জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর - এই বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটির জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর
পরিবারে | তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সপ্তম সন্তান | সেন্ট পলস্
স্কুল, মন্ট্যাগু একাদেমি ও হিন্দু স্কুলে পড়ার পর প্রেসিডেনসি কলেজে এফ এ (ফার্স্ট আর্টস) পড়তে পড়তেই
নাট্যমঞ্চের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়া ছেড়ে দেন | হিন্দু স্কুলে তাঁর সহপাঠি ছিলেন বিখ্যাত ঐতিহাসিক
রমেশচন্দ্র দত্ত | তাঁর বোন স্বর্ণকুমারী দেবী খ্যাতনামা কবি ছিলেন | ভাগিনেয়ী সরলা দেবীচৌধুরাণী
অগ্নিযুগের নারীদের মধ্যে অন্যতমা |
গগনেন্দ্রনাথের "জোড়াসাঁকোর নাট্যশালায়" তাঁর নাটকের হাতেখড়ি | এর পর যোগ দেন হিন্দু মেলায় এবং
১৮৭৪ সালে গঠন করেন "বিদ্যজন সমাজ" | উনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি লাভ
করেন | তাঁর রচিত নাটকে মধ্যে আছে কিঞ্চিত্ জলযোগ (১৮৭২), এমন কর্ম আর করবো না (১৮৭৭, যা
পরে অলীকবাবু নামে প্রকাশিত হয় ) ইত্যাদির মত লঘু নাটক | ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে আছে পুরুবিক্রম
(১৮৭৪), সরোজিনী (১৮৭৫), অশ্রুমতী (১৮৭৯) যা বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল |
তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন | সংস্কৃত থেকে অনুবাদ
করেন শকুন্তলা (১৮৯৯), উত্তর চরিত (১৯০০), রত্নাবলী(১৯০০), মালতী মাধব(১৯০০), মৃচ্ছকটিক(১৯০১)
প্রভৃতি নাটক | ফরাসী সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন মলিএর-এর "ল বুর্জুয়া জাঁতিয়োম" (হঠাত্ নবাব,
১৮৮৪), পিয়ের লোতির "ইংরাজ বর্জিত ভারতবর্ষ, ছোট গল্প ও কবিতা" (ফরাসী প্রসূন, ১৯০৪) প্রভৃতি |
মারাঠি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন ঝাঁসির রাণী (১৯০৩), বালগঙ্গাধর তিলকের "গীতারহস্য" (১৯২৪) |
১৮৭৭ সালে শুর করেন "ভারতী" পত্রিকার প্রকাশনা | বাংলা সাহিত্যের উন্নতি কল্পে ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত
"সারস্বত সমাজের" পেছনে তাঁর পচুর অবদান রয়েছে | জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র সাহিত্যকর্ম ৪৬
খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে |
উদ্যোগপতি প্রিন্স দ্বারকাথের পৌত্র হবার সুবাদে এবং দেশপ্রেমের চালিকাশক্তির প্রভাবে ব্যবসা-বানিজ্যে
যথেষ্ট উদ্দম নিয়ে নেমেছিলেন | শুরুতে নীল চাষ থেকে কিছু আয় হলেও জার্মানিতে কৃত্তিম নীল আবিস্কার
হবার পর সেই ব্যবসা আর চলে নি | ৫ই এপ্রিল ১৯১৯ তারিখে (৫ই এপ্রিল এখন ভারতের মেরিটাইম দিবস
হিসেবে উদ্যাপিত হয়) বম্বের নরোত্তম মোরারজির জাহাজ কোম্পানি "সিন্ডিয়া স্টীম ন্যাভিগেশন কোম্পানি"
চালু করার অনেক আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন একটি স্টীমার কোম্পানি | তাঁর পাঁচটি স্টীমার,
চলাচল করতে শুরু করেছিল অধুনা বাংলাদেশের খুলনা আর বরিশাল এর মধ্যে | স্টীমারগুলির নাম ছিল
সরোজিনী, স্বদেশী, ভারত, বঙ্গলক্ষ্মী ও লর্ড রিপন | দুর্ভাগ্যবশতঃ Flotila নামে একটি ইংরেজী কোম্পানীর
সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে না উঠে ১৮৮৯ নাগাদ তিনি তাঁর স্টীমার কোম্পানিটিকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য
হন |
সঙ্গীতের জগতেও তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন | সঙ্গীত শিক্ষা বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে | পিয়ানো,
বেহালা, হারমোনিয়াম, সেতার প্রবৃতি বাদ্যযন্ত্রে তিনি পারদর্শী ছিলেন | বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রচলিত
স্বরলিপি লেখার পদ্ধতির কিছু পরিবর্তনও তিনি করেছেন | তাঁর লেখা সঙ্গীতের বই "স্বর্ণলিপিগীতিমালা"
"ডোয়ার্কিন" কোম্পানি থেকে প্রকাশ করা হয় | ১৮৭৯ সালে, তিনিই প্রখম, বাংলায় "বীণাবাদিনী" নামে
একটি, সঙ্গীতের উপর পত্রিকা প্রকাশিত করেন | এছাড়া "সঙ্গীত প্রকাশিকা" পত্রিকাটিও তিনিই প্রকাশনা
করেন | ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন "ভারতীয় সংগাত সমাজ" | তিনি ব্রাহ্মসমাজের জন্যেও বহু প্রার্থনা
সঙ্গীত রচনা করেছেন | তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক, ব্রহ্মসঙ্গীত ও অন্য গান এখনও জনপ্রিয় |
ছবি আঁকাতে, বিশেষ করে প্রতিকৃতি অঙ্কনে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে গেছেন | তাঁর আঁকা ২০০০ ছবি রবীন্দ্র
ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে | বিখ্যাত ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম রদেনস্টাইন তাঁর ছবি
দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর ছবির কপি ইংল্যাণ্ডে প্রকাশিত করেছিলেন |
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন বর্ণময় এবং করুণ | কাদম্বরী দেবীর সাথে বিবাহের পর তিনি তাঁর
শিক্ষার সব ব্যবস্থা করেন | তখনকার রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তিনি কাদম্বরী
দেবীকে কলকাতার গড়ের মাঠে নিয়ে যেতেন ঘোড়ায় চড়া শেখাতে | স্টীমার কোম্পানি এবং অন্যান্য নানা
কর্মে ব্যস্ত জীবন কাটাতে হোতো | ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন | তার কিছু কাল পরই
জাহাজ কোম্পানি বিক্রি হয়ে যায় | ভগ্নহৃদয় এবং নিঃসন্তান, তিনি এর পর বেশীরভাগ সময় কাটান তাঁর
দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ও বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সান্নিদ্ধে ও ছত্রছায়ায় |
বাঙালীর সংস্কৃতিতে এই মানুষটার এত অবদান সত্বেও তাঁর আরও একটি বড় অবদান আছে | ছোটভাই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে তিনিই ছিলেন তাঁর friend, philosopher and guide - জ্যোতিদাদা |
রবীন্দ্রনাথের বেড়ে ওঠার সব দিকেই জ্যোতিদাদার প্রভাব অনশ্বীকার্য | রবীন্দ্রনাথ নিজেই ১১ই পৌষ ১৩৩৮
তারিখে কলকাতার টাউন হলে এক লিখিত ভাষণে জ্যোতিদাদা স্মরণে বলেন :---
"জ্যোতিদাদা, যাঁকে আমি সকলের চেয়ে মানতুম, বাইরে থেকে তিনি আমাকে কোনো বাঁধন পরান নি | তাঁর
সঙ্গে তর্ক করেছি, নানা বিষয়ে আলোচনা করেছি বয়স্যের মতো | তিনি বালককেও শ্রদ্ধা করতে জানতেন |
আমার আপন মনের স্বাধীনতার দ্বারাই তিনি আমার চিত্ত বিকাশের সহায়তা করেছেন | তিনি আমার 'পরে
কৃতিত্ব করবার ঔত্সুক্যে যদি দৌরাত্ব করতেন, তা হলে ভেঙেচুরে, তেড়েবেঁকে যা হয় একটা কিছু হতুম,
সেটা হয়তো ভদ্রসমাজের সন্তোষজনকও হত, কিন্তু আমার মতো একেবারেই হত না | "
--- উত্স: ডঃ শিশির কুমার দাশ - সংসদ সাহিত্য সঙ্গী ২০০৩, শিপ্রা দস্তিদার,
. এবং সুচিত্রা মিত্র - রবীন্দ্রনাথের সংগীত জীবন পূর্বভাগ