কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
*
মান্নার কথা
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
[ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]

হল্ দিঘাট!  “অবিলম্বে ভৈরবনাদে রণস্থলী প্রতিধ্বনিত করিয়া ঝালাপতি মান্না উল্লম্ফনপূর্ব্বক
সদলে  ব্যুহমধ্যে প্রতাপের নিকটবর্ত্তী হইলেন | অবিলম্বে রাণার মস্তক হইতে রাজচ্ছত্র লইয়া
আপনার মস্তকো-পরি তুলিয়া দিলেন--- লোহিত বৈজয়ন্তী উদ্যত করিয়া তত্ক্ষণাৎ শত্রুসেনার
সম্মুখবর্ত্তী হইলেন | রাজচিহ্ন দেখিয়া শত্রুগণ তাঁহাকে রাণা বলিয়া মনে করিল | তাঁহাকেই সংহার
করিবার অভিপ্রায়ে তদভিমুখে প্রধাবিত হইল |  বীরবর মান্না অদ্ভুত বীরত্ব প্রদর্শন করিয়া,  
শতশত যবনবীর ধরাপাত করিয়া সদলে জীবন বিসর্জ্জনপূর্ব্বক রাণা প্রতাপসিংহের প্রাণ রক্ষা
করিলেন |”---
.                                                                                    রাজস্থান, ৯৫ পৃঃ

রক্ত-হোরীর লাল্ খুনে লাল এক্ লা প্রতাপ হলদিঘাটে
মরণ-নেশায় মত্ত পাগল মোগল রণের  জীবন-নাটে  |
সব গেছে আর নেইকো কিছুই শুধুই বীরের ছিন্ন দেহ,
থই-থই করে রক্ত পাথার ডাকিল প্রতাপ, ‘আছ কি কেহ ?’
করুণকন্ঠে আহতের দল কহিল “ রাণাজি, আমরা আছি --
মেবারের দুখে বুক ফেটে যায়, আশিষ কর গো মলেই বাঁচি |  
ব্যথিয়া উঠিল প্রতাপের হিয়া কহিল --- ‘হায়রে ভাগ্য হত ?  
মেবারে তোরা জীবন-প্রসূন উঠেছিলি ফুটে কুসুম মত,
অকালে লেগেছে তোদের জীবনে অকাল-ঝোরার পাগলা হাওয়া---
যা-রে ঝরে’ সব মাণিক আমার মরা এ-যে নয় মুক্তি পাওয়া ?
শ্বাশত নয় চিরদিন কেহ যায়ত মেবার যাক্ না চ’লে ----
বীর-মহিমার একটা পাতায় লিখে যারে তোরা মরম দলে |
জগতের ইতি-কথার ভেতর জগৎ তোদের দেখ্ তে পাবে ----
লুপ্ত দেশের হারানো মহিমা জাগিয়ে আবার তরুণ গা’বে |
পড়িয়া চলেছে প্রতাপসিংহ ব্যথিত বুকের মর্ম্মখাতা----
এ-হেন সময়ে ঝালা সর্দ্দার মান্না কাড়িয়া রাণার ছাতা,
আহত রাণাকে বাঁচাবার তরে সাজি’ ঝালা বীর নকল-রাণা ---
রাণার সকাশে মাগিল ভিক্ষা, ‘আমার মরণে করোনা মানা !
মেবারের বল, মেবারের আশা --- রহিবে শুধুই তোমার সনে,
দেশের জন্য মাগিছে মান্না তোমার জীবন মরণ-খনে---
যাও যাও মোর মেবারের রাজা দুর্গম গিরি-গুহার তলে----
আরাবল্লীর ঊষর বক্ষে সৈন্য লভিয়া ---- বাহুর বলে,
আবার জিনিবে সোনার মেবার আবার হাসিবে ফুল্ল হাসি
বিফল হবেনা মান্নার কথা অধীন রবেনা মেবার বাসী  |
একলিঙ্গের মহিমায় ভরা কতনা বীরের জনম-ভূমি,
ধন্য হইল গোরা ও বাদল সমর ইহার চরণ চুমি---
দীপ্ত মান্না নমিয়া প্রতাপে হুঙ্কার দিল মোগল ‘পরে----
অগণন সব মোগল সৈন্য বিঁধিল বীরকে লক্ষ্য ক’রে |-----
অবশেষে বীর অমর-শয়ানে আহত হইয়া পড়িল লুটি’---
মুক্তি-পথের অমর-রাহীর আননে উঠিল কান্তি ফুটি |’
আরাবল্লীতে ঘোষিত প্রতাপ ব্যথিত বীরের মর্ম্ম ক্ষত---
নির্ব্বাক হয়ে শুনি ভীল-দল কহিল, ‘সৈন্য আমরা যত’
আবার প্রতাপ জিনিল সমর, আবার হাসিল ফুল্লহাসি
বিফল হ’লনা মান্নার কথা---- অধীন রবেনা মেবারবাসি |

.                   **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
এক টুকরো রুটি
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
[ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]
                                                 
একদিন রাণার মহিষী ও পুত্রবধূ তৃণবীজ-চূর্ণে কয়েকখানি পিষ্টক প্রস্তুত করিয়া অর্দ্ধেক বালক-
বালিকাদিগকে বন্টন করিয়া দিয়া অবশিষ্ট ভবিষ্যতের জন্য রাখিয়া দিলেন | বালক-বালিকারা
আহার করিতেছে, পার্শ্বে অতিদূরে তৃণশয্যায় শয়ান হইয়া রাণা প্রতাপ আপনার দুর্ভাগ্যের বিষয়
চিন্তা করিতে-ছেন, সহসা তাঁহার কন্যার মর্ম্মভেদী আর্ত্তনাদ কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল |  চমকিত
হইয়া রাণা বালিকার দিকে নেত্রপাত করিবামাত্র দেখিলেন, একটি বনবিড়াল পিষ্টকার্দ্ধ হরণ করিয়া
প্রস্থান  করিতেছে |-----                                                               রাজস্থান ;   
.                                               ইহার পরের ঘটনা এই কবিতায় লিপিবদ্ধ হইয়াছে
|


কাঁদিয়া উঠিল অবোধ পাঁচ বছরের মেয়ে---
‘বাবা গো কি খাব, কিছু আর নেই’ চোখে জল পড়ে বেয়ে |
‘কাঁদছিস কেন মা আমার ‘হেমা’ কেন আঁখি ছল-ছল’
কহিল প্রতাপ, ‘ আমি তোর বাপ, কি মোরে হয়েছে বল ?’
রাজার ঝিয়ারি উঠিল ফুকারি’ লাল হল গাল কেঁদে,---
‘ঘাসের রুটিটি বেড়ালে নিয়েছে, আনো বাবা তারে বেঁধে’ |
ছেড়ে দিয়ে হাল ঠুকিয়া কপাল কহিলেন মহারাণা,
‘ শান্তির কোলে নাও ওগো প্রিয় ব্যথিতের প্রাণ-খানা |
চমকি’ চাহিয়া দেখেন প্রতাপ, আন্ মনে কাঁদে প্রিয়া,
হাসি-মাখা মুখ হতাশ-মলিন ব্যথার আকুল হিয়া ;
ধৈর্য্যের বাঁধে ধরেছে ভাঙন করিবে কে তার রোধ,
লিখি কি, না লিখি ভাবিছেন রাণা জাগিছে আত্ম-বোধ |
চঞ্চল মন,  নেই কিছু ঠিক,  করিলেন শেষ স্থির,
মনের বেদনা জানা’বেন রাণা নোয়ারে ‘মোগলে’ শির---
ক্ষুৎ-পিপাসায় যার মেয়ে কাঁদে, হায় কোথা তার মান ?
যাক্ মান ডুবে অতল পাথারে যায় যাক্ যদি প্রাণ ;

রাণার আদেশে আনিল বাহক কাগজ কলম কালি,
লেখনী-হস্তে নীলাকাশপানে চাহিছেন রাণা খালি  |
লিখিলেন শেষে সাহ্-আকবরে ‘ছেলেদের দিও খেতে ;
ডাকে মোর শ্যাম বনানীর ছায়া স্নেহের আঁচল পেতে,
রাজার-প্রাসাদ চাহি না আমার, চাহি না সিংহাসন---
প্রতাপের কাছে তৃণের শয্যা বড় আদরের ধন  |’
রুদ্ধ-কন্ঠে বৃদ্ধ-মন্ত্রী ভাম্-সাহ্ কহে, ‘রাণা,
মেবারের ভালে এই ছিল লেখা কুমারী পায়না দানা !
‘মহারাণা’ বলি করোনা’ক আর মেবারের অপমান |
কহিছেন রাণা, ভিক্ষুক হয়ে চেয়েছি দয়ার দান,
‘রাণা’ -কথা মোর বড় বাজে বুকে মনে হয় উপহাস,
জননীর পদ-পূজা বিনিময়ে হেনেছি সর্ব্বনাশ |
সিংহের মত পাহাড়ের বুকে কাঁপিলেন তেজে বীর
লক্ষ বেদনা বিঁধিছে বক্ষে শিহরিছে তাঁর শির----
ক্ষণ-পরে মনে ভাসিয়া উঠিল একটু করুণ মুখ ---
রুদ্ধ ব্যথায় হাহাকারে তাঁর কাঁপিয়া উঠিল বুক ;
বিছুটির মত হানিছে চাবুক নয়নে জ্বলিছে জ্বালা,
বিদ্রোহী-বীর ভাবেন লিপিকা নিভালো মেবার-আলা |

বন্দিল “ভীল” লিপিকা লইয়া রাণার চরণ-দুটি
ঝিল্লী-মুখর প্রখর রৌদ্রে চলিল দিল্লী ছুটি |
সভা-মাঝে বসি সাহ্ আক্ বর আলোকি সিংহাসন,
‘বীরবল’ সবে ছল করি’ তাঁর করিছে ফুল্ল মন ;
এ হেন সময়ে লিপিকা হস্তে কুর্ণিশ করে ভীল,
‘মোগল-বাদ্ সা’ পড়েন বার বার বরে না কিছুতে দিল |
দিল্লীশ্বর আপনার পাশে আঁকিছে মোহন-ছবি ---
কৃপায় ভিখারী মেবারের রাণা তাঁহার অঙ্ক লভি’ |
বাদসাহ-মুখে প্রতাপের কথা শুনিল পৃথ্বীরাজ,
ভাবিল, এখনো নিখিলের পতি হাসিছে পৃথ্বী-মাঝ,--
রাজপুত কবি প্রতাপসিংহে ভরিয়া অগ্নি-বাণী
লিখিলেন, ‘বীর তোমার লাগিয়া ধন্য মেবার-রাণী,
মানের বাজেরে সকল রাজারে রেখেছে বাদ্ সা কিনে,
শুধুই প্রতাপ মেবারের মান একলা রেখেছে চিনে ;
কালের প্রভাবে হিমালয়-শির হয় যদি শেষ লয়--
চিতানল জ্বালি’ বাপ্পার নামে জীবন করিও ক্ষয় |’
কবি-লিপি নিয়া চলিয়াছে দূত আরাবলী-পথ বাহি’—
মেবারের ভূত-গরিমার পানে অনিমিখ্ যায় চাহি’,
রাণার চরণ বন্দিল শেষে কত চলি’ গিরি-পথ,
সার্থকতার সফল গরবে পুরিয়াছে মনোরথ |

পড়িয়া লিপিকা মেবার-গরিমা উজলে রাণার বুকে,
‘জানায়ো কবিরে’, কহিলেন দূতে, ‘প্রতাপ রহিবে ভূখে |’
বীর সন্ন্যাসী হ’ল প্রদীপ্ত নমিল জন্ম-ভূমি |
‘কবি-পৃথ্বীরে’  ধন্য মানিল ‘মেবার’- চরণ চুমি’ |

.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
কৃষাণ-বালা
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
[ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]
                                              
আরাবলী আর শিরোনাল ঘিরে কৈলবারা---
গায়ে গায়ে মিশে শৈলের শ্রেণী বাঁধন-হারা !
.                   মেবারের ভূত মহিমা-দীপ,
.                   এদের ললাটে এঁকেছে টীপ----
.                   ফুটি’ পাহাড়িয়া সোনার নীপ ;
.                                         অফুট ভাষা----
ছড়ায় হাওয়ার রন্ধ্রে কতই নবীন আশা !
.                             সকলি মৌনানন্দে সারা----
আরাবলী আর শিরোনাল-ঘেরা কৈলবারা |

মৃগয়ায় আজি মেবার কুমার ‘অঁদব’ বনে,
চলিয়াছে কত অনুচর নিয়া ফুল্ল মনে |
.                    শেষে অরি সিং বনের পাশে,
.                    ছুটিয়া চলেছে শিকার-আশে
.                    বন-পশু সব ঊর্দ্ধশ্বাসে
.                                     যেতেছে ছুটি’—
আঘাতে কারো বা দেহের বাঁধন যেতেছে টুটি’ |
.                     দীপ্ত কুমার তাদের সনে----
তীরের মতই চলেছে ছুটিয়া ‘অঁদব’ বনে |

অনুসরে বেগে একটি শূকর শ্যামল ক্ষেতে
যেখানে ভুট্টা-গোধূমের মাটি আঁচল পেতে,
.                     কৃষাণ-কন্যা আছিল সেথায়
.                     কহিয়া উঠিল,--- আহা ! হায় হায়---
.                     সবুজ শস্য দলিও না পায় ;
.                                   দাঁড়াও রাজা !
ঘোড়া চড়ে’ তুমি গরীবের বুকে দিও না সাজা |
.                      যেও না মত্ত মৃগয়া মেতে
শূকরে বধিব, দাও না আমায় একলা যেতে |

কুতূহলী সবে--- বধিবে শূকর কৃষাণ-বালা !
কেহ কহে, ওর রূপ বটে ভাই ভুবন আলা--
.                       গাঁথিল বালিকা আঁখির পলকে,
.                       শূকরে তীক্ষ্ণ বর্ষা-ফলকে ;
.                       স্কন্ধেতে নিয়া বিজুলী ঝলকে ;
.                                            স্থাপিয়া ভূমে,
নাও রাজা--- বলি অরি-কুমারের চরণ চুমে |
.                        হইল নয়নে নয়ন আলা----
কহিল কুমার, --- প্রেয়সী আমার তুমিই বালা |

.               **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
বায়োজীদ্-বোস্ত্তমী
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
[ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]
                                           
আকাশের গায়ে গায়ে মিশিয়াছে অসীম নীলিমা---
প্রশান্ত ধ্যানীর মত |  প্রশান্তির প্রগাঢ় মহিমা
জেগে আছে বিশ্বে শুধু ধ্যান-মৌনা প্রকৃতির কোলে---
উদ্দাম চঞ্চল লীলা স্থির যেন সমাধির দোলে |
হাসিছে মাথার ‘পরে চন্দ্রমার শুভ্রোজ্জ্বল বাতি ---
অসংখ্য তারকা-সাথে |  উছলিছে প্রেম-সিক্ত রাতি |

অনন্ত নীলিমা-তলে হেরি এক যোগী আত্মহারা
এ জ্যোত্স্নায় বনপ্রান্তে ;  অরূপের প্রেমে মাতোয়ারা
মুক্তিকামী ধ্যানী বায়োজীদ্  |  আঁখি অপলক থির----
কখনো চাহেন ঊর্দ্ধে, বক্ষে হায় কভু বহে নীর |

হেনকালে মদ্যপায়ী কোথা হ’তে আসি ধীরে ধীরে,
করে-ধরা বীণা দিয়া আঘাতিল বোস্তমীর শিরে---
সজোরে মনের সুখে |   বহে রক্ত দরদর ধারে |
সহাস্যে কহেন ঋষি,--- কেন মোরে মেলি ভাই হাঁ রে ?
কি করেছি আমি, বল্ ?

.                              মুখপানে চাহিল মাতাল---
ক’ন যোগী, --- ওরে অন্ধ প্রাণের প্রদীপখানি জ্বাল্ ;
আবার মানুষ হও !--- এত কহি আশিস্ -অমিয়া
দেন শেষে মদ্যপায়ী-শিরে  |   সে পূত মাধুরী পিয়া
ফুকারিল মদ্যপায়ী |  প্রণমিল সাধুর চরণে,
কহে,--- ক্ষম’ মোরে ; --- এ দিনের তুলনা যে নাই----
অশুভের মূর্ত্ত শুভে তোমারে পেয়েছি আমি ভাই !
ক্ষম-ভালবাসা-ঘেরা বোস্তুমীর নিজন সংসার----
এরি মাঝে বাঁধা প’লে ;  প্রি.য়তম, হে সখা আমার !

.                  **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
রূপনগরওয়ালী
কবি কনকভূষণ মুখোপাধ্যায়
[ চারণ (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থ থেকে ]
                                         
“ঔরঙ্গজেব যখন দিল্লীর সিংহাসনে অধিরোহণ করেন,  স্বরূপনগরের সামন্ত-রাজ্যে সেই সময়
একটি পরমা সুন্দরী  রাজকুমারী নবযৌবনের লাবণ্যের সহিত দিন দিন পরিপুষ্ট হইতেছিলেন |  
সেই রূপবতী কুমারীর নাম প্রভাবতী, ইঁহারই জীবন-কাহিনী নীচের কবিতাটিতে বিবৃত হইয়াছে |”
.                                                                             ---- রাজস্থান, ১৩৪ পৃঃ

রূপনগরের কুমারী প্রভার দেশজোড়া শুনি রূপের কথা,
ঔরংজীব সাহান্ শাহের --- মর্ম্মে পশেছে চঞ্চলতা |
সেনাদলে তাই পাঠায় বাদ্ শা রূপনগরের রাণার পাশে ;
‘কন্যারে তব বেগম করিব’ লিখিয়া লিপিকা সুখোচ্ছ্বাসে |
ছোটরাজা হায় রাণা শোলাঙ্কি ক্ষুদ্র তাহার শক্তি কত ?
মোগল-বাহিনী নেহারি’ অদূরে মস্তক হ’ল আপনি নত !
রাজকুমারীর মনখানি ছিল রাজপুত-তেজ-দীপ্ত-ভরা---
বেগম হওয়ার লজ্জার চেয়ে মরণে সে হয় স্বয়ম্বরা |
রাণার সকাশে নতজানু হয়ে কহে প্রভাবতী--- নিদয় পিতা
কোন্ প্রাণে আজ পিতা হয়ে তুমি জ্বালাবে মেয়ের জীবন চিতা !
তার বিনিময়ে ঘাতকে ডাকিয়া আমার জীবন ধন্য কর’ |
মোগলের করে হেলায় ফেলিয়া শাস্তি দিওনা এমনতর !
যদি তা-ও দাও দিল্লীর পথে জহরে মেটাবো মরণ-ক্ষুধা---
আমার জীবন মথিয়া সে মোরে পিয়াবে মরণে জীবন-সুধা!

কহে শোলাঙ্কি --- কি করিব প্রভা, সুখ নাই বুকে শুধুই গ্লানি!
তবু যদি দেশ শান্তিতে থাকে, অপমানে তাই কন্যা দানি |
জল-ভরা চোখ রুখেছি ব্যথায় বক্ষে চেপেছি দহন-জ্বালা--
তুই যে মা মোর নয়নের মণি--- ফণি-মনসার বেদন-মালা!
অপঘাতে পথে পরাণ ত্যজিলে রূপনগরের এড়ান্ নাহি |
বাদ্ শা এদেশ করিবে শ্মশান, সম্মতি দে মা দেশকে চাহি !
কহিল কুমারী আঁখিজলে ভাসি--- তাই হোক বাবা ইচ্ছা তব,
অপমানে মোর ভূষণ করিয়া ঝঞ্ঝা-আঘাত নীরবে স’ব |

শেষে নিরজনে লিখিল গোপনে ---- দোহাই তোমার মেবার রাণা
জানিনাকো তোমা কখন সঁপেছি --- নেবে আজি কিগো হৃদয়-খানা ?
রক্ষ’ হে বীর সতীর ধর্ম্ম, স্বেচ্ছাচার যে মরম দলে !
হীনতা কি বড় হইবে জীবনে, ব্যথার মালা যে পরায় গলে ?----
দিল পুরোহিত রাণার হস্তে রূপকুমারীর পত্রলেখা,
রণ-উল্লাসে নাচিল রাণার হিয়ার পরতে রূপের রেখা !
শেষে একদিন দিল্লীর বুকে হল এক খুনের খেলা,
বাদ্ সাহী-সেনা হঠিল পিছনে হেরি মেবারের প্রাণের মেলা !
সেনাদল নিয়া বাদ্ শাহ পুনঃ আসিল মেবার ধ্বংসিবারে---
যতবার এল পরজয়-লাজে মুখ লুকাইল বারংবারে |

রূপকুমারী সে বিজয়িনী হোল শেষে অতুলন প্রেমোদ্দামে ----
বিলাল’ অমন অনুপম রূপ-মাধুরী বিজয়ী রাণার নামে |

.                  **********************     


.                                                                                      
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর