লাটাইয়ের ফরমানকে থোরাই কেয়ার আমিও উঠলাম দু’ ধাপ। এখন পেশীর টান, না পারি উঠতে না পারি ফিরতে। ছোটরা হারিয়ে গেছে চড়াইয়ের বাঁকে। ওদের কাছে পৌঁছয়না সেল ফোন সিগন্যাল। নীচে যাদের রেখে এসেছি, ফুরিয়ে আসা তেলের ল্যাম্প। তেলের যোগানদার আমি নিরুদ্দেশ। এখানেও পৌঁছয়না ওদের আঁচ। এখানে আমার সাথী দুজন- এক- খাদের পাইন দেবদারুর আগা ফুঁড়ে আসা হুহু হাওয়া। দুই- খাড়াইয়ের আড়াল। যা করে সময় কাটে- যখন চড়াই থেকে উড়ে আসে কোনও বাজ- আলগোছে দেখে নিই- ওদের ঠোঁটে আছে কি না কোনও চেনা হাড়। আজকের তারিখ তেমনই বয়ে আনল এক অকালে কেড়ে আনা পালক। দোলনা স্মৃতির স্মারক।
এ সব বলা খুব মুশকিল কি ভাবে খোঁজা যায় নতুন শহরে বাসা। কি ভাবে পারতে হয় নাগালের বাইরে ঝুলতে থাকা হৃদয় বলে এক টুকটুকে। ওসব বাদ দিই যেগুলো কুড়িয়ে পাওয়া পাখীর ঠোকরে আধ চেড়া, যেচে দেওয়া আবাসন, কত নাম না জানা পোকা। ওসব বাদ দিই যেগুলো ঝড়ে উড়ে আসে আধ পাকা বোল, আশ্রয় চাহনি মাখা বিকেল। ওসব বাদ দিই যেগুলো আমারই অনিচ্ছার জমিতে স্বতঃ গজিয়ে ওঠা কেঁদুলির বন। পেতে রাখা প্রতীক্ষা কুঞ্জতল। বরং আমাকে বল কি ভাবে পাওয়া যায় নেড়ে চেড়ে দেখার বিজিত হৃদয় করতলে। ওরা কথা বলুক কাছে কান এনে শুনি ওরা কি মানতে রাজী ওদেরও কেউ পেতে পারে।
জীবনস্মৃতির এক জায়গায় আছে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা ও রচনার কালে যাদের ছেলেবেলা তাদের, জাগতিক বিষয় সমূহের লভ্যতা ও উপভোগের একটি তুলনামূলক চিত্র। সে ধারা এখন প্রকট। অবশ্য এটা এস ওয়াজেদ আলীর কথার ‘সেই ট্র্যাডিশন’ নয়, একটি মনবৈজ্ঞানিক সত্য। আজকে যাঁদের শৈশব, কৈশোর আথবা সদ্য প্রাপ্ত যৌবন তাঁদের উপাদান প্রাপ্তি এতই প্রতুল যে কোন বস্তুটারই, রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত খোসা শাঁস আঁটি, সমেত উপভোগের অবকাশ থাকেনা। ফলতঃ ফেলে যাওয়াতে অনেক অধরা মাধুরী অগোচরে থেকে যায়। অবশ্য একপেশে না হয়ে বলা যায় আজকের যে সময়, টিকে থাকার জন্য যে প্রতিযোগীতা, তাতে করে গহনে অবগাহনের অবসরই বা কোথায়! দ্রুত মানুষের হাতে সময় কমছে, সময়ের সঙ্গে পরিবর্ত্তনের যে কার্ভটা, স্টীপার হয়েই চলেছে! কারণে যাই থাক, হতে পারে, আরও বেশী সাচ্ছ্যন্দের অভিলাষ, জৈবিক সুখের আশা, অর্থাৎ কিনা লোভ যা মানুষকে তার স্বকীয়তা থেকে দূরে নিয়ে যায়। মানুষের স্বকীয়তা মানে সমগ্র জীব জগত থেকে যা তাকে আলাদা করে, সেই চেতনা, চরিত্রে যা প্রবৃত্তির থেকে ভিন্ন। প্রকৃত প্রেম প্রকৃত নান্দনিকতা সেখান থেকেই জন্ম নেয়ে, ভালবাসা বলে নদীটির নাব্যতা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। এই বোধ থেকেই লিখেছিলাম নোম্যাড।
সহরতলীর এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে ছিলাম আমি, তাই ছেলে বেলায় যতটুকু পেয়েছি তার সবটুকুই শুষে নেওয়া অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের অফিসের লবিতে একটা বিরাট ডিসপ্লে বোর্ড আছে, একজন প্রতিদিন সকালে ডাস্টার দিয়ে সেটায় ঝারপোঁছ করে। একদিন দেখি ক্লিনার ডাস্টারটা ফেলে গেছে ডিসপ্লে বোর্ডের ভিতর কাঁচের ঝঁপিটির নীচে । ডাস্টারটি, আমার মনে হল, পরিত্যক্ত হওয়ার অভিমানে, স্বেচ্ছায় এক গ্রীক ভাস্কর্য হয়ে গেছে। কী করে জানিনা মিশে গেল আমার নিজস্ব অভিমানে। অতএব সৃস্টি হল একটি চিত্র।
শিমুলকুঁড়ির হারানিধি ক্ষেত মজুরি করে গাঁয়ের লোকের হারা ডাকে হারাই হোলো পরে। গ্রামের শেষে ডোবার পাশে খড়ের চালায় থাকে ভালো করে চেনার আগেই হারায় সে তার মাকে। হারার বাবা করত যখন ক্ষেত মজুরির কাজ, ক্ষেতের ভিতর চলে গেল মাথায় পড়ে বাজ। বাবা যখন চলে গেল হারা তখন স্কুলে, সেদিন থেকেই বই পরা কি হারা গেছে ভুলে। বাবার পেশায় সেই থেকে সে, ক্ষিদে বালাই বড় দিনের কামাই দিনেই সরে কামাও যত পার একটা কথা বোঝে হারা পার্টি কতো দড়ো, কাজ যদি চাও তবেই পাবে পার্টির নেতা ধর। ছোটোবেলায় প্রথম যেবার পার্টির ডেরা থেকে লোক এসে তাদের ঘরের দেওয়াল দিল এঁকে, মাটির দেওয়াল সাদা মাটা কিই বা ছিরি তার, ছবি দেখে হারার মনে খুশী ধরেনা আর। ভোট বলে এক বসত মেলা বাবা তখন বেঁচে পার্টির থেকে ঠেলায় করে নিয়ে যেত যেচে। ভোট মানেই বলত বাবা এই ছবিতেই ছাপ পার্টি থেকে বলা আছে, তেমনই পার্টির চাপ। বাবা সে তার চলে গেছে এবার আবার ভোট ক্ষেত মজুরের দিনের কামাই তিরিশ টাকা মোট। গাঁয়ের ভিতর কানাকানি বাধছে নাকি গোল অন্য পার্টি ঢুকছে গ্রামে আনছে দল বল। সেদিন ছিল রাত নিশুতি ঘুমিয়ে গোটা গ্রাম চমকে হারার ঘুম ভেঙ্গে যায় শব্দ দুম্ দাম্। মাটির ঘরের জানলা মানে কঞ্চি কটা আরে, সেই ফাঁকেতে দেখল হারা আসছে মানুষ তেড়ে। বিজলীবিহীন সেই গ্রামেতে রাতের আকাশ কালো, রাতের বেলায় প্রথম হারার দেখা এত আলো। ফাটছে বোমা জ্বলছে মশাল আগুন দেওয়াল যেন ফেলছে ঘিরে গ্রামটা গোটা এমন করে কেন? জ্বলছে মশাল, জ্বলছে কুঁড়ে , জ্বলছে পাকা ধান, গাঁয়ের লোকের আর্ত্তনাদে রাত হোলো খান্ খান্। কুঁড়ে ঘরের কপাট খুলে দাঁড়িয়েছিল হারা, ঝোপের ভিতর আবছায়াতে নড়ছে ওরা কারা ঠিক করে তা বোঝার আগেই কচলে দুটি চোখ, দেখল হারা চারপাশে তার মজুদ কটি লোক, নোংড়া ভাষার তুবড়ি মুখে, হাতে আগুন শলা- 'তোর কুঁড়েতে জ্বালব চিতা গাঁ ছেড়ে তুই পালা' 'ও ভাই শোনো, তোমরা কারা, কেন এমন কর'- মুখের কথা মুখেই থাকে, মাথায় আঘাত বড়। যেমন চমক ঘুম ভেঙেছে তেমনই চমক খ্যালে, জ্বলছে কুঁড়ে দুলছে হারা, পড়ল ঘুমে ঢলে। জ্ঞান ফিরেছে ভোরের হাওয়ায় পূবে আকাশ আলো গ্রামখানি তার ভষ্ম চিতার ক্ষেতে ফসল কালো মাথার পাশে বিষম ব্যথা, কি আর যাবে করা। ঘর পুড়েছে ভাত পূড়েছে পূড়েছে কাজ করা। আগুন এবার জ্বলছে পেটে, এখন দিনের আলো হোক বুঝি তার জন্ম ভিটে পালিয়ে যাওয়াই ভাল সেই যে হারার শুরু হোলো বাঁচতে পথ চলা বছর কতক ঘুরে গেছে, কতই বা যায় বলা। ইস্টিশনের একচালাতে হারার রাত্রি কাটে দিনের বেলায় বাজার হাটে ফাই ফরমাশ খাটে। যেদিন হারার কাজ জোটেনা হয় না কিছু আয় পেটের জ্বালায় হারা সেদিন ভিক্ষে করে খায়। গাঁয়ে ঢোকার নিষেধ আছে, পুড়েছে তার ঘর ভোটের নামে সিঁদুরে মেঘ যে পার্টিকেই ধর্। শিমুলকুঁড়ির হারানিধির বয়স হোলো কুড়ি, ক্ষেত মজুরি ছেড়ে এখন করে মাধুকরী।