একই কালিক সীমার দৈর্ঘ্যে এইভাবে ধূলোমাটিজলবাতাস ছেনে ছেনে আমি - বড় ক্লান্ত । ক্লান্ত আমি ; তবু ফিরি না এখনই সেই এক শয্যার আয়োজনে মাতৃজরায়ুর পর যে-ই একমাত্র পাহারায় দিতে পারে নিশ্ছিদ্র নিরাপদ ঘুমের যোগান ; মুক্তির নির্যাসে ভিজে যায় মৃত্যুর দীর্ঘতম এ সুখ -
তাকে আমি গভীরে জড়িয়ে নেবো ; কিন্তু আজো ... ...টেনে টেনে চলি সহস্রাব্দের ক্ষত সমস্ত শরীর জুড়ে অলীক দাগের মতো , তারা ঝরে যায় ,তারা জেগে ওঠে ,তারা ঘুমোনোর ভান করে শুয়ে থাকে...... আমার লোহিতকণায় সচেতন ঘুর্ণী ; এইসব আস্ফালন- ঘটে যায় চোখে-মুখে পড়ে না জানি , শুশ্রুষার জল-চুম্বন ; কতকালের বুভুক্ষু আগুনে নিঃশেষ সঞ্জীবনী শক্তিকে ছুঁড়ে দিয়ে- এইসব ঘটনায় কাটে নাকি আমার ব্যবহৃত বেঁচে থাকা, - অব্যবহৃত জীবন মধ্যে ?
পথে নেমেছি - অন্যমনস্ক স্রোতের শৈবাল হবার জন্য তো নয় ;
হাত থেকে গলে যাওয়া বিষণ্নতার বরফে শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রা হতে পারে কে ? জানি না- পথের মানুষের হলুদ চোখে তাই ভারসাম্যহীন ডুব দিয়ে জীবনের ষোলোআনা বিনিময় খুঁজি, খুঁজবো বলেই এতদূর- রক্ত ঝরানো বুকের পাটাতনে ; শব্দ নয়, কতোগুলো বিচ্ছিন্ন অক্ষর জড়িয়ে উল্টোসাঁতার কাটি, পতঙ্গের মতো ঘুরপাক খাই নিয়ন আলোয়,
আঙ্গুল থেকে ঝড় তুলে নিতে নিতে সেদিন - বুঝে উঠতে পারিনি কোন্ হাত দুটি আমার , তার আগেই ভীড় থেকে ছিটকে পড়েছি যোজন দূরত্বে ;
পথ আমাকে নেয়নি , আমার ঘর-ও ছিলো না । মুহূর্ত থেকে মুহূর্ত - আমার কেবল শূন্যতার জরায়ুতে জন্মের অপেক্ষা আলিঙ্গন কেবল সেই এক জন্মান্ধ ভিখিরিকে যে বারবার হত্যা করতে গিয়ে নিহত হয়ে ফিরে আসে - মৃত্যুও এ হেঁয়ালি ভীষণ কেবল তাদের জন্য-
এখনো যাদের ফুসফুসে বিষাক্ত গ্যাস বিভ্রান্তিতে এখনো যারা হোঁচট খায়.....
ভাইকিং প্রেতাত্মার তেজ ঠিকরে পড়ে.... পশ্চিমে আর নয় ; চলো এগোনো যাক্ ।
আদি জনপদের ধ্বংসস্তূপ তন্ন তন্ন করে হাতড়ে যেখানে দুর্ধর্ষ জিহ্বার লালায় ভেজা রুক্ষ সমতল শিকারী নখের থাবা থেকে কেড়ে নিতে চায় - প্রাগৈতিহাসিকতার উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়,মগজের খুলি ; মৃত্যুপরবর্তী বেশ্যালয়ের দালাল যারা, স্থূল চামড়ার সেই সব ঈশ্বরের দেহরক্ষীদের মদ্যপ মুখের গন্ধে বিষাক্ত পৃথিবী এক ; তিন ভাগ জল দিয়ে ধুঁয়েমুছে ক্রমশঃ কুয়াশায় ঢেকে দেয় এক ভাগ ছিন্নবিচ্ছিন্ন মাটির ভৌগোলিক আদল, এই সব লোলুপ বৃক্ষের সদ্য জন্মানো ছালবাকড়ে কৌটিল্যের পুনরুত্থানের অবিকল চিত্র-
সাম্যবাদের সমাধির পাশেই যুদ্ধমানব ফুঁ দেয় নগরসভ্যতার দিগন্তভেদী শিঙ্গায়.....
পশ্চিমে আর কেন? চলো এগোনো যাক্।
টেনেহিঁচড়ে ধূলায় নামানো যাক্ নিরীহ রক্তের সমান বয়সী নিশান ; শুরু করা যাক অদল-বদল কয়েকশত পুরুষের ইতিহাস- আবর্তনে; মূঢ় পুঁথির গম্বুজে বসে চলো পুড়ানো যাক্,
আমি বহুক্ষণ আমাকে আর আমার লাশকে- এক খাটিয়ায় প্রথমে পাশাপাশি শুইয়ে, আবার দিক বদলে আড়াআড়ি রেখে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে মিলিয়ে দেখলাম। কোথাও কী তুলনীয়- এরা কোথাও কী পূরক বিম্ব?
শ্মশানে কাটিয়ে এসেছি যে বিগত জীবন ডোমজন্মের অভিজ্ঞতায় বুঁদ হয়ে থেকে হিমেল রক্তে; আর এই আরেক জীবন এখন খুলে খুলে পড়ে গেলো আমার মাংস থেকে - তবু দলিত সময়কে পাঁজরে পারিনা মিশিয়ে নিতে সেই সব উচ্চারণ যাদের হওয়ার কথা ছিলো অস্ত্রের শিরদাঁড়ায় প্রবল ক্ষত্রিয়জন- আমার ঠোঁট থেকে এদিক-ওদিক উড়ে যায় তারা, সন্ত্রস্ত চড়ুই যেন- লুকিয়ে থাকে ভাঙা ভেন্টিলেটরে; কিন্তু পরীক্ষা করে দেখেছিলাম আমার আলজিভ ছোট নয় খানিকটাও-
সেখানে একা খুন হতে চাওয়া আমার আহত ঊরু আর আমি; দেয়াল খামচে থাকি বোবা কব্জিতে, আঘ্রাণে বুঝি,দেয়ালের ওপাশেই গা ঘেঁষে- আছে সত্য শস্য সূর্যের বীজ অম্লান মানুষ। কেবল এপাশে নেই- এপক্ষে নেই - আমাদের বুক থেকে চুরি গেছে যা দেয়াল ভাঙার মতো স্বচ্ছ জারন; তাই তুল্য পারদে বিষাদ-লোক;
এখনও নয়। মৃত্যুকে স্পর্ধিত ইশারায় দেখে;জীবন এখনও নয় ততোটা মুখর !
ভেসে যেতে পারি ; তার চেয়েও স্বচ্ছন্দে পারি ডুবে যেতে।
ভেসে থাকতে থাকতে কিংবা ডুবে যেতে যেতে- আমাকে আঁক কষে বের করতে হবে, মানুষ কতটা ভিন্ন হয়?
মানুষ যতো ভিন্ন হয় ততটা কি বর্ণচোরা স্পর্শের সংকেত ; আঙ্গুলের দাগ বসে গেলে বিনা শর্তেই যে ঘাসফুল মরে যেতে চায়!
যায়-ও। মানুষ তেমন না কি ?
কোনও কোনও অথবা সব মানুষ - যেমন ভিন্ন হয়, ভিন্ন কি হয় তার শব্দপাঠ বহুবার সাক্ষাতেও বুঝে উঠতে পারিনি যে একক নদীর রহস্য সেই তার স্রোতের কাছে থৈ না পেলে - পোড়া কাঠ না খুঁজে আমাকে রূপক বিহঙ্গের কাছে শিখে নিতে হতে পারে ডানা ঝাপটে ঠোঁট ডুবানোর কলাকৌশল
(যদিও জানিনা,মানুষ ভিন্ন হলে বদলে যায় কিনা -তার শরীরের আদিম গন্ধও?)
শিকড় উপড়ে ফেলেছিলাম । অন্য কিছু নয় , এক-আধটু রসের জন্য -
অথচ হাতড়ে পেয়ে গেছি.... ভাবিওনি যেমন ; সেই - পূর্বপুরুষের লাম্পট্যের একেবারে অকাট্য প্রমাণ সেখানে প্রাচীন দলিলে আঁকা - নান্দনিক আলোর মিশেল চিত্রে দু'একজন শুধু নয় , প্রতিটি মুখোশ চায় পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়তে ;
সেখানে পৃথিবীর সব নারীর বুকেই শয়তানের দাঁত এর ভরাট দাগ -
আমি এখন উল্টোপথে , ঠিকানার ঠিক বিপরীত অভিমুখে ; এতোটাই মৃত যে তর্জনীর নখে দুলতে দেখি সমগ্র দশদিগন্ত -
ঊষ্ণ মাংসের কাঠামোতে সাজিয়ে স্পন্দনহীন আত্মা ; পা বাড়াই এমন এক পথে যেখানে আমার ছায়াই ঘুরিয়ে দেয় গতির আদল এতোটাই অবিশ্বস্ত - সে আলোর সমান্তরালে পশ্চিমে হাঁটে পিতৃহন্তা হবার লোভ সামলাতে না পেরে আমি তো এখনও যুদ্ধ করে যাই তার সাথে - যার রক্তপ্রবাহ আমার উৎসমুখ । হঠাৎ হঠাৎ চিতার কাঠ চুরি করে অজস্র নক্ষত্রকে দগ্ধ করতে ক্ষেপে উঠি ; শূন্যতায় আগুনের উৎসব দেখে বিকল্প চোখ তখনও উন্মাদ যেন-বা আমারই কনুই এর ভাঁজে স্পষ্টতর পোড়া দাগ ... তবুও মুঠোতে জমা হবে শীতল সৈকত ভেবে প্রসারিত করি দু'বাহুর মরচে পড়া কল-কব্জা এবং আঙ্গুল ; কিংবা স্রোতের সাথে বালির ছন্দ-কথন শেষ না হতেই সেখানে কান পেতে রাখি চোরাকুঠির প্রতিধ্বনি শুনতে চাই বলে -
আমি তো মৃত আগ্নেয়লাভা , বর্ষীয়ান ছাইয়ের স্তূপ ; ঠোঁটে তৃষ্ণা মেখে চেয়ে চেয়ে দেখি - কারা যেন শুষে নেয় জলের আধার ।
ডান-পা বাম-পা ডান-পা করে রোলিং হাতলটা এক ধাঁচ দৈর্ঘ্য বেধে সোজাসুজি শেষে গিয়ে থামে, আমার মতো কিছু হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা মানুষের জন্য ।
পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত ; তবু নিপুণ না হতে পারা ভ্রাম্যমান আঙুল যেখানে পিছলে যেতে যেতে জড়িয়ে থাকে কিংবা জড়িয়ে থাকতে থাকতে পিছলে যায় - একটি কাঁচের জানালায় পুরে রাখতে হয়েছিলো সবটুকু মনোযোগের মধ্যবিন্দু ; তাই নখদুটো উড়িয়ে নেয় প্রতিবেশি সুললিত কম্পন ;
যখন বেপাড়ার চোখগুলো সুযোগের খোঁজে জরীপে নেমেছিলো ।
শব্দের থাকে , এবড়ো-থেবড়ো অলিগলি অনেক গোঙানির ব্যাকরণে একদুটোও বিরামচিহ্ণের অধ্যায় নেই ঠোঁটে শুধু লাল ছাপ বসে -কামগন্ধহীন ;
বিকেলের রোদে সাবধানে দু'নখ শুকোতে দিয়ে দেখি তীব্রতার প্যারামিটার নামতে থাকলে আক্রোশ ঢের বেড়ে যায় ; - নিরাপদ সূর্যেরও পোহাতে হয় ছায়ার আপোষ । তেজহীন - আমার যদিও নামের পরে ঠিকানার খালি ঘরে দাগ বসানোর মত কিছু সরঞ্জাম ছিলো না - তবু পথের অদৃশ্য ধারাপাত খুললে ছিঁড়ে যেতেই হয় শেকলমুখো বিশ্বস্ত যানজট ।
ভিখিরিকে রাজদণ্ড দিয়েছিলে । দিয়েছিলে বটে !! অথবা - অথবা আমিই বিপ্রতীপ আলোয় ভুল বর্ণে তুলেছিলাম প্রথম শৈবাল - জাতিস্মরের বুনট চিহ্নের মতো স্বাদহীন, গন্ধহীন ব্যঞ্জনে যদিও নিজস্ব পাপের গোপন ফসিল তার ; হাতড়ে হাতড়ে যেন খুঁজে ফেরা - খুঁজে ফিরতে থাকা ..... খড়কুটো আঁকড়ে ধরার দুটো আঙ্গুল - জন্মান্ধ স্বপ্নের বিকলাঙ্গ ফসল হঠাৎ
সিঁড়ি ভেঙে যেতে যেতে - না'ই যদি মিললো কোনো শেষ ধাপ , অখণ্ড রাজত্বের দ্বিমাত্রিক লোভ ভিন্ন আর সব-ই ছেঁড়া কুয়াশার পাল ; কেটে কেটে এগোনো কৃষ্ণপক্ষের পথ ....
স্থিরচিত্রে নেহায়েৎ ছিন্নমূল এক সিংহাসন ; কিন্তু কাঁদিয়েছে অনেক-
অনেক কাঁদিয়েছে কিন্তু .....পেয়েও হারিয়ে ফেলার
মজ্জাগত পিচ্ছিল নেশায় , অন্ধকার সুড়ঙ্গের জটিল মানচিত্র হাতে পেয়েই - পুড়িয়ে এসেছি যে দ্বিধাহীন সেই অভিষেকের রাজমুকুট
অন্য আকাঙ্ক্ষার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মনে হয় যেন বা কোথাও সুনসান এক জায়গায় ট্রেনটা আমাকে নামিয়ে গেছে । সেখানে একা একটা স্টেশন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে -শুয়ে থাকে চাকার অপেক্ষায় ; সহসা কারো গন্তব্য হয় না সে স্টেশন ট্রেনের পায়ের শব্দরহস্য রোদদুপুরে তার জানা নেই - কোনও বুড়ো মাস্টার নেই ময়লা হয়ে যাওয়া রং চটে যাওয়া পতাকাটা ঘড়ি মিলিয়ে ওড়ানোর জন্য সে দাঁড়ায় না প্রতিদিন - দাঁড়ায় না .....কোনও দিন -
আমি এইসব দেখি । দেখতে থাকি ...... মনে করতে থাকি ....
আদৌ দেখি কি কিছু ! দেখার কাছাকাছি হয়তো একটা আবহ তৈরি করি মাত্র দেখব - দেখব ভাবি ; কিংবা এই দৃশ্যের মধ্য দিয়েই আমি নিজেকেও চালিয়ে নেই - এমন এক সময়ে যা আমার একান্ত ইতিহাসের নথিভুক্ত নয় যে সময় আমার চেনা ছিলো না । যদিও আমার কাছে রেলের চেয়ে জাহাজের আবেদন বেশি - তবুও সেই স্থবির সময়-এ বাকি যা কিছু পার্থিব সবই বাহুল্য মনে হয় ; টিকেটের হলুদ কাগজটা কেবল হাতে রাখি - যাতে জ্বলজ্বল করে অন্য কোনো শহরের নামছাপ এমনকী আমার শরীরের কোথাও-ও আমার নখের চিহ্ন ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না । বিনা মানুষের স্টেশনে আমার তল্লাসি চলতে থাকে ; হাতড়ে হাতড়ে অস্তিত্বের পোস্টমর্টেম করা হয় - আমিও বলে দিতে থাকি, কে যেন বলিয়ে নিতে থাকে অতীতের যত কিছু অমার্জনীয় যা কিছু ব্যক্তিগত পাপ নামে গচ্ছিত - দেহের সব ভাঁজ খুলে খুলে খোঁজ নেওয়া হয় গোপন স্খলনের , সেই স্টেশনে আমি ছাড়া কেউ যায় নি কোনোদিন ।
আত্মপ্রতিকৃতি উন্মোচনের ঐ মুহূর্তে আমার দু'চোখ থেকে প্রকৃত ঘৃণা ঝরেছিলো - আমি দু'হাত তুলে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম নিজের সামনে
নিজের সামনে -
একা দাঁড়াতে গিয়ে বুঝেছিলাম অশুভসত্তাকে সৃষ্টি করে ঈশ্বর আড়ালে নিজেকেই বাঁচিয়েছিলেন ।