কবি দুর্গাদাস লাহিড়ি - জন্ম গ্রহণ করেন বর্ধমান জেলার চক-ব্রাহ্মণগড়িয়া গ্রামের বারেন্দ্র শ্রেণীর উচ্চ কুলীন কিন্তু দরিদ্র ব্রাহ্মণবংশে | মাতা ইচ্ছাময়ী, পিতা সুধারাম লাহিড়ির প্রথম পক্ষের স্ত্রী ছিলেন | দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নাম পদ্মমণি | শৈশবে দুর্গাদাস তাঁর মায়ের সঙ্গে গ্রামেই থাকতেন | তাঁর পিতা পদ্মমণিকে নিয়ে উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়ায় সামান্য উপার্জনে বসবাস করতেন | অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে পদ্মমণিকে কোন এক সদাশয় ব্যক্তির বাড়ীতে রান্নার কাজ নিতে হয়েছিল |
১৮৭৮ সালে দুর্গাদাসের ১৫ বছর বয়সে, মা ইচ্ছাময়ী বাসন বন্ধক রেখে ১০-১৫ টাকা সংগ্রহ করে ছেলেকে কলকাতায় তাঁর পিতার কাছে পাঠিয়ে দেন শিক্ষালাভের আশায় | বোধহয় আর্থিক কারণেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে দুর্গাদাসের বিবাহ সম্পন্ন করা হয়, হাওড়ার সাঁতরাগাছি গ্রামের বিহারীলাল চৌধুরীর কন্যা রাধারঙ্গিণীর সাথে |
কলকাতার শীলস ফ্রি কলেজ থকে বহুবার চেষ্টার পর এনট্রান্স পাশ করে মেট্রপলিটান কলেজ (অধুনা বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্ত্তি হন | তিনি এফ.এ. বা বি.এ. পাশ করেছিলেন কি না জানা যায় না | কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি "সাধারণী", "সোমপ্রকাশ", "নববিভাকর", "সুলভ সমাচার", "বঙ্গবাসী", "জন্মভূমি" প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় গল্প কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করেন | জীবনধারণের জন্য শালকিয়ার ক্যালেডোনিয়া প্রেসে প্রুফ রিডারের কাজে বহাল হন সামান্য বেতনে | ১৮৮৬ সালে হাটখোলা থেকে প্রকাশিত "বঙ্গরবি" পত্রিকায় সম্পাদনার কাজে তাঁর হাতেখড়ি হয় এবং ১৮৮৭ সাল থেকে তিনি "অনুসন্ধান" পত্রিকার সম্পাদনা করেন | ১৯০৬ সালে তিনি "বঙ্গবাসী" পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন | আরও পরে "সাহিত্য সংবাদ" ও "স্বদেশী" পত্রিকা সম্পাদনা করেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন |
দেশ বিদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি স্বদেশ ভাবনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন | তখন ইংরেজ শাসক ভারতবর্ষ থেকে খাদ্যদ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করে মুনাফা লাভের চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য তিনি "অন্নরক্ষিণী সভা" স্থাপন করে সারা দেশে সাড়া ফেলে দেন, যার ফলে ইংরেজ সরকার রপ্তানিপ্রথা কিছুটা সংযত করতে বাধ্য হন | বরিশাল স্বাদেশিক সম্মেলনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকুমার মিত্র, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার সঙ্গে তিনিও পুলিশের দ্বারা নিগৃহিত হয়েছিলেন | কলকাতায় ফিরে এসে কলেজ স্কোয়ারে বিশাল জনসভায় সরকারী বর্বরতার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন |
তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল হাওড়া জেলার গ্রন্থাগার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া | হাওড়ার একদা- বিখ্যাত ডিউক পাবলিক লাইব্রেরির তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোগী | তিনি হাওড়ায় একাধিক সাহিত্য সম্মেলন করেছিলেন যার একটির সভাপতি ছিলে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় | সেই উপলক্ষে হাওড়া জেলা কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজনও করেছিলেন |
তাঁর রচনা সম্ভার বিশাল |
"রাণী ভবানী" (১৯১০), "লক্ষণ সেন" (১৯১০), "রাজা রামকৃষ্ণ" (১৯১১), "মণি বেগম" (১৯২০) প্রভৃতি তাঁর ঐতিহাসিক জীবনী উপন্যাস, ছোট গল্পের সংকলন "নবরত্ন" (১৯১৭), সাত খণ্ডে "পৃথিবীর ইতিহাস" (১৯০৯- ১৯), "সুবর্ণ বলয়" নামক সামাজিক উপন্যাস, আট খণ্ডে প্রকাশিত "পৃথিবীর ইতিহাস" (১৯১০-১৯), দু খণ্ডে প্রকাশিত "স্বাধীনতার ইতিহাস" (১৯০৯), উনচল্লিশ খণ্ডে প্রকাশিত চতুর্বেদের মূলভাষ্য, অনুবাদ ও ব্যাখ্যা (১৬ খণ্ডে ঋগ্ বেদ, ২ খণ্ডে শুক্ল যজুর্বেদ, ৭ খণ্ডে কৃষ্ণ যজুর্বেদ, ৯ খণ্ডে সামবেদ এবং ৫ খণ্ডে সমগ্র বেদের নির্যাস জ্ঞানবাদ) |
এর উপর রয়েছে তাঁর জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে স্মরণীয় কীর্তি ----- দুশো সাতাশ জন গীতিকারের (সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সমেত) লেখা, পাঁচ হাজার ছশো তেষট্টিটি গানের সংগ্রহ "বাঙালীর গান" (১৯০৫), যা কিনা বাংলা গীতি সংকলনের ধারায় সর্ববৃহৎ গ্রন্থ | এই গ্রন্থে তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে লিখেছেন --- "ইঁহার লেখনীপ্রসূত অমূল্য রত্নরাজিতে আজি সাহিত্যভাণ্ডার উজ্জ্বলিকৃত" |
এ ছাড়াও আছে কানিংহামের "The History of Sikhs" গ্রন্থের বঙ্গানুবাদের সম্পাদনা (১৯০৭), টেনিসনের "Enoch Arden" এর পদ্যানুবাদ (১৯১১) |
তাঁর রচনায় আদর্শ ও প্রচারধর্ম প্রাধান্য পাওয়ায় সাহিত্যরস ক্ষুণ্ণ হয়েছে | বঙ্গবাসী পত্রিকা ও গোষ্ঠির নায়ক যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর রক্ষণশীল মতামতের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন | তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন | আধুনিক স্ত্রীশিক্ষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল না | অসবর্ণ বিবাহ কে তিনি হানিকর বলে নিন্দা করেছিলেন | অস্পৃশ্যতা নিবারণ আন্দোলন তাঁর মনঃপূত হয় নি | ইচ্ছার ঐকান্তিকতা সত্ত্বেও প্রাচীন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন বলে তাঁর গল্প-উপন্যাস-কবিতা কোনোটাই একালের পাঠকের দরবারে এসে পৌঁছায় নি |
তবুও তিনি বাংলা সাহিত্যে বরেণ্য, কারণ তাঁর মত মানুষের জন্যই আজ আমরা এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছি |
. --- উত্স: দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত "বাঙালীর গান" ১৯০৫ . অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সর্বানন্দ চৌধুরীর ভূমিকা, ২০০১ সালে . পঃবঃ বাংলা একাডেমি কর্তৃক "বাঙালির গান"-এর পুনঃপ্রকাশ . ডঃ শিশির কুমার দাশ, সংসদ সাহিত্য সঙ্গী ২০০৩