রূপনগরওয়ালী কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায় [ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]
“ঔরঙ্গজেব যখন দিল্লীর সিংহাসনে অধিরোহণ করেন, স্বরূপনগরের সামন্ত-রাজ্যে সেই সময় একটি পরমা সুন্দরী রাজকুমারী নবযৌবনের লাবণ্যের সহিত দিন দিন পরিপুষ্ট হইতেছিলেন | সেই রূপবতী কুমারীর নাম প্রভাবতী, ইঁহারই জীবন-কাহিনী নীচের কবিতাটিতে বিবৃত হইয়াছে |” . ---- রাজস্থান, ১৩৪ পৃঃ
রূপনগরের কুমারী প্রভার দেশজোড়া শুনি রূপের কথা, ঔরংজীব সাহান্ শাহের --- মর্ম্মে পশেছে চঞ্চলতা | সেনাদলে তাই পাঠায় বাদ্ শা রূপনগরের রাণার পাশে ; ‘কন্যারে তব বেগম করিব’ লিখিয়া লিপিকা সুখোচ্ছ্বাসে | ছোটরাজা হায় রাণা শোলাঙ্কি ক্ষুদ্র তাহার শক্তি কত ? মোগল-বাহিনী নেহারি’ অদূরে মস্তক হ’ল আপনি নত ! রাজকুমারীর মনখানি ছিল রাজপুত-তেজ-দীপ্ত-ভরা--- বেগম হওয়ার লজ্জার চেয়ে মরণে সে হয় স্বয়ম্বরা | রাণার সকাশে নতজানু হয়ে কহে প্রভাবতী--- নিদয় পিতা কোন্ প্রাণে আজ পিতা হয়ে তুমি জ্বালাবে মেয়ের জীবন চিতা ! তার বিনিময়ে ঘাতকে ডাকিয়া আমার জীবন ধন্য কর’ | মোগলের করে হেলায় ফেলিয়া শাস্তি দিওনা এমনতর ! যদি তা-ও দাও দিল্লীর পথে জহরে মেটাবো মরণ-ক্ষুধা--- আমার জীবন মথিয়া সে মোরে পিয়াবে মরণে জীবন-সুধা!
কহে শোলাঙ্কি --- কি করিব প্রভা, সুখ নাই বুকে শুধুই গ্লানি! তবু যদি দেশ শান্তিতে থাকে, অপমানে তাই কন্যা দানি | জল-ভরা চোখ রুখেছি ব্যথায় বক্ষে চেপেছি দহন-জ্বালা-- তুই যে মা মোর নয়নের মণি--- ফণি-মনসার বেদন-মালা! অপঘাতে পথে পরাণ ত্যজিলে রূপনগরের এড়ান্ নাহি | বাদ্ শা এদেশ করিবে শ্মশান, সম্মতি দে মা দেশকে চাহি ! কহিল কুমারী আঁখিজলে ভাসি--- তাই হোক বাবা ইচ্ছা তব, অপমানে মোর ভূষণ করিয়া ঝঞ্ঝা-আঘাত নীরবে স’ব |
শেষে নিরজনে লিখিল গোপনে ---- দোহাই তোমার মেবার রাণা জানিনাকো তোমা কখন সঁপেছি --- নেবে আজি কিগো হৃদয়-খানা ? রক্ষ’ হে বীর সতীর ধর্ম্ম, স্বেচ্ছাচার যে মরম দলে ! হীনতা কি বড় হইবে জীবনে, ব্যথার মালা যে পরায় গলে ?---- দিল পুরোহিত রাণার হস্তে রূপকুমারীর পত্রলেখা, রণ-উল্লাসে নাচিল রাণার হিয়ার পরতে রূপের রেখা ! শেষে একদিন দিল্লীর বুকে হল এক খুনের খেলা, বাদ্ সাহী-সেনা হঠিল পিছনে হেরি মেবারের প্রাণের মেলা ! সেনাদল নিয়া বাদ্ শাহ পুনঃ আসিল মেবার ধ্বংসিবারে--- যতবার এল পরজয়-লাজে মুখ লুকাইল বারংবারে |
রূপকুমারী সে বিজয়িনী হোল শেষে অতুলন প্রেমোদ্দামে ---- বিলাল’ অমন অনুপম রূপ-মাধুরী বিজয়ী রাণার নামে |