দাশরথি রায়
মাঘ ১২১২ ~ ২রা কার্তিক ১২৬৪ বঙ্গাব্দ
জানুয়ারী / ফেব্রুয়ারী ১৮০৬ ~ ১৭ অক্টোবর ১৮৫৭
কবি দাশরথি রায় বা দাশু রায় - বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঁচালীকার ছিলেন |  তিনি জন্ম গ্রহণ
করেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কাটোয়া মহকুমার করজ গ্রাম অঞ্চলের বাঁধমুড়া গ্রামে |
পিতা দেবীপ্রসাদ রায়, মাতা শ্রীমতি দেবী |

ছেলেবেলায় তিনি বাঁধমুড়ার নিকটস্থ পীলা গ্রামে তাঁর মামা রামজীবন চক্রবর্তীর বাড়ীতে থাকতেন |  
সেখানেই তিনি গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষালাভ করেছিলেন | অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পাঠশালার "সরদার
পড়ুয়া" নামে অবিহিত হয়েছিলেন | পাঠশালা থেকেই তাঁর ভবিষ্যতে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঁচালীকার
হবার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল! একবার গুরুমশায়ের কাছে মার খাওয়ার পর প্রতিবাদ করেন পাঁচালীতে ---

.                        "দয়াকর গুরুমশায় মোর পানে,
.                        অত প্রহারে বুঝি বাঁচিব না প্রাণে |"

পাঠশালার পাঠ শেষ করে দাশরথি রায় পীলা গ্রামের কাছে বহরা গ্রামের হরকিশোর ভট্টাচার্যের কাছে
ইংরেজী শিক্ষা লাভ করেন | সেই সময় পীলা গ্রামে, সরকারী রেশম কুঠীর কাছে স্বামী পরিত্যক্তা অক্ষয়া
বায়তিনি বা পাটনী নামে এক সধবা মহিলা বাস করতেন | তিনি আকা বা আকাবাঈ নামে যথেষ্ট জনপ্রিয়
ছিলেন | তাঁর একটি কবিগানের দল ছিল (
এই নারী কবিয়াল এর রচিত কোনো কবিগান আমরা এখনো হাতে
পাই নি
) |  দাশরথি সেই দলে যোগ দেন এবং অল্পকালের মধ্যেই টপ্পা এবং কবিগান রচনায় পারদর্শী হয়ে
ওঠেন | অক্ষয়ার দলে যোগ দিয়েই দাশরথী নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছিলেন | মামা রামজীবন
ভাগনের এই কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে তাঁকে ৩ টাকা মাইনেতে অনন্তপুর কুঠুরিয়া গ্রামের একটি নীলকুঠিতে
কেরাণীর চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন | কিন্তু দাশরথিকে তাঁর মামাই সেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন
কিছুদিনের মধ্যেই, কারণ তিনি গোপনে অক্ষয়া কবিয়ালের দলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন | চাকরি
যাবার পর তিনি আবার অক্ষয়া কবিয়ালের দলে প্রকাশ্যে যোগ দেন |

ক্রমশঃ কবিগানের চাপান-উতোরের মধ্যে বিপক্ষের কবিয়ালরা অক্ষয়া ও দাশরথিকে নিয়ে কুৎসিতভাবে
আসরে ছড়া কাটতে লাগলেন | এমন কি পিতৃ-মাতৃকূলও সেই আক্রমণ থেকে রেহাই পেল না | এমনই এক
কবির লড়াইয়ে  কবিয়াল পুরুষোত্তম দাশের চরম আঘাতের পর দাশরথি রায় অক্ষয়ার দল ছেড়ে, মাত্র ৩০
বছর বয়সে, নিজের দল গড়লেন ১৮৩৬ সালে |

অল্পকালের মধ্যেই সমগ্র বাংলায় দাশু রায়, বলিষ্ঠ পাঁচালীকার হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন |  
তিনি ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য প্রভাবিত নতুন বাংলা সাহিত্য থেকে সাতন্ত্র্য রক্ষা করে পুরোনো পাঁচালীকে
এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন | দাশরথি রায় প্রথাগতভাবে লেখাপড়া শিখেছিলেন কি না সে বিষয়ে পণ্ডিতদের
মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে | তবে সনাতন ধর্মীয় এবং লৌকিক সাহিত্যে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ছিল এ কথা
অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই | তিনি রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত, হরিবংশ, ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ,
বিষ্ণুপুরাণ, রাধাতন্ত্র, চৈতন্যচরিতামৃতের কাহিনি পাঁচালীর ছন্দে লিপিবদ্ধ করেছিলেন | এ ছাড়া তিনি
সমকালীন সামাজিক ঘটনাবলি, যেমন বিধবা বিবাহ, অবলম্বনেও পাঁচালী রচনা করেছিলেন | আজও গ্রাম
বাংলার অনেক স্থানে লোকের মুখে দাশু রায়ের পাঁচালী গান শোনা যায় |  ক্ষিপ্র চঞ্চল ছন্দ, অনুপ্রাসময়
বাকপটুত্ব তাঁর প্রসিদ্ধির মূলে | তিনি  
কবি নবীনচন্দ্র সেন-এর কবিতার মুগ্ধ পাঠক ছিলেন তা তিনি তাঁর
রচনায় জানিয়ে গেছেন |

দাশরথি রায়ের পাঁচালী গান প্রথম গ্রন্থাকারে  প্রকাশের উদ্যোগ তিনি নিজেই নিয়েছিলেন |  কলকাতার
জাতীয় গ্রন্থাগারে তাঁর নিজের প্রকাশিত একটি পাঁচালী-গ্রন্থ পাওয়া যায়, যার প্রকাশ কাল ১২৫৫ বঙ্গাব্দ বা
১৮৪৮ খৃষ্টাব্দ | তাঁর মৃত্যুর পর অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা তাঁর পাঁচালী প্রকাশ করেন |

বাংলার পণ্ডিত সমাজও দাশরথি রায় কে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন |
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, "যিনি
বাঙ্গলা ভাষায় সম্যক্ রূপ ব্যুত্পন্ন হইতে বাসনা করেন, তিনি যত্নপূর্বক আদ্যোপান্ত দাশু রায়ের পাঁচালী পাঠ
করুন |" কলকাতার জমিদার রাধাকান্ত দেব দাশরথি কে সম্মান ও সমাদর করতেন | বিখ্যাত পণ্ডিত
রাখালদাস ন্যায়রত্ন ভট্টাচার্য দাশরথি রায়ের পাঁচালীর সম্পাদক হরিমোহন মুখোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন,
"দাশরথি রায়ের কবিত্বে আমি চিরদিন মুগ্ধ" | দাশরথির গ্রামের ভৈরব বাবু একদা তাঁকে কবির দল থেকে
আলাদা করতে না পেরে বলেছিলেন যে তিনি আর দাশরথির
মুখ দর্শন করবেন না | তিনিও পরে আড়াল
থেকে দাশু রায়ের পাঁচালী শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একজোড়া শাল উপহার দিয়েছিলেন | দাশরথিও তাঁর স্বভাব
সিদ্ধ মহানুভবতার সাথে বলেছিলেন,
---  "আজ আমার জীবন ও সঙ্গীত সার্থক হইল, আমিও কৃতার্থম্মন্য
হইলাম |"

ডঃ হরিপদ চক্রবর্তীর মতে কলকাতার ইংরেজী প্রভাবযুক্ত স্থানের চেয়ে গ্রাম বাংলার ইংরেজী প্রভাব মুক্ত
স্থানে তিনি অধিকতর জনপ্রিয় হয়েছিলেন |

কাশিম বাজার জমিদার বাড়ীতে দুর্গোত্সবে পাঁচালীগান গেয়ে বাড়ী ফেরার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন
এবং তার অল্প কয়েক দিন পর পরলোক গমন করেন |


.                                    --- উত্স:   
ডঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর রায় সম্পাদিত "দাশু রায়ের পাঁচালী" ১৯৯৭  
.                                                 
দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত "বাঙালীর গান" ১৯০৫  
.                                                 
ডঃ শিশির কুমার দাশ, সম্পাদিত "সংসদ সাহিত্য সঙ্গী" ২০০৩


আমাদের ঠিকানা :
srimilansengupta@yahoo.co.in    


.
আমাদের কাছে
কবি দাশরথি রায়ের কোনো ছবি নেই |
একটি ছবি আমাদের কাছে পাঠালে
আমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে  
প্রেরকের নাম এইখানে ছবির সাখে
উল্লেখ করবো |
আমাদের ঠিকানা-
srimilansengupta@yahoo.co.in