কবি কামিনী দাসীর কবিতা
www.milansagar.com
*
চোক্ গেল
কামিনী দাসী

হে বিহঙ্গ! তরু-শাখে বসিয়া সুস্বরে
‘চোক্ গেল’ ‘চোক্ গেল’ শুদ্ধ এই রবে
কেন বলবার বার প্রকাশ যাতনা?
কিছু না বুঝিতে পারি, কিসের লাগিয়া
শিখেছে এ ভাষা তুমি অহে নভোচর!
সামান্য মানব আমি, নাহি বুদ্ধি-লেশ,
শুনিয়া তোমার রব করি অনুমান,
যেন এই পৃথিবীর পাপ-ক্রিয়া যত
নিরখি নয়নে, সহিতে না পারি, তাই
উচ্চৈস্বরে ‘চোক্ গেল’  ‘ চোক গেল’ বলি
প্রকাশ মনের ভাব অহে দ্বিজবর!
নতুবা তোমার কন্ঠ বিবর হইতে
উথলে যে স্বর-সুধা, ঊষা সমাগমে,
(যখন আরক্ত রাগে রঞ্জি পূর্বাকাশে,
সমুদিত দিনমণি চারু নব বেশে),
সে স্বর শুনিয়া হেন বোধ হয়, যেন
গাইয়া বিভুর গুণ সুমধুর তানে
ছড়াও পৃথিবী-তটে সুস্বর-লহরী,
শ্রবণে যে রব ত্যজি সুখ-নিদ্রাবেশ
উঠেরে মানবকুল অলস নয়নে |
বিভু-কৃত বন্দী তুমি মানব সদনে
আর আর পাখী সহ-বিপিনবিহারী |
যতনে মহীপ-নিদ্রা-ভঞ্জন-কারণ
গায় বন্দী সকৌতুকে ললিত সুস্বরে ;
ঈশ-নিয়োজিত বন্দী বিহগ--নিচয়
তা চেয়ে কি মিষ্ট স্বরে গায় না ললিত?
কিম্বা  এবে সে বিচারে কিবা প্রয়োজন?
জিজ্ঞাসি’ তোমারে অহে সুনাদী বিহঙ্গ!
ত্যজি নিজ কল স্বর বল  কোন্ হেতু
ডাক সদা ‘চোক্ গেল’ ‘চোক গেল’ রবে?
অতিশয় কৌতূহল-পূর্ণ মম মন ;
দিয়া সত্য পরিচয় সরল হৃদয়ে
কর কর আমার এ তৃষা নিবারণ,----
হউক অচিরে মম সংশয় ভঞ্জন |

.          ********************                                                          
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
দয়া
কামিনী দাসী

সজ্জন-মানসাকাশে কে তুমি সুন্দরী !
বিতর বিমল বিভা অয়ি স্মিতাননে !
প্রকাশে চপলা বটে শ্যামল জলদে,
অল্প ক্ষণমাত্রস্থায়ী তার তীক্ষ্ম জ্যোতিঃ ;
কিন্তু তব তনু-জাত কান্তি সমুজ্জল
উজলে গো হৃদাকাশে সদা সম ভাবে |
তবু সানুকূল দৃষ্টি নাহি যার প্রতি,
বৃথায় মানব-দেহ দরে সে ধরায় |
তোমার মহিমা বলে এ মহী-মন্ডলে
প্রসবে সুফল  কত কে বলিতে পারে?
বিষম বিপদ্ জালে জড়িত দেখিয়া
কোন জনে, কেন মন হয় গো ধাবিত
বিমোচিতে থারে সে বিপদ্-পাশ হ’তে
দরিদ্রতা--রূপিণী রাক্ষসী ভয়ঙ্করী
করে গো শাসন যবে কোন ভাগ্য-হীনে,
যথা সাধ্য তার ক্লেশ দূর করিবারে
কেন যত্নবান হয় মানব-মন্ডলী?
পীড়ায় কাতর কেহ কাঁদে আর্ত্তস্বরে,
শুনি সেই স্বর, হেরি সে মলিন মুখ
কোন্ বৃত্তি--বশে মন হয় গো ব্যথিত ?
দয়া তার নাম---শুভকরী বৃত্তি সেই |
যার হৃদে তুমি বাস কর নিরন্তর,
ধন্য ধন্য সেই জন ধন্য এ জগতে !
দয়া--শূন্য হিয়া মরু সম গণি আমি |

.          ********************                                                          
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
আশা
কামিনী দাসী

অয়ি আশা! তোমার কুহক মন্ত্র বলে
মোহিত মনুজ-মন, হায় রে এরূপ
ছলিবারে পারে হেন সাধ্য আছে কার ?
সদা ক্রীড়া কর তুমি মানবের মনে ;
যদি কভু তিলমাত্র হও অন্তরিত,
অমনি ত্বরিত আসি হইয়া উদয়
প্রকাশ মোহিনী-লীলা জীবমুগ্ধকরী |
তুমি যদি না থাকিতে অয়ি বিশ্বরমে !
এ মহীভূবন হ’ত দুঃখের নিলয় |
অসীম ক্ষমতা তব কে বর্ণিতে পারে
তাপিত জীবের তুমি সুখ-প্রদায়িনী ;
সংসার-যন্ত্রণা বিষে জজ্জর--হৃদয়
হইয়া যে জন, বীতরাগ জীবনেতে,
তোমা বিনা কার সাধ্য সে ব্যথিত জনে
দেয় রে সান্ত্বনা-বারি যাতনা অনলে ?
ভুলিয়া পূর্ব্বের দুঃখ তোমার প্রভাবে
পুনরায় চেষ্টা করে লভিবারে সুখ |
ভুবন-মোহিনী ! জন-চিত্ত-বিনোদিনি !
মনুষ্য-হৃদয়ে তুমি তরঙ্গিনী সম
প্রবাহিত অবিরাম |  অয়ি মায়াবিনি !
লুপ্ত-ধন-প্রাপ্তি-আশা, পুনঃ সুখ-ইচ্ছা,
মহীপ-ধন-পিপাসা, নব প্রেম-তৃষা,
যুবতী জন-লালসা, সন্তান-কামনা,
ঈশ্বর সকাসে সদা মুক্তি-পদ ভিক্ষা,
তোমার প্রভাবে নিত্য মানসে উদয় |
তোমার করুণা-দৃষ্টি যদি না হইত
প্রাণি-গণ প্রতি, কেহ না বাঁচিত কভু
এ ভব-সংসার-ধামে | অয়ি কুহকিনি !
বর্ণিতে মহিমা তব সুধী-জন-গণ
অক্ষম, আমি কি হায় পারি তা বর্ণিতে ?
চাপল্য-প্রকাশ-মাত্র লেখনী-চালন----
বামন হইয়া শশাঙ্ক ধরিতে ইচ্ছা |

.          ********************                                                          
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
বাল্য-বাস-ভূমি
কামিনী দাসী

অয়ি বাল্য-বাস-ভূমি!  বিরহে তোমার
ব্যাকুল এ প্রাণ মম হায় গো সতত ;
সতত চাহে গো আঁখি হেরিবার তরে
কমনীয় কান্তি তব নয়ন রঞ্জিনী  |
যথায় প্রশস্ত ভূমি-সমাবৃত
শোভিত প্রকৃতি সতী হরিত বসনে ;
শ্যামল বিটপি-শাখে পক্ষী নানা জাতি
করিত কাকলী রব-শ্রবণ-রঞ্জন |
স্ব স্ব নিয়মিত কাল করি অধিকার
বিরাজিত ছয় ঋতু ; প্রকৃতি সুন্দরী
নব নব রূপ ধরি প্রিয় ঋতু গণে
তুষিতেন, তোষে যথা রজনী বিগতে
স্মিতমুখী কমলিনী সরাগ তপনে |
শরীরের স্বাস্থ্যকর বিমল বাতাস
বাহিত, জীবের মনে প্রমোদ বিতরি |
বিকশিয়া ফুল-কুল চারু প্রভাব দানে
উজলিত তনু তব অয়ি প্রিয় ভূমি !
অকৃত্রিম শোভাময় তোমার শরীর
হেরিয়া মোহিত হ’ত চক্ষু-মনঃ-প্রাণ |
ফুলকুল-প্রিয়া আমি ছিলাম কৈশোরে ;
সতত চঞ্চল হ’ত মানস  আমার,
কৌমার স্বভাব হেতু , সাজিতে কৌতুকে
মনোরম ফুল-সাজে -----অপার আনন্দ |
প্রশস্ত নির্ম্মল তব চারু অঙ্ক-দেশে
সুখময় কৌমার কাল-----হায় রে যে কালে
জানিত না মন চিন্তা-ব্যাধির যাতনা,
সারল্য-মিশ্রিত হর্ষ-উৎসের তরঙ্গ
উঠিত হৃদয়-মাঝে দিবস রজনী  ;
কোথায় সে মন এবে, কোথায় সে স্থান ?
ভাবিলে উপজে হায় যাতনা বিষম,
অনর্গল অশ্রু-ধারা বরষে নয়নে |
আর কি গো প্রিয় ভূমি হেরিব তোমায় ?
আর কি স্বজন সহ সুখের তরঙ্গে
ভাসিব তেমতি, হায় যথা তব ক্রোড়ে
যাপন করেছি কাল সদানন্দ সহ ?
যদ্যপিও প্রিয় ভূমি পাই গো তোমায়,
কিন্তু আর আসিবে না সে সুখের দিন,
গিয়াছে যে দিনচয় অলক্ষিতরূপে |
হেরিলে তোমারে এবে, এ মম হৃদয়ে
কি ভাব উদিত হবে, দুর্ব্বল লেখনি
বর্ণিতে সমর্থ নহে সে ভাব নিচয় |

.          ********************                                                          
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
মনোরম স্বপ্ন
কামিনী দাসী

একদা রজনী-যোগে বিরাম শয়নে
করিয়া শয়ন, মুদি নয়ন-যুগল,
করিতেছি নিদ্রা-দেবী চরণ সেবন,
হেন কালে অকস্মাৎ কিবা মনোরম
অপরূপ স্বপ্ন আসি মানসে উদিত |
দেখিলাম যেন স্বর্গ-পুরী মনোহর,
নাম যার বৈজয়ন্ত, দেবরাজধানী  ;
দেবতার রাজা ইন্দ্র মহিষী পৌলোমী
যথায় করেন বাস সুরগণ সহ |
নিরম্মিয়াছে বিশ্বকর্ম্মা সভা সুগঠন ;
যে য়ে স্থলে যে যে বস্তু হয় শোভমান
দিয়াছে সে সমুদয় ; সে সভা সম্বন্ধে
পারে কি উপমা দিতে সামান্য মানব ?
দেবদেবীগণ সদাবাঞ্ছিত যে স্থান,
কণক--খচিত চারু রাজ সিংহাসনে,
তদুপরি সমাসীন ইন্দ্র দেবরাজ,
বাম ভাগে শচী দেবী পুলোম-দুহিতা----
স্নিগ্ধ জ্যোতির্ম্ময়ী তনু, ফুল্ল পদ্মনামা----
যাঁর রূপে প্রভান্বিত অমর-ভবন |
সুমুখী কিঙ্করীদ্বয় সুভুজ চালনে
ঢুলায় উভয় পার্শ্বে চামর ললিত ;
ধরে ছত্র ছত্রধর মহেন্দ্র-মস্তকে ;
আর দেব দেবীগণ, যথাযোগ্য স্থানে,
বসেছেন সবে, সভা করিয়া উজ্জ্বল |
অমর-বেষ্টিত ইন্দ্র কি দৃশ্য সুন্দর,
তারাদল মধ্যে যেন সুধাংসু উদয় |
নন্দন-কানন-জাত কুসুম সৌরভ
চুরি করি সমীরণ ভ্রমিছেন সদা,
বিতরি মধুর বাস অমর-নাসায়,
চুম্বি বিদ্যাধর বালা অলকা কুঞ্চিত |
অপ্সরী কিন্নরী কত নাচে তালে তালে,
নয়ন রঞ্জিনী রূপে, চারু বিম্বাধরে
চপলা-বিজিত হাসি ----মানস মোহন |
তাল মান-লয়-রাগ-রাগিণী-সহিত
গাইছে গায়ক গীত সুমধুর স্বরে |
বাজিছে অমরালয়ে বিবিধ বাজনা----
মৃদঙ্গ, মন্দিরা, বীণা, মুরজ, ররাব |
এইত দেবের সভা বর্ণিনু কিঞ্চিৎ,
দুর্ব্বল রসনা মম, অধিক বর্ণিতে
নাহিক ক্ষমতা আর, নিরস্ত হইনু |
.  দেখিলাম আর  এক দৃশ্য অপরূপ----
শূন্যোপরে শোভে যেন সহস্র বিমান,
তাহে নিবসেন কত ভারত নন্দন,
বীরত্ব, ঔদার্য্য আদি গুণের সাগর ;
সুবিশাল বক্ষস্থল ; প্রসন্ন বদন ;
বিনির্গত শান্তি-জ্যোতিঃ নয়ন যুগলে ;
প্রশস্ত ললাট ----যেন ধর্ম্মের দর্পণ ;
বিভু-প্রেমে পরিপূর্ণ মানস-নিলয় |
সকলে একত্র হয়ে, একতান মনে,
গাইছেন বিভু গুণ সানন্দ অন্তরে |
সে মহাপুরুষগণে বিলোকন করি,
ভক্তি-রস-পরিপ্লুত হৃদয়-কন্দর |
ভাবিলাম মনে মনে, ভারত-জননী
পূর্ব্বেতে ছিলেন কত গৌরব-আস্পদা,
কত সাধু-সুত গর্ভে করিলা ধারণ----
অদ্যাপি যাদের যশো-নির্ম্মল-চন্দ্রিক ;
করিছে মানব মনঃ-কুমুদ-বিকাশ |
দেখিলাম আর কত আর্য্যবালাগণ,
সতীত্ব-সুরত্ন-হারে ভূষিত-হৃদয়া,
আনন্দে করেন বাস সে সুখ সদনে |
সবে বীর-বালা, বীরাঙ্গানা, বীর্য্যবতী,
ত্রিদিব-সুন্দরী-সম সুচারু-দর্শনা,
বহুল সদ্ গুণ-জালে মন্ডিত মানসা ;
যাঁহাদের যশোরাশি কীর্ত্তন কারণ,
ভারতের পূর্ব্বতন মহা কবিচয়,
কত শত কাব্য-মালা গাঁথিয়া যতনে,
দিয়াছেন ভারতের চারু গলদেশে |
এইরূপ স্বর্গ-শোভা নিরীক্ষণ করি
ভ্রমিতেছে মহোল্লাসে, হেনই সময়
সহসা ভাঙ্গিল নিদ্রা মেলিনু নয়ন |
কোথা স্বর্গপূরী ? কোথা দেব সভাতল ?
কোথা দেব-সিংহাসনে পৌলমী রঞ্জন ?
কোথা বা সে শচী দেবী সুবিম্ব-অধরা ?
কোথা আর আর যত দেবতা মন্ডলী  ?
কোথা নৃত্য-সুনিপুণা অপ্সরা নিনাদ ?
কোথা বা গায়ক দল ?  কোথায় বাদক
কোথা মৃদঙ্গের মৃদু গভীর নিনাদ  ?
কোথা বীণা ঝঙ্কারিত স্বর সুমধুর ?
কোথা সেই বীরগণ ভারত নন্দন ?
কোথা ভারতের সতী দুহিতা নিচয় ?
কিছুই না দেখি আর সে স্বর্গীয় লীলা,
রয়েছি শয়িত  স্বীয় পূর্ব্বের শয়নে |
ভাবিনু অন্তরে অদ্য যামিনী সুন্দরী
সদয়া আমার প্রতি, জানিনু নিশ্চয় |
সানুকুলা স্বপ্ন-দেবী, যাঁহার প্রসাদে
দেখিলাম স্বর্গ-শোভা, অদ্ভুত দর্শন |

.          ********************                                                          
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
সুখ-দুঃখ-গতি
কামিনী দাসী

প্রাবৃটে জলদে মলিন তপন,
নিদাঘে অরুণ ঘোর দরশন |
শরতে আকাশ অতি নিরমল,
ঘন ঘনাবৃত বর্ষায় খ-তল ;
নদী হ্রদ আদি জলাশয় চয়,
বর্ষাগমে বিস্তারিত তনু হয় |
খরতর গ্রীষ্ম ঋতু-আগমনে,
ক্ষীণ দেহ শুষ্ক রবির কিরণে
আইলে সরস বসন্ত সময়,
উল্লাসিত জীব জন্তু সমুদয় ;
মৃদু মৃদু বহে মলয় পবন,
করে যেন দেহে অমৃত বর্ষণ ;
পুষ্প-পরিমলে দিক্ সমাকুল,
কল স্বরে গান করে পিককুল ;
আনন্দ-অন্তরে বসুধা যুবতী
বরিবারে যেন দেব ঋতুপতি,
শাখি-শাখা-করে লয়ে পুষ্পাঞ্জলি,
প্রিয় মধু-পদে দেন কুতুহলী |
কিন্তু হায় যবে আগত শিশির,
থাকে না সে শোভা আর ধরণীর ;
নবীন-যৌবনা মেদিনী কামিনী
পতির বিচ্ছেদে যেন উন্মাদিনী,
বেশ-ভূষাহীনা, অবশশরীরা,
সুধীর প্রকৃতি শোকেতে অধীরা
শন্ শন্ স্বনে উত্তর পবন,
বহে, দীর্ঘ শ্বাস শোক-নিদর্শন ;
হিম-বৃষ্টি-ছলে ঝরে অশ্রু জল,
আর্দ্র ধরা বাস মলিন অঞ্চল |
তাই করি মনে দৃঢ় অনুমান,
চির দিন কভু না যায় সমান ;
এক ভাবে কিছু না যায় জগতে,
কালে কালে সব বিপরীত এতে |
চক্রগতি রূপে সুক-দুখ-গতি,
মনুজ--সমাজে করে গতাগতি |

.         ********************                                                  
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
স্বপ্নে বামা-দর্শন
কামিনী দাসী

.        মরি কি অদ্ভুত হেরিনু স্বপন,
কৃশাঙ্গী কামিনী এক বিমলিন বেশা,
বিজন বিপিন-ভূমে করিছে রোদন ;
নিকটে যাইয়া তাঁরে করিনু জিজ্ঞাসা |

.  কে তুমি কামিনি ? বনে কাঁদ একাকিনী
অশ্রুবারি পরিপ্লুত  কপোল-যুগল,
বিলুন্ঠিত কেশ-পাশ-নব  কাদম্বিনী,
কমল গঞ্জিত চারু বদন কোমল |

.   কি লাগি এ দশা তব?  অয়ি সুবদনে !
অট্টালিকা ত্যজি কেন অরণ্যে বসতি ?
কন্টক কর্ক্কর ফুটে কোমল চরণে,
বিদরে হৃদয়, হেরি তোমার দুর্গতি

.   নিরুপম রূপ তব ;  ও রূপ হেরিতে,
অনুমানি, দিনমণি কভু নাহি পায় |
ভ্রমিছ কাননে এবে এ দীন বেশেতে ;
কালের কুটিল গতি বুঝা নাহি যায় |

.  বিষ’দে মলিন মূর্ত্তি যদিও তোমার,
তথাপিও তব অঙ্গ-কান্তি নিরমল  |
ক’রেছে এ ঘোর বনে প্রভার বিস্তার,
শশি-করে করে যথা ধরণী উজ্জ্বল |

.    পরিচয় দেহ অয়ি নবীনা অঙ্গমে  !
কোন্ উচ্চ বংশে জন্ম করেছ গ্রহণ ?
করেছ বরণ কোন্ ভাগ্যধর জনে ?
কি রূপে হইল ছিন্ন সে প্রেম -বন্ধন ?

.   নর জাতি মধ্যে তুমি যাহার কামিনী
তার সম ভাগ্যবান্ নাহিক ভূতলে |
তোমারে হেরিয়া আমি এই অনুমানি,
অবতীর্ণা বুঝি রমা রামারূপ--ছলে |

.   এতেক বচন মম শুনি সে ললনা ;
দিলেন উত্তর অতি ম়ৃদু কল রোলে ;
‘মম পরিচয় তব জানিতে বাসনা ?
শুন তবে, কর ক্ষুণ্ণ শ্রবণ-যুগলে |’

.   ‘নাম মম দময়ন্তী ভীম-ভূপ-বালা,
নিষাধিপতি নল নৃপেন্দ্র-রমণী  |
ভ্রাতৃ সনে স্বামী মম করি দ্যূত খেলা
আইলেন বনে, আমি হইনু সঙ্গিনী |’

.  ‘তদবধি ছায়া প্রায় ছিনু যে সঙ্গেতে,
তিল মাত্র এক পদ নহি অন্তরিত |
হায় গো নিদ্রিত আমি দুর্দ্দৈব-বশেতে ;
গিয়াছেন তাজি মোরে জনমের মত |’

.   ‘সতত সদয় নাথ ছিলেন আমারে ;
না জানি সহসা কেন হইয়া নিদয়,
ভাসালেন অভাগীরে অকূল পাথারে |
জানিনু ললাট-লিপি খন্ডন না হয় |’

.    বলিতে বলিতে এই আত্ম বিবরণ,
দুঃসহ যন্ত্রণা-ভারে হইয়া কাতর,
পড়িলেন ধরা’ পরে বিগত চেতন,
হায়রে বিচ্ছিন্ন যেন লতা-কলেবর  |

.     সসম্ভ্রমে আমি তাঁরে তুলিবার তরে
প্রসারিনু কর, আহা এমন সময়
নিরদয়া স্বপ্ন দেবী হলেন আমারে,
অন্তর্হিত রামা-রূপ মধুরিমাময়  |

.         ********************                                                  
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
সাবিত্রী
কামিনী দাসী

.   সতী-শ্রেষ্ঠা  গুণবতী অশ্বপতি-সুতা,
তাঁহার চরিত অতি অদ্ভুত সুন্দর
সখী সনে বনে গিয়া সে কোকিল-রুতা
হেরি সত্যবানে দিলা আপন অন্তর |

.   তদবধি সেই জন জাগে তাঁর মনে,
হৃদি পটে চারু রূপ হইল চিত্রিত ;
কিন্তু তাঁর বর্ষমাত্র পরমায়ু শুনে,
অর্পিতে সে বরে পিতা মাতা অসন্মত |

.   কত মতে গুরুজন নষেধিলা তাঁরে
না শুনিলা কা’র কথা মহীপ-কুমারী  |
বলিলেন----‘বিধি-বিধি কে লঙ্ঘিতে পারে  ?
পতি মম সত্যবান্ আমি তাঁর নারী  |’

.    শুনি সাবিত্রীর এ প্রতিজ্ঞা দৃঢ়তর,
বনে হ’তে সত্যবানে করি আনয়ন,
বিধি মতে তনয়া প্রদানে নৃপবর ;
পতি সনে যান সতী কুটীর ভবন |

.    যদিও নরেন্দ্র-সুতা, সাবিত্রী সুন্দরী
তথাপিও শ্বশুরের কুটীর-আবাসে
যাপন করেন সুখে দিবস শর্ব্বরী ;
নাহি দুঃখ-লেশ সত্যবান্ সহবাসে |

.   সাবিত্রীর রূপে দীপ্ত কুটীর-ভবন,
সেবা  বশে প্রীত সত্যবান্ পিতা মাতা,
শীলতাদি গুণে তুষ্টা ঋষি-পত্নীগণ
ভাবেন অন্তরে ইনি রমা জগন্মাতা |

.    এইরূপে ক্রমে ক্রমে দিন হয় গত ;
নিকটে আগত দেখি আয়ুঃ-শেষ কাল
মনে  মনে  বিষাদিতা  সাবিত্রী সতত
গোপন করেন বাহ্যে রহস্য করাল |

.      এক দিন অপরাহ্নে ধীর সত্যবান্ ,
জননী জনক স্থানে লয়ে অনুমতি,
কাষ্ঠ ফল আহরিতে ঘোর বনে যান,
চলিলা কান্তারে সতী কান্তের সংহতি |

.   আহরণ করি ফল আকর্ষণী করে
ভাঙ্গিছেন শুষ্ক কাষ্ট, এমত সময়
উপস্থিত শিরঃ-পীড়া, ঘোর ব্যথা-ভরে
নৃপতি-নন্দন অতি বিকল হৃদয় |

.     অবতরি বৃক্ষ হ’তে প্রণয়িণী-কোলে
রাখি শির, নৃপ-সুত করিলা শয়ন,
দেখিয়া সাবিত্রী সতী ভাসে অশ্রু-জলে
বসন-অঞ্চল লয়ে করেন ব্যজন |

.   ক্রমশঃ যাতনা বৃদ্ধি হইতে লাগিল,
বুঝিলেন সত্যবান্ মরণ নিকট,
ভাবি বৃদ্ধ পিতা মাতা চক্ষে ঝরে জল ;
আগত সমীপ-দেশে শমন বিকট |

.   বলিলেন সত্যবান্ ----- ‘অয়ি প্রাণপ্রিয়ে !
ভাসায়ে তোমায় দুঃখ-দুস্তর সলিলে
জন্ম মত যাই আমি পৃথিবী ত্যজিয়ে,
দহিবে কোমল অঙ্গ বৈধব্য-অনলে |’

.   একে চক্ষুহীন পিতা তায় পুত্র-শোকে
হবেন কাতর, শান্ত ক’রো গুণবতি,
ঘূর্ণিত মস্তক, বাক্ সরে না হে মুখে,
দৃষ্টি-শক্তি-হীন নেত্র, বিদায় হে সতি |’

.   বাক্য-অন্তে মৃত্যু তাঁর হরিল চেতন,
মুদিত হইল চারু নয়ন-কমল |
দেখি নৃপ-বালা শোকে করেন রোদন,
গন্ড-যুগ বহি ধারা পড়ে অবিরল |

.   আইল কৃতান্ত-দূত বিকট মূরতি,
স্পর্শিতে নারিল শবে ভয়াকুল মন,
স্তম্ভিত শরীর, দেখি সতী-অঙ্গ-জ্যোতি
ফিরি গেল, দিতে বার্ত্তা শমন-সদন |

.   দূত সহ মৃত্যু-পতি আসিয়া কাননে,
দেখিলা রমণী এক অপূর্ব্ব-রূপিণী,
অন্তর্যামী ধর্ম্মরাজ জানিলেন মনে,
এই সে সাবিত্রী সতী মহা তেজস্বিনী

.   অঙ্গুষ্ঠ সম এক পুরুষ কলেবর,
সত্যবান্ দেহ হ’তে হইল বাহির,
তাঁরে বাঁধি লয়ে দূত চলিল সত্বর,
পতির এ গতি দেখি সাবিত্রী অস্থির |

.    বলিলেন প্রেতপতি ----‘বিধির ইচ্ছায়
হরিনু তোমার স্বামী, নাহি দোষ মম,
পতি শোক সমাকুলা হেরিয়া তোমায়
এ মম অন্তরে ক্লেশ উপজে বিষম |’

.    এত বলি শমন চলিলা নিজ স্থান,
পশ্চাতে পশ্চাতে যান সাবিত্রী সুন্দরী
হেরিয়া কহেন যম,--- ‘গৃহেতে প্রয়াণ
কর শীঘ্র-গতি সতি !  তামসী শর্ব্বরী  |

.     কৃতাঞ্জলি-পুটে ধীরা কন সবিনয়ে,
‘গৃহে যাই হেন ইচ্ছা নাহি প্রভু আর,
যাব সেই নিত্য ধামে পৃথিবী ত্যজিয়ে,
কান্তের যে গতি মম সেই গতি সার |’

.   শুনিয়া সাবিত্রী-বাণী কৃতান্ত-হৃদয়
দুঃখেতে হইল দ্রব, হায় কি অদ্ভুত !
জগত-নিবাসী জনে যে জন নাশয়
হেরি সতীদুঃখ তার মন দয়াযুত |

.  প্রবোধি বলেন ধর্ম্ম,----‘ অয়ি নৃপ-সুতে |
তুমি জ্ঞানবতী, কর শোক সংবরণ,
সকলেই ক্ষিপ্ত হবে কালের মুখেতে,
জন্মিলেই মৃত্যু আছে অবশ্য লিখন |’

.   এত বলি ত্বরা-গতি যান ধর্ম্মরাজ ;
পুনশ্চ চলিলা বালা শমন--সংহতি |
দেখি ক’ন যম, -----‘বালে !  একি তব কাজ ?
বৃথা কেন বৎসে !  কর মম সনে গতি ?’

.   ‘হ সতি ! বর যাহা তব মনোমত,
বিনা সত্যবান্ যাহা চাহ দিব আমি |’
শুনিয়া বলেন বামা,--- ‘ নহি যে প্রার্থিত
অন্য কোন বরে আমি, বিনা সেই স্বামী |’

.   ‘তবে যদি দয়াময় দয়া প্রকশিয়ে
অর্পিবেন বর মোরে, জনক আমার
হউন কৃথার্থ প্রিয় তনয় লভিয়ে,
অন্য কোন বরে মম নাহি ইচ্ছা আর |’

.   ‘তথাস্তু’ বলিয়া যম যান পুনরায়
সঙ্গে চলে তাঁর দ্যুমৎসেন-পুত্রবধূ |
কান্ত বিনা কামিনীর কত দুঃখ হায় !
মলিন বদন যেন রাহুগ্রস্ত বিধু |

.     পুনরপি প্রেত-পতি বলেন বামারে,----
‘কি লাগিয়া বৎসে পুনঃ এস মম সনে ?
দিনু বর, যাহ চলি আবাস-আগারে,
আবৃতা অবনী দেখ তিমির-বসনে |’

.    পুনশ্চ বিনয় সহ বলে নৃপ--বালা,-----
‘যাবনা গৃহেতে, গৃহে কি কাজ আমার ?
ত্যজি গিয়াছেন নাথ, সেই শোকজ্বালা
জ্বলিছে হৃদয় মাঝে, হায় অনিবার |’

.   আবার বলেন যম,----- ‘অয়ি চারুশীলে  !
হেরি তব স্বামী-ভক্তি সন্তুষ্ট হইয়ে
দিব বর অভিমত,  হে পতি-বৎসলে |
লও শীঘ্র, যাই আমি আপন নিলয়ে |’

.   কর যোড়ি সাবিত্রী বলেন মৃদু স্বরে,------
‘যদি বর দিবে প্রভু আপন ইচ্ছায়,
অন্ধ যে শ্বশুর চক্ষু লভুন সত্বরে,
বারে বারে বর নিতে মন নাহি চায় |’

 ‘তথাস্তু’ বলিয়া যম করিলেন গতি,
পুনশ্চ পশ্চাতে যায় নৃপতি-বালিকা |
জিজ্ঞাসেন ধর্ম্ম,----- ‘কেন এস গুণবতি !
যাও ফিরি, ঘোরা নিশা নক্ষত্র মালিকা |’

.   তথাপি নিবৃত্তা নহে নৃপতি নন্দিনী  |
দেখিয়া বলেন যম করুণ বচনে,-----
‘শুন অয়ি সতী-কুল-সতত-বন্দিনি !
যে বর চাহিবে তাহা দিব এইক্ষণে |’

.   সাধ্বী অশ্বপতি-বালা বলে মৃদু ভাষে-----
‘পুনঃ পুনঃ বরে প্রভু নাহি প্রয়োজন,
বার বার লোভে ধর্ম্ম সহজে বিনাশে,
এক মাত্র চাই তব চরণে শরণ |’

.     পুনরায় ‘লও বর’ বলেন শমন |
‘লঙ্ঘিতে না পারি বাক্য’ বলেন রমণী,
যদি প্রভু মম প্রতি দয়াযুক্ত মন,
‘এই বর মাগে স্বামি-বিয়োগ--দুঃখিনী |’

.   ‘সত্যবান্-ঔরসে তনয় শত জন
হইবে আমার, প্রভু দেহ এই বর |’
শুনিয়া ‘তথাস্তু’ বলি চলিলা শমন,
যান সঙ্গে রাজ-সুতা বিরস অন্তর |

.   দেখিয়া বলেন ধর্ম্ম,---- ‘হে সাবিত্রী সতি,
পুনঃ কেন  মম সনে এস ধর্ম্মশীলে  !
তিন বর দিয়া আমি তুষি গুণবতী !
তোমায়, তথাপি কেন ফিরি নাহি গেলে |’

.    বদ্ধাঞ্জলি  সাবিত্রী বলেন মৃদু ভাষে,-----
‘তব দত্ত বর কভু নহিবে অন থা,
অবশ্য যাইব ফিরি আমি নিজ বাসে,
কিরূপেতে প্রভু তব সিদ্ধ হবে কথা  ?’

.   ‘সত্যবান্  ঔরসেতে জন্মিবে তনয়,
আপনি চলিলা লয়ে সেই সত্যবানে,
তব বরে পুত্র আমি লভিব নিশ্চয় ;
কিন্তু হায় আর না পাইব সত্যবানে |’

.    শুনি সাবিত্রীর এই কাতর বচন,
সলজ্জিত মৃত্যুপতি করুণার্দ্রচিত,
বলিলেন,----- ‘লও সতি তব পতি-ধন,
মৃত দেহে পুনঃ আত্মা করহ যোজিত |’

.     ‘সৃষ্টি কালাবধি আমি বহু সতী--পতি
করেছি হরণ, কিন্তু তোমার সমান
কভু নাহি দেখি হেন নিরুপমা সতী ;
স্বামি-সহ সুখে বাসে করহ প্রয়াণ |’

.       ‘যাবৎ উদিবে চন্দ্র সূর্য্য নভস্তলে
তাবৎ গাইবে মহী তব যশোগান,
করিলে সাবিত্রী--ব্রত সেই পুণ্য--ফলে
হবে সুখী ব্রতা-রতা তোমার সমান |’

.       এইরূপে আশীর্ব্বাদি সাবিত্রী সতীরে
অন্তর্হিত হইলেন দেব মৃত্যু--পতি |
তিমিরে পূরিত দিক্ দৃষ্টি না সঞ্চরে
বৃক্ষ-মূলে সপতি সাবিত্রী গুণবতী  |

.      মৃদু স্বরে কামিনী সম্বোধি সত্যবানে
কহিলেন,-----‘কত নিদ্রা যাও প্রিয়তম ?
‘এসেছিলে অরণ্যেতে শেষ দিবা মানে
এবে দেখ বন-ভূমি ব্যাপ্ত ঘোর তম |’

.   শুনি কান্তা-কন্ঠ কান্ত হয়ে চমকিত
উঠিলা, উন্মীলি পদ্ম-পলাশ নয়ন,
বলিলেন,-----‘ প্রিয়ে ! নিশা অন্ধকারাবৃত ;
কেন কর নাই মম সুষুপ্তি ভঞ্জন ?

.   পতি-কন্ঠ-স্বর বামা আকর্ণি শ্রবেণে,
হর্ষোত্ফুল্ল  নেত্রে ধনী  চাহিয়া রহিল |
ক্ষণকাল অসমর্থা বাক্যের কথনে
প্রকৃতিস্তা হয়ে সতী শেষে উত্তরিল  |

.  কহিলেন নৃপ-বালা,------‘কিসের কারণ
করি নাই নিদ্রা-ভঙ্গ,  পরে প্রকাশিব,
এবে শীঘ্রগতি চল কুটীর ভবন,
ব্যাকুলিত গুরু জন ভাবিয়া অশিব |’

.   ব্যস্ত হ’য়ে চলিলেন কুটীরাভিমুখে
সত্যবান্ সহ সতী সাবিত্রী সুন্দরী  ;
যথায় মহিষী সহ মগ্ন মনোদুঃখে
দ্যূমৎসেন নৃপ , পুত্র  পুত্র-বধূ স্মরি |

.   নিবিড় কানন ভীম শ্বাপদ-সঙ্কুল,
তাহাতে তামসী নিশা,  বধূ সত্যবান্
কিরূপে আছে সে বনে ভাবিয়া আকূল,
নৃপতি সহিত  রাণী হন হতজ্ঞান |

.    এইরূপে দুই জন মগ্ন চিন্তা-ভরে,
হেন কালে সত্যবান্ সাবিত্রী সহিত
আইলা কুটীরে ;  পুত্র পুত্র-বধূ হেরে
উভয়ের নেত্রে হর্ষ-অশ্রু বিগলিত |

.  গুরুজন-পাদপদ্মে করিয়া প্রণতি
বসিলেন দুই জনে, দুর্ঘটনা যত
একে একে বলিলেন সে সব ভারতী,
শুনি নৃপ, নৃপ-জায়া হইলা বিস্মিত |

.   মুনি, মুনি-পত্নী-গণ আইলা দেখিতে
সত্যবান্ সাবিত্রীরে, বন-বিবরণ
শ্রবণ করিয়া অতি পরিতুষ্ট চিতে
আশীর্ব্বাদ করি সবে করিলা গমন |

.    ধন্য, বামা-কুল-মণি সাবিত্রী সুন্দরী  !
বাঁচাইলে মৃত পতি ছলিয়া শমনে |
তোমার পবিত্র নাম গাবে নর নারী
অতুল আনন্দে মাতি এ বিশ্ব ভুবনে |

.      তোমার আদর্শ করি যত কুল-বালা,
পতি--পদে রতি মতি রাখুক যতনে |
নিজ পতি-ভক্তি-বলে নব বিধি বালা
সৃজন করিলে এই অখিল ভুবনে  |

.    সুখে থাক ভুমন্ডলে সতী-কুল-সতি !
নিখিল জগতে তব নাহিক তুলনা |
পতি-সহ যাপ কাল অহে গুণবতি !
চির আয়ুঃ লভ তুমি হে ভূপ-ললনা  |

.         ********************                                                  
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
স্বর্গীয়--শিশু
কামিনী দাসী

.   স্নেহময় প্রিয়জন দরশন-আশে
আসিয়া হেথায়, কিবা প্রমোদ লভিনু,
বিপুল আনন্দ-বারি নাহি পেয়ে স্থান,
হায়রে, মানস-উত্স উছলি উঠিল |

* এই শিশুটি যশোহরান্তর্গত চাঁচড়া নিবাসী শ্রীল শ্রীযুক্ত রাজা
হেমদাকন্ঠ রায় বাহাদুরের পুত্র এবং গ্রন্থকর্ত্রীর ভাগিনেয় | ইনি সন
১২৮৫ সালের ১১ই ফাল্গুন শুক্রুবার জন্ম গ্রহণ করিয়া সন ১২৮৭
সালের ১৮ই পৌষ মঙ্গলবার এক বৎসর দশ মাস দিবস বয়ক্রম
কালে কালের করাল গ্রাসে পতিত হয়েন |

# হেথায় অর্থাৎ আতপুর রাজবাটী |

হেরি আর্য্য-সুতাদ্বয়-বদনকমল
বিষম বিরহ-তাপ হ’ল অন্তর্হিত ;
নিরখি কোমল-মূর্ত্তি বাল বালা গুলি,
করিনু প্রার্থনা, বর দেহ, বিশ্বপিতঃ,
চিরজীবী হয়ে এরা থাকে যেন সবে
সার্দ্ধ-একবর্ষমিত বয়স্ক একটি
দেখিলাম শিশু | তার সুচারু মূরতি
নিরখি’ নয়ন-যুগ পলক-বিহীন |
কিবা সে শিশুর বর্ণ অতি মনোরম,
শ্বেত-রক্ত-বিমিশ্রিত ছটা নিরমল !
অল্প-সংখ্য দন্ত-পাঁতি মুকতা সমান ;
প্রবাল-নিন্দিত প্রভাশালী ওষ্ঠাধর ;
আয়ত নয়ন-প্রান্ত, স্নিগ্ধ শ্বেত আভা
মধ্যে সুনিবিড় কৃষ্ণ তারক-যুগল ;
দর্পণ সদৃশ জ্যোতির্যুক্ত সে ললাট ;
প্রস্ফুট গোলাপ সম চারু গন্ডদেশ |
অর্দ্ধস্ফুট কথা-গুলি মরি কি মধুর !
নবনীত নিব তার কোমল শরীর |
ঈদৃশ সুন্দর শিশু পূর্ব্বে কভু আর
হয় নাই মম নেত্র পথের পথিক |
স্বভাব-সিদ্ধ-সম্বন্ধ-প্রভাব বশতঃ
অনুগত হ’ল শিশু একান্ত আমার ;
গত হ’ল ছয় মাস আশাতীত সুখে |
হায় রে নির্দ্দয় কাল কীটের দংশনে
ছিন্ন শিশু-পুষ্প-কলি হইল অকালে !
অশনি-আঘাত সম এ মম হৃদয়ে
বাজিল সে শোক-শেল নিদারুণরূপে |
এসেছিনু য়বে হেথা, কি প্রমোদ রসে
ছিল রে পূর্ণিত হৃদি ; এখন কি দশা !
স্বর্গ নরকের সহ প্রভেদ যেমতি
তেমতি সে মন সহ এ মন প্রভেদ |

.         ********************                                                  
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
স্বর্গীয় কন্যা বিভাবতী
কামিনী দাসী

কাঁদায়ে আত্মীয় স্বজনগণে
.    কোথা গেলে বিভা নয়ন-তারা ?
---  ---  ----  ---  ---  ---  ---  ---  ---

•        বিভাবতী গ্রন্থকর্ত্রীর একমাত্র কন্যা ছিলেন | ইহার
পিতার নাম শ্রী যোগেন্দ্র নারায়ণ ঘোষ |  ইনি সন ১২৮৩
সালের ৭ই অগ্রহায়ণ জন্ম গ্রহণ করিয়া  সন ১২৮৭ সালের
সালের ৩০ শে চৈত্র, চারি বত্সর চারি মাস দ্বাবিংশ দিবস
বয়ঃক্রম কালে, পিতা মাতার ক্রোড় অন্ধকার করিয়া কাল-
কীটে দংশিত হন  |


স্মরি তোর সেই সুচারু মুখ
.    অবিরত ঝরে নয়নে ধারা |

কোমল অরুণ ওষ্ঠ-অধরে
.    বিরাজিত সদা মধুর হাসি  ;
কুন্দ-কলি সম দশন-রুচি
,    প্রকাশিত কিবা সুষমা রাশি !

মৃণাল-নিন্দিত বাহু-যুগলে
.    ধরিতিস যবে এ গলদেশ,
ভাবিতাম স্বর্গ তুচ্ছ তখন,
.     এ সুখের বুঝি নাইরে শেষ

সরলতা মাখা স্নেহের স্বরে
.    ডাকিতে রে  যবে মা মা মা ব’লে
জ্ঞান হ’ত বুঝি বাণীর বীণা
.    এরূপ মধুর কভু না রোলে |

সহজে শিশুর চপল গতি,
.    কিন্তু হায়, তব গমন হেরে,
নিতম্বিনী-বৃন্দে  পাইত লাজ,
.     ধীরগতি যতা মরালবরে |

অগ্র ভাগ বক্র নিবিড় কেশ,
.    বঙ্কিম সীমন্ত শোভিত তায় ;
অঞ্জনে রঞ্জিত নয়ন গন্ড,
.     ভূষিত থাকিত তনু ধূলায় |

পরিহিত বাস পুরুষ বেশে
.    আভরণ-হীন থাকিতে প্রায় ;
কভু বা সাজিয়া নবীন বধূ
.     কি সুন্দর খেলা খেলিত হায় !

সতত আমার মানস-পটে
.   চিত্রিত রয়েছে সে সব ছবি ;
ভুলিব না তোরে থাকিতে প্রাণ
.   যাবত উদিবে শশাঙ্ক রবি  |

আয় আয় আয়, অরে বিভাবতি
.    আর এক বার দেখি সে মুখ ;
ও চাঁদ-বদন হেরিলে এখন
.    দূরে পলাইবে সকল দুখ |

দুখিনী জননী ব’লে কি রে তোর
.    মনেতে হয় না করুণা-লেশ ;
এত কঠিনতা শিথিল রে কবে?
.     ভুলেও ভাব না অভাগী-ক্লেশ |

অশ্রু-পূর্ণ মম নয়ন দেখিলে,
.   মরি রে কাতরা হইতে কত ;
সযতনে সেই সুকোমল করে
.   মুছাইয়া অশ্রু, সুধাসিঞ্চিত---

বচনে, রোদন-কারণ জিজ্ঞাসা
.   করিতে যখন, ও মুখ হেরি
মনোদুঃখ মনে পাইত বিলয়,
.    লইতাম তোরে কোলেতে করি |

হায় রে এখন দিবস রজনী
.   সতত নয়নে ঝরিছে জল,
বিভা রে ! আমারে ছড়িয়া গিয়াছে,
.   কে মুছাবে অশ্রু বল রে বল ?

হেলিতে দুলিতে সুমন্দ গমনে
.    আসিতে আসিতে দু বাহু তুলে,
হাসিতে হাসিতে বলিতে সুমুখি !-----
.     ও মা মা আমারে নিন্ না কোলে  |

হায় রে এখন শ্রবণ-বিবরে,
.    বিভা রে !  সে তোর মধুর ধ্বনি
সতত ধ্বনিত হ’তেছে রে মরি !
.    গিয়েছ কোথায় নেত্র-নন্দিনি ?

নিশামুখে আহা অলস নয়নে
.    কোলে উঠিবার কারণে কত
কাঁদিতে, এবে তা করিয়ে স্মরণ
.    হ’তেছে যাতনা বর্ণনাতীত |

এখন প্রদোষে বসিয়ে বিরলে
.    নয়নের জলে ভাসাই ক্ষিতি,
নিবার নিবার এ ঘোর যাতনা,
.    এস এস কোলে রে বিভাবতি !

হে কৃতান্ত ! মোরে হইয়ে সদয়
.    লয়ে যাও যথা আছে সে বিভা,
যুড়াক যুড়াক তাপিত জীবন,
.    হেরি সে বিভার বদন-বিভা |

বিভার কোমল বদন-কমল
.    নিরখিনু যেই দিনেতে হায়,
সে সুখের কিবা দিব রে উপমা,
.    বাণী কৃপা-হীন এ রসনায় |

অপার আনন্দ-পয়োধি-সলিলে
.    নিমজ্জিত হ’ল নয়ন মন ;
ভাবিলাম মনে হায় কতক্ষণে
.    দেখিবেন কান্ত এ সুবদন |

একাকী আমার হৃদয় কন্দরে
.     ধরে না ধরে না এ সুখ-রাশি ;
কতক্ষণে প্রাণ-প্রিয়তম জন
.     দেখিবেন সুতা শারদ শশী  |

হায় রে অচিরে পূরিল বাসনা,
.    উপস্থিত কান্ত হৃদয়-নিধি,
হেরি শিশু-মুখ সপুলক মনে
.     ভাবিলেন -----হ’য়ে প্রসন্ন বিধি।

দিয়াছেন এই তনয়া-রতন ;
.    ইহার লালন-পালন-ফলে
উপজিবে কত সীমাহীন সুখ
.     দুখী দম্পতির ললাট-তলে  |

তনয়ার মুখে অর্দ্ধ-বিনির্গত
.    কুন্দ-কলি সম দশন হেরি,
সফল হইবে মানব-জনম,
.     সমুদিত মনে আশা-লহরী  |

শীলতার সহ সুধাময় ভাষে
.    তুষিত সে শত্রু, স্বজনগণে ;
হেরিয়া শিশুর বুদ্ধির বিকাশ,
.    অনুপম সুখ পেতাম মনে |

এইরূপ সুখে গত বর্ষ চারি,
.   হায় রে কি কাল উদয় হ’ল !
হরিতে বিভার জীবন-পবন
.   দুরন্ত শমন আসি উদিল |

ক্রমান্বয়ে রোগে ভুগি’ তিন মাস
.    প্রশমিতে তনু-যাতনা যত,
স্বর্গ-পুরী চলি গেল বিভাবতী,
.    ত্যজিয়ে পৃথিবী জনম মত |

হায় রে শ্মশানে লয়ে শিশুরে
.    প্রহর অধিক বসি রহিল,
তার পরে তারে করাইয়া স্নান
.    চিতার উপরি তুলিয়া দিল |

কৃষ্ণ-চতুর্দ্দশী শশীর সমান
.    হয়েছিল তার শরীর ক্ষীণ ;
ফুল্ল শতদল সম মুখ-কান্তি,
.     উন্মীলিত চারু নেত্র-নলিন |

অহহ বালক-স্বভাব-বশেতে
.    হইয়াছে যেন কোপে মগন !
তাই বিভাবতী আছে রে নীরবে,
.    নিমেষে-বিহীন করি নয়ন |

যতনে আদরে ধরি যে বদন
.   লইতাম ঘ্রাণ অসংখ্য বার,
সেই সুকোমল আনন-কমলে
.    দিলা পিন্ড, পরশি তিন বার |

অনন্তর তৃণ সহিত অনল
.   জ্বালিয়া তাহার দিলা বদনে,
করিলেন হায় শেষ ক্রিয়া তার,
.    ক্ষণে ভস্ম তনু হ’ল দহনে |

রাশি-জাত নাম খগেন্দ্র-বাহিণী
.    পিন্ডদান-মন্ত্রে সফল হ’ল,
হায় আদরের নাম বিভাবতী
.    মেদিনী-মন্ডলে এবে লুকাল  |

কেবল রহিল মানস-পটেতে
.    পাষাণে খোদিত রেখার মত,
কভু না মুছিবে সে নামাঙ্ক-গুলি ;
.    ইষ্ট-মন্ত্র ইষ্ট নহে রে তত |

ক্রমেতে কলসী আর সে অঙ্গার
.    তরঙ্গ--তাড়নে গেল কোথায় ;
কমল-পলাশ-জীবন-সদৃশ
.    মানব-জীবন দেখিবে হায়  |

বিভার লালন-পালন-সুখেতে
.    বিগত হ’য়েছে বরষ চারি ;
এখন কি দুখে দহিছে হৃদয়,
.    তাহা কি প্রকাশ করিতে পারি ?

সুখ-অংশভাগী করিবার তরে
.   যাঁহার কারণে ব্যাকুল মন
হ’য়েছিল, এবে কি দশা তাঁহার,
.   দেখ্ চেয়ে দেখ্ পাপ-নয়ন |

কোথায় এখন সে সুখ-কুসুম,
.   ফুটেছিল যাহা মানস-বনে,
কোথায় এখন সে বিভা-লতিকা
.    শুষ্ক এবে যাহা কাল-দহনে ?

সম্বত্সর গতে আইলেন উমা
.   গিরিশ--গেহিনী গিরীশ বাসে ;
বঙ্গবাসী যত বাল--বৃদ্ধ--যুবা
.    প্রোমদ-পয়োধি সলিলে ভাসে :

গৃহ গৃহাঙ্গন পরিস্কার ক’রে
.    সাজায় যতনে দ্বার সকল ;
সুখ-স্রোতস্বতী  বহে বঙ্গ-হৃদে,
.    শারদ প্রকৃতি শোভে উজল |

সুদৃশ্য বসন, সুচারু ভূষণে
.   সাজিছে বালক-বালিকা-চয় ;
দেখিয়া আগত নগেন্দ্র-বালিকা
.   এ বঙ্গ-ভুবন আনন্দময় |

এ আনন্দ-দিনে সে আনন্দময়ী
.    কোথায় আমার সে বিভাবতী ?
দুখিনী-জননী-অঞ্চলের নিধি
.     কেন হ’রে নিলি রে কাল কুমতি ?

হইয়াছে শূন্য অঙ্ক রে আমার,
.    অঙ্ক-সুশোভিনী কোথায় বিভা ?
হে বিভো আর যে সহে না সহে না
.   এ ঘোর যাতনা রজনী দিবা  |

দেখিলে বিভার সে চারু আনন
.    কতসুখ হ’ত উদিত মনে ;
বিম্ব ওষ্ঠাধরে সুধামাখা হাসি
.     বিরাজিত মরি সকল ক্ষণে |

যে সুখ বিভার লালন পালনে
.    পেয়েছি, এবে তা স্বপন-প্রায়,
দহিবে মানস বিভা-শোকানলে,
.    যাবৎ এ দেহ র’বে ধরায় |

জনক-জননী-স্নেহ-সুধা-রসে
.     হ’য়েছি বঞ্চিত অনেক দিন ;
পেয়ে বিভাবতী নয়ন-নন্দিনী
.     ছিল রে জীবন যাতনা হীন !

এখন বিষাদ-সমুদ্র-সলিলে
.    ডুবিল ডুবিল এ মন-তরী,
কৃপা-কণা-দানে কর দুঃখে ত্রাণ
.     ত্বরায়, হে বিভো ভব-কান্ডারী  |

আনন্দময়ী সে গিরীন্দ্র-বালিকা,
বঙ্গ-জন-গণ-আনন্দ-দায়িকা,
আসিছেন সহ লক্ষ্ণী সরস্বতী,
লইয়ে কুমার গুহ গণপতি |

মহোৎসবময় এ বঙ্গ-ভুবন ;
ধন্য অভয়ার শুভ আগমণ !
সুখেতে শারদ প্রক়তি হাসিছে,
বাল, বৃদ্ধ, যুবা পুলকে ভাসিছে |
গগনে উদিত সুধাংশু নির্ম্মল
বিতরে কৌমুদী রজত-উজ্জ্বল |
সরসী-কমল বিমল হয়েছে
কমল কুমুদ কতই ফুটেছে  |
তুলি শতদল শক্তি-ভক্তি-গণে
দিতেছে অভয়া-অভয়-চরণে |
কাম-রিপু রামা কামদা-সদনে
মনোমত বর চাহে সর্ব্ব জনে ;
ভক্তি-পাশে বান্ধা ভবেশ-ভাবিনী
পূরেন ভক্তের বাঞ্ছা ত্রিনয়নী  |
.   এ শুভ সময়ে হে নগ-নন্দিনী  !
কোথা বিভাবতী নয়ন-নন্দিনি  ?
হর্ষে পরিপূর্ণ সকলের মন,
দুখানলে দহে আমার জীবন |
হেরি শোভাময় শারদীয় শশী,
কার মন নাহি হয় গো উল্লাসী  ?
কিন্তু হেরি সেই সুধাংশু শোভন,
ঝরে আভাগিনী-নয়নে জীবন,
বিহনে সে হায় বিভার বদন,
শোভাহীন এই রজনী-রঞ্জন |
পাইলে সুন্দর বসন ভূষণ
হ’ত বিভা কত হর্ষেতে মগন ;
বেশ-ভূষা-প্রিয়া ছিল অতিশয়,
পড়িলে মনেতে বিদরে হৃদয় |
এ আনন্দ-দিনে কারে সাজাইব ?
আদরের নামে কারে বা ডাকিব  ?
প্রতিমা দর্শন করিবার তরে
যে’ত বিভা কত পুলক অন্তরে ;
দেখিতে প্রতিমা এবার কে যাবে  ?
হেরি মা তোমায় কে সুখে ভাসিবে  ?
বিসর্জ্জন দেখি বিগত বত্সর
ঘরে এসে বিভা নিদ্রায় কাতর ;
সে বিজয়া-দিনে ওগো মা ভবানি !
কারে কোলে লয়ে জুড়াব এ প্রাণি  ?
অলস নয়নে কে আসিবে কোলে ?
কে ডাকিবে সুধামাখা মা  মা ব’লে  ?

.         ********************                                                  
সূচিতে...    


মিলনসাগর
*
ভ্রমরাষ্টক
কামিনী দাসী
( “ভ্রমরাষ্টক”  প্রবন্ধটী সংস্কৃত ভ্রমরাষ্টকের অনুবাদ )


( ভ্রমরের উভয় সঙ্কট |  )

সুগন্ধ-সংযুতা,          ভুবন-বিদিতা,
কেতকী হেম-বরণী
পদ্ম ভাবি তায়,           মধুর আশায়,
পড়িল ভৃঙ্গ অমনি ;
কুসুমের রজে               নয়ন সহজে,
দৃষ্টি-শক্তিহীন হ’ল,
কন্টকের ঘায়,           পক্ষ ছিন্ন তায়,
কি দুর্দ্দৈব উপজিল |
পড়িয়ে আপদে,       অলি-রাজ কাঁদে,
আপনারে তিরস্কারে,
না পারে থাকিতে ,     না পারে যাইতে,
পড়িল বিষম ফেরে |



( ভ্রমরের অসন্তষ্টি হেতু পরাভব |  )

ত্যাগ করি গন্ধ-যুতা সুনব মল্লিকা,
মধুকর গেল পরে যথায় যুথিকা ;
দৈবাং ত্যজিয়ে তারে চম্পকেতে গেল ;
পশ্চাতে সরোজ-গত ; প্রমাদ ঘটিল -----
নিশাকর-বিধি-বশে হায়রে তথায়
বন্ধ হ’য়ে কাঁদে মূঢ় না দেখি উপায় |
সন্তোষ-বিহীন চিত্ত যত মূঢ় জন
পরাভব-পদে প্রাপ্ত হয় সর্ব্বক্ষণ |



( ভ্রমরের অপমান  | )

যে দিন হইতে তব মুকুল উদ্ গত,
চূত! তদবধি ভৃঙ্গ তোমার আশ্রিত ;
ফলের বাহিরে অলি করয়ে ভ্রমণ,
তথাপি কর না তুমি তারে সম্ভাষণ ;
যে কীট পড়ে নি তব নয়ন-পথেতে,
পরাপর পরিজ্ঞান নাহি চূত !  তব,
ধিক্ হে তোমারে ধিক্, অধিক কি কর |



( ভ্রমরের দশার দৈবকৃত বিপর্য্যয়  |  )

জনম নবীন নীরজ-বনে,
পান করে মধু যথেচ্ছ মনে,
মালতী কুসুমে হেলে বিহরে ;
করে গুঞ্জা-লতা সেবন এঁবে |
হায় হায় ধিক্ দৈব-প্রভাবে !
কি কি দশা প্রাপ্ত হ’ল এ ভৃঙ্গ
হায় দেখ সবে অলির রঙ্গ |



( ভ্রমরের ভ্রান্তি--হেতু নাশ |  )

পলাশ কুসুম ভাবি মনেতে
পড়িল ভ্রমর শুক-তুন্ডেতে ;
জন্বু-ভ্রমে শুক তায় বধিল,
অবিবেকতার ফল ফলিল |



( ভ্রমরের বিড়ম্বনা | )

বিশাল আলেখ্য-পদ্ম করি দরশন,
স্ফীত-কলেবর হ’য়ে, অতি হৃষ্ট মন,
কি আশ্চর্য্য  কি  আশ্চর্য্য এ কি এ কি বুলি,
লেখ্য-পদ্ম উপরেতে পড়িলেক অলি  |
সুগন্ধ নাহিক এতে নাহি মধু-কণা,
নাহি সৌকুমার্য্য, দেখি, হ’য়ে ক্ষুব্ধ মনা,
ঘুরায়ে মস্তক, লাজে শির করি নত,
করিল গমন প্রতারিত মধুব্রত |



( ভ্রমরের দৈব-বশে অধম-সেবা |  )

নলিনী-বন-ল্লভ এই যে  ভ্রমর,
কুমুদিনী-কুল-কেলি-লা রস-পর,
বিধি-বশে বিদেশেতে হ’য়ে উপস্থিত,
পিয়ে বন-মল্লী-রস করি সম্মানিত |



( ভ্রমরের হর্ষে বিষাদ | )

যামিনী যাইবে, প্রভাত হবে,
তপন উদিবে, পদ্ম হাসিবে,
কোষ-গত ভৃঙ্গ এরূপ চিন্তে ;
এমন সময় করী দুরন্তে
ভখিল নলিনী মৃণাল সহ ;
হায় হায় একি দুখ দুঃসহ !

.                                             ********************                                   
সূচিতে...    


মিলনসাগর