কবি অরুণ মিত্র-র কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
১।      বিড়ম্বনা       
২।      
মরতার কথা   
৩।      
দুপুরের সূর্য      
৪।      
কথা      
৫।      
রিকশাওয়ালা   
৬।      
নিসর্গের বুকে     
    
*
বিড়ম্বনা   

শেষ বর্ষায় মরা গাঙে দেখি এল প্লাবন |
আজকে তোমার অধরে হাসির ভরা জোয়ার ;
গ্রীষ্মের জ্বালা বিছানো যে-মুখে প্রতি রেখায়
ফুটল সেখানে ঘন আনন্দ রস-মধুর |

বহুকাল পরে প্রথম প্রেমের লাগে আমেজ,
নব অনুরাগে তোমার শরীর লীলাকমল
অপাঙ্গে আজ অভ্যর্থনা রবাহূতের,
কলকাকলিতে ভরালে ঘরের চাপা বাতাস |

এই যে আমার কণ্ঠে জড়ালে কর-ভূষণ!
আমি যেন দিগ্বিজয়ী, আমায় পারিতোষিক
দিলে বহুমালা | অতলস্পর্শ মায়া তোমার |
আশ্লেষে দিতে চাও অতীতের ক্ষতিপূরণ |

গভীর তোমার ফল্গু-প্রেমের ধারা উছল :
ধন্য আমার দীর্ঘ বেকার দশা মোচন |
পাগলা বাঁশিতে চমকাও কেন? করা কী আর?
আসলো বোমারু---নীচের তলায় চল পালাই |


.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
অমরতার কথা   

.        বাসনগুলো এক সময়ে জলতরঙ্গের মতো বেজে উঠবে | তার ঢেউ দেয়াল
ছাপিয়ে পৃথিবাকে ঘিরে ফেলবে | তখন হয়তো এই ঘরের চিহ্ন পাওয়া যাবে না |
তবু আশ্চর্যকে জেনো | জেনো এইখানেই আমার হাহাকারের বুকে গাঢ়
গুঞ্জন ছিল |

.        আমার বদ্ধ বাতাসে যে-গান পাষাণ হ'য়ে থাকে তা ভেঙে ছিটিয়ে পড়ুক,
কল্পনার স্বর সমুদ্র হোক এই আশায় আমি অথই | অবিশ্রাম অনুরণনে পাঁচিল
ধ্ব'সে যাবে, কলরোলে ভিটেমাটি তলাবে | তখন ঘূর্ণির পাকে বুঝে নিয়ো
কাথায় সেই বিন্দু যেখান থেকে জীবন ছড়িয়ে পড়লো মৃত্যুর গহ্বরে |

.        কাঠকুটো আসবাব আবার বন্য হ'য়ে উঠবে | ওরা কচি পাতার ঝিলমিল
মুড়ে ঝিমোয়, ভিতরে-ভিতরে কোথায় হারিয়ে থাকে অঙ্কুরের ঝাপটানি |
তবু সূর্য ডুবলে আমার চোখে বার-বার ঘনিয়ে আসে বন |

.        ওরা আবার বন্য হ'য়ে উঠবে | আমার ছাত দেয়াল মেঝের শূণ্যতা ভ'রে
অরণ্য জাগবে | সবুজের প্রতাপে এই শুকনো কাটামো পূর্ণ হবে | সেই ধ্বংসের
গহনে খুঁজে নিও আমার বসতি, সেখানে পোড়ামাটি-ইটের ভিতরে রস
ছিলো অমৃতের মতো |




.                        ********************************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
দুপুরের সূর্য   


দুপুরের সূর্য গুঁড়িয়ে গেল আর আমি অনুভব করলাম
তোমার স্পন্দন থমথমে রাতের মতো
তোমার শুকনো মুখ শস্যের শিকড়ে শিকড়ে ছাওয়া
অনুভব করলাম |




.                 ********************                                                         
উপরে


মিলনসাগর
*
কথা   


সহজ বলার ছিল যেমন নিশ্বাস |
ক্ষেতে মাঠে জল পড়তে অঙ্কুরেরা হেসে
মাথা নাড়ল একসঙ্গে, আমাকে আকাশ
দেখাল, দেখাল মেঘ, নীল পরিবেশে
যখন বাতাসে ডানা মেলে বুনো হাঁস
উড়ে গেল, টুপটাপ শান্তিকণা শেষে
আমার মুখেও লাগল, ঘাসজমি জুড়ে
ঘন্টা বাজল শিশুদের, খেলার দুপুরে,


তখনই আমার কথা উত্স থেকে জেগে
বৃষ্টি রোদ অপাপের সমান্তরালের
পথ ধরল | আমি সেই নদীস্রোতোবেগে
আমাকে ঢাললাম অমনি টের পেলাম বেড়
চোরা পাথরের | এক কুটিল প্রণালী
কথা ভাঙে, বুক খেলে বাঁকা চতুরালি |


.            ********************                                                               
উপরে


মিলনসাগর
*
রিকশাওয়ালা   


রিকশার চাকা দুটো ঘুরতে-ঘুরতে এইখানটাতে এসে দাঁড়ায় | আমার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করে |
যে-লোকটা চালায় একদিনও তার কামাই নেই, এই বিষম ঠাণ্ডাতেও না | এমনিতে তাকে দেখে
আমার চেনবার কথা নয়, কারণ তার মুখটা রোজই বদলায় | চাকাদুটো ঘোরা থেকে চিনি |

সন্ধের পর ছেলে-বউকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে | কোন্ মহল্লা থেকে তা
আমার কাছে পরিষ্কার নয় | শুধু এইটুকু বুঝতে পারি, ভুতুড়ে আলোগুলো পার হয়ে গেলে একটা
যে-প্রকাণ্ড শীতের রাত পড়ে, তার ওপারে সে থাকে | যেথানেই থাকুক কিছু আসে যায় না |
আমার বাড়িটা যে তার চেনা, আমাদের দুজনের পক্ষে এটাই বড় কথা |

শাতের ঢেউ যে-সব রাস্তায় আছড়ে পড়ে সেই সব রাস্তা দিয়ে রিকশা চড়ে আমি অনেকবার
গিয়েছি | তখন মানুষটার মধ্যে আগুন গনগন করতে দেখেছি, যেন তার অস্থিমজ্জা জ্বলছে |
আমার গায়ে সেই আঁচ এসে লেগেছে | তার সুতির ফতুয়াটা যখন তীব্রভাবে উড়তে থাকে এবং
আমার ভয় হয় আমার গরম জামাকাপড় বুঝি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে | কিন্তু না, প্রত্যেকবারই
সে ভুতুড়ে আলোগুলোর ভিকর দিয়ে আমাকে আবার এখানে ঠিকমতো পোঁছে দিয়েছে | এমন
কি, তার বাড়িটা যে একসময় খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিল, এ অনুভূতিটাও আর লেশমাত্র
থাকেনি | আজও সে আমাকে নিয়ে শীতের রাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং নিরাপদে আবার
ফিরিয়ে আনবে |

খুব সম্ভব কোনো একদিন সে আর আসতে পারবে না | ভেতরের আগুনটা নিভে গিয়ে সে ঠাণ্ডায়
জমে পাথর হয়ে কোথাও পড়ে থাকবে | কিন্তু তা বলে রিকশার চাকা দুটো তো মাটিতে গেড়ে
যাবে না | তারা আবার ঘুরবে এবং তাই থেকে আমি বুঝব সেই রিকশাওয়ালা হাজির হয়েছে, এখন
যেমন বুঝি | এটাই আমার কাছে স্বস্তি |




.                          ********************                                                               
উপরে


মিলনসাগর
*
নিসর্গের বুকে   


আমি এত বয়সে গাছকে বলছি
তোমরা ভাঙা ডালে সূর্য বসাও
হাঃ হাঃ আমি গাছকে বলছি
অন্ধকার হয়েছে আর আমি নদীকে বলছি
তোমার মরা খাতে পরী নাচাও
হাঃ হাঃ আমি নদীকে বলছি
থরায় মাটি ফেটে পড়ছে
আর আমি হাঁটছি রক্তপায়ে
যদি দু-একটা বীজ ভিজে ওঠে
হাঃ হাঃ যদি দু-একটা
নিসর্গের বুকে আমি হাড় বাজাচ্ছি
আর মাদারির মতো হেঁকে বলছি
এই আওয়াজ হয়ে যাবে একমাঠ ধান
ঝিঁ ঝিঁ হুতোম প্যাঁচা শেয়াল
আস্থায়ী আর অন্তরায় রাত ধুনছে
আমি বলছি একমাঠ ধান
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ


.          ********************                                                    
উপরে


মিলনসাগর