. বাসনগুলো এক সময়ে জলতরঙ্গের মতো বেজে উঠবে | তার ঢেউ দেয়াল ছাপিয়ে পৃথিবাকে ঘিরে ফেলবে | তখন হয়তো এই ঘরের চিহ্ন পাওয়া যাবে না | তবু আশ্চর্যকে জেনো | জেনো এইখানেই আমার হাহাকারের বুকে গাঢ় গুঞ্জন ছিল |
. আমার বদ্ধ বাতাসে যে-গান পাষাণ হ'য়ে থাকে তা ভেঙে ছিটিয়ে পড়ুক, কল্পনার স্বর সমুদ্র হোক এই আশায় আমি অথই | অবিশ্রাম অনুরণনে পাঁচিল ধ্ব'সে যাবে, কলরোলে ভিটেমাটি তলাবে | তখন ঘূর্ণির পাকে বুঝে নিয়ো কাথায় সেই বিন্দু যেখান থেকে জীবন ছড়িয়ে পড়লো মৃত্যুর গহ্বরে |
. কাঠকুটো আসবাব আবার বন্য হ'য়ে উঠবে | ওরা কচি পাতার ঝিলমিল মুড়ে ঝিমোয়, ভিতরে-ভিতরে কোথায় হারিয়ে থাকে অঙ্কুরের ঝাপটানি | তবু সূর্য ডুবলে আমার চোখে বার-বার ঘনিয়ে আসে বন |
. ওরা আবার বন্য হ'য়ে উঠবে | আমার ছাত দেয়াল মেঝের শূণ্যতা ভ'রে অরণ্য জাগবে | সবুজের প্রতাপে এই শুকনো কাটামো পূর্ণ হবে | সেই ধ্বংসের গহনে খুঁজে নিও আমার বসতি, সেখানে পোড়ামাটি-ইটের ভিতরে রস ছিলো অমৃতের মতো |
সহজ বলার ছিল যেমন নিশ্বাস | ক্ষেতে মাঠে জল পড়তে অঙ্কুরেরা হেসে মাথা নাড়ল একসঙ্গে, আমাকে আকাশ দেখাল, দেখাল মেঘ, নীল পরিবেশে যখন বাতাসে ডানা মেলে বুনো হাঁস উড়ে গেল, টুপটাপ শান্তিকণা শেষে আমার মুখেও লাগল, ঘাসজমি জুড়ে ঘন্টা বাজল শিশুদের, খেলার দুপুরে,
তখনই আমার কথা উত্স থেকে জেগে বৃষ্টি রোদ অপাপের সমান্তরালের পথ ধরল | আমি সেই নদীস্রোতোবেগে আমাকে ঢাললাম অমনি টের পেলাম বেড় চোরা পাথরের | এক কুটিল প্রণালী কথা ভাঙে, বুক খেলে বাঁকা চতুরালি |
রিকশার চাকা দুটো ঘুরতে-ঘুরতে এইখানটাতে এসে দাঁড়ায় | আমার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করে | যে-লোকটা চালায় একদিনও তার কামাই নেই, এই বিষম ঠাণ্ডাতেও না | এমনিতে তাকে দেখে আমার চেনবার কথা নয়, কারণ তার মুখটা রোজই বদলায় | চাকাদুটো ঘোরা থেকে চিনি |
সন্ধের পর ছেলে-বউকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে | কোন্ মহল্লা থেকে তা আমার কাছে পরিষ্কার নয় | শুধু এইটুকু বুঝতে পারি, ভুতুড়ে আলোগুলো পার হয়ে গেলে একটা যে-প্রকাণ্ড শীতের রাত পড়ে, তার ওপারে সে থাকে | যেথানেই থাকুক কিছু আসে যায় না | আমার বাড়িটা যে তার চেনা, আমাদের দুজনের পক্ষে এটাই বড় কথা |
শাতের ঢেউ যে-সব রাস্তায় আছড়ে পড়ে সেই সব রাস্তা দিয়ে রিকশা চড়ে আমি অনেকবার গিয়েছি | তখন মানুষটার মধ্যে আগুন গনগন করতে দেখেছি, যেন তার অস্থিমজ্জা জ্বলছে | আমার গায়ে সেই আঁচ এসে লেগেছে | তার সুতির ফতুয়াটা যখন তীব্রভাবে উড়তে থাকে এবং আমার ভয় হয় আমার গরম জামাকাপড় বুঝি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে | কিন্তু না, প্রত্যেকবারই সে ভুতুড়ে আলোগুলোর ভিকর দিয়ে আমাকে আবার এখানে ঠিকমতো পোঁছে দিয়েছে | এমন কি, তার বাড়িটা যে একসময় খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিল, এ অনুভূতিটাও আর লেশমাত্র থাকেনি | আজও সে আমাকে নিয়ে শীতের রাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং নিরাপদে আবার ফিরিয়ে আনবে |
খুব সম্ভব কোনো একদিন সে আর আসতে পারবে না | ভেতরের আগুনটা নিভে গিয়ে সে ঠাণ্ডায় জমে পাথর হয়ে কোথাও পড়ে থাকবে | কিন্তু তা বলে রিকশার চাকা দুটো তো মাটিতে গেড়ে যাবে না | তারা আবার ঘুরবে এবং তাই থেকে আমি বুঝব সেই রিকশাওয়ালা হাজির হয়েছে, এখন যেমন বুঝি | এটাই আমার কাছে স্বস্তি |