কবির মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে লেখা, মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র "গণশক্তি"-র ৮ই মার্চ ১৯৯৮ এর সংখ্যায় প্রকাশিত, বাল্যবন্ধু ও ঢাকার প্রতিশ্রুতিবাণ লেখক সোমেন চন্দের খুন হবার দিনটিকে স্মরণ করে লেখা কবিতাই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কবিতা ---
কবির জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত দুটি কবিতা যা তাঁর মৃত্যুর পরে কল্যাণ চন্দ সম্পাদিত, ৩১১ গাঙ্গুলী বাগান, কলকাতা-৭০০০৪৭ থেকে প্রকাশিত, "সাহিত্য চিন্তা" পত্রিকার, বর্ষ ২৭, অগ্রহায়ণ ১৪০৫, ডিসেম্বর ১৯৯৮, বিশেষ স্মরণ সংখ্যায় প্রকাশিত করা হয় | ---
আমি তুমি পাশাপাশি হেঁটে যাই যদি আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে আরো কেউ হাঁটে! কখনো আলোর নীচে যদি এসে নিমেষে দাঁড়াই সন্ধ্যাকালে দু'টি ছায়া পথের উপরে এসে পড়ে ; কিন্তু না দু'টি তো নয় তিনটে ছায়াই একাকার হয়ে নড়েচড়ে!
তৃতীয় ছায়াটি কা'র, কেন সারাক্ষণ থাকে পাশাপাশি? এই ছায়া-সহচর কী চায় তোমার কাছে সন্ধ্যায় প্রদোষে অতবা আমার কাছে এই অবেলায়?
সন্ধ্যা রাত্রি ভোর কেবলি তো ঘুরে ফিরে আসে, পিপাসা দারুণ বাড়ে রাক্ষুসি বেলায় ; তোমার আমার ছায়া কখনো সংলগ্ন হ'লে কোথা থেকে অন্য এক ছায়া পাশে এসে মুহুর্তে দাঁড়ায়
একি কোনো গুপ্তচর যার শিরোস্ত্রাণ ঢেকে আছে কালো আচ্ছাদনে, যে কেবল কাছে কাছে হিতাকাঙ্ক্ষী সেজে আমাদের নিয়ে যেতে চায় বধ্যভূমির দেশে গোপন আড়ালে? অথবা কি অন্তরঙ্গ প্রকৃত সুহৃদ যে বাঁচায় নিয়ে যায় যোগবিয়োগের ছায়াপথে নতুন সৃষ্টির আশু প্রয়োজনে!
কী অদ্ভুত লাগে এই ছায়া নিয়ে বেঁচে থাকা, যখন সামনে দেখা যায় দিনগুলি ছিন্ন ক'রে দাঁতে ও নখরে বাদ সাধে অদৃশ্য শ্বাপদ, পড়ে যায় প্রতিশ্রুতি জলন্ত অঙ্গারে |
বাতাস যেদিক থেকে আসে সেদিকে ছুটে যাওয়া যায়? উত্তর দক্ষিণ দিকে পূর্বে না পশ্চিমে প্রবল হাওয়ার টানে মাঝে মাঝে . সব দৃশ্য কাঁপে | কোথা থেকে আসে এই হাওয়া, . এরকম তরঙ্গ উচ্ছল!
ওই যে বালক কাজ করে চায়ের দোকানে, কাপ ডিস ধোয়, কাপ তুলে দেয় . হাতে হাতে ভিড়াক্রান্ত স্টলে ওর কি বুকের মধ্যে ঢোকে . এই হাওয়া?
ওই যে ভিখিরী ফুটপাথে এখনো নিশ্চল বসে থাকে গ্রীষ্মের রৌদ্দুরে ভাঙা থালা পেতে কিছু ভিক্ষার আশায়, এই হাওয়া তার বুক ছোঁয়?
ওই যে মাঠের বক্তা মহতী সভায় হাত নাড়ে, পা-ও নাড়ে, বক্তৃতায় শ্রোতাদের মনকে নাচায়--- এই হাওয়া নিমেষের জন্যও কি এসে . তার বুকে জীবনের সুস্থ কোনো ছন্দ রেখে যায়
এই হাওয়া মাঝে মাঝে প্রেমিকের . সুগভীর স্পর্ষের মতন ; এই হাওয়া দূরস্থিত ফুলের সভার . গন্ধবহ দূত ; অথচ শরীরে মনে স্পর্শে তার ফোটে না . এখন সুগোপন আকাঙ্খার ফুল |
ভালোবাসা, আহা, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে | সমস্ত সংসার আজো রক্তস্রাবী প্রাণের লীলায় দিশেহারা | প্রেমাস্পদা প্রেমিকেরা আপন স্বভাবে আকাঙ্খাকে বারে বারে লাল নীল পান্নায় নীলায় এখনো সাজায় কিম্বা ঋতুরঙ্গ বিন্যাসের দিনে নির্জন নদীর মতো হৃদয়ের পথে প্রবাহিত হতে গিয়ে বাধা পায় কিম্বা এক সামান্য ঋণে একটি অঙ্কুর ক্রমে কান্তিময় প্রশাখায় স্ফীত |
যন্ত্রণার অন্য নাম ভালোবাসা | তাই হাহাকার ক্রমশ অন্তরতম চেতনার বিরল ছোঁয়ায় অনন্য আকার ধরে, ক্রমে নীল পূর্ণিমা-জোয়ার সমগ্র সত্তায় সেই পুরাতন স্বাদ খুঁজে পায় যার নাম ভালোবাসা | যেদিকে তাকাই ক্রান্তিকালে যদিও বিপন্ন প্রাণ তোমাকেই জেনেছি আড়ালে ||
কবিতার কাছে আমি চাইনি কিছুই | শুধু ডেকে বলি : এইখানে বসো | পঞ্চাশ বছর ঘুরেছি তোমার দ্বীপে, আজ সূর্যাস্তের আলো মিশে যায় সন্ধ্যার আঁধারে, আজ আমি বড়ো ক্লান্ত দীর্ঘ পর্যটনে, এ মুহুর্তে চাই তুমি কাছে এসে দাঁড়াবে এখানে মুখোমুখী, গোধূলীর বিধূত নিমেষে |
প্রশ্ন ছিল : তোমার বাগানে যদি কিছু ফুল কখনো ফুটিয়ে থাকি তার জন্য কিছু কৃতজ্ঞতা তুমি কি জানাবে, নাকি তারুণ্যের যৌবনের কল্পনার সমস্ত উদ্যোগ তোমার শরীরে কোনো চিহ্ন না রেখেই লুপ্ত হবে অগোচরে কালের তিমিরে?
দেখলাম তুমি নিরুত্তর কী রকম উদাসীন প্রশ্নের উত্তরে | বোঝা গেল পৃথিবীতে বেশ . কিছু প্রশ্ন থেকে যায় কোনোকালে যার কোনো উত্তর মেলে না |
নক্ষত্র জয়ের পর মানুষের জন্য থেকে যায় নক্ষত্র যুদ্ধের উত্তেজনা | কথা ছিল নক্ষত্র জয়ের পর এই পৃথিবীতে ভাঙা ভাঙা ঘরবাড়ি সৌধ ও প্রাচীর আবার নির্মিত হবে, আবার মানুষ নিজস্ব স্বপ্নের সঙ্গে মুখোমিখি হবে জতুগৃহ রাক্ষসী বেলার দ্রুত অবসানে |
নক্ষত্র জয়ের পর পৃথিবীর দেশে দেশে ভগ্নবুক নরনারী দ্যাখে প্রতিদিন দিকে দিকে স্ফুলিঙ্গের মতো কেবল ছড়িয়ে যায় নক্ষত্র যুদ্ধের উত্তেজনা |
নিরাময় হবে ভেবে পীড়িত মানুষ প্রকৃতির কাছে যেতে চায় ; নিসর্গের আলো হাওয়া রৌদ্রের ভিতরে নদী পাহাড়ের ধারে কিংবা কোনো অরণ্যের সবুজ সভায় | নিরাময় হবে ভেবে পীড়িত মানুষ প্রতিবেশী হৃদয়ের কাছে মুক্ত করে দিতে চায় বুকের অর্গল |
দ্যাখে সেই প্রতিবেশী নিজেই কেমন অস্থিরতা জড় করে হৃদয়ে মননে অন্য কোনো আশ্রয়ের খোঁজে উন্মাদের মতো দ্রুত ছুটে ছুটে যায় |
দুঃখ করো না আমি আবার আসবো আমি ব্যর্থ নই, শূণ্য নই বৃক্ষ থেকে ঝরে যাওয়া শুকনো ফুল কিংবা উড়ে যাওয়া কীটদষ্ট পাতা নই ; আমি অন্ধকারে মিশে আছি তাই অদৃশ্য, আমি হাজার দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে কাঁপছি, তাই উধাও : আমি দারুণ ক্ষোভের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন তাই দেখতে পাচ্ছ না ; কিন্তু একদিন ঝরণার জলের শব্দ শোনা যাবে, বাঁশি বাজার শব্দ ; সে দিন সব বিষাদ সরিয়ে আমি আসব, আমি আসব |
কবিতার জন্য আমি বহুদূর যেতে রাজী | পাহাড় পর্বত মাঠ যেন সব একাকার কবিতার নীল পাখী উড়ে যায় দৃশ্য ছুঁয়ে | কেন যে ভেতর থেকে আনন্দ-যন্ত্রণা ঠেলে দেয় বার বার স্মৃতির সৈকতে কিংমা দূর ওই অভ্রলীন পাহাড়ের দিকে অথবা প্রবীণ গাছএ ওই ছায়ায় বাঁকলে আমার স্বপ্নকে নিয়ে খেলা করে স্থির জলে স্থলে |
জীবনে অনেক কথা জমা হয়ে থাকে , সব কথা কখনো কি বলা হয়ে যায়? মেঘে ঢাকা অন্ধকারে শ্রাবণ রাত্তিরে স্মৃতির ঢেউয়ের বাঁকে বাঁকে ফোটে ছবি, ফোটে মুহুর্তের, তারপর মিশে যায় শেষ স্তব্ধতায় ঘুমের শরীরে | ফাল্গুনের দিনে হঠাৎ হাওয়ার ঢেউ কড়া নাড়ে দরোজায়
সজ্জিত দূতের মতো, নিয়ে আসে উদাস স্মৃতিকে, তারপর আড়ালে কোথাও দ্রুত মিশে যায় |
স্মৃতিতেই মিশে আছে কথাগুলি, সব কথা কখনো কি বলা হয়ে যায়? সমস্ত দিনের শেষে সমস্ত কাজের শেষে তবু কথা থেকে যায় বুকের গভীরে জীবন বিকীর্ণ হোক দিকে দিকে না বলা অনেক কথা থেকে যায় তবু এমনকি শেষ দিনটিতে |