কবি কামিনী দাসীর কবিতা
www.milansagar.com
*
স্তোত্র
কামিনী দাসী


ওহে বিশ্বনাথ,                  বিশ্বজন তাত,
বিশ্বের পালক প্রভো !
অবোধ রসনা,                   বিষম বাসনা,
করিতেছে ওহে বিভো !
তোমার মহিমা,               অপার অসীমা,
বর্ণিবারে করি মন
ওহে দয়াময়,                 দাও হে অভয়,
আমি অতি হীন জন |
যে দিকে নয়ন,                   ফিরাই যখন,
হেরিতে রচনা তব,
সৃষ্ট-বস্তু-শোভা,                মনঃ প্রাণলোভা
তার কি উপমা দিব ;
রবি, শশী, তারা                সিন্ধু, বসুন্ধরা,
হয়ে সবে এক তান,
মহিমা তোমার,                 অনন্ত অপার,
করিতেছে সদা গান ;
প্রফুল্ল কমল,                    তাহে ভৃঙ্গ-দল,
গুন্ গুন্ গুন্ স্বরে,
মধুর স্বননে,                   তোষে প্রাণীগণে,
মরি কি পিযুষ ক্ষরে
প্রভাত সময়,                        অরুণউদয়,
জানিয়া বিহঙ্গগণে,
সুমধুর স্বরে,                      কলরব করে,
বর্ণি বিভু-গুণ-গানে ;
পুনশ্চ যখন,                      লোহিত-বরণ,
যান রবি অস্তাচলে,
বিহগ-নিকর,                       পূরিত-উদর,
জয়-ধ্বনি দিয়া চলে |
তোমার শাসনে,                   এ মহী-ভুবনে,
ছয় ঋতু সুবিরাজ,
তব আজ্ঞা-ক্রমে,                 নিযুক্ত নিয়মে,
সাধিতেছে নিজ কায |
করুণা-সাগর,                      ওহে সৃষ্টিকর,
তোমারি করুণা-বলে,
জীব, জন্তু যত,                   স্ব স্ব মনোমত,
বাস করে জলে স্হলে |
রোগ, শোক, পাপ,                 সকল সন্তাপ ;
নাশ করে তব নামে,
মূঢ় যেই জন,                       না লয় শরণ,
ও চরণ-মোক্ষ-ধামে |
ওহে বিশ্বপতি,                আমি হে অতিথি,
তব ভক্তি-সুধা-আশে,
পদ প্রান্তে স্থান,                   কর হে প্রদান ;
মজি ব্রহ্ম-প্রেম-রসে  |


.                                               ********************                                    
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
ঊষা
কামিনী দাসী

কে গো তুমি প্রভাময়ী  ! নিশা অবসানে,
দরশন দাও আসি গগন-প্রাঙ্গণে,
বিস্তার করহ নিজ অঙ্গ-শুভ্র-জ্যোতি ?
তবাগমে প্রাচী দিক্ হয় হাস্যবতী  |
জানাতে জগত-জনে তব আগমন,
প্রবাহিত মৃদুগতি শীতল পবন ;
করিবারে তোমারে সাদর অভ্যর্থনা,
করয়ে বিহগকুল সুরবে ঘোষণা,
ত্যজি নীড় বিচরণ করে ইচ্ছামত ;
দেখিতে দেখিতে হয় অরুণ উদিত |
এই যে আরক্ত রবি গগনে উদয়,
পথ-প্রদর্শিকা তাঁর তুমি জ্ঞান হয়  |
রজনীতে নিদ্রাভোগ করি জীবগণ,
নিজ নিজ কাযে সবে দেয় এবে মন |
বালক বালিকাগণ আনন্দিত মনে,
নিয়োজিত নিয়মিত স্ব স্ব অধ্যয়নে |
প্রফুল্ল কুসুম-কুল উদ্যান ভিতর,
মধুলোভে মধুকর চলিছে সত্বর,
গুন্ গুন্ রবে সুমধুর তান তুলে,
এক ফুলে মধু পিয়ে যায় অন্য ফুলে |
সরোবরে বিকসিত অমল কমল,
প্রভাত-পবন-ভরে করে ঢল ঢল  |
গোপাল গো-পাল লয়ে চরাইতে যায়
চপল গো-শিশু গুলি সঘনে লাফায় ;
একবার যায় ছুটে, আসে আরবার,
পিয়ে স্তন, গন্ড-যুগে বহে দুগ্ধধার |
এ চারু প্রত্যূষ কালে রে বিমূঢ় মন !
কর কর একবার বিভুরে স্মরণ,
অখিল জগতে যিনি একমাত্র গতি,
তাঁহার চরণে কর অসংখ্য প্রণতি |

.          ********************                                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
প্রভাত
কামিনী দাসী

উঠহে ভাবুকবর, নিশা অবসান,
কোকিল-দম্পতি গায় সুমধুর গান ;
আলাপি’ ললিত স্বর পাপিয়া-নিকর,
করিতেছে উল্লাসিত শ্রবণ--বিবর |
আর যত খগকুল হইয়া মিলিত
গাইছে বিভুর নাম মহা হর্ষ চিত |
দ্যুমণি প্রেরিত দূতী ঊষা সুবদনা,
হেরিয়া তাহারে যেন পূর্ব্ব দিগঙ্গনা,
অন্ধকার রূপ নিজ বদন--অম্বর
করিলেন দূর, হাস্য-স্ফুরিত অধর ;
প্রিয়--আগমন--বার্ত্তা করিয়া শ্রবণ,
সহর্ষ অন্তরে করে সময় পালন |
ক্রমে ক্রমে দিনমণি সুবর্ণ বরণে
অগ্রেতে রঞ্জিত করি বৃক্ষশিরোগণে,
পরে করিলেন ধরাতল সমুজ্জ্বল,
নিদ্রা ত্যজি’ জীব জন্তু জাগ্রত সকল |
কিবা শোভা এ সময় সরসী-সলিলে,
প্রকম্পিত কমলিনী পবন--হিল্লোলে ;
দুঃসহ বিরহ তাপে হ’য়ে খিদ্যমানা
ছিলেন ত্রিযামা যোগে মুদিত বদনা,
এবে পেয়ে  প্রামপতি-কর রূপ কর,
প্রেমোল্লাসে প্রফুল্লিত শরীর সুন্দর  |
কমল উন্মেষে সেই সরোবর-তীর
সৌরভে মোদিত করে প্রভাত সমীর
পেয়ে পরিমল ঘ্রাণ ভ্রমর সকল,
আসিতেছে মধু--লোভে হইয়া চঞ্চল |
কমল--কাননে বহে প্রমোদ--তরঙ্গ,
কুমুদিনী বিষাদ--সমুদ্রে ঢালে অঙ্গ |
দেখ হে ভাবুক ! এবে প্রকৃতি--ললনা
ধরেছেন কিবা রূপ, কি দিব তুলনা |
কিবা সে প্রান্তর ভূমি শষ্পদামাবৃতা,
হরিত বসনে যথা প্রকৃতি শোভিতা ;
নীহারের বিন্দু শোভে তৃণদলোপরি,
মুক্তা-হারে বিভূষিতা অতি সুশোভন,
বোধ হয়, প্রকৃতির রম্য নিকেতন |
যথায় পাদপ-চয় শির উচ্চ করি
দন্ডাইয়া আছে যেন ভীষণ প্রহরী  ;
যথায় লতিকাবলী বাহু বিস্তারিয়া,
আলিঙ্গয়ে তরুকুলে প্রণয়ে মাতিয়া ;
যথা বন--পুষ্প--রাজি হ’য়ে বিকসিত,
সৌরভ বিস্তারি করে দিক্ আমোদিত
যথায় ভ্রমরকুল মধু--পান--আশে ;
গুঞ্জরি ললিত রাগে ফিরে ফুল-পাশে ;
প্রভাত--পবন যথা বহে মৃদু গতি,
যে বায়ু সেবনে প্রাণ প্রফুল্লিত অতি |
স্ব স্ব স্বরে  রব করে বিহগ--আবলী,
শ্রবণ রঞ্জন কিবা সে কল কাকলী  |
এইরূপ প্রাভাতিক শোভা মনোহর,
বর্ণিতে না পারি আমি বিমূঢ় অন্তর  |
উঠ তুমি ত্বরা করি ত্যজিয়া শয়ন,
ঈশ--উপাসনা--রসেমগ্ন কর মন,
সমাপন করি অগ্রে বিভু--উপাসন,
হের হে প্রভাত--শোভা হে ভাবুক জন |

.          ********************                                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
সন্ধ্যা
কামিনী দাসী

ধরিয়া আরক্ত ছবি,                অস্তাচলে চলে রবি’
দিবস হইল অবসান,
অদর্শনে দিনমণি,                    সরোবরে কমলিনী,
দুঃখ-ভরে ঢাকিল বয়ান ;
পদ্মে দেখি মুকুলিত,                 ভৃঙ্গকুল বিষাদিত ;
ইতস্ততঃ ভ্রমিয়া বেড়ায়,
কমল-অন্তরে কেহ,                   লুকায় আপন দেহ,
মনোসুখে যামিনী কাটায় |
অস্তমিত দিনমণি,                   করিয়া কাকলীধ্বনি,
খগকুল আসে নিজ বাসে ;
নীড়স্থিত শিশুগণে,                   দেয় অতি সযতনে,
আহারীয় মনের উল্লাসে |
গোপাল গো--পাল লয়ে             গৃহ--মুখে আসে ধেয়ে,
গো-ক্ষুরে উথ্বিত ধূলি--রাশি |
পরিশ্রমী নরগণ,                        বিরাম লভে এখন,
সন্ধ্যা-বায়ু সেবনে উল্লাসী  |
বন উপবন মাঝে,                      মধু পিয়ে কুতূহলী,
গুন্ গুন্ স্বরে গায় গীত |
রজনী আগতা দেখি ;                   কুমুদী প্রফুল্ল মুখী,
ভাসিতেছে সরসী--সলিলে,
দিনমণি আগমনে,                      মুদিবে চারু বদনে,
বিজরিত হবে দুঃখজালে |
ক্রমে সন্ধ্যা গত হলো,                যামিনী কামিনী এল,
নবরূপ ধরিল ধরণী,
আলোক জ্বালিয়া তবে,            গৃহ--কর্ম্ম করে সবে,
শিশু কুলে তোষেন জননী  |


.                                            ********************                                  
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
রাত্রি
কামিনী দাসী

কোমল প্রকৃতিময়ী আইল রজনী,
উদিত গগন দেশে দেব নিশামণি |
উজ্জ্বল চন্দ্রিকাভাসে ভরিল ভুবন,
প্রকাশিত চন্দ্রমল্লী কোমল বদন |
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারাবৃন্দ হইয়া উদিত,
করেছে গগন-কায় হীরক খচিত |
ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরিতেছে খদ্যোত-নিকর,
মলিন চন্দ্রমা--করে যাহাদের কর |
বিধু--প্রতিবিম্ব পড়ি সরসী --হৃদয়ে,
ক্ষণে ক্ষণে আন্দোলিত সমীর--সহায়ে |
তটিণী--তটস্থ তরুচ্ছায়া পড়ে জলে,
বুঝি তারা নিজাকৃতি হেরে কুতূহলে |
সুষুপ্ত জগত এবে, সুধীরা প্রকৃতি,
নিরখি ভাবুক জন ভাবে মুগ্ধমতি |
কেবল বহিছে নদী কুল কুল স্বরে,
যেন কোন জন কল বংশী--ধ্বনি করে ;
কেবল শ্বাপদকুলে অন্বেষি আহার,
সর্ব্ব স্থলে ভ্রমণ করয়ে অনিবার |
রাত্রিচর পেচক কখন শব্দ করে,
কথন শৃগালকুল ডাকে উচ্চৈঃস্বরে |
ঝিঁ ঝিঁ স্বরে অবিরত ঝিল্লী করে রব,
ভাবুকের মনে নব ভাব সমুদ্ভব |
শন্ শন্ শব্দে করে তাল তরুচয় |
সঙ্গে লয়ে প্রিয়তমা স্বপন সখীরে,
ভ্রমিছেন নিদ্রা দেবী অখিল সংসারে |
কি ধনী, দরিদ্র কিবা মধ্যবর্ত্তী জন,
সকলেই সম সুখী হয়েছে এখন |
শ্রান্তি নিবারিণী নিদ্রা তোষেন সবায়
শোক সন্তাপাদি যত সব দূরে যায় |

.          ********************                                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
গ্রীষ্ম
কামিনী দাসী

আইল নিদাঘ কাল, আকৃতি অতি করাল,
যার ভয়ে চরাচর, সবে হয় ভীত রে |
সুপ্রচন্ড দিবাকর, বরিষে প্রখর কর,
কাতর পথিকচয়, হইয়া তাপিত রে |
জগত-জন-জীবন, শ্রান্তিহারী সমীরণ,
অনল--কণিকা সম, উষ্ণতম হয় রে |
খেচর ভূচর যত, হইয়া ব্যাকুল চিত,
বাছিয়া শীতল স্থলে, বসতি করয় রে |
প্রতপ্ত সরসী--রারি, অস্থির সলিল--চারী,
পালাবার পথ নাহি, ভেবে নিরুপায় রে |
বলে কি ঘটিল কাল, এল কি বিষম কাল,
গেলে এ কুমতি কাল, সব জ্বালা যায় রে |
মানবের কলেবরে, অবিরত স্বেদ ঝরে,
শীতল চন্দন লেপি, ঘর্ম্ম নিবারয় রে |
সুস্নিগ্ধ কুসুমচয়, সতত সুগন্ধ--ময়,
বিনাশি গ্রীষ্মের তাপ, করে সুখোদয় রে |
গোষ্ঠে গোষ্ঠচারী যত, আহারে হয়ে বিরত,
শীতল পাদপ-তল, করিছে আশ্রয় রে |
চাতক বিশুষ্ক কন্ঠে, জলদে ডাকে উত্কন্ঠে,
শুনে সে কাতর স্বর, দুঃখ উপজয় রে |
দিনমান অবসানে, মনোরম শোভা বনে,
গ্রীষ্মের প্রদোষ অতি, রমণীয় হয় রে |
নানা পুষ্প প্রস্ফুটিত, সৌরভে দিক্ মোদিত
চুরি করি ফুল--গন্ধ, গন্ধবহ বয় রে |
ফুল্ল শিরীষ প্রসূন, যার কোমলতা গুণ,
আর্য্য গ্রন্থকারগণ, করেন বর্ণন রে ;
কামিনী কোমল করে, আহরি’ আনন্দ ভরে,
করে যে কুসুমবরে, কর্ণ--আভরণ রে |
বিশ্বপতি বিধাতার, ইচ্ছা কিবা চমত্কার,
দিবাভাগে প্রাণিগণ, ছিল সন্তাপিত রে ;
পেয়ে  এ প্রদোষকাল, সুখেতে হরিছে কাল,
উষ্ণভাব ত্যজি বায়ু, বহে শীতাশ্রিত রে |

.          ********************                                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
বর্ষা
কামিনী দাসী

বিগত হইল গ্রীষ্ম বর্ষা সমাগত,
চাতকগণের চিত্ত অতি প্রফুল্লিত |
তেজোশালী সূর্য্যদেব এবে বিমলিন
মেঘের নিকট হন পরাক্রম হীন |
রজনীতে চন্দ্র তারা না পায় প্রকাশ,
বারিদ আবৃত সদা অসীম আকাশ  |
শ্যাম তনু মেঘমালা কিবা সুশোভন,
চমকে চপলা বালা উজলি ভুবন |
কখন গরজে মেঘ মৃদুল গভীর,
কদাপি ভীষণ রবে শ্রবণ বধির  |
বজ্রাঘাত হয় কভু অবনী মন্ডলে
নিপতিত কত জীব কালের কবলে |
ধারাধর হতে ধারা পড়ে অবিরল,
দরশনে পরিতৃপ্ত নয়ন যুগল  |
হ্রদ সরোবর চয় জলে উচ্ছ্বাসিত
এ সময়ে ভেককুল বড় হরষিত,
পাইয়া নুতন জল ইচ্ছা অনুসারে,
লণ্ফ ঝম্ফ করে কত ডাকে উচ্চৈঃস্বরে |
আনন্দ মনেতে যত কৃষক নিকর,
নত মুখে কৃষি কার্য্যে সতত তত্পর |
পেয়ে বরিষার বারি তটিনী সকল,
দ্রুতগতি প্রবাহিত করি কল কল ;
উঠিছে তরঙ্গকুল বিপুল ভীষণ,
সুখেতে সন্তরে ভীম জল জন্তুগণ |
জলদ গরজ রব করিয়া শ্রবণ,
আনন্দে উন্মত্ত প্রায় হয়ে শিখীগণ,
নাচিছে, বিস্তারি চারু চন্দ্রক কলাপ,
দরশন মানবের দূরে যায় তাপ |
কেতকী কদম্ব পুষ্প হ’য়ে প্রস্ফুটিত,
করিছে কানন ভূমি অতি সুশোভিত |
বারি সিক্ত তরু পত্র পবনে চালিত,
টুপ টাপ্ ঝরে জল-বিন্দু অবিরত |
পূর্ব্ব দিক্ হ’তে বায়ু বেগে প্রবাহিত
সে বায়ু সেবনে পীড়া সম্ভব নিশ্চিত
জল--কণা--জালে পড়ি অরুণ কিরণ,
সমুদিত শত্রু--ধনু বিবিধ বরণ |
সে সুন্দর ধনুরূপ নিরখি নয়নে,
কে না চিন্তে করে সেই অখিল কারণে ?
ধন্য সেই নিরঞ্জন ধন্য শক্তি তাঁর !
ধন্য ধন্য শিল্পী তিনি কৌশল--ভান্ডার  !

.          ********************                                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
শরৎ
কামিনী দাসী

সুখদ শরৎ আইল জগতে,
মরি কি সুন্দর শোভা অবনীতে !
দৃষ্টি করি যবে প্রান্তর প্রদেশে
স্বভাব সজ্জিত তথায় সুবেশে |
শ্যাম শস্য-তুণ সমীরণ-ভরে,
আন্দোলিত হ’য়ে কিবা শোভা করে
বিকশিত কাশ-কুসুম-নিচয়,
বিশদ স্বভাব-সুষমা-নিলয় |
প্রচন্ড মার্ত্তন্ড প্রখর কিরণে,
শুষ্ক পথ, হর্ষ পথিকের মনে |
গতায়তে আর নাহি কোন ক্লেশ,
সানন্দে মানব ভ্রমে নানা দেশ |
জলাশয়ে শোভে অমল কমল ;
মধু--পানাশয়ে মধুপ নিকর,
মধুর গুঞ্জন করে নিরন্তর,
নলিনীরে যেন তুষিবার তরে,
স্ত্ততিপাঠ করি ভ্রমরে ভ্রমরে |
হংস আদি জলচর পক্ষিগণে
স্বচ্ছ নীরে কেলি করে হৃষ্ট মনে |
বারি রাশি মৃদু মারুত--তাড়িত,
সঘনে ললিত লহরী উথ্বিত |
প্রস্ফুটিত স্থলে স্থল-কোকনদ,
অতুল সৌন্দর্য্য-গরিমা-আস্পদ |
মৃদুল সৌরভ ফুটে শেফালিকা
মানবের মনোনয়ন-রঞ্জিকা |
গগন মন্ডল অতি নিরমল,
মেঘহীন, নীল প্রভায় উজ্জ্বল |
শারদ সুধাংশু কিবা মনোহর,
হেরি পুলকিত মনুজ--অন্তর |
সমুজ্জ্বল গ্রহ, তারকা-নিচয়
দরশনে কে না বিমোহিত হয় ?
সুখদা ক্ষণদা আগতা যখন
কৌমুদী প্রকাশে উজ্জ্বল ভুবন |
আর কত বিধ শারদীয় শোভা,
বর্ণিতে কে পারে, জন মনোলোভা ?
ধন্য বিশ্বপতি ! ধন্য সৃষ্টি তাঁর !
বার বার তাঁর পদে নমস্কার |

.          ********************                                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
হেমন্ত
কামিনী দাসী

বিগত শরৎ ঋতু হেমন্ত আইল,
ক্ষেত্রে ধান্য শীষ সব পাকিয়া উঠিল |
নাহি আর ধান্য-ভূমি শ্যাম প্রভাময়,
পীতবর্ণ ধরি নব শোভাধার হয় |
অন্য শস্য ক্ষেত্র যত হরিত-রঞ্জিত
চারু রূপ ধরি তথা প্রকৃতি রাজিত |
সুতীক্ষ্ম কর্ত্তনী করে কৃষক সকলে
কাটে ধান্য, গ্রাম্য গীত গায় কুতূহলে
বহু যত্নে কায়-ক্লেশ করি অনুক্ষণ
শ্রমলব্ধ ধন পেয়ে কৃষী হর্ষ মন |
উত্তর পবন মন্দ মন্দ প্রবাহিত,
ক্রমে ক্রমে অল্প অল্প শীত অনুভূত |
রাত্রি কালে বৃষ্টি তুল্য হিনানী পতন
মলিন হিমাংশু আর গ্রহ তারাগণ |
প্রভাতে নীহার বিন্দু শোভে তৃণদলে
যেন কি মুকুতা পাঁতি পতিত ভূতলে  |
হিমাগমে একেবারে পদ্ম পায় লয়,
পৃথিবীতে প্রিয়বস্তু ক্ষণস্থায়ী হয় |
স্থলে স্থল-পদ্ম আর নহে প্রস্ফুটিত,
হিমরাজে দেখি যেন ভয়েতে কুন্ঠিত |
হেমন্তের সমাগমে ভুজঙ্গ-নিচয়,
আবাস-বিবর-মাঝে লুক্কায়িত হয় ;
সর্পকৃত অত্যাচার হয়েছে লাঘব,
বিকল করিছে কিন্তু ব্যাঘ্র-উপদ্রব |

.          ********************                                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
শীত
কামিনী দাসী

আইল দুরন্ত শীত অবনীমন্ডলে,
শাসিতে জগত জনে ভীম ভুজ-বলে |
শীত ভয়ে প্রাণীগণ ব্যাকুল অন্তর,
নিবারণ হেতু সবে হয় যে তৎপর  |
শীতে উপজয় কভু এরূপ জড়তা
হস্ত পদ প্রসারিতে  থাকে না ক্ষমতা |
উষ্ণ বস্ত্র ব্যবহার করে নরগণ,
শাল, লূই , বনাত প্রভৃতি আগণন  |
শয়ন সময়ে পাছে শীতে হয় ক্লেশ,
এ কারণে করে তার উপায় বিশেষ ,
তুলা বস্ত্র বিনির্ম্মিত গাত্র আচ্ছাদন,
গায়ে দিয়া সুখে করে রজনী যাপন |
এ সময়ে দুঃখী লোক বড় কষ্ট পায়,
দেখিলে তাদের দুঃখ হৃদি ফেটে যায়,
বস্ত্রাভাবে শীতে তনু হয় যে কম্পিত,
অতি কষ্টে করে তারা রজনী বাহিত ;
প্রাতঃকালে সন্ধ্যা কালে সেই দুঃখীগণ,
অনল উত্তাপে করে শীত নিবারণ |
এ সময়ে রবি-কর অতি মৃদুতর
মানবের পক্ষে উহা অতি সুখকর ;
প্রভাতে, রাত্রিতে জলস্পর্শে মহা ক্লেশ,
অনল তপন তাপে সুখ এক শেষ |
শীতে রোমাঞ্চিত তনু হয় ঘন ঘন,
অতিবেগে প্রবাহিত উত্তর পবন |
মশকাদি ক্লেশপ্রদ ক্ষুদ্র কীট যত,
তাহাদের অত্যাচার অল্প অনুভূত |
প্রাতে জলাশয় হ’তে বাষ্প সমুথ্বিত,
দেকিতে দেখিতে বায়ু সহিত মিলিত |
রাত্রিকালে নভঃস্থল ধূমাবৃত হয়
চন্দ্রমা-আলোকে দিক্ সমুজ্জ্বল নয় |
হিম-পাতে তৃণ সব গিয়াছে জ্বলিয়া,
যাবত বৃক্ষের পত্র পড়িছে ঝরিয়া |
কোমল প্রকৃতি তনু শোভাময় অতি,
বিশুষ্ক দেখিয়া নর বিষাদিত মতি |
কেবল গোলাপ পুষ্প হয়ে প্রস্ফুটিত
করিছে মানব মন প্রমোদে পূর্ণিত |

.          ********************                                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
বসন্ত
কামিনী দাসী

আগত সরস বসন্ত-রাজ,
সহ নিজ সহচর সমাজ |
বৈতালিক সম বিহগগণ,
নব ভূপবরে করে স্তবন,
গায়ক কোকিল পঞ্চমে গায়,
পাপিয়া রাগিণী দিতেছে তায় ;
নর্ত্তন--নিপূন খঞ্জন জাতি,
নাচে ভূপাগমে সানন্দ মতি ;
বিবিধ সুকন্ঠ বিবঙ্গ স্বরে,
সুধা বরিষয় শ্রুতি বিবরে |
চুরি করি চূত মুকুল গন্ধ,
বহিছে মলয়-অনিল মন্দ,
পরশে শরীর শীতল হয়,
শ্রান্তি পীড়া আদি সব নাশয় |
একালে ভ্রমণ সুখদ অতি
রমণীয় রূপ প্রকৃতি সতী |
তরু লতা আদি ভূরুহ দল,
ধরে নব নব কোমল দল  |
নয়ন--রঞ্জন কুসুম চয়,
এ সুখ-সময়ে প্রফুল্ল হয় |
সুলোহিত আভা  অশোক ফুল
করিছে ভ্রমর-মন আকুল,
ব্যস্ত হয়ে অলি বসিছে তায়,
মধু না পাইয়ে ফিরিয়া যায় |
প্রফুল্ল মাধবী লতিকাবলি,
মধু--দানে ধনী তুষিছে অলি  |
পলাস পুষ্প হেরি মনে হয়,
মধু-নৃপতি-ধনু প্রভাময় |
শুভ্র জ্যোতি কুন্দ  কুসুম ফুল্ল,
উজলে কানন, শোভা অতুল্য
স্ফুটিত ললিত মালতী ফুল,
সমীরে চালিত গন্ধ মৃদুল |
বেব গন্ধরাজ, মল্লিকা, যুথী,
বিতরে সৌরভ মধুর অতি |
পরিতৃপ্ত নাসা সুরভি ঘ্রাণে,
সুখী কর্মযুগ ভ্রমর-গানে |
ধন্য বসন্ত ঋতু শ্রেষ্ঠতম ,
সুখদ কেহ নহে তব সম |
ধন্য বিশ্বপতি করুণাময়  !
সৃজিলা যিনি ও সুখ সময় |

.       ********************                                                      
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
স্বভাবের-শোভা
কামিনী দাসী

এ ভব ভবন, কিবা সুশোভন, কর বিলোকন,
.                        নয়ন দ্বয় !
সুরম্য মূরতি, ধরেছে প্রকৃতি, হেরে জন-মতি,
.                        প্রফুল্ল হয় |
ঊর্দ্ধ নীলকায়, নভঃ শোভা পায়, স্থিত যার গায়,
.                        গ্রহ নিকরে |
সুশীতল কর, শশাঙ্ক সুন্দর, হৃদয় উপর,
.                        বিরাজ করে |
তারকার শ্রেণী, হেরি অনুমানি, চারু মুক্তা-মণি-
.                        মালিকা হবে ;
সে হেতু অম্বরে, উরসি উপরে, রাখে সমাদরে,
.                        অমূল্য ভেবে ;
অবনী উপরে, দেখ দৃষ্টি ক’রে, কত ভূষা ধরে,
.                        ধরণী--কায় |
নীলাভ ভূধর, সমুচ্চ শিখর, স্পর্শিতে অম্বর,
.                        উঠিছে হায় |
পর্ব্বত--সদন, অগম্য কানন, করে বিচরণ,
.                        সে বন মাঝে,
শার্দ্দূল কুঞ্জর , মহিষ শূকর, কীট ক্ষীণতর,
.                        শ্বাপদ--রাজে |
বিষাক্ত দশন,   ভুজঙ্গমগণ,   করয়ে ভ্রমণ,
.                        তুলিয়ে ফণা,
মণি শিরোপরে, সুপ্রভা বিতরে,  যেন তমো হরে,
.                        দ্যুমণি--কণা |
কোথাও নির্ঝর,   ঝরে ঝর ঝর,   সুমধুর তর,
.                        সে স্বর অতি |
কোথা বা তটিনী,  করি কল ধ্বনি,  দিবস রজনী,
.                        করিছে গতি |
কোথাও সুন্দর,   বিহঙ্গ নিকর,  বসি তরু’  পর,
.                        মধুর স্বরে,
গায় বিভু-গান, শ্রবণে যে গান,  বিমোহিত প্রাণ,
.                        নয়ন ঝরে  |
হয়ে কুসুমিত,  তরু সুশোভিত, গন্ধে আমোদিত,
.                        দিক্ সকল,
পেয়ে পরিমল,  হইয়া বিকল,   ধাবিত চঞ্চল,
.                        ভ্রমর দল  |
কোন সরোহৃদে, ফুল্ল কোকনদে, মত্ত রূপ মদে,
.                        যেন নলিনী,
প্রফুল্ল নয়নে,  হেরিছে তপনে, বদ্ধ প্রেম-গুণে,
.                        সে দিনমণি |
অতলা সাগর,  নদীকলেশ্বর,  কত জলচর,
.                        নিবাসে তায়,
নীল বারি পরে,  তরঙ্গে বিহরে,  নেত্র মনোহরে,
.                        সে সুষমায় |
এইরূপ কত,  শোভা শত শত ,  হেরিয়ে মোহিত,
.                        নয়ন তুমি ;
এ সব সৃজন,  করিলা যে জন,   স্মর অরে মন,
.                        সে বিশ্বস্বামী  |
সদা ভাব তাঁরে,  ভাবিলে যাঁহারে, হইবে অচিরে
.                        বাসনা পূর্ণ,
সার মুক্তি--পথ,  লভিবে ত্বরিত,  পাপ দূর গত,
.                        হইবে তূর্ণ |

.                   ********************                                                   
সূচিতে...    




মিলনসাগর
*
সিত রজনী
কামিনী দাসী

নিরমল নীলাকাশ করিয়া আসন
উদিত হয়েছে কিবা শশাঙ্ক শোভন,
চারি দিকে সুবেষ্টিত নক্ষত্র-সমাজ,
মধ্য স্থলে পূর্ণ-শশী করিছে বিরাজ,
বিতরে অমৃত-কর অতি স্নিগ্ধ-কারী ;
কৌমুদী-বসনাবৃতা ধরণী সুন্দরী  |
তরু লতা তৃণ-জালে চন্দ্রমা-কিরণ,
ফলিত হয়েছে আহা সুন্দর কেমন !
ফুটিয়াছে চন্দ্রমল্লী বিপিন--ভূষণ,
পরিমলে তুষিতেছে ভাবুকের মন |
ক্ষণে দৃষ্টিপাত করি দেখি সরোবরে,
শশি-প্রিয়া কুমুদিনী হসিত অধরে,
করিতেছে নানা রঙ্গ লয়ে সুধাকরে,
কম্পিত কোমল তনু মন্দ বায়ু-ভরে,
নিজ পতি হেরে সতী অতি হর্ষমতি ;
কিন্তু দেখি ম্লানমুখী নলিনী যুবতী,
প্রানেশ বিরহে ধনী হয়ে ক্ষিণ্ণমনা,
হায় রে মুদিত-মুখী সুচারু-বদনা |
বায়ু-ভরে তরঙ্গিত সরসীর জল,
চন্দ্র-প্রতিবিম্ব  তার করে ঝলমল ;
যেন বিধু কুতূহলী স্বদেহ দর্শনে,
স্বচ্চ সরোমুকুরেতে দেকিছে বদনে |
এইরূপ সুখময়ী  শশিযুতা নিশি,
নিরখি অন্তর, বিভু-প্রেমেতে উল্লাসী ;
প্রীতি-পুষ্পে মাখাইয়া ভক্তির চন্দন,
সানন্দে মানসে পূজি ঈশ্বর-চরণ  |

.                   ********************                                                   
সূচিতে...    




মিলনসাগর
*
উপবন
কামিনী দাসী

আহা মরি কি সুন্দর এই উপবন,
তরু লতা জালে কিবা হয়েছে শোভন !
ফুটেছে বিবিধ ফুল বিবিধ বরণে,
বিভাসিত উপবন কুসুম-কিরণে |
চুরি করি ফুল্ল ফুল পরিমল-ধন,
বহিতেছে গন্ধবহ সুমন্দ গমন |
পুষ্প-মধু-পান-মত্ত যত ভৃঙ্গকুল
বসিছে প্রসূনোপরি হইয়া ব্যাকুল,
গুন্ গুন্ রবে করে সঘনে ঝঙ্কারে,
আনন্দে কুসুম বনে করিছে বিহার |
বসিয়া কোকিল-রাজ তরু-শাখা’ পরে,
হরষিত চিতে গান গায় পঞ্চ স্বরে |
বিবিধ বিহগ হ’য়ে একত্র মিলিত,
করিছে কাকলী-রব শ্রবণ ললিত
মরি কিবা মনোরম সেই কল তান,
বিনায়াসে মানবের তোষে মনঃ প্রাণ !
উন্নত পাদপচয় শ্রেণী বিরাজিত,
হরিত পত্রেতে শাখা প্রশাখা মন্ডিত |
অরুণ-কিরণ-যুত নবীন পল্লব,
কোন কোন শাখা শিরে হয়েছে উদ্ভব |
মৃদুল মারুত ভরে কাংপে শাখা চয়,
ইঙ্গিত করিছে বলি অনুমান হয় |
কোন স্থানে রমণীয় লতিকা-বিতান,
করিতেছে উদ্যানের সুষমা বিধান |
কুসুম-ভূষিতা লতা দোলে বায়ু--ভরে,
কৃশাঙ্গী কামিনী যেন সুখে নৃত্য করে |
পরস্পর বিজড়িত লতিকা--নিচয়,
কমনীয় কান্তি হেরে মোহিত হৃদয় |
নয়ন-রঞ্জন এই সুরম্য উদ্যান,
সন্তোপিত চিত্তে করে সান্ত্বনা প্রদান |

.             ********************                                                   
সূচিতে...    




মিলনসাগর
*
তৃষিত চাতক
কামিনী দাসী

উদিত নবীন মেঘ আকাশ মন্ডলে,
উড়িছে চাতক চয় দেখ দলে দলে,
নব বারি-ধারা পানে হয়ে আশান্বিত
চিতোল্লাসে নভঃ পথে ফিরে ইতস্ততঃ ;
কিন্তু হায় এ কি পরিতাপের বিষয় |
বহিল প্রবল বায়ু যেন কি প্রলয়,
প্রচন্ড পবনাঘাতে নীরদ-নিকর,
শ্যামবর্ণ ত্যজি তনু হইল ধূসর,
দেখিতে দেখিতে ছিন্ন ভিন্ন কলেবর,
ক্রমেতে বিলীন হলো গগন-অন্তর |
তৃষিত চাতকগণ এরূপ হেরিয়া,
বিধাতার প্রতি কহে আক্ষেপ করিয়া ;
হে বিধাতঃ এ কি তব যোগ্য আচরণ,
হৃদয়-নিলয় তব কঠিন কেমন |
এই যে নবীন মেঘ উঠিল গগনে,
শীতল করিবে ধরা বরষি জীবনে,
ধারাপাতে পৃথিবীর হবে সুমঙ্গল,
বপন করিবে বীজ কৃষক সকল,
জন্মিবেক শস্য যাহা জীবের জীবন,
যদ্বারা বিনাশি ক্ষুধা বাঁচে জীবগণ |
আমরা চাতক জাতি মনের উল্লাসে,
ঊর্দ্ধমুখে ছিনু সবে চাহিয়া আকাশে,
নবীন বারিদ-বিন্দু সুখে করি পান,
শীতল করিব চির-তৃষা-যুক্ত প্রাণ,
তাহাতে বিবাদী বায়ু হইল এমন,
নিরাশ হইনু সবে পাইতে জীবন |
আছে বটে পৃথিবীতে বহু জলাশয়,
সে বারি পানেতে তৃপ্ত মোরা কভু নয়
নীরদ-নৃঃসৃত যেই অবিমিশ্র বারি,
সেই বারি আমাদের তৃষা স্নিগ্ধকারী  |

.             ********************                                                   
সূচিতে...    




মিলনসাগর
*
নদী
কামিনী দাসী

অয়ি স্রোতস্বতি শৈল-সম্ভবে  !
কি ভাবিছ বল সুকল রবে ?
বুঝিতে ও ভাষা না পারি যদি,
কিন্তু অনুমানি শুন গো নদি !
জীব-হিত-হেতু হয়েছ ব্রতী,
পর-দুঃখ হেরি কাতরা সতি,
তাই মৃদু স্বরে বলিছ নরে,
সদা যেন দয়া ধর্ম্ম আচরে !
অয়ি প্রবাহিণি ! শিখরী-সুতে !
জন্ম তব মহী-শুভ সাধিতে
গিরিজে! তোমার প্রভাব বলে,
সদা উপকৃত মনুজকুলে  |
বাণিজ্য ব্যাপারে সুবিধা কত,
তব হৃদে তরী চলিছে শত,
অনায়াসে যায় বিবিধ দেশ,
দূরিত জীবের শরীর ক্লেশ ;
তৃষায় কাতর পথিক চয়
পান করি তব শীতল পয়,
শ্রম পরিহরি হরিষ মনে,
পুনরপি রত হয় প্রয়াণে |
ক্ষেত্র-কর্ম্ম করি ক্লান্ত বদনে,
অঞ্জলি বান্ধিয়ে যুগল করে,
পিয়ে তব নীর পিপাসা হরে |
নিঘাদ-তাপিত পশু সকলে,
যূত-সহ নামি তব সলিলে,
অবগাহি দেহ শীতল নীরে,
পুনরপি ধীরে উঠয়ে তীরে |
তব বারি-গুণে অয়ি তটিনী  !
উর্ব্বরতা-শক্তি পায় ধরণী  |
শুভদে ! তোমার শুভ জীবন
তরু লতা তৃণ আদি জীবন |
তীর--দেশ তব কিবা শোভিত,
মানবের মন করে মোহিত |
হরিত--বাসনা প্রকৃতি ধনী,
চারু কান্তিময়ী স্মিতবদনী  |
সুরঙ্গ-রঞ্জিত তরঙ্গ-মালা,
(পর কি হে ধনি! রতন-মালা?)
অনিল-ভরেতে তোমার কায়,
মৃদু মৃদু কাঁপে কি শোভা পায় |
রবি-কর-পাতে বিমল বারি,
হয় জন-মনোমোহনকারী  |
চিন্তানলে চিত দহে গো যার,
হেরিলে তোমার সুষমা-ভার,
ক্ষণিক কারণ সে দুঃখী মন
হরিষ-রসেতে হয়-মগন |
তরঙ্গিণি ! তব অসীম গুণ,
বর্ণিবারে আমি নহি নিপুণ |
বিভুর আদেশ পালন করি,
সুখিনী  তুমি গো দিবা শর্ব্বরী,
সে আজ্ঞা-পালনে বিরত নর,
পাপানলে সদা দহে অন্তর |

.       ********************                                                           
সূচিতে...    




মিলনসাগর
*
তামসী নিশা
কামিনী দাসী

তিমির-বাসনা যামিনী আইল,
ক্রমেতে জগত সুষুপ্ত হইল,
রাজ-পথে আর নাহি জন-স্রোতঃ
সবে নিদ্রা দেবী সেবা অনুরত |
ফুল-মধু-পান ত্যজি অলি--দলে,
রয়েছে নীরব নিদ্রার কৌশলে |
পক্ষিগণ করে নীড় সমাশ্রয়,
রজনী বিহারী পেচক বিহঙ্গ,
অন্ধকার রাত্রে বাড়ে তার রঙ্গ,
মনের আনন্দে করে বিচরণ,
পেচক-চরিত্র হয় দুষ্ট জন |
তামসী নিশাতে তস্কর সকল,
অনায়াসে সাধে অভীষ্ট সকল |
পাতকী-প্রধান লম্পট-নিচয়,
তিমির দর্শনে প্রফুল্ল হৃদয় ;
কুলটা রমণী আনন্দিত মনে,
তোষে পাপ তৃষা অতি সঙ্গোপনে |
সরোবর-নীরে কুমুদিনী ধনী
জীবেশ-বিরহে বিষণ্ণ বদনী  |
অসংখ্য তারকা-রাজি সমুদিত,
যেন কি আকাশ হীরক-খচিত |
শশি-সন্নিধানে নক্ষত্র-নিকর,
প্রকাশিত শক্ত নহে নিজকর
দিন পেয়ে আজ তেজ দেখ তার,
জগতের রীতি এই সে প্রকার |
তমোময়ী  নিশা  হেরিয়া নয়নে,
পুলকিত মতি খদ্যোতিকা গণে,
ঝাঁকে ঝাঁকে তরু’ পরে শোভাকরে,
কভু দলবদ্ধ ফিরিছে অম্বরে |
এ রজনী যোগে রে অবোধ মন,
এক মনে ভাব বিভুর চরণ,
ভাবিলে যাঁহারে মুক্তি পরিণামে,
ভুলনা তাহারে তুমি অষ্ট যামে |

.       ********************                                                           
সূচিতে...    




মিলনসাগর
*
নলিনীর প্রতি
কামিনী দাসী

দিনমণি-প্রিয়া অয়ি নলিনি!
এ কি তব রীতি বলনা শুনি,
জীবন সঁপেছ দিনেশ প্রতি,
মধুর প্রণয়ে হয়েছে ব্রতী |
রজনী আগত হেরি নয়নো
ঢাক লো বদন দুঃখিত মনে,
দুঃখেতে যামিনী যাপন করি,
ঊষাগমে পুনঃ ওলো সুন্দরী,
প্রেমোল্লাসে ভরে প্রফুল্ল মুখী,
হের কান্তে, হ’য়ে অতুল সুখী |
ভানু সহ তব প্রণয় এত,
অলি তবে কেন ও পদানত ?
তব মধু-পান করি সতত,
খ্যাত ভূবনে নাম মধূব্রত |
সেই সে ভ্রমর মূদিত মনে,
করে কেলি সদা তোমার সনে |
দিনকরে প্রেম জ্ঞাপন-তরে
ঢাক যবে মুখ বিষাদ-ভরে,
তথাপি তব সে প্রাণ-ভ্রমর,
থাকে অন্তরে না হয় অন্তর |
একাকিনী তুমি যুগল পতি,
হায় হায় এ কি সতী-প্রকৃতি ?
রমণীকুলে সহিবারে গ্লানি,
সৃজছে বিধি তোরে লো নলিনি |

.       ********************                                                           
সূচিতে...    




মিলনসাগর
*
মনুষ্যের স্বভাব
কামিনী দাসী

দেখ দেখ অই প্রসারি নয়ন,
সরসী-কমলে কিবা সুশোভন,
ফুটেছে কমল চারু পরিমলে,
দুলিছে প্রভাত-পবন-হিল্লোলে |
আহা কি সুন্দর, নেত্র বিনোদন |
মধু লোভে আসে মধুলিহগণ ;
মধুর গুঞ্জন করে অবিরত,
শ্রবণে শ্রবণ হয় বিমোহিত |
কিন্তু হায় হায় যবে কমলিনী,
মধুহীনা হবে বিশুষ্কবদনী,
তখন কি আর এই ভৃঙ্গ দলে,
মধুর গুঞ্জনে তুষিবে কমলে  ?
নলিনী-সদনে আসিবে না আর,
অন্য ফুল-দলে করিবে বিহার |
তেমনি যখন মনুজ-সদনে,
থাকেন কমলা অচপল মনে,
কত জনে তাঁর স্তুতি বাদ করে,
যশোগীত ধ্বনি পরসে অম্বরে |
বহু জন পূর্ণ সে সুখ-ভবন
হর্ষ-কলরব উঠে অনুক্ষণ |
ভাগ্য-দোষে যবে হায় রে কমলা,
তারে ত্যাজি যান হইয়া চঞ্চলা,
দুরবস্থা হেরি কে তারে জিজ্ঞাসে ?
কেবা আসে বল শ্রীহীন সে বাসে ?
ধন-হীন হেরি তোষামোদি-দল,
কায় মনে সেবে অন্য ধনিদল  |
ধন-শূন্য নরে কেহ না আদরে,
অভিমানে মানি-নেত্র জল ঝরে
নলিনী ভ্রমরে মানব-প্রক়তি,
সুন্দর আদর্শ, চারু উপমিতি |

.       ********************                                                           
সূচিতে...    




মিলনসাগর
*
কোকিল
কামিনী দাসী

বসন্তের আগমনে নবামোদে মাতি’,
কে তুমি বিহঙ্গবর তরু--শাখে বসি’,
বরিষ সঙ্গীত--সুধা জগত মাতায়ে ?
তোমার  ললিত স্বর পশিলে শ্রবণে,
ভাসে রে হৃদয় মম সুখের তরঙ্গে ;
ভাবি বুঝি বাণী দেবী সদয়া হইয়া,
স্বীয় বীণা-বিনিঃসৃত ,সুতান-লহরী
প্রদানী তোমারে, কিহে পাঠাইলা হেথা,
বিনোদিতে শোক--তপ্ত মনুজ--হৃদয় ?
আছে ত বিহঙ্গ বহু ভারত--কাননে ;
গায় রে পাপিয়া গীত অতি সুললিত ;
শ্যামার সুন্দর তানে মোহিত মানস ;
আর আর কল--নাদী পক্ষী আছে কত,
ঢালে রে অমৃত--ধারা শ্রবণ--বিবরে,
তোষে বটে মনঃ প্রাণ মধুর সঙ্গীতে ;
কিন্তু তব সম পাখি কারেও না গণি |
মথি স্বর--সিন্ধু সেই দেব সৃষ্টি--পতি
দিলা তার সার--ভাগ চারু কন্ঠে তব,
কলকন্ঠ নাম তব তেঁই এ জগতে------
তেঁই হে বিহঙ্গ--মাঝে শীর্ষ--স্থান তব |

.       ********************                                                           
সূচিতে...    




মিলনসাগর