কবি বিহারীলাল চক্রবর্ত্তীর কবিতা যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে। |
যোগেন্দ্রবালা ("সাধের আসন" --- তৃতীয় সর্গ, ১৮৮৮) (নির্বাচিত স্তবক) ১ অধরে ধরে না হাস, আঁধার কেশের রাশ, করুণ কিরণে আর্দ্র বিকসিত বিলোচন ; প্রফুল্ল কপোলে আসি উথলে আনন্দ-রাশি, যোগানন্দময়ী-তনু, যোগীন্দ্রের ধ্যানধন | ২ পীনোন্নত পয়োধরে কোটি চন্দ্র শোভা হরে, বিন্দু বিন্দু ক্ষীর ক্ষরে, স্নেহে স্নিগ্ধ চরাচর, আদ্রিয়া হিমাদ্রিমালা সুরধুনী করে খেলা, সুধাকরে সুধা ক্ষরে, পিয়া প্রাণে বাঁচে প্রাণী, অমর, দানব, নর | ৩ তরল দর্পণ-ভাস, দশ দিক সুপ্রকাশ ; দশ দিকে কার সব হাসিমাখা প্রতিমা ; রাজে যেন ইন্দ্রধনু! তোমার মতন তনু, তোমার মতন কেশ, তোমার মতন বেশ, তোমারি মতন দেবি! আনন-মধুরিমা | তোমারি এ রূপরাশি আকাশে বেড়ায় ভাসি ; তোমার কিরণ-জাল ভূবনে করেছে আলো, গ্রহ তারা শশী রবি, তোমারি চিহ্নিত ছবি ; আপন লাবণ্যে তুমি বিভাসিত আপনি | মোহিত হইয়া দেখে ভক্তিভাবে ধরণী | ৪ অধরে ধরে না হাস, মনে ওঠে কি উল্লাস? অখিল ব্রহ্মাণ্ড বুঝি উদয় হয়েছে প্রাণে? ক্ষণে ক্ষণে অভিনব মহান মাধুর্য্য তব! কি যেন মহান গীতি বাজিয়াছে ঐকতানে | ৫ অমৃত-সাগরে হাসে ঘুমন্ত জোছনা জল, আহা কি হৃদয়হারী বায়ু বহে অবিরল! ফুলের বেলার কোলে সুধীর লহরী দোলে, অতি দূর দৃষ্টিপথে অতি ধীর ঢল ঢল ; ঈষৎ দোদুল্যমান প্রফুল্ল কমল-বনে কে তুমি ত্রিদিবরাণী বিহর আপন মনে? ৬ কে এঁরা সঙ্গিনী সব? লোচনের নবোত্সব, উদার অমৃত-জ্যোতি, সুধাংশু-কলিত কায়া, বেড়িয়ে বেড়ায় যেন তোমার প্রাণের ছায়া | ৭ আকুল কুন্তলজাল, আননে অপূর্ব আলো, নয়ন করুণাসিন্ধু, মূর্ত্তিমতী দয়াময়ী ; বেড়িয়ে বেড়ায় যেন তোমারি প্রাণের ছায়া | ৮ অমৃত-সাগরে ভাসি, মৃদুমন্দ হাসি হাসি আদরে আদরে তুলি' নীল নলিনী আনি, মিটায়ে মনের সাধ সাজাইছে পা দুখানি | ৯ আমিও এসেছি বালা! প্রেমের প্রফুল্ল-মালা, সৌরভে আকুল হয়ে পারিনি পরাতে গায়ে ; সজল নয়নে শুধু চেয়ে আছি রাঙা পায়ে | . *************** উপরে মিলনসাগর |
বিষাদ ("সারদামঙ্গল" --- দ্বিতীয় সর্গ, ১৮৭৯) (নির্বাচিত স্তবক) ৯ কেন গো ধরণী-রাণী বিরস বদনখানি ? কেন গো বিষন্ন তুমি উদার আকাশ? কেন প্রিয় তরুলতা, ডেকে নাহি কহ কথা? কেন রে হৃদয় --- কেন শ্মশান উদাস? ১০ কোন সুখ নাই মনে, সব গেছে তার সনে ; খোলো হে অমরগণ স্বরগের দ্বার! বল, কোন পদ্মবনে লুকায়েছ সংগোপনে?--- দেখিব কোখায় আছে সারদা আমার! ১১ অয়ি, একি, কেন কেন, বিষন্ন হইলে হেন? আনত আনন-শশী, আনত নয়ন, অধরে মন্থরে আসি কপোলে মিলায় হাসি, থর থর ওষ্ঠাধর, স্ফোরে না বচন | ১২ তেমন অরুণ-রেখা কেন কুহেলিকা ঢাকা, প্রভাত-প্রতিমা আজি কেন গো মলিন? বল, বল, চন্দ্রাননে, কে ব্যথা দিয়েছে মনে, কে এমন --- কে এমন হৃদয়-বিহীন! ১৩ বুঝিলাম অনুমানে, করুণা কটাক্ষ-দানে চাবে না আমার পানে, কবেও না কথা! কেন যে কবে না, হায়, হৃদয় জানিতে চায়, সরমে কি বাধে বাণী, মরমে বা বাজে ব্যথা! ১৪ যদি মর্ম-ব্যথা নয়, কেন অশ্রুধারা বয়? দেববালা ছল-কলা জানে না কখন ; সরল মধুর প্রাণ, সতত মুখেতে গান, আপন বীণার তানে আপনি মগন! ১৫ অয়ি, হা, সরলা সতী সত্যরূপা সরস্বতী! চির-অনুরক্ত ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি পদ-পদ্মাসন কাছে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে--- কি করিবে, কোথা যাবে, দাও অনুমতি! স্বরগ-কুসুম-মালা, নরক-জ্বলন-জ্বালা, ধরিবে প্রফুল্লমুখে মস্তকে সকলি | তব আজ্ঞা সুমঙ্গল, যাই সব রসাতল, চাইনে এ বরমালা, এ অমরাবতী! ১৬ নরকে নারকী-দলে মিশিলে মনের বলে, পরাণ কাতর হ'লে ডাকিব তোমায় ; যেন দেবী, সেইক্ষণে --- অভাগারে পড়ে মনে, ঠেল না চরণে, দেখো, ভুল না আমায়! ১৭ অহহ! কিসের তরে অভাগা নরকে পড়ে, মরু --- মরু-মরুময় জীবন লহরী! এ বিরস মরুভূমে--- সকলি আচ্ছন্ন ধূমে, কোথাও একটিও আর নাহি ফোটে ফুল! কভু মরীচিকা মাঝে বিচিত্র কুসুম রাজে, উঃ! কি বিষম বাজে, যেই ভাঙে ভুল! এত যে যন্ত্রণা-জ্বালা, অবমান, অবহেলা তবু কেন প্রাণ টানে! কি করি, কি করি! . *************** উপরে মিলনসাগর |