কবি হরিশচন্দ্র নিয়োগীর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
১।   নিপীড়ণ        
২।   
হাসিও না     
৩।   
প্রেম-পূর্ণিমা   
 
নিপীড়ন
("মালতীমালা" থেকে নেওয়া, ১৮৯৯)

                           ১
জড়িত কনক-লতা কনকের ফুলে
.              কেন নীল "বেনারসী" প'রেছ, সুন্দরা?
দীপ্ত-মরকত-কণ্ঠী শ্রীকণ্ঠের মূলে,
.               বাঁধিয়াছ এত সাধে কেন, রূপেশ্বরি?

                           
                           ২
মুকিতার মালা-রূপে উরস উপরে,
.                সপ্ত সৌদামিনী-লতা করে ঝলমল ;
কোমল মৃণাল-ভুজ বেড়িয়া প্রসরে,
.                হেমে মরকত-হীরা চমকে চঞ্চল |


                           ৩
শ্রুতি-মূলে দুলে কাল-মাণিকের দুল,
.                চিকুরে মুকুতা-পাঁতি ঝলে প্রতিভায় ;
অলকে কুঞ্চিয়া কত বিগলিত চুল,
.                কৃশ-কটি বাঁধিয়াছ হেম-মেখলায় |


                           ৪
এত সাজে সাজিয়াছ কেন রূপেশ্বরি?
.                 কোমলাঙ্গ রত্ন-মণি-কনক-পীড়ণে---
কেন আজ রাখিয়াছ নিপীড়িত করি,
.                 ইহাতে কি বাড়িয়াছে শোভা, মনোরমে?


                           ৫
শরদের মনোহর পূর্ণ শশধরে,
.                  সাজাইলে মণি রত্ন নানা আভরণে,
বাড়িবে কি শোভা তার রত্ন-রাজি প'রে?
.                   হীরক যে ম্লান হয় জড়িলে কাঞ্চনে!


                           ৬
তবে কেন পড়িয়াছ বল থরে থরে,
.                    হেম-রত্ন-বিজড়িত নানা আভরণ ;
পূর্ণ-শরদিন্দু লাজে তব কলেবরে,
.                    হেম-রত্নে হেন চন্দ্রে কেন নিপীড়ন!


                           ৭
পর, দেবি, শ্বেত-সূক্ষ্ম কোমল বসন,
.                     খুলে ফেল' রত্ন-ময় হেম-অলঙ্কার ;
এ নির্দোষ-রূপে নহে মণি সুশোভন,
.                      বিদ্রূপ, --- যে চারু কেশে পাঁতি মুকুতার |


.                    ***************                                              
পরে


মিলনসাগর
হাসিও না
("বিনোদমালা" থেকে নেওয়া, ১৮৭৮)

                            ১
হাসিও না, হাসিও না, ইন্দু-নিভাননে!
.                তুলো না শেফালি-হাসি মধুর অধরে,
ও মধুর হাসি আজি সহে না নয়নে,
.                নেহারি ও মৃদুহাসি হৃদয় বিদরে!


                            ২
জান কি, জীবনাধিকে! মরমে আমার---
.                কি অনল জ্বলিতেছে দিবস-যামিনী?
সেই হুতাশন, সেই বিষাদের ভার---
.                পার কি বুঝিতে তুমি, বল, সুহাসিনী?


                            ৩
বুঝিও না প্রাণ-জ্বালা, প্রেয়সি আমার!
.                বুঝিলে কি জুড়াইবে জ্বলন্ত-অনল?
পারে কি বারিতে কেহ অনল উদ্গার,
.                করে যবে শতধারে অনল অচল?


                            ৪
সহস্র শিখায় এই দেখ, প্রিয়তমে!
.                পলে পলে, স্তরে স্তরে সেই হুতাশন---
হৃদয়-কাননে সুখ-ব্রততীর সনে,---
.                দগ্ধ করিতেছে এই কুসুম যৌবন |


                            ৫
আজি তুমি দূর-দেশে যাবে, সুহাসিনী!
.                কত দিনে ফিরিবে, কি ফিরিবে না আর?
সেই সঙ্গে উচ্ছসিত প্রেম-তরঙ্গিনী
.                শুখাইছে, দেখ, অই হৃদয়ে আমার |


                            ৬
কালি যবে দিন-মণি পশ্চিম কুণ্ডলে,
.                ডুবিবেন ম্লান-জ্যোতিঃ, বিদায়ী-চুম্বনে
চুম্বি নলিনীর চারু বদন বিমলে,
.                রঞ্জি হেমাম্বুদ-দাম আরক্ত-কিরণে ;


                            ৭
চামেলির গন্ধ সনে বহিলে অনিল,
.                ফুটিলে মল্লিকা বেল সন্ধ্যা-প্রমোদিনী,
কুহরিলে চুত-কুঞ্জে উল্লাসে কোকিল,
.                দেখা দিলে ধরাতলে সন্ধ্যা সৌরভিনী ;


                            ৮
এই সন্ধ্যাকালে যবে আসিব হেথায়,
.                জুড়াইতে ক্ষত হৃদি দিবসের রণে,
দেখিব---চপলে দূরে গঙ্গা বহে যায়,
.                কাঁপে তাল-তরু-শির সুমন্দ পবনে |


                            ৯
দেখিব সকলি অই শ্যাম তরুগণ,
.                গাহিতেছে দধিমুখ শাখায় শাখায় ;
নিরখিব নিরানন্ত রঞ্জিত গগন,
.                ছড়ান জলদ শ্বেত তুলারাশি প্রায় |


                            ১০
দেখিব সকলি, কিন্তু দেখিব না আর---
.                এই সন্ধ্যাকালে সান্ধ্য আকাশের তলে
প্রেম-রশ্মি-স্নাত চারু বদন তোমার ;
.                দেখিব না চন্দ্রকর অশোকের দলে |


                            ১১
যাও তবে, প্রিয়তমে, কি বলিব হায়!
.                জ্বলুক এ হুতাশন, বিদায় এখন ;
ভাগ্যে যদি থাকে দেখা হবে পুনরায়,
.                তা' না হ'লে এই দেখা জন্মের মতন |


                            ১২
বিদায়ের কালে এই ধর উপহার ;
.                বিমল-মুকুতা কত নয়নের জলে
ঝরিতেছে, শতেশ্বরী তাহে অনিবার
.                গাঁথিলাম,---প'রে যাও তোমার ও গলে |


.                    ***************                                              
পরে


মিলনসাগর
প্রেম-পূর্ণিমা
("মালতীমালা" থেকে নেওয়া, ১৮৯৯)

                             ১
কত সুখে আছি দেখ, এসেছি আবার
.                বিজলিতে সৌদামিনী তিমির-মণ্ডলে ;
কত সুখে শুনি পুনঃ ভ্রমর ঝঙ্কার,
.                চুমিয়া ভ্রমরী গায় কমলিনী-দলে |


                             ২
সেই এসেছিনু আজি হ'ল কত দিন,
.                সপ্ত উষা সপ্ত সন্ধ্যা করি অবসান ;
চক্রবালে সপ্ত রবি হইল বিলীন,
.                বিষাদে বিগত আজি সপ্ত দিনমান |


                              ৩
সেই সপ্ত দিবসের অসহ্য উচ্ছ্বাসে,
.                হৃদয়ের সেই পূর্ব জোয়ারের জল,
আজি এই আকুলিত প্রেমের সম্ভাষে
.                মিশাইয়া উছলিল সাগর অতল ;


                              ৪
যে দিন আসিয়াছিনু, সেই দিন প্রিয়ে!
.                দেখেছিনু যামিনীর অর্দ্ধ অবসানে,
রেখেছিল নিশি কাল-অঞ্চলে বাঁধিয়ে,
.                ক্ষয়িত-চন্দ্রমা-মণি বিষন্ন-বয়ানে |


                              ৫
কিন্তু আজি নিশীথিনী কতই পুলকে,
.                ফেলিয়া দিয়াছে সেই মণি পুরাতন ;
নূতন চাঁদের টিপ পরিতে অলকে,
.                কালরূপে সাজিয়াছে কত মনোরম!


                              ৬
কালরূপে কাল চুলে বিনাইল সতী,
.                কাঁচা-হেম-সুগঠিত তারকার ফুল,
জোনাকীর হীরাগুলি দিয়ে রূপবতী,
.                পরিয়াছে শ্রতি-মূলে রতনের দুল |


                              ৭
আজি এই পূর্ণ-অমা,---নাহি চারু-শশী,
.                যামিনী তমসে ভরা দেখ মনোরমে!
জোছনা আলোময়ী নন্দন-রূপসী,
.                নাহি আজি খেলা করে যামিনী সনে |


                              ৮
সচন্দ্র-যামিনী আর অমা-তমিস্রায়,
.                কি প্রভেদ আছে বল, জীবন-সুন্দরী?
কেবল না হেরি আজি চারু চন্দ্রমায়---
.                হাসাইতে ধরণীরে রঙ্গরস করি |


                              ৯
সকলি সমান আছে, দেখ রূপেশ্বরী!
.                সেই এ বিনোদ-কুঞ্জ পূর্ণ সুষমায়,
জড়াইয়া সহকারে বিনোদ-বল্লরী,
.                সেই ফুটি ফুল-পুঞ্জ সৌরভ ছড়ায় |


                              ১০
সকলি সমান যদি আছে অবিকল,
.                তবে কেন বল, এই অমা-যামিনীর,
এই প্রেম-অভিযানে হৃদয়-যুগল,
.                মলিনিবে নিরানন্দ পশি সুগভীর?


                              ১১
না রহিল চারু চন্দ্র নাহি ক্ষতি তায়,
.                নাহি কায চন্দ্রভাসে রঞ্জিয়া ধরণী ;
থাকুক যামিনী সতী মাখি তমসায়,
.                মৃদু করে সুধু তারা জ্বলুক এমনি |


                              ১২
সেই তুমি, সেই আমি, দেখ বিদ্যমান,
.                সেই প্রাণ, সেই মন, সুচারুহাসিনি!
জলোচ্ছ্বাসে সেই পদ্মা বহে খরসান,
.                কি ক্ষতি করিবে তবে অচন্দ্র-যামিনী |


                              ১৩
তবে কেন মৃদু হেসে বলিলে এখনি,
.                "জ্যোত্স্না রাকি নহে, নিশি ভরা অন্ধরকারে ;"
আমি বলিলাম "আজি আমার রজনী ;"
.                উত্তরিলে "নাহি সুখ এ বন-বিহারে |"


                              ১৪
কেন সুখ নাহি বল, শত সুখ আছে,
.                চির সুখ-প্রদায়িনী তুমি প্রেম-রাণি!
শত সুখ পাই যদি থাক তুমি কাছে,
.                নেহারি অমৃত-মাখা ও বদন-খানি |


                              ১৫
মরুভূমি মাঝে কিম্বা বনের ভিতরে,
.                যেখানে থাকিবে কাছে তুমি, বিনোদিনি
অসুখেও স্বর্গ-সুখ পশিবে অন্তরে,
.                সেইখানে প্রবাহিবে সুধা-প্রবাহিণী |


                              ১৬
কত দুঃখে দেখ এই অমা-তমস্বিনী,
.                পঞ্চদশ নিশীথিনী দিবসের পরে,
পূর্ণচন্দ্র-প্রেম-সুখে হ'য়ে সোহাগিনী,
.                রাখে পূর্ণ শশধরে হৃদয়ে আদরে |


                              ১৭
সেই দিনেকের সুখ পাইবার তরে,
.                কত আশা করে থাকে যামিনী সুন্দরী ;
সেই একদিন চাঁদে বক্ষঃস্থলে ধরে,
.                তৃপ্ত করে যত আশা প্রাণের ভিতরি |


                              ১৮
অমাবস্যা আছে ব'লে তাই কি যগতে,
.                পূর্ণিমা-যামিনী-ভাতি এত মনোরম |
অদেখা-বিরহ-জ্বালা সহি কোন মতে,
.                তাই এত আদরের প্রেম-সম্মিলন |


                              ১৯
কি বলিব, অই অমা-যামিনী সম,
.                ছিল এ হৃদয় মম পূর্ণ তমিস্রায় ;
পঞ্চদশ দিবা নিশি করি অতিক্রম,
.                পায় তবে নিশীথিনী পূর্ণ-চন্দ্রমায় ;---


                              ২০
আমার সে অমা নিশা, কিন্তু প্রিয়তমে!
.                পক্ষ পূর্ণ না হইতে---দেখ---অবসান ;
পূর্ণিমা-চন্দ্রমা চারু ভাতিল নয়নে,
.                কি জ্যোত্স্নায় এ হৃদয় আজি ভাসমান!


                              ২১
আশা-পথ চেয়ে যথা থাকে নিশীথিনী,
.                চন্দ্রমা হৃদয়-মণি ধরিতে হৃদয় ;
আমার সে আশাময়ী তুমি, বিনোদিনই!
.                তব আশে ছিনু কত আশ্বাসিত হ'য়ে |


                              ২২
সেই আশা দেখ প্রিয়ে! পূরিল আমার ;
.                পূর্ণ-শশী-রূপে উঠি আমার অম্বরে,
জুড়াইলে চকোরের প্রাণ অনিবার,
.                অমল প্রেমের সুধা বরুষণ ক'রে |


                              ২৩
অদর্শনে উচ্ছ্বাসিত করিয়া হৃদয়,
.                দিনেকের সম্ভাষণ সপ্ত দিনান্তরে,
কি কুহকে করে মন চিরানন্দময়,
.                ফুটায় কুসুম কত হৃদয়-ভিতরে!


                              ২৪
না হইতে যামিনীর অর্দ্ধ-অবসান,
.                হবে অস্তমিত পুনঃ, তুমি শশধর!
যে জ্যোত্স্নায় বিভাসিত করিলে এ প্রাণ,
.                সে বিভাস কোন দিন হবে কি অন্তর?


                              ২৫
সপ্তাহ-অন্তরে কিম্বা মাসেকের পরে,
.                ভালবাসা-নীরে মজি হৃদয় আমার,
নিরখিব আহৃদয় আকিঞ্চন করে,
.                পূর্ণিমার চন্দ্র-রূপে তোমায় আবার!


                              ২৬
উঠিও ডুবিও, তুমি পূর্ণ-শশধর!
.                অদেখা তিমিরে প্রাণ করিয়া বিকল ;
দিবা নিশি এই সাধ করি নিরন্তর,
.                থাকে যেন ভাতি তব অনন্ত, অচল |


                              ২৭
চল তবে যাই কুঞ্জ-কানন-বিহারে,
.                মৃদু-পদে কুঞ্জ-পথে করি বিচরণ ;
কি করিবে অমাবস্যা ঘোর অন্ধকারে,
.                প্রেমের পূর্ণিমা তুমি রয়েছ যখন!


                              ২৮
দেখ কিবা পথগুলি সুন্দর সরল,
.                আরক্ত কঙ্কর দিয়ে হয়েছে সজ্জিত ;
পাছে ব্যথা পায় তব চরণ-উত্পল,
.                সেই ভয়ে যেন কুঞ্জ সদা সশঙ্কিত |


                              ২৯
দেখ ও পথের ধারে হেরিয়া তোমায়,
.                চমকি ফুটিল কত ফুল মনোহর ;
চামেলি শেফালি তরু নমিয়া শাখায়,
.                বন-রাণী-ভ্রমে ফুলে পূজে নিরন্তর |


                              ৩০
বসন্ত-বরণ-বাসে আবরিত কায়,
.                ফুটি বাস ফেটে পড়ে চম্পক বরণ ;
রূপ-জ্যোতি অন্ধকারে দামিনী খেলায়,
.                তিমির-উজ্জ্বল শোভা কর বিতরণ |


                              ৩১
একি রঙ্গ! সুরঙ্গিণি! নেহারি তোমায়,
.                দেখি কত অলি করে মধুরে গুঞ্জন ;
আসিয়া জোনাকী-পাঁতি বসনে জড়ায়,
.                না জানি কি মোহ তুমি কর বিতরণ!


                              ৩২
বলেছিলে তুমি সেই,---গত বহুক্ষণ,
.                "জ্যোত্স্না রাতি নহে, নিশি ভরা অন্ধকারে,"
ভেবেছিলে হেরি বুঝি অচন্দ্র গগন,
.                তিমিরে নাহিক সুখ কানন-বিহারে?


                              ৩৩
কিন্তু কত সুখ তাহে বুঝিলে এখন,
.                অচন্দ্র সচন্দ্র নিশি সকলি সমান ;
পূর্ণ জোয়ারের জল বহিছে যখন,
.                কেমনে সে জলস্রোত বহিবে উজান?


.                    ***************                                              
পরে


মিলনসাগর