অপর্ণা হাওলাদার-এর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
নির্জনতম দেয়াশলাই


কেননা কুকুরের জিহ্বাই একমাত্র ;
হয়ে উঠেছিলো
সভ্যতার যোগ্যতম প্রতিনিধি ।

সেদেশে যদিও পাহাড় ছিলো এককালে
এবং সমুদ্রও ।
আর ছিলো শিশুনদী শিশুফুল শিশুপাখি
যুবকেরা একদিন ভালোবাসতো ।
এককালে ......

ভূমিদস্যুর ভ্রুকুটিতে সমতলমুখী আকাশচুম্বিতা আজ ।
আজ পাহাড় উপড়ে এসে নদীর পরিধি কমায় ;
আর লাভের ছাঁকনিতে ধরা পড়ে সমুদ্রসীমাও
জল সেঁচে তেলের ওজনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হাঙরের দামে

মায়ের বুক থেকে মাড়ির দাগ মোছার আগেই
নিলামে উঠে যায় শিশুর দুধের দাঁতসব ;
শ্রমবাজার খাই-খাই চোখে গিলে ফেলতে থাকে
একটা নয় , আধটা নয় -
যা কিছু মানুষের গোপন লাইসেন্স !
শোওয়ার ঘরে ঢুকে বিছানার চাদর শুঁকে দেখে .
দেখে নেয় রাত্রিযাপনের চিহ্নগুলো -

যৌবন মিছিল নয় , ক্ষোভ নয় , ক্ষুধা নয় ।
নেহায়েৎ উৎপাদনের উপকরণ সে ;
সোজাসাপ্টা বিনিময়ের মূল্যমান জানে
যুবকের নেই আত্মহত্যার-ও অধিকার
রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বাইবেলে ;
আজ ।

আজ এইসব সময়কে মেলে ধরে একা
নির্জনতম দেয়াশলাই ঘষে ঘষে
আমি -

আমি পৃথিবীর মৃত্যু কামনা করি ।
আমি কবিতার বৈকল্য প্রার্থনা করি ।

আমি সূর্যের মুখাগ্নির প্রস্তুতি নেই .....

একা ।


.    ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
মেয়েটা নদীকে “মা” ডাকতো

মেয়েটা নদীকে "মা" ডাকতো ।

যে নদীতে ওর ঘর-চালা-গোয়াল
আর সাথে দেড় বছরের ভাই -
মা'র কোল চুরি করা ভাই
ভেসে গিয়েছিলো
গত আষাঢ়ের আগের আগের বার বানে

....নাকি তারও আগের !
সেই নদীকে -

কাঁশের ফাঁকে হাঁটতে হাঁটতে মুখে
বুলানো জোয়ার-বাতাস আঁচল ভেবে -
মায়ের নুন-হলুদ গন্ধ আঁচল ভেবে ;
আরামে চোখ বুজে ফেলতো
খোলা মাঠে শিশিরের ঘুম -
মেয়েটা
কাশবনের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে
ছোটোমেয়ের মত আহ্লাদ করতো -
টেংরার চচ্চরি ছাড়া তুলবে না মুখে ভাত
হঠাৎ হঠাৎ

মেম্বারের পুকুরের একটা নির্দিষ্ট রুই
শিশুদেহের মতোই মসৃণ ;
"বাবাই" বলে ডাক দিলেই সাঁতরে আসে -

বাবাই ।
ওর ছোটো ভাই । দেড় বছরের ভাই -
মা'র কোল চুরি করে নেওয়া ভাই !

বছর দশেকের মেয়ে । পিঠখোলা জামায়
আটকে দুপুরের রোদ ও লাল ঘামাচি
(শরীর তৈরি হয়নি এখোনো সেটাই বাঁচোয়া )
পা দুলিয়ে বসে থাকতো পাড়ে ,
জোঁক কিলবিল মাটি ফেটে সলাৎ ছলাৎ
ঢেউ ভাঙতো -
তবু যে জল কেড়েছে মা - মা'র কোল
চুরি করা ভাই ;
পান্তার বিশ্বস্ত আড়ত ;
সেই জলকেই -

"মা"

হা ঈশ্বর !

ও নদী , এত কিছু ধারণ করো -
একটা ছোট্টো মেয়ের গর্ভের দায় নিতে পারো না !



.    ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
নিষিদ্ধ প্রত্যয়

একই কালিক সীমার দৈর্ঘ্যে এইভাবে ধূলোমাটিজলবাতাস ছেনে ছেনে আমি
- বড় ক্লান্ত ।
ক্লান্ত আমি ; তবু ফিরি না এখনই সেই এক শয্যার আয়োজনে
মাতৃজরায়ুর পর যে-ই একমাত্র
পাহারায় দিতে পারে নিশ্ছিদ্র নিরাপদ ঘুমের যোগান ;
মুক্তির নির্যাসে ভিজে যায় মৃত্যুর দীর্ঘতম এ সুখ -

তাকে আমি গভীরে জড়িয়ে নেবো ; কিন্তু
আজো ... ...টেনে টেনে চলি সহস্রাব্দের ক্ষত
সমস্ত শরীর জুড়ে অলীক দাগের মতো ,
তারা ঝরে যায় ,তারা জেগে ওঠে ,তারা
ঘুমোনোর ভান করে শুয়ে থাকে......
আমার লোহিতকণায় সচেতন ঘুর্ণী ; এইসব আস্ফালন-
ঘটে যায় চোখে-মুখে পড়ে না জানি , শুশ্রুষার জল-চুম্বন ;
কতকালের বুভুক্ষু আগুনে
নিঃশেষ সঞ্জীবনী শক্তিকে ছুঁড়ে দিয়ে-
এইসব ঘটনায় কাটে নাকি আমার ব্যবহৃত বেঁচে থাকা,
- অব্যবহৃত জীবন মধ্যে ?

একা ঘুরে-ফিরে বিনম্র কক্ষপথ খুঁজি নাই আর ; আজ-

তাই আমি ক্লান্তিকে দিয়ে যাই নিষিদ্ধ প্রত্যয় ;

দেখা যাক্ এক জন্ম-বীজে কতবার মৃত্যু প্রাপ্ত হয় !


.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
পথ যাকে গ্রহণ করেনি

পথে নেমেছি -
অন্যমনস্ক স্রোতের শৈবাল হবার জন্য তো নয় ;

হাত থেকে গলে যাওয়া বিষণ্নতার বরফে
শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রা হতে পারে কে ? জানি না-
পথের মানুষের হলুদ চোখে তাই ভারসাম্যহীন ডুব দিয়ে
জীবনের ষোলোআনা বিনিময় খুঁজি, খুঁজবো বলেই
এতদূর- রক্ত ঝরানো বুকের পাটাতনে ;
শব্দ নয়, কতোগুলো বিচ্ছিন্ন অক্ষর জড়িয়ে উল্টোসাঁতার কাটি,
পতঙ্গের মতো ঘুরপাক খাই নিয়ন আলোয়,

আঙ্গুল থেকে ঝড় তুলে নিতে নিতে সেদিন -
বুঝে উঠতে পারিনি কোন্ হাত দুটি আমার ,
তার আগেই ভীড় থেকে ছিটকে পড়েছি যোজন দূরত্বে ;

পথ আমাকে নেয়নি , আমার ঘর-ও ছিলো না ।
মুহূর্ত থেকে মুহূর্ত -
আমার কেবল শূন্যতার জরায়ুতে জন্মের অপেক্ষা
আলিঙ্গন কেবল সেই এক জন্মান্ধ ভিখিরিকে
যে বারবার হত্যা করতে গিয়ে নিহত হয়ে ফিরে আসে -
মৃত্যুও এ হেঁয়ালি ভীষণ
কেবল তাদের জন্য-

এখনো যাদের ফুসফুসে বিষাক্ত গ্যাস
বিভ্রান্তিতে এখনো যারা হোঁচট খায়.....


.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
বিলাসীমহল

ভাইকিং প্রেতাত্মার তেজ ঠিকরে পড়ে....
পশ্চিমে আর নয় ; চলো এগোনো যাক্ ।

আদি জনপদের ধ্বংসস্তূপ তন্ন তন্ন করে হাতড়ে
যেখানে দুর্ধর্ষ জিহ্বার লালায় ভেজা রুক্ষ সমতল
শিকারী নখের থাবা থেকে কেড়ে নিতে চায় -
প্রাগৈতিহাসিকতার উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়,মগজের খুলি ;
মৃত্যুপরবর্তী বেশ্যালয়ের দালাল যারা,
স্থূল চামড়ার সেই সব ঈশ্বরের দেহরক্ষীদের
মদ্যপ মুখের গন্ধে বিষাক্ত পৃথিবী এক ;
তিন ভাগ জল দিয়ে ধুঁয়েমুছে ক্রমশঃ কুয়াশায় ঢেকে দেয়
এক ভাগ ছিন্নবিচ্ছিন্ন মাটির ভৌগোলিক আদল,
এই সব লোলুপ বৃক্ষের সদ্য জন্মানো ছালবাকড়ে
কৌটিল্যের পুনরুত্থানের অবিকল চিত্র-

সাম্যবাদের সমাধির পাশেই যুদ্ধমানব ফুঁ দেয়
নগরসভ্যতার দিগন্তভেদী শিঙ্গায়.....

পশ্চিমে আর কেন? চলো এগোনো যাক্।

টেনেহিঁচড়ে ধূলায় নামানো যাক্
নিরীহ রক্তের সমান বয়সী নিশান ;
শুরু করা যাক অদল-বদল
কয়েকশত পুরুষের ইতিহাস- আবর্তনে;
মূঢ় পুঁথির গম্বুজে বসে চলো পুড়ানো যাক্,

চলো পুড়িয়ে দেই -

অশরীরি আত্মার এই বিলাসীমহল।



.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
আমি আমার লাশকে স্বীকৃতি দিতে এসেছিলাম

আমি বহুক্ষণ আমাকে আর আমার লাশকে-
এক খাটিয়ায় প্রথমে পাশাপাশি শুইয়ে,
আবার দিক বদলে আড়াআড়ি রেখে
এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে মিলিয়ে দেখলাম।
কোথাও কী তুলনীয়-
এরা কোথাও কী পূরক বিম্ব?

শ্মশানে কাটিয়ে এসেছি যে বিগত জীবন
ডোমজন্মের অভিজ্ঞতায় বুঁদ হয়ে থেকে হিমেল রক্তে;
আর এই আরেক জীবন এখন
খুলে খুলে পড়ে গেলো আমার মাংস থেকে -
তবু দলিত সময়কে পাঁজরে পারিনা মিশিয়ে নিতে
সেই সব উচ্চারণ যাদের হওয়ার কথা ছিলো
অস্ত্রের শিরদাঁড়ায় প্রবল ক্ষত্রিয়জন-
আমার ঠোঁট থেকে এদিক-ওদিক উড়ে যায় তারা,
সন্ত্রস্ত চড়ুই যেন-
লুকিয়ে থাকে ভাঙা ভেন্টিলেটরে;
কিন্তু পরীক্ষা করে দেখেছিলাম
আমার আলজিভ ছোট নয় খানিকটাও-

সেখানে একা খুন হতে চাওয়া আমার আহত ঊরু
আর আমি; দেয়াল খামচে থাকি বোবা কব্জিতে,
আঘ্রাণে বুঝি,দেয়ালের ওপাশেই গা ঘেঁষে-
আছে সত্য শস্য সূর্যের বীজ অম্লান মানুষ।
কেবল এপাশে নেই- এপক্ষে নেই -
আমাদের বুক থেকে চুরি গেছে যা
দেয়াল ভাঙার মতো স্বচ্ছ জারন;
তাই তুল্য পারদে বিষাদ-লোক;

এখনও নয়।
মৃত্যুকে স্পর্ধিত ইশারায় দেখে;জীবন
এখনও নয় ততোটা মুখর !




.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
রূপ  নাকি  রূপান্তর!

ভেসে যেতে পারি ;
তার চেয়েও স্বচ্ছন্দে পারি ডুবে যেতে।

ভেসে থাকতে থাকতে কিংবা ডুবে যেতে যেতে-
আমাকে আঁক কষে বের করতে হবে,
মানুষ কতটা ভিন্ন হয়?

মানুষ যতো ভিন্ন হয়
ততটা কি বর্ণচোরা স্পর্শের সংকেত ;
আঙ্গুলের দাগ বসে গেলে বিনা শর্তেই
যে ঘাসফুল মরে যেতে চায়!

যায়-ও। মানুষ তেমন না কি ?

কোনও কোনও অথবা সব মানুষ -
যেমন ভিন্ন হয়,
ভিন্ন কি হয় তার শব্দপাঠ
বহুবার সাক্ষাতেও বুঝে উঠতে পারিনি
যে একক নদীর রহস্য সেই
তার স্রোতের কাছে থৈ না পেলে -
পোড়া কাঠ না খুঁজে আমাকে
রূপক বিহঙ্গের কাছে শিখে নিতে হতে পারে
ডানা ঝাপটে ঠোঁট ডুবানোর কলাকৌশল


(যদিও জানিনা,মানুষ ভিন্ন হলে বদলে যায় কিনা
-তার শরীরের আদিম গন্ধও?)



.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
শিকড়

শিকড় উপড়ে ফেলেছিলাম ।
অন্য কিছু নয় ,
এক-আধটু রসের জন্য -

অথচ হাতড়ে পেয়ে গেছি....
ভাবিওনি যেমন ; সেই -
পূর্বপুরুষের লাম্পট্যের
একেবারে অকাট্য প্রমাণ
সেখানে প্রাচীন দলিলে আঁকা -
নান্দনিক আলোর মিশেল চিত্রে
দু'একজন শুধু নয় ,
প্রতিটি মুখোশ চায়
পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়তে ;

সেখানে
পৃথিবীর সব নারীর বুকেই
শয়তানের দাঁত এর ভরাট দাগ -

ভীষণ অস্ত্র ভেতরেই ছিলো ,
নাগরিক কায়দায়
অনভ্যস্ত সেজে আরেকবার
চতুর নখে বালি ছেনে ছেনে -
কংক্রীট বিছিয়ে দেওয়ার মতো...
সব পৌরাণিক ছাল-বাকড়ে !

যদিও করিনি কিছুই । কেন ?

মোহরের লোভে
আমিও কি ধরিনি কুড়াল ?


.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
জন্মকালের বিপরীত দিকে হাঁটি


আমি এখন উল্টোপথে , ঠিকানার ঠিক বিপরীত অভিমুখে ;
এতোটাই মৃত যে তর্জনীর নখে দুলতে দেখি সমগ্র দশদিগন্ত -

ঊষ্ণ মাংসের কাঠামোতে সাজিয়ে স্পন্দনহীন আত্মা ; পা বাড়াই
এমন এক পথে যেখানে আমার ছায়াই ঘুরিয়ে দেয় গতির আদল
এতোটাই অবিশ্বস্ত - সে আলোর সমান্তরালে পশ্চিমে হাঁটে
পিতৃহন্তা হবার লোভ সামলাতে না পেরে
আমি তো এখনও যুদ্ধ করে যাই তার সাথে -
যার রক্তপ্রবাহ আমার উৎসমুখ ।
হঠাৎ হঠাৎ চিতার কাঠ চুরি করে
অজস্র নক্ষত্রকে দগ্ধ করতে ক্ষেপে উঠি ;
শূন্যতায় আগুনের উৎসব দেখে বিকল্প চোখ তখনও উন্মাদ
যেন-বা আমারই কনুই এর ভাঁজে স্পষ্টতর পোড়া দাগ ...
তবুও মুঠোতে জমা হবে শীতল সৈকত ভেবে প্রসারিত করি
দু'বাহুর মরচে পড়া কল-কব্জা এবং আঙ্গুল ; কিংবা
স্রোতের সাথে বালির ছন্দ-কথন শেষ না হতেই সেখানে
কান পেতে রাখি চোরাকুঠির প্রতিধ্বনি শুনতে চাই বলে -


আমি তো মৃত আগ্নেয়লাভা , বর্ষীয়ান ছাইয়ের স্তূপ ;
ঠোঁটে তৃষ্ণা মেখে চেয়ে চেয়ে দেখি -
কারা যেন শুষে নেয় জলের আধার ।



.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
"মিডওয়ে"র কাঁচে একঘেয়ে আঙুল

ডান-পা বাম-পা ডান-পা করে রোলিং হাতলটা
এক ধাঁচ দৈর্ঘ্য বেধে সোজাসুজি শেষে গিয়ে থামে,
আমার মতো কিছু হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা মানুষের জন্য ।

পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত ; তবু নিপুণ না হতে পারা
ভ্রাম্যমান আঙুল যেখানে পিছলে যেতে যেতে জড়িয়ে থাকে
কিংবা জড়িয়ে থাকতে থাকতে পিছলে যায় -
একটি কাঁচের জানালায় পুরে রাখতে হয়েছিলো
সবটুকু মনোযোগের মধ্যবিন্দু ; তাই নখদুটো উড়িয়ে নেয়
প্রতিবেশি সুললিত কম্পন ;

যখন বেপাড়ার চোখগুলো সুযোগের খোঁজে জরীপে নেমেছিলো ।

শব্দের থাকে , এবড়ো-থেবড়ো অলিগলি অনেক
গোঙানির ব্যাকরণে একদুটোও বিরামচিহ্ণের অধ্যায় নেই
ঠোঁটে শুধু লাল ছাপ বসে -কামগন্ধহীন ;

বিকেলের রোদে সাবধানে দু'নখ শুকোতে দিয়ে
দেখি তীব্রতার প্যারামিটার নামতে থাকলে আক্রোশ
ঢের বেড়ে যায় ; -
নিরাপদ সূর্যেরও পোহাতে হয় ছায়ার আপোষ ।
তেজহীন -
আমার যদিও নামের পরে ঠিকানার খালি ঘরে
দাগ বসানোর মত কিছু সরঞ্জাম ছিলো না -
তবু পথের অদৃশ্য ধারাপাত খুললে ছিঁড়ে যেতেই হয়
শেকলমুখো বিশ্বস্ত যানজট ।

নখ বেয়ে চলে যায় সাদা জল ; গড়িয়ে যায় -

আঙুলের ফাঁকে তখনও গুঁজে আছে বেগুনি ছাড়পত্র -


.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
রাজদণ্ড

ভিখিরিকে রাজদণ্ড দিয়েছিলে ।
দিয়েছিলে বটে !!
অথবা -
অথবা আমিই বিপ্রতীপ আলোয়
ভুল বর্ণে তুলেছিলাম প্রথম শৈবাল -
জাতিস্মরের বুনট চিহ্নের মতো
স্বাদহীন, গন্ধহীন ব্যঞ্জনে যদিও
নিজস্ব পাপের গোপন ফসিল তার ;
হাতড়ে হাতড়ে যেন খুঁজে ফেরা -
খুঁজে ফিরতে থাকা .....
খড়কুটো আঁকড়ে ধরার দুটো আঙ্গুল -
জন্মান্ধ স্বপ্নের বিকলাঙ্গ ফসল হঠাৎ

সিঁড়ি ভেঙে যেতে যেতে -
না'ই যদি মিললো কোনো শেষ ধাপ ,
অখণ্ড রাজত্বের দ্বিমাত্রিক লোভ ভিন্ন
আর সব-ই ছেঁড়া কুয়াশার পাল ;
কেটে কেটে এগোনো কৃষ্ণপক্ষের পথ ....

স্থিরচিত্রে নেহায়েৎ ছিন্নমূল
এক সিংহাসন ;
কিন্তু কাঁদিয়েছে অনেক-

অনেক কাঁদিয়েছে কিন্তু .....পেয়েও হারিয়ে ফেলার

মজ্জাগত পিচ্ছিল নেশায় ,
অন্ধকার সুড়ঙ্গের জটিল মানচিত্র
হাতে পেয়েই -
পুড়িয়ে এসেছি যে দ্বিধাহীন সেই
অভিষেকের রাজমুকুট

আজ নাহয় দু'একপা নামুক দেবদারু রোদেও .... !


.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
"ছাই হওয়ার আগ মুহূর্তে"


ছাই  হওয়ার   আগ  মুহূর্তে - (প্রথমার্ধে )

আঙুলে পেঁচানো ভোকাট্টা সেই সুতো -
সুতো কেটে কবে পালিয়েছিলো ঘুড়ি !
ঘুড়ির পিঠে মুখ ডুবিয়ে ঘুমোক সূর্য ;
সূর্যের মত নিজের আগুনে পুড়ি ।

পুড়তে গিয়েও অবাক হওয়ার পালা
পালাবদলের ছাই ছড়ানো চোখ ;
চোখ ঢেকে যায় রঙিন নক্সা কাঁচে -
কাঁচের গর্ভে আমার জন্ম হোক ।

পুড়তে পুড়তে আবার জন্ম হোক ।



ছাই  হওয়ার   আগ  মুহূর্তে - ( দ্বিতীয়ার্ধে )

নদী ভেবে যেই পা ডুবিয়ে দেই -
জল ভেঙে নিমরস মাটি সুদ কষে ,
মাটি ভেবে যেই বসত আকর নেই -
ভিত জুড়ে পাথরে পাথর শরীর ঘষে ।

কিছু চতুর মানুষ ; পাথর শরীর ঘষে ।



.            ****************                                                                     
উপরে


মিলনসাগর
*
ওপেন চ্যালেঞ্জ : ঈশ্বরকে

বিস্ময়ে হাঁটতে থাকি মিশেল ঘোরের নাজুক বোধে ;

অন্য আকাঙ্ক্ষার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মনে হয় যেন বা
কোথাও সুনসান এক জায়গায় ট্রেনটা আমাকে নামিয়ে গেছে ।
সেখানে একা একটা স্টেশন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে
-শুয়ে থাকে চাকার অপেক্ষায় ;
সহসা কারো গন্তব্য হয় না সে স্টেশন
ট্রেনের পায়ের শব্দরহস্য রোদদুপুরে তার জানা নেই -
কোনও বুড়ো মাস্টার নেই ময়লা হয়ে যাওয়া রং চটে যাওয়া
পতাকাটা ঘড়ি মিলিয়ে ওড়ানোর জন্য সে দাঁড়ায় না প্রতিদিন -
দাঁড়ায় না .....কোনও দিন -

আমি এইসব দেখি ।
দেখতে থাকি ......
মনে করতে থাকি ....

আদৌ দেখি কি কিছু !
দেখার কাছাকাছি হয়তো একটা আবহ তৈরি করি মাত্র
দেখব - দেখব ভাবি ;
কিংবা এই দৃশ্যের মধ্য দিয়েই আমি নিজেকেও চালিয়ে নেই -
এমন এক সময়ে যা আমার একান্ত ইতিহাসের নথিভুক্ত নয়
যে সময় আমার চেনা ছিলো না ।
যদিও আমার কাছে রেলের চেয়ে জাহাজের আবেদন বেশি -
তবুও সেই স্থবির সময়-এ বাকি যা কিছু পার্থিব
সবই বাহুল্য মনে হয় ;
টিকেটের হলুদ কাগজটা কেবল হাতে রাখি -
যাতে জ্বলজ্বল করে অন্য কোনো শহরের নামছাপ
এমনকী আমার শরীরের কোথাও-ও আমার নখের চিহ্ন ছাড়া
কিছু পাওয়া যায় না । বিনা মানুষের স্টেশনে
আমার তল্লাসি চলতে থাকে ; হাতড়ে হাতড়ে অস্তিত্বের
পোস্টমর্টেম করা হয় - আমিও বলে দিতে থাকি, কে যেন বলিয়ে নিতে থাকে
অতীতের যত কিছু অমার্জনীয় যা কিছু ব্যক্তিগত পাপ নামে গচ্ছিত -
দেহের সব ভাঁজ খুলে খুলে খোঁজ নেওয়া হয় গোপন স্খলনের ,
সেই স্টেশনে আমি ছাড়া কেউ যায় নি কোনোদিন ।

আত্মপ্রতিকৃতি উন্মোচনের ঐ মুহূর্তে আমার দু'চোখ থেকে
প্রকৃত ঘৃণা ঝরেছিলো -
আমি দু'হাত তুলে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম নিজের সামনে

নিজের সামনে -

একা দাঁড়াতে গিয়ে বুঝেছিলাম
অশুভসত্তাকে সৃষ্টি করে ঈশ্বর আড়ালে নিজেকেই বাঁচিয়েছিলেন ।

সেদিন আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় ছিলোনা তাঁর ।



.                    ****************                                                             
উপরে


মিলনসাগর
*
আরশি

চোখ আরশি-তে পড়তেই
ঘরময় পারা দেওয়া কাঁচ -
টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
কিছুটা উঠতি যৌবন যেন
তার আগ্রাসী জিহ্বার মতো ;
সরু কাঁচ , কাঁচের গুঁড়ো
রক্তে ভেজার আগেই উধাও -

আর সব জেনে নেওয়া গেলো ,
ছোটো ছোটো উত্তরগুলো-ও ;
কেবল দেখা বাকি .......

চিবুকের কাটা দাগ এখোনো কতোটা গভীর -

আজকাল পাওয়া যায় পালকের তীর ?


.       ****************                                                                           
উপরে


মিলনসাগর
*
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর

ভূমিকা না করে সরাসরি বলি ।

আপনার সময়ের মূল্য অনেক ;
আমার কালিও কিছু অ-মূল্য নয় !

এর-ওর থেকে জোগাড়যন্তর করে
আপনার ব্যাংক নিয়মের ফাইলগুলো
চষছিলাম । বহুদিন । বহুভাবে ।
নৈব নৈব চ । কি বুঝিনি তাও বুঝিনি ।
মানে এত এত ডলার , সোনা
জমির দলিল ,দালানকোঠা , ইট পাথর
শেয়ারের কাগজ -
আসলে রিজার্ভ কার জন্য ? ঠিক কার
কাজে লাগবে এসব কাগুজে বাঘ !


মতিঝিলের মিডপয়েন্টে বসে আপনি
নিশ্চয়ই দেখেন ; শহরটা কীভাবে আগাগোড়া
মুড়ে যায় কার্বন মনোক্সাইডে । শুনেছেন
পঁচিশ বছরের মধ্যে দেশ  নাকি
বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হচ্ছে ;
এখানে সেখানে পড়ে থাকবে একেকটা
জমির খন্ড , সমুদ্রসীমা এগিয়ে এসে
ঢুকে যাবে বাড়ির উঠোনে । জানেন ?

জানেন নিশ্চয়ই -

বদ্বীপ থেকে দ্বীপ .......
বেশ পোয়েটিক মেটাফর

ইন্টারজেনারেশনাল ইকুইটি থিওরি
আপনার নখদর্পণে । বিস্তৃত বর্ণনা তাই
নিষ্প্রয়োজন ।

আমার কেবল একটি ছোটো আবেদন -

জনাব ,
আমি কি আপনার ব্যাংকে আমার
সন্তানের নিমিত্তে কিছু বিশুদ্ধ বাতাস
ভল্ট করতে পারি ?

তার সন্তানের জন্য
......খানিকটা মিঠা পানি ?

আর ......
তার সন্তানের জন্য -
ভল্ট করার মত মনে হয়
বাকি শুধু লবণ আছে ;
যাতে জন্মের পর গলায় ঢুকিয়ে
দম আটকে মেরে ফেলা যায় !

ব্যাংক নীতি এ ব্যাপারে কতটা শিথিল -
জানাবেন । দয়া করে জানাবেন ।


.       ****************                                                                           
উপরে


মিলনসাগর