কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
*
প্রণাম
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
(
কবিতাটি কবির জ্যেষ্ঠপুত্র কাঞ্চনকুমারের নামকরণ ও অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান উপলক্ষে লিখেছিলেন ১০ই চৈত্র ১৩৪৩ এর
আগে বা ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে।
)

মনের প্রশান্ত লোকে ছিল কোথা নীরব গোপন
.        চির-শিশু প্রকাশ-ব্যাকুল---
চঞ্চল তাহার লীলা ক্ষণে ক্ষণে ভুলাইছে মন
.        দোলাইয়া মরমের মূল!
মুখখানি ভাষাহীন কলরোলে তবুও মুখর
.        অপরূপ লাগে বিস্ময়---

যাঁহার করুণা লভি দেখিল সে প্রথম আলোক
.        প্রকৃতির রূপ অভিরাম---
ভূবন ভরিয়া আজ দিকে দিকে তাঁরি জয় হোক
.        সে পিতারে---পিতার প্রণাম।


.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
"চারণ" (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থের উত্সর্গ-কবিতা
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়

শ্রীযুক্ত শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য
অগ্রজপ্রতিমেষু ---

মনে পড়ে একদিন জীবনের প্রভাত-বেলায়,
মেবার-কাহিনীগুলি ধরেছিলে সম্মুখে আমার ;
তখনো ফোটেনি আলো আঁখিপাতে আছিল আঁধার ---
বিকাশ-উন্মুখ হিয়া কোরকের স্ফুটন-মেলায় !

তুমি এলে বাঁশি হাতে কন্ঠে ভরি’ মহিমার গান
আঁকিলে সে কোন্ ছবি ছিলনাক মুখে যার ভাষা !
নিখিল পাগল-করা অপরূপ যার ভালোবাসা --
সেই মোরে ভুলাইল ; সে মাধুরী ভরিল পরাণ !

তখনো কি জানিতাম এই ছবি মনে একদিন
স্মৃতির মালিকা গাঁথি দোলাইবে কবে মোর মন !
প্রকাশ-ব্যথার শেষে মোর মনে আসিবে ‘চারণ’----
বিস্ময়ে হেরিনু আজ আসিল সে হারানো নবীন |

মধুর স্মৃতির মালা গাঁথি’ তাই দিনু তব করে---
জানি মোর ক্ষুদ্র দান, তবু তুমি লবে সমাদরে |

.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
মহিমময়ী
[ ধাত্রী পান্না ]
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
[ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]


অপমান বড় বেজেছে বক্ষে কাঁদে সর্দ্দার করিম্-চাঁদ,
রহি’ রহি’ বুড়া উঠিছে ফুলিয়া চক্ষে মানে না জলের বাঁধ |
উচ্ছৃঙ্খল রাণা বিক্রম কথা শুনি’ যত মল্লদের ----
মানীর মাথায় হানিয়া আঘাত ডাকিয়া এনেছে গ্রহের ফের |
মেবারের সব সর্দ্দার জুটি সত্যে আজিকে বদ্ধপণ
উদয়ের নামে পালিবে রাণা মেবারের হেম-সিংহাসন |
আপন মহলে যাপিবে জীবন রাণা বিক্রম বন্দী হ’য়ে ---
বালক রাণার পতাকার তলে বনবীর য়াবে ছত্র ব’য়ে |
যুক্তির সনে মিলে গেল সবি ; মেবারের নব জীবন-ছবি,
শুধু মিলিল না -- বনবীর-মন হ’ল উচাটন শক্কি লভি’  !
লোভের আগুনে দিয়ে ইন্ধন জাগায়ে বন্য খুনের তৃষা,
শীতল-সেনীর পুত্র হইল হরষে মগন দিবস-নিশা ---
বিক্রম আর উদয়ে সরায়ে নিস্কন্টক হই না কেন ----
অথই পাথারে ভাবে বনবীর মহারাণা হবে সে-ই
আলোর যখন ঢলিল ক্লান্তি আঁধার ঘিরিল স্তব্ধ ভূমি ---
ধীরে ধীরো এল মূক নিশীথিনী ভুবন-রাণী চরণ ভূমি ;
আঁধারের সেই কালোয় কালোয় নিখিল আছিল কালিমা ভরা ---
একটুও নেই ভালবাসা তা’তে নেইক শান্তি দুঃখ-হরা ;
যেন জগতের সকল দুঃখ সহিছে নীরবে নিঝুম রাতি,
প্রাণের মেলায় নেই কোলাহল যেন নিভে গেছে প্রাণের বাতি,---


এমন সময়ে বিক্রম-প্রিয়া কাঁদিয়া উঠিল করুণ সুরে,
হায় বনবীর স্বামী-প্রাণ নিলি রংমহালের অন্তঃপুরে !
চমকি’ উঠিল উদয়ের পুরে প্রেমময়ী তার ধাত্রীমাতা ;
শিরে হাত দিয়া বসিয়া ভাবিল কত অগণন চিন্তা যা-তা !
পাগলের মত আকুল কন্ঠে কাঁদিয়া উঠিল ব্যথার বারি,
রাণাজিকে মাগো !  শেষ করে দেছে বনবীর বুকে ছুরিকা মারি’ |
পান্নার বুকে ভাঙিয়া পড়িল সহসা-ই যেন আকাশ খানা--
হতাশ হইয়া ভাবিল বুঝি-বা বনবীর আজি হইবে রাণা !
বারেক শিহরি’ কহিল পান্না, তাইতো বারি, কি উপায় হ’বে ?
রাজ্যের পথ সুসার করিতে বনবীর সে কি নীরব র’বে ?
স্তম্ভিত মুখ নত নির্ব্বাক মুখেতে বারির নেইকো ভাষা ---
অবশ চরণ কাঁপে থর থর শিথিল কবরী হাওয়ায় ভাসা !
খট্টার পরে ঘুমায় উদয়, পান্না রহিল নিমেষে চাহি’---
মাভৈঃ মাভৈঃ কহি’ ওঠে শেষে, মাগো বারি !  আর চিন্তা নাহি ?
মেবারের এই শেষ দীপশিখা কখনো নিবিতে দেব না আমি--
কহিছে পান্না করি যোড়পাণি, ঊর্দ্ধে হেরিছে জগত্স্বামী !
লতা-পাতা-ঢাকা ফলের চুপ্ ড়ি আনিতে বারিকে আদেশ দিয়া,
কুমারের সাজ পুত্রে পরায়ে খট্টার পরে পুত্রে নিয়া--
কহিল পান্না, ঘুমাও ঘুমাও বাছনি আমার মাণিক ওরে !
চন্দন-মুখে চুমা দিল আঁকি’, মাতৃবক্ষ ভাসিল লোরে !
নিয়ে এল বারি ফলের চুপ্ ড়ি ভরি’ তাহে কত সবুজ লতা,
জানিল না বালা মেশানো তাহাতে পান্না মায়ের কতই কথা  !
চুপ্ ড়ির নীচে শোয়ায়ে উদয়ে লতা পাতা দেহে ঢাকিয়া দিল --
বারির মাথায় তুলি’ দিয়ে শেষে সব তারে ধাই বিজ্ঞাপিল |


ধাই মাগো !  তুমি সর্ব্বনাশী যে, ক্ষুধা যে তোমার বিশ্বগ্রাসী ----
মাতা রাক্ষসী, কহিতেছে বারি, জানো শোনো ওগো বিশ্ববাসী ---
রাক্ষসী হ’তে সয়তানী মাতা রাক্ষস-ও নিজ পেটের বাছায়,
বুকের রক্ত পলকে নিঙাড়ি’ পুলকে তাহার জীবন বাঁচায় !
স্থির বিস্ময়ে কহিল পান্না’ চন্দন তরে ভাবনা কিসে ?
সে যে রাজপূত, তার খুন সাথে এই মেবারের গরিমা মিশে |
‘বাপ্পা-সমর-হামীরে’ র নাম শিশু উদয়ের নামেই র’বে,
যদি জ্বলে এই শেষ দীপখানি মেবারের মুখ উজল হ’বে |
চন্দন মোর রাজপূত বাছা জীবন বিলাবে রাণার তরে ---
ধাত্রী মায়ের এই গৌরব --- বীর সন্তান আমার ঘরে |
দু’বছর পরে মরিত-ই সে ত মেবারে রাখিত ধর্ম্মজ্ঞানে ---
দেশের ধর্ম্মে সঁপিনু তনয়ে, --- অভাগী মায়ের মর্ম্ম জানে |
ক্রন্দনরতা থামিল পান্না বলিল বারিকে শীঘ্র যেতে,
দূর নিরালায় বীরার প্রান্তে --- আসিবে এখনি খুনিরা মেতে !
চেয়ে গেল বারি পান্নার দিকে কতই ভাবনা ভাবিয়া মনে---
কত চলি’ পথ শ্যামল ক্ষেত্রে গাহিল নদীর কলস্বনে |
পান্নার বুক কাঁপিয়া উঠিল দুম্ দুম্ পা’র শব্দ পেয়ে,
ওই বনবীর খোলা ছুরি হাতে আসে প্রাসাদের কক্ষ বেয়ে |
বনবীর আসি’ কহিল, ধাই রে’ কুমার উগয় ঘুমায় কোথা ?
সরিল না বাক্ মায়ের কন্ঠে, আঙ্গুল বাড়ায়ে দেখাবো, হোথা---
সজোরে নিঠুর ছুরিকা বসায়ে মা’র সম্মুখে পুত্র-বুকে
পিশাচের মত বনবীর শেষে হাসিয়া উঠিল পশুর সুখে |
গোঙানির সাথে ভাসিয়া আসিল একটু শুধুই মাঁ-আঁ ধ্বনি,
হিমানী-শীতল হইল বালক শেষ হ’ল  মার নয়ন-মণি |
স্তব্ধ ধাত্রী বক্ষের ‘পরে পুত্রে লইয়া চলিল ধীরে---
কাঁদিতে কাঁদিতে চলে আন্ মনে বারি যেথা বসে’ বীরার তীরে |
অবশেষে দিল চিতার আগুনে ধাত্রী পান্না আপন পুঁজি --
বীরা-তীর আজও আঘাতিয়া ফেরে পুত্রহারা পুত্র খুঁজি |


উদয়ে লইয়া পান্না ও বারি কুম্ভমেরুর দুর্গপানে
চলিয়াছে পুনঃ রাখিতে কুমারে বিশ্বাসী-হাতে নির্জন স্থানে |
কমল্মীরের চূড়ায় চূড়ায় ঝলে যেন কত মুকুতা-ফলক,
ঝরে আঁখিজল চোখে পদ্মের হেরি’ জননী রূপের ঝলক |
ধূলিকণা কত অঙ্গে মাখিল মেবার যে তার জন্মভূমি ?
অদূরে দাঁড়ায়ে দেখে সর্দ্দার, পান্না কাঁদিছে অবনী চুমি’
চমকিত হ’ল জৈন জোয়ান্ রাজপুতানীর ভক্তি দেখে ---
বীরের জাতিতে প্রণাম জানিয়ে মনে মনে ভাবে শক্তি এ’কে !
সর্দ্দার বলে, ধাত্রী-জননী তুমি যে আমারি মায়ের মত !
যা কহিবে মোরে শির পাতি’ লব, বল মা বক্ষে কিসের ক্ষত !
আশা-শা’ সনে ব্যথা-বিনিময়ে কহিল ধাত্রী নয়নজলে ---
উদয় সোনার মেবার প্রদীপ ---পালিও তাহারে আপন বলে’ |
বন্দিল শেষে আশা-সর্দ্দার পান্না মায়ের চরণ দুটি---
কুমারের পদে নোয়াইয়া শির শেষে তারে নিল বক্ষে লুটি’ |


পান্নার ত্যাগ এখনো রেখেছে মেবারের রাজ-প্রদীপ জ্বালি’---
ভুবনে মহিমময়ীর কীর্ত্তি অমর আখরে ঝলিছে খালি ||

.                    **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
কর্ম্মদেবী
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
[ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]

.         “সূর্য্যতোরণ-রক্ষক শহিদাস শত্রুহস্তে জীবন বিসর্জ্জন করিলে কৈলবার পুত্ত সেই পদে
নিয়োজিত হইলেন |  পুত্তের বয়ঃক্রম তখন যোড়শবর্ষ | চিতোর রক্ষার জন্য তাঁহার বীরপিতা
ইতিপূর্ব্বে যুদ্ধে নিহত হইয়াছিলেন |পুত্তের প্রতিপালনার্থ তদীয় জননী কর্ম্মদেবী পতির সহগামিনী
হইতে পারেন নাই | আজ হইতে আজি তিনি স্বহস্তে পুত্রকে রণশয্যায় সজ্জিত করিয়া চিতোর
রক্ষার জন্য রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতেআদেশ প্রদান করিলেন | পুত্রকে রণসাগরে ঝম্পপ্রদানে আদেশ
করিয়াই তিনি ক্ষান্ত হন নাই | বীরপুত্রের অনুগমন করিয়া জগতে তিনি বীরবালার জ্বলন্ত উদাহরণ
রাখিয়া গিয়াছেন |”----
.                                                                                       
রাজস্থান পৃঃ ৮৪


মোগল ঘিরিয়াছে মেবার রাজধানী রুদ্ধ হইয়াছে চিতোর-ধাম,
অসির ঝঞ্ঝনা রণিছে ক্ষণে-ক্ষণে, ফিরিছে সবা-মুখে উদয় নাম |
জটলা শেষ করি’  মিলিছে ভায়ে ভায়ে, উজল করিবারে মায়ের মুখ,
মেবার সর্দ্দার গাহিছে মার জয়, যুদ্ধ-ভেরী ভরে চারণ-বুক !
রণের উল্লাসে চন্দাবৎ সবে দীপ্ত হয়ে পরে সাজোয়া-সাজ,
মত্ত রণ-নেশা ঘিরেছে আঁখিপাত তাদের শিরে আজি পড়েছে বাজ |
প্রধান সেনাপতি-মুকুট লভিয়াছে ভক্ত জয়মল রাঠোর বীর,
তাহার সাথে চলে পুত্ত “শহিদাস”  রাবৎদুদা সেই “চন্দ”  ধীর |
সকলে অনাহত মরণ-আহবেতে শুনেছে জননীর করুণ ডাক |
মেবার চিরদিন বীরের জননী যে চায়না কিছুতেই যশের ঢাক |
শোভিছে গৈরিক সবার পরিধানে, মেবার সৈনিক তুলিছে স্বর,
‘ত্বংহি জননী গো স্বরগ হতে সেরা’ ঘুচাও ক্ষুদ্রতা আপন-পর ;
রণের তপোভূমে পড়িল শহিদাস তোরণ-রক্ষক অমর প্রাণ,
মরার মত মরে’ সেই’ত জিনিল রে মরিয়া রণভূমে সমরখান |
কিশোর ‘পুত্তের’ নবীন হিয়াখানি তিলেক সহেনাক সবুর আর,
চলেছে অসি নিয়া, তাথিয়া তা-তা থিয়া নাচিয়া ওঠে সে যে বারম্বার |
কখনো ভুল’না রে পুত্ত সুত মোর চন্দাবৎ-কুলে জনম তোর
সঁপিও রণে প্রাণ কহিছে বীর নারী তনয়ে চুমিছে মা পরাণভোর |

কর্ম্মদেবী শেষে আপনি রণে যেতে সকলি করিয়াছে সমর ঠিক,
প্রাণের ধন তরে কাঁদিছে মার প্রাণ শান্তিহীন হয়ে সকল দিক,
কহিছে বীরবালা কর্ণবতী মায়ে, আমিও মাগো আজি বরিব রণ,----
স্বামীর পাশে যাব কমলাবতী কয় আজিকে রণে যেতে বড়ই মন |
‘চল গো তাই সবে আমার মেয়ে-বউ দেশের নামে কর জীবন-পণ |’
কর্ম্মদেবী বলে, ‘নমো মা ভগবানে তিনিই বিপদে যে আপন জন,
পুত্ত রণে শুলে মোদেরও অমানিশা ছাইবে কালো করি জীবন-পথ,
জীবন-ধূলা-খেলা নিমেষে ভেঙ্গে দেবে সত্য-সুন্দর মরণ-রথ |’

চিতোর দ্বার হতে পুত্ত বাহিরিয়া খেদাল’ বহুদূরে মোগলদের |
এদিকে গিরি-শিরে মা-বোন-জায়া হেরে বুঝি-বা ভাবে এল গ্রহের ফের |
মোগল বাদ্ সার হস্তে দূরবীণ্ নেহারে হঠে তার চমূর দল,
নূতন বিক্রমে নূতন সেনা নিয়ে চলিছে আকবর নবীন বল |
পুত্ত মহাবীরে এখনি বধে ফেল সাহান্--সাহজীর হুকুম এই,
রণের উল্লাসে ছুটেছে তুর্কীরা সকলে বলে বীর পূত্তে বাঁধিবেই |
হঠাৎ আকবর উঠেন চমকিয়া আওয়াজ হয় কোথা গুরুম্-গুম্
ও’ দিকে সেনা তার একের পর এর ঘুমায় নিরালায় মরণ ঘুম,
বিজুলি চমকায় ঊষর গিরি গায় ফুটেছে  নিরালায় মোহন রূপ,
তিনটি নারী সেথা যোদ্ধৃ-বেশে সাজি জ্বেলেছে বন্দুকে যজ্ঞধূপ |
হেরিল সম্রাট মহিমময়ীদের রুদ্র সুন্দর মধুর বেশ,
কহিল ‘রাজপুত তুমিই ধন্য, ধন্য, রাজবারা বীরের দেশ |’
‘ওদের বধিও না হে মোর সেনাগণ’,  কহিল ‘সাবধানে বন্দী কর’ –
এমন শত্রু যে নিখিল-গৌরব দেখিনি এ জীবনে এমনতর |’
কেহই পারিল না তাদের বাঁধিবারে লাগিল গুলি শেষে দেহের মাঝ,
কর্ম্মদেবী আর কর্ণ-কমলার ঢলিল পাহাড়েতে জীবন-সাঁঝ |

সৈন্যদল নিয়ে পুত্ত সেথা আসি, হেরিল এ’জগতে কেহই নাই,
আসিল ক্ষীণ স্বর মায়ের কাছ হতে ‘পুত্র ভাবিওনা আমরা যাই,---
যুদ্ধ কর তুমি, শত্রু বধ’ তুমি, চলেছি মোরা আজি অচিন দেশ,
রক্ষ, বীর তুমি মেবার-জননীরে না পার, মৃত্যুতে মিশিও শেষ |
পলকে ছিঁড়ে গেল জীবন-বীণা তার যা ছিল মরতের শান্তি-সুখ |
ছেলের কাছ থেকে মাতাকে কেড়ে নিল নিঠুর শঠ কাল সর্ব্বভুক |
প্রিয়ার মুখপানে চাহিল মহাবীর হেরিল আঁকা সেথা সজল হিম,
কাঁদিল, কোথা প্রিয়া আমার প্রিয়তমা, মা-বোন বিনা হিয়া তিক্ত নিম  |
বাঁধন-হারা হয়ে পুত্ত ঝাঁপ দিল কতই অগণন সেনার’ পর ;
জীবন উপহাস মৃত্যুকামী সে যে তাহার ঘর নাই কিসের ডর !
ক্লান্ত রণে বীর-দেহের ক্ষত হ’তে পড়িল অবিরল লালিম খুন,
থামিল লাল ধারা, প্রবাহ থেমে গেল, জগৎ গেয়ে গেল ‘পুত্তগুণ’  |

প্রধান সেনাপতি মিস্ত্রী সনে লাগি কাতরে সারে ভাঙা দূর্গ-চূড়,
মেবার-মহিমার মশাল হাতে জ্বালা গাহিছে জয়মল নবীন সুর,
এমন সময়তে অদূরে উঁচু হতে মারিল আকবর চোরাই মার,
নিমেষে ডুবে গেল নবীন ভাস্কর দীপ্তি ফুটিল না মেবারে আর |
দূর্গ জুড়ে ছায় কাঁদন হায় হায়, কোথায় গেলে বীর-- দেশের বল ?
মেবার মুছে তার নীরব আঁখিধার, নাই যে জয়মল আশার স্থল |
গুপ্ত ঘাতকের গুলির ঘায়ে ঘায়ে শহীদ্ চলে গেল মরণপুর---
আক্ বর-সাহ মোগল বাদ্ সার জীবনে এ’ কালিমা হ’ল না দূর |
আপন মন-গড়া নীতিতে আবরিয়া স্থাপিয়া মর্ম্মর-মূর্ত্তিদ্বয়
দিল্লী-দরবার-সমুখে ‘আকবর লিখিল’ জয়মল-পুত্তজয়,

উঠিল দাউ-দাউ জহর দাবানল চিতার সে আগুনে পুড়িল সব |
মোগলসেনা-দল অপর দিকে তোলে তুর্কীসম্রাট-স্তুতির রব ||

.                    **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
চৈতক-চবুতর          
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
[ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]


.     ১৬৩২ সংবত ( ১৫৭৭ খ্রীষ্টাব্দে ) হল্ দিঘাটের যুদ্ধ হয় | রণশ্রমে ক্লান্ত প্রতাপসিংহকে পৃষ্ঠে
লইয়া তাঁহার প্রাণরক্ষার্থ পরম প্রভুভক্ত অশ্ব চৈতক পর্ব্বত-প্রদেশের দিকে ধাবিত হইল |  বীরত্বের
মহিমা পশু চৈতককে কতখানি আকৃষ্ট করিয়াছিল এবং এই রাজপুতবীরধর্ম্ম সে কি ভাবে গ্রহণ
করিয়া আত্মত্যাগ করিতে পারিয়াছিলেন এবং সেইস্থলে কি করিয়া প্রতাপ ও শক্তের মিলন হইল,
সেই কাহিনী নীচের কথা-কবিতাতে বর্ণিত হইয়াছে |

                              
.                                  হল্ দিঘাটের পরে-----
বীর প্রতাপের বীর্য্য হেরিয়া শক্তে’র আঁখি ঝরে |
সেলিমে’র পাশে ভাবিছে কেবল ---- সেকি প্রতাপের ভাই  ?
দেশ-বিদ্রোহী তুর্কীর দাস --- কোথায় তাহার ঠাঁই ?
অন্তরে তার জ্বলিল আগুন প্রতাপের হেরি রণ---
তুর্কীর পাশ ছিঁড়িতে এবার ‘শক্ত’ করিল মন |
যখন প্রতাপে বাঁধিতে ছুটিল খোরাসানী মুলতানী ---
পিছনে তাদের ছুটিল শক্ত মুছিতে আপন গ্লানি !
ভাবিল সেলিম্ হয়ত শক্ত প্রতাপে বধিয়া আজ---
কাঁচা খুন মাখি সে শিরে ধরিবে নবীন রাণার তাজ |

সওয়ার দু’জন রাণার পিছনে বেগে চলিয়াছে ছুটি---
ন.নে তাদের প্রতিহিংসার বহ্নি উঠিছে ফুটি’ |
.                                    পিছনে শক্ত বীর----
রণ-দুর্ম্মদ খুনের নেশায় কাটিল দোঁহার শির |
হইল শক্তখোরাসানী আর মুল্ তানী-আগ্ গল,---
হৃদয়ে লভিল অসীম শক্তি---- বাহুতে নবীন বল |

.                                   রক্ষি’ রাণার প্রাণ ----
গাহিল শক্ত একলিঙ্গ ও বাপ্পার জয়গান |
অবশেষে বীর অশ্ব ছুটায়ে চলিল নদীর পারে---
‘হো নীল্ ঘোড়েকী সোয়ার’ বলিয়া ঘন ঘন চীত্কারে |
অদূরে হেরিল ক্রন্দনরত প্রতাপ পড়িয়া ভূমে,
মরণ-পথের যাত্রী তাহার  প্রিয় চৈতকে চুমে ----

.                                  আর কহে বার বার---
কোথায় চলিলে জীবনের সাথী---- বহে তার চোখে ধার |
প্রতাপের হেন ব্যথা-ক্রন্দন বাজে শক্তের বুকে--
শেষে সে দাঁড়ায় প্রতাপের পাশে মৌন-নীরব মুখে |

.                                 কহিল প্রতাপ এ কি---
আসিয়াছ মোরে বধিতে শক্ত’ এ মহা সুযোগ দেখি’ ?
নাও ভাই প্রাণ শিরোপা পাইবে, বাদ্ শাও এই-চায়--
ভায়ের রক্তে মিটে যদি তৃষা মোর খেদ নাহি তায় !

.                                  শক্ত ফুকারি’ ওঠে---
নয়নে তাহার বীর মহিমার অশ্রুর মেঘ ফোটে |
যোড়পাণি করি’ কহে সে প্রতাপে, প্রাম নিতে আসি নাই---
চরণে তোমার আজিকে নিজেকে সঁপিতে এসেছি ভাই !
যা কিছু ভায়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষম’ দাদা স্নেহ দিয়া----’
প্রতাপ উঠিয়া বাঁধিল শক্তে দুহাতে আলিঙ্গিয়া |
লুটায়ে শক্ত প্রতাপের পায়ে, কহিল, ‘চরণে র’বো
অনুজেরে আর ঠেলিওনা দূরে চরণের ধূলা লবো |’

.                                 বীর-হৃদয়ের টানে ---
বীর ভাই আজ বীরেরে বাঁধিল অভিমান অবসানে  |
উপরে পাহাড় নিন্মে তটিনী বহি যায় তর তর,
এরি মাঝে দু-হুঁ  ভাই-তে বাঁধিল চৈতক্-চবুতর |*

*মহারাণা প্রতাপসিংহের প্রাণপ্রিয় বিখ্যাত নীল-অশ্ব চৈতকের
স্মৃতি-বেদী |

.                    **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
রাঙা রাখী
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
( কবিতাটি কবির শ্যালকের কন্যা পারুলের শুভবিবাহের অনুষ্ঠান উপলক্ষে লেখা। লিখেছিলেন
২০শে ফাল্গুন ১৩৪৮ তারিখে, সোনামুখী। )

রাঙা রাখীর সোনার পরশ
.        কে ছোঁয়ালো কিশোর মনে---
সেই ছোঁয়াতে জাগল পুলক
.        মন-বনানী সঙ্গোপনে।

শ্যাম সাগরের পুলক দোলায়
.        মিলন-মায়া ভূবন দোলায়
সন্ধ্যা জ্বালে আরতি দীপ
.        প্রাণ-মিলনের এই লগনে---
বিভুর আশীস পড়ুক ঝরে
.        আজ তোমাদের চলার ক্ষণে (খনে)।

.       
  **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর