণ্ঠন্‌।
দিন আসে আবৃত্তির মত।
অনুষঙ্গে নাচে চারিদিকে
প্রাণবীজ, বায়না দেওয়া বসন্তের বুকে।
সূর্যকর খর করতালি
দিগন্তে উড়ায় শুধু বালি,
গৃহ কপোতের ঝাঁক ডিগ্ বাজী খায় মত্ত সুখে
নীল চন্দ্রাতপে।
জঠরে দামামা বাজে দশটায় ঠিক্।
আত্মসমর্পণ যোগ কি কঠোর এই দুর্দ্দিনে।
সদাগরী অফিসের জ্বলম্ত কঠাহে
তেল্‌, নুন্, ঝাল্‌ মাখা আত্মাদের স্তূপে
প্রতীতিই পক্ক হয় প্রত্যভিজ্ঞা রূপে।

অগ্নিবর্ষী আকাশের নিচে
তৃষাতপ্ত সহরের বিষাক্ত প্রাঙ্গণে
নিঃশেষ শায়ক এই বালক নায়ক।
বুকে তার নামে এই দ্বিপ্রহর দগ্ধ খর দিন
প্রবৃত্তির আবৃত্তির মত।
নাগরিক চাটুবাক্য শুধে গেছে তার শেষ ঋণ।
বন্দরের শুল্ক দেওয়া শেষ।
দগ্ধরথ অশ্বহীন যৌবনের সেনা
চেয়ে দেখে অন্তঃপুর দাবাগ্নি মুখর,
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ধ্বসে পড়ে পৌরুষ প্রাকার।
বিধ্বস্ত দিনের শেষ ক্লান্ত মুল্ তানে,
বারবার প্রাণ প্রার্থনায়।
সূর্য ডোবে। নভশ্চক্রনেমি অচঞ্চল।
আরক্ত কুন্তল
পশ্চিম সমুদ্র তীরে
সন্ধ্যা বসে শ্লথনীবি প্রত্যালীঢ় পদে॥

এ গোলকে কতদিন দেহরক্ষী হয়ে
আর কতদিন, কেন্দ্র খসা তারা সম।
বৈরিতার তাপে এই ভূলোক ত গলে যাবে ক্রমে
মধূত্থের মত, সীমাহীন শূন্যতার
গর্ভে। বাধ্য তবু সাক্ষী থাকিতে ইহার
নিষ্পলক, মূক, জরা প্রকুঞ্চিত দেহে।
প্রাক্তন প্রতীত হয় ভবিষ্যের ভ্রূণে
এ সান্ত্বনা মানি তাই দিন গুনে গুনে
চরম ক্ষয়ের পর্ব্ব নীরবে কাটাই
বর্ব্বরের লীলা ক্ষেত্রে। এখন গোধূলি
নামে ক্ষমাম্লান সবিতার ক্রোড় হতে
আসন্ন তাণ্ডবে ক্ষুণ্ণ খাণ্ডব নগরী॥

.             ****************                                                         
সূচীতে    




মিলনসাগর
*
সকালে শহীদ হয়ে ফিরে আসে মায়েদের কাছে
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
গোপাল হালদার সম্পাদিত “পরিচয়” পত্রিকার বৈশাখ ১৩৭৩ (এপ্রিল ১৯৬৬) সংখ্যায়
প্রকাশিত।

অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন মৃত্তিকার গভীরে সংহত
স্বর্ণবীজ উদ্ভিদের মন
সেখান থেকেই সব নরম-পালক
সরু থির-থিরে অবয়ব নিয়ে
একরাশ নিমবিত্ত জন্ম নেয়
আকাশের নিচে। একরাশ তারা।
আনন্দ মাইতি আর আবুল কাশেম।
শহরতলীর বস্তি, গ্রামের মাটিতে---
কুমোরের স্নেহে গড়া মাটি-রং মায়েদের দেখেছি তাদের
.                ব্যথা টল্-টল্‌ ঘন চোখের পাতায় কাঁপে
মর্মন্তুদ জীবনের ভার---
মাটি-রং মায়েদের।
আনন্দ ও শাস্তির গুপ্তচর তারা---
আবুল কাশেম আর আনন্দ মাইতি।
আমাদের দেশ আর সারা মানুষের দেশে
সংগঠন। দিনভর চাঁপদানি চটকল
লোকো-শেড ঘুরে ঘুরে শাণিত হয়েছে।
উৎকর্ণ গভীর রাত্রে টোকা দেয় দরজায়---
দরজা খুলে বাসি ঢাকা খাবারের ক্ষুধা---
মায়ের আশ্রয়।
ভুখ-মিছিলের এক মিটিংএ অসংখ্য তারা
বিন্দু বিন্দু জমে,
ময়দান---রক্তবীজ সাগর সঙ্গমে।
ওৎ পেতে ছিল---
হেলমেট্ সঙ্গীন আর বুলেটের নৃশংস প্রতিভা।
রাত্রে আর চুপি চুপি ফেরে নাই তারা---
দরজায় টোকা নেই---শব নেই---স্বাদ নেই ষড়যন্ত্রের।
মায়েরা গভীর ঘুমে---আচ্ছন্ন রাত্রির গায়ে নিষ্পলক তারা।
সকালে শহীদ হয়ে ফিরে আসে মায়েদের কাছে
একরাশ ফুল হয়ে, নিম্নবিত্ত জীবনের বুকে
আনন্দ মাইতি আর আবুল কাশেম॥

.             ****************                                                         
সূচীতে    




মিলনসাগর
*
অর্বাচীন
জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত “কৃত্তিবাস” পত্রিকার বৈশাখ ১৩৭৩ (এপ্রিল ১৯৬৬) সংখ্যায়
প্রকাশিত।

( ভাগ্যবান শ্রীঅতনু সরখেলকে )

তীব্র স্পষ্ট কথা---মানে, অত্যন্ত বিশুদ্ধ কীট-দষ্ট
এক খচ্চরের কানের মতন
দুর্গন্ধ ছড়াতে গিয়ে হোঁচট খায়।
একটা স্পষ্ট কথা অহরহ ঢুকতে চেষ্টা করেছে রোজ---.
গত কয়েক বছর ধরেই---
( বাসে বাসে বন্দরঘাটায় আর ডলির আনাচে কানাচে ঘুরে
বুঝতে পেরেছি সেটা---)
সামূহিক মগজে---অর্থাৎ
সেই পুরনো ছাই-রং ঝিটা, প্রাক্তন বড়োবাবু প্রিয়া,
এখনও ধুঁক্ ছে---
প্রায় বারোটা বেজে এসেছে তার,
অর্বাচীন শেষ কবিতা লেখার নোংরা আকাশ
তাকে ল্যাট্রিন-চাটা নীল মাছির মতো ছেঁকে ধরেছে।
ভাস্কর্যই চাই আজ।
মনের বালাই নিয়ে তাই অশ্লীল খিস্তি
সাম-গান কাঁচা মাংস নির্লোম নিতম্বের দিকে
ছোকরা নেত্রপাত, আর
আকাশ-মাটি মাখা উপুড় করা ডাস্টবিনে
সপ্তর্ষির নির্জন আলোক---।
এ সবেতেই নির্বাচন, প্রসিদ্ধ।
সেই শেষ নির্বাচনে হেরে গিয়ে শব্দকোষ
উচ্চৈঃশ্রবা-ডিম্ব হয়ে গেছে।
উপায় তো নেই।
তবু, একটা স্পষ্ট কথা বলতে গিয়ে
পুরনো বাড়ির নড়্ বড়ে থামটা পড়ে গেল---
তোতলা বুড়ো ক্যানভাসার অতনু সরখেল ছিল
সেখানে দাঁড়িয়ে,
বেঁচে গিয়ে সেও তা দেখেছে।
অবিনাশ কুণ্ডুর অমিত-বিক্রম শ্বশুরের মতো
নিষ্ফল তীর্থে ঘুরে বেড়ানো স্পষ্ট কথাগুলো
বাঁচবে না জানি,
সোনালী মাছেরা সব হল্ দে হতে হতে
উপকারী উট হয়ে গেছে।
একেবারে শেষ শেষ অর্বাচীন কবিতায় অবশ্য
জলে @ উঠবে মৃত্যু-সূর্যে নূতন বাবুরা॥

@ - বানান যেমন দেওয়া, তেমনই রাখা হয়েছে।

.             ****************                                                         
সূচীতে    




মিলনসাগর
*
চূনিকা
জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত “মাসিক বসুমতী” পত্রিকার চৈত্র ১৩৫২ (মার্চ ১৯৪৬) সংখ্যায়
প্রকাশিত।

আইভি লতা:

মিশুকে লতা।
ঘুরে ঘুরে ওঠে
আমারই জান্ লা বেয়ে
নিঠুর আমি,
দিয়েছি কেটে তার উদ্ধত গতিকে
অনেকবার,
তাও আঙুল বাড়িয়ে দেয় নিঃসঙ্কোচে
আমার দিকে।
লোক চিনেছে, সে!
আমার স্বভাব,
কাকেও ঘিরে লতিয়ে ওঠা।


দুপুর:

তীক্ষ্ণ দুপুর
চীলের স্বরের মত
কানে এসে লাগে
উজ্জ্বল স্তব্ধতা
একটা গাছেও
নড়ছে না কোনো পাতা
ইজি-চেয়ারের কোলের উপর মাথাটা রেখে
ভাবছি,
যেদিন ভাবতে শিখেছি দুপুর দেখে।


দীপা:

কালো দীঘির পাড়ে,
গামের চেনা মেয়ে
মেঘাড়ম্বর শাড়ী পরে
দুলে দুলে চল্ ছে আপন মনে।
আমি কাছে এসে বলি:
কেমন আছো দীপা?
ওমনি হঠাৎ ডালিম ফুলের মত
লজ্জায় রাঙা হয়ে
পালিয়ে যাবার আগে---
আঁচল থেকে বকুল ফুলের মালাখানি
দিল ছুঁড়ে আমারি গায়ে---
এমন লাজুক মেয়ে॥

.             ****************                                                         
সূচীতে    




মিলনসাগর