কবি জ্যোতিষ্মতী দেবীর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
অভিনব বেশে
রাণী জ্যোতিষ্মতী দেব

তুমি,    অভিনব বেশে দেখা দাও আসি,
.                আমার মানস মাঝে |
আমি,   তব-আশা-পথ-দরশ-প্রয়াসী,
.                ব্যাপৃত যে তব কাজে ||
তুমি,    চুপে চুপে আসি চুপে চুপে যাও,
.                একি খেলা প্রেমময়!
আমি,   পাছু পাছু ছুটি দাঁড়াও দাঁড়াও,
.                খুঁজি সারা বিশ্বময় ||
তুমি,    চাও কি গো আমি কিছু যে বুঝি না,
.                তোমার খেলার ধারা |
আমি,   চাহিলে ধরিতে ধরাতো দিলে না,
.                করিবে আপনহারা ||
তুমি,    করেছ আমারে খেলার পুতুল,
.                যে খেলা খেলিবে খেল |
আমি,   যোগাইব যাহা তব অনুকূল,
.                তুমি রাখ বা ভাঙ্গিয়া ফেল ||
তুমি,    আবরি নয়ন রেখেছ সদাই,
.                তোমার বাসনা মত |
আমি,   পরশি হৃদয়ে দেখিতে না পাই,
.                অন্ধসম ভ্রমি কত ||

.          ****************                                                           
উপরে   




মিলনসাগর
*
কামনা
রাণী জ্যোতিষ্মতী দেব

ওহে গুণময় শ্যাম!
কেন হে নিদয় হয়ে মোরে হলে বাম ?
সতত সোহাগভরে,
বামে লয়ে শ্রীরাধারে,
লিখেছ হে শিরোপরে রাধা রাধা নাম |
জ্যোতির্ম্ময়ী শ্রীশ্রীমতী,
বিতরিছে অঙ্গজ্যোতি,
লভি সে কিরণ-দ্যুতি রাধানাথ নাম ||
প্রেমভাবে প্রাণভরা,
প্রকৃতি সে পরাত্পরা,
নাহি জন্ম মৃত্যু জরা সকাম নিষ্কাম |
খেলিতে প্রেমের খেলা,
ব্রজধামে ওহে কালা!
ভুলাইলে ব্রজবালা ত্রিভঙ্গিমঠাম |
বিষম বিরহ-তাপে,
জ্বলে ছিলে সে উত্তাপে,
কেন তবে এ বিপাকে ফেল অবিরাম ?
বিনয়ে কহি কাতরে,
রেখ নাথ! অভাগীরে,
তোমার চরণ-তলে ওহে গুণধাম!
জীবনের পর পারে,
মিলাইও প্রাণেশ্বরে,
দুঃখ জ্বালা যাবে দূরে পূরে মনস্কাম |


.                                                  ****************                                      
উপরে   




মিলনসাগর
*
বনফুল
রাণী জ্যোতিষ্মতী দেব


হায়, হইতাম যদি আমি বনফুল |
নীরবেতে বনমাঝে,                    ফুটিতাম প্রতি সাঁজে,
উচ্ছ্বাসে ভরিয়া হৃদি হতাম আকুল ||


আর নাহি চাহিতাম কিছু ভালবাসা |
কাহার পরশ তরে,                     হৃদয় না যাচিত রে,
হত না যাতনা প্রানে হইয়ে নিরাশা ||


তবে সাধ না হইত কার দরশন |
এ নয়ন সচকিত,                          না হইত অবিরত,
বিজন গহনে হত নীরবে পতন ||


সদা আশার হিল্লোলে না নাচিত প্রাণ |
কাহার প্রেমের লাগি,                  নিশিদিন নাহি জাগি,
করিত না এ অভাগী দিন অবসান ||


কভু অদূরেতে শুনি পাতার মর্ম্মর |
উত্কর্ণ শ্রবণে হায়,                    শুনিত না সদা তায়,
দহিত না নিরাশেতে সতত অন্তর ||


বনেই ফুটিত বনেই ঝরিত তবে |
সুশোভিত কাননেতে,                না ফুটিয়া হরষেতে,
শুকায়ে নিরাশা-তাপে যেত না নীরবে ||


প্রকৃতির বুকে যে গো হইয়া বিলীন |
কুসুম-জনম সার,                          করিতাম বার বার,
ঝরিতাম ফুটিতাম সুখে প্রতিদিন ||


অনাবিল স্বার্থশূণ্য হত এ হৃদয় |
প্রণয়-পরাগমাথা,                            তাহে না যাইত দেখা,
পরতে পরতে লেখা সর্ব্বস্থানময় ||


দেবতা উদ্দেশে হত নিয়োজিত মন |
রহিয়া কুমারী বালা,                          জীবনের সারাবেলা,
ভজিতাম অন্তরেতে বিভুর চরম ||


.                                                  ****************                                      
উপরে   




মিলনসাগর
*
বিরহ-নিশি
রাণী জ্যোতিষ্মতী দেব


উঠিয়া বসিয়া,                    পথ নিরখিয়া
চমকি চমকি চাই |
বিগত রজনী,                      হইল সজনী,
বঁধুয়া আসিল নাই ||
হয়ে উত্কন্ঠিতা,                 বিরহব্যথিতা,
নিশি করি জাগরণ |
নিশি অবশেষে,               আবেগ অলসে,
নাহি এল সেই জন ||
কোথায় সজনি,                  কোথা গুণমণি,
আমার হৃদয়চোর ?
আমারে ছলিয়া,                  গেল পলাইয়া,
সকলি হরিয়া মোর ||
করিয়া যতন,                       করিনু চয়ন,
হৃদয় কুসম সম।
গাঁথিনু যে মালা,                   নয়ন উজলা,
সুচিকন মনোরম ||
শুকাইল মালা,                 বাড়িল যে জ্বালা,
পোহাল বিরহ-নিশি |
সে অস্ত সাগর,                    ডুবে শশধর,
ঊষার আলোকে মিশি ||
ছিল গো যামিনী,                  চন্দ্রমাশালিনী,
জ্বালাইতে অভাগীরে |
রজত ধারায়.,                   ভাসায়ে ধরায়,
লুকাইল ধীরে ধীরে ||
কি সুন্দর রাতি,             কি জোছনা ভাতি,
উছলিল কূলে কূলে |
ভাঙ্গা মেঘগুলি,               নানা ঢেউ তুলি,
চলেছিল দুলে দুলে ||
গগনেতে শশী,                  হাসি মৃদু হাসি,
করে মোরে উপহাস |
বৃথায় জীবন,                      ধরিলে এখন,
কিছার জীবন-আশ ||
সজল নয়ন,                       হৃদয় স্পন্দন,
অবিরত হয় মম |
শিরে হানি কর,                   কাঁপি থর থর,
না আসিল প্রিয়তম ||
ফেলিলাম খুলি,                      ভূষণ সকলি,
ত্যজিনু বলয় দূরে |
আসিল বিরহ,                     দুর্জ্জয় দুঃসহ,
আমার হৃদয়পুরে ||
ছিঁড়িল সে মালা,                 যাহা সারাবেলা,
জীবনে ছিল গাঁথা |
ফেলিনু দলিয়া,                  প্রীতি প্রেম মায়া,
কত যে আশার কথা ||
উদিল অরুণ,                       দুলাইয়া ঘন,
বহিল প্রভাত-বায় |
আছি যার আশে,                এ ছার আবাসে,
সে জন এল না হায়!
কোথা সেই নিধি,                    খুঁজি নিরবধি,
আমার কণ্ঠের হার |
দেহের জীবন,                         হৃদয়-রতন,
চাহি তারে আনিবার ||
এ বিরহবাসে,                       পরাণ উদাসে,
না পারি বাঁধিতে মন |
খুঁজিতে তাহারে,                   বিশ্ব চরাচরে,
ছুটিতেছে অনুক্ষণ ||
বিরহ-নিশিতে,                    মম এ হৃদেতে,
পেয়েছিগো যত ব্যথা |
গিয়া তার পাশে,                  মিলন-আবাসে,
সুখেতে রহিব তথা ||


.                                                  ****************                                      
উপরে   




মিলনসাগর
*
মরীচিকা
রাণী জ্যোতিষ্মতী দেব

দিবস রজনী কত ধীরে ধীরে চলি যায় |
মরীচিকা কুহেলিকা মাখিয়া হৃদয় হায় ||
বহিতেছি জীবনেতে কত বোঝা নিরাশার |
কভু কুহকিনী আশা প্রকাশে প্রভাব তার ||
কি জানি যে কোন্ পথে চলেছি আপন মনে |
উন্মত্ত অধীর হয়ে ভাবি আশা-প্রলোভনে ||
কি জানি কি আশে সদা ধাইতেছে প্রাণ মোর |
হৃদয়েতে মরীচিকা নয়নে তামসী ঘোর ||
মিটিল না মন-সাধ দহে বহ্নি আকাঙ্ক্ষার |
আকুল উদ্ভ্রান্ত প্রাণে ছটিতেছি অনিবার ||
জানি না যে কিবা আশে এখন বসিয়া রই |
কিবা যাদুমন্ত্র-বলে এ যাতনা প্রাণে সই ||
পাগলিনী মত ধাই ছুটে কল্পনার কোলে |
আশা মরীচিকা মোরে তুষে যে মধুর বোলে ||
সুধাইনু কাতরেতে কহ মাগো অভাগীরে |
কোথায় পাইব বল মম প্রিয় প্রাণেশ্বরে ?
ত্যজিব কি ছার প্রাণ ধরিতে না পারি আর |
নিরাশা-অনলে হৃদি হইতেছে ছারখার ||
আকাঙ্ক্ষার শতবহ্নি জ্বলিত্ছ্ জ্বালাময় |
আশার সহস্র ছবি গোপনে হৃদয়ে রয় ||
প্রশমিতে নাহি পারি হৃদয়-যাতনা মোর |
নিবারিত নাহি হয় মম এ নয়ন-লোর ||
কহ মাগো পূরিবে কি এ মম হৃদয়ে-আশ ?
অথবা এ চির দুঃখে করিব গো বসবাস ||
আঁধারে ভ্রমিব আমি বহি এ জীবন ভার |
হতাশ্বাস জীবনেতে করিব কি হাহাকার ||
কহিল আশ্বাস বাণী মরীচিকা আশা মোরে ---
“আশার নিবৃত্তি আছে জীবনের পর পারে ||
নিশ্চিতের বাস যথা নাহি অনিশ্চিত আশ |
অনিশ্চিত চাহে যেবা ঘটে তার হা হুতাশ ||
মোহেতে মজিয়া হায় বেড়াওনা ছুটে ছুটে |
আঁধার এ দীর্ঘ পথে মরিবে কণ্টক ফুটে ||
প্রতীক্ষায় রহ বসি যাপ দিন গণনায় |
কাটাও জীবন তব সেই প্রিয় সাধনায় ||
আছে দুঃখ শেষে সুখ এই জানি চিরদিন |
নিরাশায় সুখ স্মৃতি, হয় নিশি শেষে দিন ||
নদীতে তরঙ্গ বহে রহে হৃদয়ে উদাস |
সঙ্গীতে পরাণ ভরা তাহে স্নেহের বাতাস ||
উথলি বাহিয়া যায় যবে দুঃখের লহর |
সুখস্রোত বাধা আসি দেয় দেখা তদুপর ||
দুঃখের নিশ্বাস আছে হাসি রহে হরষের |
অনাদর অপমান কত সোহাগ স্নেহের ||
বিরহের দুঃখ বিঁধে প্রাণে কণ্টক সমান |
মিলন-সুধার স্রোতে পুনঃ হয় ভাসমান ||
নীরবতা রহে ঘিরে যে গো সুদূর প্রবাস |
সাহারার মরু আছে, কাননে ফুল বিকাশ ||
জলন্ত শ্মশান আছে, আছে সুকোমল প্রাণ |
শোকের সঙ্গীত উঠে প্রাণে গাহে বিহঙ্গ যে গান ||
রবি শশী তারা রহে হেরি নীলাকাশ ঘেরা |
অমার আঁধার শেষে পুনঃ জোছনার ধারা ||
হতাশ্বাস দীর্ঘশ্বাস প্রাণে ভীষণ নিরাশা |
প্রীতি প্রেম ভালবাসা রহে ভবিষ্যৎ আশা ||
আছে নিদ্রা জাগরণ সুপ্তি বিস্মৃতি স্বপন |
অনন্ত আকাশ মাঝে প্রাণ করে বিচরণ ||
কভু নিরাশার আঘাতেতে প্রাণ বিদলিত |
মুক্ত সে গগনতলে হয় আশা অঙ্কুরিত ||
সাধনায় সিদ্ধ হয় জানি মনের বাসনা |
স্থিরচিত্তে সদা কর সেই দেবের সাধনা ||
পাইবে সে পর পারে অভীষ্ট দেবতা |”
নিরবিল আশা, পুনঃ ব্যাপে প্রাণে নীরবতা ||


.               ****************                                                            
উপরে   




মিলনসাগর
*
মাধবীলতা
রাণী জ্যোতিষ্মতী দেব

সহকারে শোভিতেছ অয়ি লতে সতী |
আশ্রয় করিয়া আছ তরুবর পতি ||
সুদৃঢ় প্রণয়ডোরে পতিরে সুন্দরী |
বেঁকে বেঁকে বাঁধিয়াছ অতি যত্ন করি ||
যতক্ষণ দেহে তব থাকয়ে জীবন |
হরিষে পতির পাশে রহ ততক্ষণ ||
ও মাধবা তব প্রেম অসীম অপার |
সে প্রেমে বাঁধিয়া রাখ কান্ত আপনার ||
আহা মরি কিবা শোভা দেখিতে সুন্দর |
পতি-বুকে দেহ ভার রাখ নিরন্তর ||
সদাই প্রফুল্ল মনে রহ বিনোদিনী |
পতিরে ছাড়িতে কভু নাহি চাহ ধনী ||
দৌবাধীন কার্য্য বিনা কি আছে সংসারে |
পতির আশ্রয় হতে বঞ্চিলে তোমারে ||
নাহি রহ ক্ষণমাত্র পড়া লুটাইয়ে |
নাথেরে ত্যজিয়া মর কাতর হইয়ে ||
কুসুম লতিকা মরি কমনীয় কায় |
সহকারে বেষ্টনিয়া আর শোভা হয় ||
সুমন্দ পবনভরে হেলিয়া দুলিয়া |
পতি সনে কত কথা কহ লো হাসিয়া ||
বিরহ বিচ্ছেদ জ্বালা কভু নাহি হয় |
জনমের মত তুমি লয়েছ আশ্রয় ||
না জান কলহ কভু মান অভিমান |
সন্তোষে পূরিত তব প্রেমভরা প্রাণ ||
সহকার পতি তব যদি রোষভরে |
কখন তোমারে লতা নিক্ষেপয়ে দূরে ||
পুনরায় তুমি তারে কর লো বেষ্টন |
হাসিমুখে প্রাণনাথে দাও আলিঙ্গন ||
প্রেমের প্রতিমা তুমি প্রণয়ের রাণী |
রমণীকুলের লতা তুমি শিরোমণি ||
রবিতাপে শুষ্ক হয়ে কোমল শরীর |
নীরব নিষ্পন্দ হয় পরাণ বাহির ||
তথাপিও নাহি ছাড় পতিরে তোমার |
বেষ্টিতা হইয়া তবু রহ অনিবার ||
বলেতে তোমারে টানি করে উত্পাটন |
সহকার হতে ছিন্ন মাধবী তখন ||
দৈব প্রতিকুল হলে কেবা রোধ করে |
বিষম কালেতে যদি গ্রাসে তরুবরে ||
ভয়ঙ্কর ভীমরূপ প্রচণ্ড পবন |
বিনাশি তরুরে করে জীবন হরণ ||
তুমিও পতির সনে ও মাধবীলতা |
ভূতলে পতীতা হও হইয়া আহতা ||
অকাতরে তুচ্ছ করি নিজেক জীবন |
পতি সনে নিজ প্রাণ কর বিসর্জ্জন ||
সহমরণের প্রথা ভারতে যে ছিল |
তোমারে হেরিয়া তাহা প্রতীতি জন্মিল ||
ধন্য লো মাধবীলতা ধন্য তুমি সতী |
একমনে সযতনে সেব প্রাণপতি ||
শুন গো মাধবীলতা কহিনু তোমারে |
শিখাও ও রীতি তব রমণীগণেরে ||
ধিক্ ধিক্ নারীকূলে জনম যাহার |
না করে অনুগমন পতি দেবতার ||
বিচ্ছিন্ন হইয়া নিজ প্রাণপতি সনে |
কেন বা সে রহে আর এ ছার ভুবনে ?
আশ্রয় তরুর সহ করি উত্পাটিতা |
কুটিল করাল কাল করিয়া দলিতা ||
নিক্ষেপয়ে মরুভূমে আশ্রিতা লতারে |
কালের কুঠারাঘাতে কাটি তরুবরে ||
লয়ে যায় নন্দনেতে সুশৌরভ আশে |
সুশীতল ছায়া তরু পারিজাত পাশে ||
সেই ছায়াতলে কেন না যাও ছুটিয়া |
জুড়াবে তাপিত প্রাণ আশ্রয় লভিয়া ||
প্রয়তম করুবরে করি আলিঙ্গন |
সুশীতল কর এই তাপিত জীবন ||
প্তিব্রতা সতীরাণী মাধবী সুন্দরী |
তোমায় এ প্রেম যেন অনুরূপ করি ||
বিধবা রমণীগণ শিখি এই নীতি |
আশ্রয় লইতে যায়, নিজ প্রাণপতি ||
অকাতরে তুচ্ছ করি নিজের জীবন |
তোমার এ পতিব্রতা-পূত আচরণ ||
জীবনে করুক সার এই মহা ব্রত |
বিচ্ছিন্ন হইয়া হায় স্বামী মনোমত ||
নাহি রয় ক্ষণকাল জীবিত ধরায় |
মিলাইয়া দেয় প্রাণ সে তরু-ছায়ায় ||
করিবে বিশ্রাম চির সেই ছায়াতলে |
মিলাবে পরাণ নিজ পতি-পাদমূলে ||
আলিঙ্গিয়া রবে সদা জীবনে মরণে |
এ মরতপুরে কিবা অমর-ভবনে ||
তব সম প্রেমব্রত করি উদযাপন |
অনন্তে মিলিয়া হোক অনন্তমিলন ||


.               ****************                                                            
উপরে   




মিলনসাগর
*