কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
*
ঔরঙ্গজীব ও রাজসিংহ  (গাথা)
কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায়
বিরূডিহা, ১৯শে জৈষ্ঠ্য ১৩৩৪


গোঁড়া বাদ্ সাহ ঔরঙ্গজীব্ ভাবিতেছে বসি আপন মনে,
রণ-কৌশল যশবন্তের বীর বিক্রম,--   তাহার মনে,---
হিন্দুর-যশ বিঁধিছে বক্ষে, সেনাপতি তার হোক্ না কেন ?
হিন্দুর প্রতি হিংসা ও দ্বেষে অন্ধ বাদ্ সা ভাবিছে যেন --
দিল্লীর ঐ হেম-মস্ নদ্ খানি ও’ পারে লইতে জিনে ?
অন্ধ কূটীল দৃষ্টি তাহার সন্দেহে চলে মানুষ চিনে |
তাইতে যেথায় রণের নেশায় বিদ্রোহ-বিষে আগুন জ্বলে
কোশলী বাদ্ শা তাদের দমনে মরণ বরিতে নানান ছলে,
যশোবন্ত্ সিং’এ যুদ্ধে পাঠায়ে খোদার সকাশে মরণ যাচে
চলে গেলে বীর ভাবে মনে মনে এ রণে মরণ হয়না পাছে ---
অবশেষে যবে “আফগান দেশ” অন্তর্দ্রোহে উঠিল মাতি
পাঠাল বাদশা সেথা “যশোবীরে” নিল সে আদেশ শির্ষ পাতি |
মন্ত্রণা করি বাদশা তাহার নীলবিষে পথে পরাণ নিল
বাদশার লাগি উদার হিন্দু অম্লানে প্রাণ সমর্পিল |
প্রসবিল রাণী কাবুলের বুকে সুকুমার এক নবীন ছেলে,
যশোবন্তের কূলের প্রদীপ দেখিল জননী নয়ন মেলে |
হয়তো ব্যথায় কাঁদিল হৃদয় হয়ত ঝরিল অশ্রুকণা,
দয়িতের লাগি প্রিয়ার প্রাণের কি ব্যথা বুঝুল সে এক জনা ?
পাষাণেতে রাণী বক্ষ বাঁধিয়া কহিল ভৃত্য দুর্গাদাসে,
নিয়ে চল্ তোর মায়েরে বত্স যেথায় “পৃথ্বী” দিল্লীবাসে |
কত দুর্গম পথ ভাঙি শেষে প্রবেশিল মাতা দিল্লীপুরী,
হেরিল সেথায় শ্মশান জ্বেলেছে ক্রুর বাদশার শাপিত ছুরি |
বুকের মানিক প্রাণাধিক রাণী বইবে কোথায় সহাস-চুমে ?
তা না হায় মাতা গুপ্ত ছুরিতে হেরিল কুমার ক্লান্ত ঘুমে |


এমন সময় শিহরিল রাণী হেরি বাদশার “হুকুমনামা”,
কুমার অজিতে চাহে সে এখনো “মা”রে ধরি শিশু কাঁদিল আঁ-মা!
দুর্গা দাসেরে কহিতেছে রাণী পারিবনা ছেলে সমর্পিতে
তার বিনিময়ে ইচ্ছা করে সে পারিবে আমার জীবন নিতে,---
রাক্ষস সবই গ্রাস করিয়াছে শুধুই আমার একটি বাকি ?
শয়তান যদি তাও কেড়ে নেয় কেমনে মা’ হয়ে পরাণ রাখি ?
কঠোর কণ্ঠে কহিল দুর্গা ভয় নাই মাগো রাঠোর আমি !
প্রভুর প্রসাদে কত আনন্দে যপিয়াছি আমি দিবস-যামী ;
রাঠোর কূলের শেষ দীপটুকু নিভে যাবে এক আমিও থেকে,
এ ব্যথা আমার বড় বাজে মাতা বাঁচাব তাহারে জীবন রেখে |
বরং হুকুম দিউন বাদ্ সা’ দেশে লয়ে যাই কুমার, মারে |
জ্বলিয়া উঠিল হীন বাদসাহ আদেশ করিল --- “কতক সেনা
কুমার অজিতে আনহ এখনি যাহাদের তায় রয়েছে চেনা” !
হাতিয়ার হাতে দুর্গা ও রাণী অনুচরদর সঙ্গে নিয়া,
বাপ্পার জয় গাহিয়া ভেদিল অগনন সেনা উল্লাসিয়া ;
নির্বাক সব মোগল সৈন্য ছুটে পাছু পাছু তাদের হেরি,
বীর বিক্রমে দিল্লীর বুকে গালে যারে জয় আনন্দেরি |
রাজসিংহের হস্ত ধরিয়া কহিতেছে রাণী শুনহ রাণা!
অসহায় এক মেবার কুমারী আশ্রয় যাকে করোনা --- না - না ----
কহে মহারাণা সন্তান গেছে থাক মা কুমার অজিতে লয়ে,
তোমাদের লাগি ঝঞ্ঝা আঘাত উপেখিয়া যাব বক্ষে সয়ে!
যতদিন রবে একটা পাথর একখানি ইঁট প্রাসাদ গায়ে,
ততদিন রবে জননী আমার উদয়পুরের দুর্গৃ-ছায়ে!


আশার আলোয় দীপ্ত হইয়া নামিল মহিষী ঊর্দ্ধপানে ---
মাতৃ-মনের গোপন-লিপিকা পড়ি গেল কিনা সেই জানে ?
অবশেষে রাণী জয় জয় কহি শুনাল রাণারে অভয় বাণী,
চলিলাম বাছা মারবার পথে দুর্গারে নিয়া সৈন্য আনি ---
মেবার ভরিয়া আগুন জ্বালাব ক্ষুধা নিয়া মোর বিশ্বগ্রাসী ;
উল্লাস সাথে ছড়াইবে জ্বালা জ্বালাময়ী মোর বিশের বাঁশী ;
পাগল হইবে সে গানে মেবার ছুটিবে এবার আগল ভাঙি,---
নবীন-জীবনে জাগিবে জননী, বক্ষ তাহার জ্বালায়ে রাঙি!
স্তব্ধ হইল শুনি মহারাণা মহিসময়ীর স্বদেশ-কথা,
ভাবিল এই না সোনার মেবার, মেবার কন্যা ভজন রতা ?
একদিন শেষ রণ নির্ঘোষি বাজিল দামামা রণস্থলে ---
মারবার আর মেবার মিলেছে কম নয় কহ সৈন্যবলে ?


সৈন্য চালনা করিতে করিতে ঔরংজীব বাদশা নিজে,
গিরির বর্ত্মে আটক পড়িয়া বুঝিল বাঁধন যাতনা কি যে ?
ক্ষুৎপিপাসায় ক্লান্ত কাতর মোগল বাদশা পাগল মত
ঘৃণা-লজ্জায় দুঃখ-ব্যথায় মস্তক তার নিম্নে নত!
ওদিকে আবার বেগম-উদীরে বন্দী করেছে পাহাড় চালে
“বাদশাহজাদা আকবর” ম্লান পরাজয় আঁকা তাহার ভালে |
আরাবল্লীর ঊষর বক্ষে “বাপ্পার” জয় ভরিয়া উঠে,
ভীম সিং আজ আজিসে হারায় রাণার আননে হাস্য ফুটে |
রণ উল্লাসে ফুল্ল “রাণী মা” সন্তান স্নেহে বক্ষ ভরে
বার বার চুমে দুর্গার শির মায়ের আশিষে নয়ন ঝরে |
মোগল সেনার কাতরোক্তিতে কাঁদিল রাণার হৃদয়খানি
উদার হিন্দু ক্ষমার ধর্ম্মে বাদশা ও সেনা মুক্তি দানি,---
অমর কীর্তি রেখে গেল রাণা মেবার গিরির স্বর্ণ চূড়ে
রাণীজির পাশে কুমার অজিত দুর্গাদাসের নিশান উড়ে |

কালের শিলায় এঁকে গেল রাণা ব্যাধি-জর্জ্জর করুণ ছবি,---
চারণীর গানে অমর হইল তাদের গাথা গায় চারণ-কবি ||

.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
আজি নয়নের নীরে
কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায়
নবশক্তি, ১২শ সংখ্যা, ৪র্থ বর্ষ

আজি নয়ন তীরে ---
পল্লীর গানে আঁখি দুটি মোর খালি চায় ফিরে ফিরে
জৈষ্ঠের দিনে তৃণ যে সেথায় পথে বিলায়েছে মায়া
মাঠের ওপর পড়িয়াছে স্নেহে আষাঢ় মেঘের ছায়া
পল্লীর মেয়ে গাগরি ভরিতে চলেছে দিঘির জলে
অলস চরণে আপনার মনে দু পায় তৃণেরে দলে
লীলাময়ি বধু পাশে চলে তার লাজুক মহিমা নিয়া
ছড়ায়ে সহজ লীলার মাধুরী পল্লীর পথ দিয়া
কভু চলে ধীরে দেহ লতাটিরে সলাজ বসনে ঢাকি
আবার কখনও থমকি দাঁড়ায়ে চায় মেলি দুই আঁখি
দূরের পথিকে দেখিয়া ভাবে সে আসিয়াছে বুঝি প্রিয়
বাতাসে উড়িছে ঐ না তাহার শুভ্র উত্তরীয়
তারপর হায় ভরে হতাশায় তাহার বুকের আশা
যখন হিরি সে নিকটে পথিক মিছে হোল ভালবাসা
অলস কিশোরী কলস ভরিয়া সখি সাখে ফিরে ঘরে
জানি না ভাই ওর কি তখন নয়নে বাদল ঝরে
মনে হয় ওর আঁখিজল খালি জানে প্রিয় পরিচয়
কচি বুকে তাই করিবে সে ওর প্রিয়তমে অক্ষয়
উহার অশ্রুসনে ---
মোর মন যেন ফিরে চলে যায় গ্রামের কুঞ্জ বনে ||

.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
ছন্নছাড়া
কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায়

পাহাড়ের বুক চিরি
.        কত দেশ বাহি ওই
শ্রোতধারা চলে বহিয়া |
বিধুরের তপ্ত বুকে ---
.        দু’ফোঁটা অশ্রুর কণা,
সুখে দুখে গিয়াছে সহিয়া |

.                আকাশের মৌন নীলিমাটি,
.                        উঠিয়াছে ফুটি ---
.                দিগন্তের অন্তহীন দেশে
.                কে তুমি গো কূলবালা ?
.                        নিরালায় আলা করি ---
.                আনমনা বিমোহিনী বেশে ?

কোন সে সুদূরে থাকি,
.        বিধুরের মধু সুখে ---
আঁকি দাও চুমা তৃপ্তিহীন ?
কল্পনার দেশে তব ;
.        অভিনব রূপ ধরি
হও বালা অভিসার লীন |

.                না ‘জানি সে কত নদী বেয়ে,
.                        কত না সগর ছেয়ে ---
.                জেগে রয় দুটি তব আঁখি |
.                বনানীর সীমান্ত প্রদেশে,
.                        এলাইয়া কেশ ;
.                ক্লান্তি আনো প্রিয়তমে ডাকি |

বিরহী চপল-পাখী ডাকিতেছে,
.        ‘বউ কথা কও‘ ---
বিনিময়ে লহ মোর প্রাণ ?
স্বচ্ছতা মাখানো সাঁঝে,
.        বাজিতেছে ব্যথা ---
ঝরে যেন সাজা’ন বাগান |

.                ফেণীল জলধী বক্ষ পরে,
.                        ভাসে থরে থরে
.                যেন কার তপ্ত আঁখিজল |
.                ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী জলে
.                        ভাসে ব্যথাগান্ ;
.                মন হয় বেদন বিহ্বল |

ওই সুরে মিলাইয়া সুর ---
.        বিধুরের বাঁশী,
গাহি ওঠে বেহাগ-বেদন |
ব্যথাময় ব্যর্থতায় ভরি,
.        বিরহিণী স্মরি ---
উঃ হুঃ ’করে নীরবে রোদন |

.                হায় ছন্নছাড়া কবে তোর,
.                        চলা হবে শেষ ?
.                বাঁধিবি সে চপল প্রিয়ায় ?
.                মিলন-বেলায় হবি ভোর ---
.                        ধন্য হবে তোর, ---
.                প্রাণখানি পুতঃস্নানে প্রাণের মেলায় ||

.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
পল্লীবালা
কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায়
বিরূডিহা, বৈশাখ ১৩৩৬, “উপাসনা” পত্রিকায় প্রকাশিত


বৈশাখের খররৌদ্রে পল্লীপথে ভাসে মোর মন
অবিশ্রান্ত ঝিল্লীরবে পূর্ণ জাম আম্রের কানন
বাখান ধূলায় যেথা বিলানো, প্রফুল্ল আনন
.                        আমি চাই সেথা যেতে ফিরে ---

যেথায় হাসিছে আজো অনাদৃতা শ্যাম সরোবর
প্রাণের বধূর লাগি | যেথা ফোটে পদ্ম মনোহর ---
জলের কলসী লয়ে যেথা বধূ জলে বাঁধে ঘর
.                        রচি মায়া সন্ধ্যা তিমিরে

হেরি আজ ফুটে ওঠে আমার মানস আঁখির আগে
বিমলিনা পল্লী মেয়ে | হয়তো সে মোর কাছে মাগে
স্নেহের সান্ত্বনা বাণী! হৃদয়ে বিক্ষোভ জাগে ---
.                        কই তারে ওরে মোর মেয়ে

তোরে আমি বাসি ভালো বল মোরে হইয়া আমার
কিসের বেদনা তোর ? বল মোরে কেন হাহাকার ?
তাহার আঁখির বাঁধ ভাঙি বহে যমুনার ধার
.                        বালিকা রহিল মুখ চেয়ে

গ্রামের মমতা জাগে বালিকার উষ্ণ আঁখি জলে
বেদনা গুমরি ফিরে হুতাশিয়া মোর মর্ম্ম তলে
কভু বা চোখের পাতা ভিজায়ে কে যেন মোহে বলে
.                        পাই নাই স্নেহ ভালবাসা

ওর সাথে এ বিশ্বের মূর্ত্ত যত বেদনার ছবি
ফুটে ওঠে মোর মনে | নিখিলের নিরাশ্রয় কবি
মোর কণ্ঠে গেয়ে ওঠে গান! হোথা কি ওঠে না রবি ?
.                        যেন নাহি আলো ভালোবাসা |

কণ্ঠে তার দোলে হেরি এ বিশ্বের বেদনার মালা
ওর দুঃখে বক্ষে মোর পল্লীঘেরা যত দুঃখ জ্বালা
হেরি আজ বাঁধিয়াছে নীড়! ফুটে আজ পল্লীবালা
.                        মানবের মনের আলোকে

হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেদনার করুণ গাথায়
গ্রামের মমতা ঝরে | শিশিরের সজল মায়ায়
বালিকা রহিল আঁকা | বৈশাখীর প্রশান্ত সন্ধ্যায়
.                        ম্রিয়মান গোধূলি আলোকে |

.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
সোনার পল্লী মেয়ে
কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায়
ভাদ্র, ১৩৩৪, “উপাসনা” পত্রিকায় প্রকাশিত


সোনার পল্লী মেয়ে ---
সজল নয়নে কাহার আশায় পথ পানে রও চেয়ে ?
সে জানে কী তব মৌনী নীরব দুই চাহনির ভাষা ---
পাইয়াছে সে কি তোমার বুকের এতটুকু ভালবাসা ?
অন্তরে তব অমিয় মাখানো যে প্রেম লুকানো আছে ---
সে জানে কী শত অমরার মধু তুচ্ছ তাহার কাছে ?
নগরীর দূর কোলাহলে ফিরে সখা তোমায় ভুলে যায়,
দয়িতের কাছে শুধু অবহেলা তাই কাঁদো বেদনায় ?
সুরার পরশে যে ভুলিয়া গেল প্রেয়সীর সন্ধান ---
বিলাসিনীদের রূপের পঙ্কে যে ডুবি গাহিল গান,
আজিও তাহার মঙ্গল লাগি নিতি সাঁঝে বেদীতলে
গলায় আঁচল বেড়িয়া বালিকা তুমি কাঁদ আঁখিজলে |
কত লাঞ্ছনা বুকে সয়ে যাও মূলে সরেনাক বাণী ---
সর্ব্বংসহা ধরণী মায়ের তুমি যে দুলারী রাণী,
বালিকার বেশে ভূবন ভোলাতে হে মোর পল্লীবালা ?
কিশোর পারায়ে যৌবনে কর নিখিল নয়ন আলা ;
রূপে গুণে তুমিসুন্দরী বধূ বক্ষে কত না মধু ---
পল্লী কুটীরে সন্ধ্যা জালাও নিয়ত পল্লী বধূ |
পল্লী পথের ধারে ---
কাহার আশায় আঁখিজল তুমি ফেলিতেছ বারে বারে ?

.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর