কবি কেদার ভাদুড়ীর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
আমার বুদ্ধিতে তুমি
কবি কেদার ভাদুড়ী

আমার বুদ্ধিতে তুমি বোধগম্য কিছুই হলে না |
আয়ু যার ফুরিয়েছে  জলে--- বাউন্ডুলে----
তার, শুধু তারই প্রেমে পড়ে
১০৮ রক্তজবা কিনে তুমি কেন যাও মায়ের মন্দিরে ?
কেন আর আরবার ঘরে ফিরে এসে
রক্তাক্ত সিন্দুর মাখো সূর্যের আগুনে |

সারাটি দিন তুমি কি উপোষ ক’রেছো  ?
ভিজে চুল শুকিয়েছো রোদে ?
পেটে পিত্তি নিয়ে কি কথা বলেছো তুমি  ?
কি কথা বলেছো  ?
এবং অসুখ তার অনিবার স্বেচ্ছায় নিয়েছো |

এই কি প্রার্থনা ছিলো ? এই কি মানত ছিলো, মেয়ে  ?
দুটো ভ্রূর মাঝখানে জন্মচিহ্ন এঁকে
তুমি নাকি এম. এ, ক্লাসে পড় ?
প্রত্নতত্ত্ব খুঁড়ে
উজ্জ্বল নিঃশ্বাসে তুমি চুম্বনের শুদ্ধসত্ত্ব ঘুমে
স্বপ্ন কি দেখেছো শুধু আর
আয়ুস্কাল দিয়েছো ফিরিয়ে  ?

আমার যুক্তিতে তুমি বোধগম্য কিছুই হলে না
আমার বুদ্ধিতে তুমি উড়ো ধান উড়িয়েছো নীলে---
  
.                *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সত্যি  (এক )
কবি কেদার ভাদুড়ী

শুধু, সাতটি বিবাহ করেছি ব’লে
আদালতে মামলা উঠলো |
প্রতিবেশীরা এরকমই,
ক্রূর, স্বার্থপর এবং হিংসুটে, নিন্দুক |

বিচারক বললেন ; তুমি কিসে বিশওয়াশ কর ?
---- আই বিলীভ ইন আওয়ার হেরিটাঝ, স্যার  |

কিন্তু , হিন্দু কোড বলে-----
...... আমি হিন্দু নই, স্যার
হিন্দুত্বে বিশ্বাস করিনা |

তবে ?
------ সিন্ধুত্বে বিশ্বাস করি |
সব নদীই তো সিন্ধুতে আসে,
মেশে, এবং বহুত নোনতা হলেও  নিশ্চিত ভালোবাসে |

সত্যি  ?

সামনের সারিতে বসেছিলো জেনিফার
জেমিমা, জিউলিন, ইরিনা, তিরিনা, তিউলিন
এবং সারিনা. তারা  সবাই
বেলন ও বেলচা নিয়ে সমন্বরে
বলে উঠলো  :   সত্যি |

অ্যান্ড দ্য আদালত ওয়াজ অ্যাডজারন্ ড
সিইনি ডাই-ই  |

          *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সত্যি  (দুই )
কবি কেদার ভাদুড়ী

চোখে রোদ-চশমা, রাত্রেও |
কাঁধের ওপরে একটা কালো বেড়াল  |
দুটো পায়ের একটা, কাঠের |

যখন কথা বলে, বলে মানে বলতে চায়
জিভটা একটা লম্বা টিকটিকি হয়ে
টকটক করে |

আর তুমি তখন-না
দু’আঙুলে তুড়ি মেরে বলে ওঠো : সত্যি সত্যি |
সত্যি কিসের ? সত্যি এ দেশের | নিয়তি |

       *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মনে আছে ( নয় )
কবি কেদার ভাদুড়ী

বেশ মনে আছে, অনেকটা জাপানী জিন-রিকসার মতো,
মতো ঠিক নয়, আরো সরু, আরো ছোট, আরো ফিনফিনে এক
গরব মিঞাকে দিয়ে গাড়ি বানিয়েছিলো বাবা | রামনগরের দুটো ছাগল
একটা কালো, একটা লাল ইয়া বড়ো, লম্বকর্ণ, পাজী
নচ্ছারের মতো তেজ ও সাহস, তাদের |

খুব সক্কালে কাল্লু ও লাল্লুকে গাড়ীতে জুতে বাবা বেরোতো সাহেব বাজারে |
সঙ্গে চাবুক, হাতে লাগাম, পাশে বড়ো দুটো ঝোলা আনাজের |
মাছের ; খালি গা, পরনে ধুতি, গায়ে শুভ্র উপবীত কাশ্যপগোত্রের,
রাস্তার লোকেরা দাঁড়িয়ে পড়তো , পেটে হাসি ; সুষুম্নাকান্ড থেকে
সেই হাসি ছড়িয়ে পড়তো মুখে |  বাবা বলতো : রাবিশ  |

ইস্ , ছাগলদুটো মার খেয়ে যে মরে যাবে ! মার মুখে শুধু এই কথা |
ব্যথা বোধহয় অন্যখানে |  কে জানে ! কেননা, গরদের নতুন শাড়িটা
ভেজা ভেজা মনে হতো সবসময়ে |  আমি বলতাম : কাঁদছো ?
তুমি এতো কাঁদ কেন,  মা ? না, সেকথা নয় | যা মনে আছে
কাল্লু ও লাল্লুকে শেয়ালে খেলো একদিন আমের বাগানে | গিয়ে দেখি,
ডাক শুনে গিয়ে দেখি, দুটি শেয়াল সামনে, দুটো বা পেছনে |
পাছার দিকে লেজের তলার দুটোরই তাবৎ মাংসখন্ড নেই |
সেইদিন রাত্রেই স্বপ্ন দেখলাম, এখনো দেখি, বাবা ও শেয়াল
দুজনেই ধূর্ত, কিন্তু অসম্ভব কালো, তারই মধ্যে গরদের শাড়ি
ভেজা ভেজা, যেনো  |

             *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মনে আছে ( দশ )
কবি কেদার ভাদুড়ী

বেশ মনে আছে, আমাদের জমিদার নরনারায়ণ রায়
একবার কেনিয়া থেকে এক জেব্রা আনিয়েছিলেন যাট হাজার টাকায় |
বেটা এমন পোষ মেনে গিয়েছিলো যে সাঁতরে পদ্মার চরে গিয়ে
সূর্যাস্ত দেখতো  |

ফেরার সময় আমরা ওকে কলা দেখাতুম, খেতো না  |
এতোই ভদ্র যে মাথা নীচু করে গটগট করে হেঁটে যেতো
বাড়ির মেয়েরা বলতো ; কিরে, তোর কবে বিয়ে হবে ?
ঠিক ওই সময়ওর চোখে নেমে আসতো মাউন্ট কিলিম্যাঞ্জারো
ট্যাঙ্গানিকা হ্রদ, বোধহয়  |


জমিদার ঘোষণা করলেন, ও যদি কারোর বাড়িতে ঢোকে. ঢুকবে না অবশ্য,
আর, আমি ডাকলেও যদি বেড়িয়ে না আসে, তবে ও হবে তার |
শুনে, বাবা কী ভাবলো, কে জানে ? দূর থেকে একটা মেয়ে গাধা কিনে আনলো,
সাধন ঠাকুরের পান্তুয়া খাইয়ে পোষ মানালো, তারপর এক গামলা
কালো নীল রং নিয়ে বসলো, হাতে তুলি লাহা কোম্পানীর |
নরনারায়ণ রায় ডাকলেন : আয়, ওরে আয় | আসবে কি, ওর চোখে
তখন কেনিয়া, কিলিম্যাঞ্জারো ট্যাঙ্গানিকা হ্রদ |  আসবে কি
ওর দেহে তখন পদ্মার সূর্যাস্ত, ওর নাকে তখন গাত্র হলুদের গন্ধ
নরনারায়ণ বললেন : সন্ধে হলো, লগ্ন বোধহয় এখুনি, যাই |

          *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তাই হোক
কবি কেদার ভাদুড়ী

পাছায় লাথি মারা আমার ব্যামো হয়েছে আজকাল |
সেদিন গাছের পাছায় লাথি মেরে বললাম :
ফুল দাও, ফল দাও, ছায়া
দৌড়ুতে জানো না  ?
জগিং করতে পারো না  ?
পৃথিবীটা ঘুরে এসে বলতে পারো না : দেখে এলাম ?

আজ আবার দুঃখের পাছায় লাথি মেরে বললাম :
হাসতে জানো না  ?
অশ্রুজলে ভাসো কেন, অতো ?
বলতে পারো না আমি গাছ, বৃষ্টি আনি
মনো-অক্সাইড গায়েব করি
অম্লজান ছেড়ে দিয়ে বলি :  বাঁচো  |

এইসব শুনেটুনে দুঃখ গিয়ে গাছের কানে কানে কী বললো
গাছ এসে দুঃখের গালে চুমো দিল
তারপর তাদের ভাবসাব হয়ে গেলে
সেই থেকে মানুষের বুকে ফুটে উঠলো শ্লোক
সেই থেকে মানুষের মুখে ফুটে উঠল চোখ
অমনি সভ্যতার মহাপ্লাবন হাঁক দিল : তাই হোক্, তাই হোক্ |

       *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
একটি আধুনিক কবিতা
কবি কেদার ভাদুড়ী

রাত্রি একটা কি দুটো হবে |
বাইরে ষাঁড়ের মতো বৃষ্টি হচ্ছে, তবু,
ঘরের ভিতরে আমি, গোরুর মতো ভিজছি |

পাশের ঘরে মাসতুতো ভাই ছিলো,
নান্দনিক বোস  |
তার, বছরখানেক হলো,
ব্রেনোট্রানস্ প্ল্যানটেশন হয়েছে |
অর্থাৎ হার্টের ভাল্ ভ ডিফেক্ট ছিলো বলে
শূকরছানার হৃদয়ের ভাল্ ভ বেয়াকুফ বসানো হয়েছে |

‘বেয়াকুফ’ তো বলবোই, কেননা
ওকে ডাকতেই আমাকে তোয়ালে দিয়ে মোছাবে বলে
ও এমন ডেকে উঠল যে,
শূকরছানার মতো ডেকে উঠল যে
আমার সম্পূর্ণ শরীরটাই যেন কচু---
মানকচু, শোলাকচু, গাঁটিকচু এমন কি
ওলকচুও যে নেই, হতে পারে  ?

বেদ, বেদান্তের কথা ব’লে লাভ নেই |
পৃথিবী জানুক-----
রাত্রি একটা কি দুটো হবে |
বাইরে ষাঁড়ের মতো বৃষ্টি হচ্ছে,
আমি গোরুর মতো ভিজছি |

    *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
প্রায় সমস্বরে
কবি কেদার ভাদুড়ী

মা নেই, এমন এক ছোট ছেলেকে পড়াই, বাড়ি রাজস্থানে |
ছেলে যে এমন ছোট্ট হতে পারে এবং সুন্দর, না দেখলে বিশ্বাসই হয় না  |
হঠাৎ একদিন, আচমকা, একটা লালচে ওয়েডিং কার্ড ধরিয়ে সে বললো : জী হাঁ

আসবেন, জরুর আসবেন স্যর, হমরা পিতাজিকী সাধি সতেরোই জুনে |
আমি হাসবো না কাঁদবো ? কী করবো ?  কিছুই বুঝতে না পেরে
বলেই ফেললাম : ইয়ে বহুৎ খুশী কী বাত, প্রায় সমস্বরে  |

.                    *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
স্কুলে
কবি কেদার ভাদুড়ী

স্কুলে পড়ে, স্কুলে ; তবে কোন্ শ্রেণীতে বলবো না |
বললাম : পুরী গেছ ? কোনদিন ?  বললো : গেছি  |
বললাম : গোয়া গেছ ? গোয়ায় ? কোনদিন ? বললো : গেছি  |
বললাম : গোয়ার সমুদ্র ভালো,  না পুরীর ?
বললো  : না, বললো না পরিবর্তে তার
নাকের নিচে এবং ঠিক ওষ্ঠের ওপরে তর্জনীটা টেনে
আলতো ঘষতে লাগলো, আলতো  |
চতুর্থ ঘন্টা বেজে উঠলে, ছেলেরা
টিফিনের বাক্স নিয়ে বাইরে গেলো |
ও কিন্তু গেলো না  |

বললাম: বলো  | ও বললো : বলতেই হবে স্যার ?
বলেই, পুরীতে বেণী আছে, সুভদ্রা জননীর,
গোয়ায় ফেনী আছে, স্যার, কোকো বা কাজুরাণীর,
বলেই এমন হাসতে থাকলো যে,

এমন হাসতে থাকলো যে
আমিও হেসে ফেললাম  |

.      *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ব্রাহ্মণ
কবি কেদার ভাদুড়ী

চলুন কিছু খাওয়া যাক ; বড্ড খিদে পেয়েছে, জানেন  ?
এই বলে এগিয়ে এসে আমার মুখের সে সোজাসুজি হলো  |
বললো : কাছেই ‘হামিদা বানু রেস্টুরেন্ট, সস্তা কিন্তু ভালো’ |
পরিবর্তে না হয় কিছু কমপ্যানি দেব কঙ্কন বাজায়ে |

কঙ্কন ? বাজায়ে ?  কঙ্কন বাজায়ে ?  কি আশ্চর্য : ওই শব্দ-যুগ্মে
উঠে এলো, সেই আঁধার আঁধারি রাতে ঝিরিঝিরি শীতে শৈত্যে
উঠে এলো ভূমন্ডলের সমস্ত কবিতা, মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো কিছুক্ষণ
তারপর যমুনা বা গঙ্গায় স্নান সেরে ব্রাহ্মণী নয় ব্রাহ্মণ |

বল্লাম : ব্রাহ্মণ, তুমি এ লাইনে কতদিন, কতক্ষণ ? ও দেখি শিরিশিরি
বনকাপাসের মতো কেঁপে উঠে হঠাৎ আনত চোখে বিস্ফারিত বলে উঠলো,
স্যর, আপনি ?  দেখলাম এই সেই মেয়ে যাকে আমার কোচিং-য়ে
একদা ব্রাহ্মণ বলে ডাকতাম,  একদা ব্রাহ্মণ বলে ডাকতাম, ব্রা  হ্ম  ণ  |

এখন  ? এখন আমি কী করি ? সম্ভ্রম ? ওকে সসম্ভ্রমে ‘হামিদা বানু’ তে
.                                                               খাইয়ে-দাইয়ে শেষে
আমার কোচিং-য়ে পুনরায় ভর্তি করে নিলুম, কেননা সমিধভার করি আহরণ
.                         আমিও গৌতম ঋষি, আমিও সত্যকাম, আমিও ব্রাহ্মণ |

.                           *************************  

.                                                                               
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর