কবি দাশরথি রায় বা দাশু রায় - বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঁচালীকার ছিলেন | তিনি জন্ম গ্রহণ করেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কাটোয়া মহকুমার করজ গ্রাম অঞ্চলের বাঁধমুড়া গ্রামে | পিতা দেবীপ্রসাদ রায়, মাতা শ্রীমতি দেবী |
ছেলেবেলায় তিনি বাঁধমুড়ার নিকটস্থ পীলা গ্রামে তাঁর মামা রামজীবন চক্রবর্তীর বাড়ীতে থাকতেন | সেখানেই তিনি গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষালাভ করেছিলেন | অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পাঠশালার "সরদার পড়ুয়া" নামে অবিহিত হয়েছিলেন | পাঠশালা থেকেই তাঁর ভবিষ্যতে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঁচালীকার হবার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল! একবার গুরুমশায়ের কাছে মার খাওয়ার পর প্রতিবাদ করেন পাঁচালীতে ---
পাঠশালার পাঠ শেষ করে দাশরথি রায় পীলা গ্রামের কাছে বহরা গ্রামের হরকিশোর ভট্টাচার্যের কাছে ইংরেজী শিক্ষা লাভ করেন | সেই সময় পীলা গ্রামে, সরকারী রেশম কুঠীর কাছে স্বামী পরিত্যক্তা অক্ষয়া বায়তিনি বা পাটনী নামে এক সধবা মহিলা বাস করতেন | তিনি আকা বা আকাবাঈ নামে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন | তাঁর একটি কবিগানের দল ছিল (এই নারী কবিয়াল এর রচিত কোনো কবিগান আমরা এখনো হাতে পাই নি ) | দাশরথি সেই দলে যোগ দেন এবং অল্পকালের মধ্যেই টপ্পা এবং কবিগান রচনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন | অক্ষয়ার দলে যোগ দিয়েই দাশরথী নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছিলেন | মামা রামজীবন ভাগনের এই কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে তাঁকে ৩ টাকা মাইনেতে অনন্তপুর কুঠুরিয়া গ্রামের একটি নীলকুঠিতে কেরাণীর চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন | কিন্তু দাশরথিকে তাঁর মামাই সেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন কিছুদিনের মধ্যেই, কারণ তিনি গোপনে অক্ষয়া কবিয়ালের দলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন | চাকরি যাবার পর তিনি আবার অক্ষয়া কবিয়ালের দলে প্রকাশ্যে যোগ দেন |
ক্রমশঃ কবিগানের চাপান-উতোরের মধ্যে বিপক্ষের কবিয়ালরা অক্ষয়া ও দাশরথিকে নিয়ে কুৎসিতভাবে আসরে ছড়া কাটতে লাগলেন | এমন কি পিতৃ-মাতৃকূলও সেই আক্রমণ থেকে রেহাই পেল না | এমনই এক কবির লড়াইয়ে কবিয়াল পুরুষোত্তম দাশের চরম আঘাতের পর দাশরথি রায় অক্ষয়ার দল ছেড়ে, মাত্র ৩০ বছর বয়সে, নিজের দল গড়লেন ১৮৩৬ সালে |
অল্পকালের মধ্যেই সমগ্র বাংলায় দাশু রায়, বলিষ্ঠ পাঁচালীকার হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন | তিনি ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য প্রভাবিত নতুন বাংলা সাহিত্য থেকে সাতন্ত্র্য রক্ষা করে পুরোনো পাঁচালীকে এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন | দাশরথি রায় প্রথাগতভাবে লেখাপড়া শিখেছিলেন কি না সে বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে | তবে সনাতন ধর্মীয় এবং লৌকিক সাহিত্যে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ছিল এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই | তিনি রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত, হরিবংশ, ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, রাধাতন্ত্র, চৈতন্যচরিতামৃতের কাহিনি পাঁচালীর ছন্দে লিপিবদ্ধ করেছিলেন | এ ছাড়া তিনি সমকালীন সামাজিক ঘটনাবলি, যেমন বিধবা বিবাহ, অবলম্বনেও পাঁচালী রচনা করেছিলেন | আজও গ্রাম বাংলার অনেক স্থানে লোকের মুখে দাশু রায়ের পাঁচালী গান শোনা যায় | ক্ষিপ্র চঞ্চল ছন্দ, অনুপ্রাসময় বাকপটুত্ব তাঁর প্রসিদ্ধির মূলে | তিনি কবি নবীনচন্দ্র সেন-এর কবিতার মুগ্ধ পাঠক ছিলেন তা তিনি তাঁর রচনায় জানিয়ে গেছেন |
দাশরথি রায়ের পাঁচালী গান প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ তিনি নিজেই নিয়েছিলেন | কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে তাঁর নিজের প্রকাশিত একটি পাঁচালী-গ্রন্থ পাওয়া যায়, যার প্রকাশ কাল ১২৫৫ বঙ্গাব্দ বা ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দ | তাঁর মৃত্যুর পর অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা তাঁর পাঁচালী প্রকাশ করেন |
বাংলার পণ্ডিত সমাজও দাশরথি রায় কে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন | বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, "যিনি বাঙ্গলা ভাষায় সম্যক্ রূপ ব্যুত্পন্ন হইতে বাসনা করেন, তিনি যত্নপূর্বক আদ্যোপান্ত দাশু রায়ের পাঁচালী পাঠ করুন |" কলকাতার জমিদার রাধাকান্ত দেব দাশরথি কে সম্মান ও সমাদর করতেন | বিখ্যাত পণ্ডিত রাখালদাস ন্যায়রত্ন ভট্টাচার্য দাশরথি রায়ের পাঁচালীর সম্পাদক হরিমোহন মুখোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, "দাশরথি রায়ের কবিত্বে আমি চিরদিন মুগ্ধ" | দাশরথির গ্রামের ভৈরব বাবু একদা তাঁকে কবির দল থেকে আলাদা করতে না পেরে বলেছিলেন যে তিনি আর দাশরথির মুখ দর্শন করবেন না | তিনিও পরে আড়াল থেকে দাশু রায়ের পাঁচালী শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একজোড়া শাল উপহার দিয়েছিলেন | দাশরথিও তাঁর স্বভাব সিদ্ধ মহানুভবতার সাথে বলেছিলেন, --- "আজ আমার জীবন ও সঙ্গীত সার্থক হইল, আমিও কৃতার্থম্মন্য হইলাম |"
ডঃ হরিপদ চক্রবর্তীর মতে কলকাতার ইংরেজী প্রভাবযুক্ত স্থানের চেয়ে গ্রাম বাংলার ইংরেজী প্রভাব মুক্ত স্থানে তিনি অধিকতর জনপ্রিয় হয়েছিলেন |
কাশিম বাজার জমিদার বাড়ীতে দুর্গোত্সবে পাঁচালীগান গেয়ে বাড়ী ফেরার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার অল্প কয়েক দিন পর পরলোক গমন করেন |
আমাদের কাছে কবি দাশরথি রায়ের কোনো ছবি নেই | একটি ছবি আমাদের কাছে পাঠালে আমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে প্রেরকের নাম এইখানে ছবির সাখে উল্লেখ করবো | আমাদের ঠিকানা- srimilansengupta@yahoo.co.in