কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত-র কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
১।     হে ললিতা ফেরাও নয়ন!       
২।     
ভিজে কলকাতা   
৩।     
ছায়া হেঁটে যায়      
৪।     
ভয়      
৫।     
বাতাস যেদিক থেকে    
৬।     
ভালোবাসা                
৭।     
উত্তর মেলে না            
৮।     
রাত্রি তুমি যত পারো      
৯।     
নক্ষত্র জয়ের পর        
১০।    
নিরাময় হবে ভেবে    
১১।    
দুঃখ করো না আমি আবার আসব   
১২।    
আমাকে হত্যা করার আগে  
১৩।    
একবার ভেবে দ্যাখো   
১৪।    
একচক্ষু   
১৫।    
কথা       
১৬।    
বড়োই আশ্চর্য লাগে           
      
কবির মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে লেখা, মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র "গণশক্তি"-র ৮ই মার্চ ১৯৯৮ এর
সংখ্যায় প্রকাশিত, বাল্যবন্ধু ও ঢাকার প্রতিশ্রুতিবাণ লেখক সোমেন চন্দের খুন হবার দিনটিকে স্মরণ করে
লেখা কবিতাই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কবিতা ---        

১৭।    ৮ই মার্চের স্মৃতিতে         

কবির জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত দুটি কবিতা যা তাঁর মৃত্যুর পরে কল্যাণ চন্দ সম্পাদিত, ৩১১ গাঙ্গুলী বাগান,
কলকাতা-৭০০০৪৭ থেকে প্রকাশিত, "সাহিত্য চিন্তা" পত্রিকার, বর্ষ ২৭, অগ্রহায়ণ ১৪০৫, ডিসেম্বর ১৯৯৮, বিশেষ
স্মরণ সংখ্যায় প্রকাশিত করা হয় | ---

১৮।    বসন্ত     
১৯।    
কবিতালোক      



 
*
হে ললিতা ফেরাও নয়ন!

হে ললিতা ফেরাও নয়ন!
যদি শুভ্র শ্রীদেহের স্বাদ
আর নাশ আশ্লেষ-শয়ন
মুক্তিস্নান এনেছে জীবনে,
দূরে থাক লোক পরিবাদ |

জীবনের নাট্য-যবনিকা
প'ড়ে যাবে, মনে রাখো নাকি?
মুছে গেলে জীবন্ত জীবিকা
কী করিবে তখন একাকী?
শুধু চোখে ক্লান্ত গতভাষ!

হৃদয়ের ব্যাকুল শ্বাপদ
খুঁজে ফেরে আরক্ত শিকার,
কান পেতে স্থির হ'য়ে শোনে
পক্ষধ্বনি শত বলাকার |
ঘুম নাই নিদ্রালু নয়নে |

উতরোল নিবিড় রজনী |
খোলো রক্ত লাজ-আবরণ,
লজ্জা-অপমান শঙ্কা ছাড়ো!
শোনো মোর ধমনীর ধ্বনি,
আগে রাখো মানুষের মন!

উপরেতে আকাশ ছড়ানো,
নিচে কাঁপে মদালস বায়ু,
হে ললিতা, কাছে এসো, শোনো---
হিমসিক্ত তোমার চুম্বনে
শেষ হবে মোর পরমায়ু!

অদূরেতে কৃষ্ণ মৃত্যু কাঁপে,
তবু যেন তৃণের মতন
ভেসে চলি অন্তিম বিপাকে,
আকাঙ্ক্ষায় স্তব্ধ অচেতন,
মৃত্যু আনে নৈশ পরিশ্লেষ |

তাণ্ডবের দীর্ঘশ্বাস শুনে
আছিলাম ঘোর অচেতন,
আকাঙ্ক্ষার জাল বুনে-বুনে
এইবার হয়েছে উধাও
বক্ষোমাঝে উদ্ধত নয়ন |

এই লহ মোর দুই হাত |
অতীতের সাধনায় বুঝি
আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু বরাভয়
লভিয়াছি দেহপ্রান্ত খুঁজি!
ক্লান্ত তনু সুন্দর অক্ষয় |


.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
ভিজে কলকাতা

বর্ষণ বিধ্বস্ত দিন, থমথমে ঘন অন্ধকার
গহন নিবিড় নীলে ; গ্রীষ্ম শেষে দুরন্ত শহরে
উন্মুখ শ্রাবণধারা, অসহ্য গুমোট ঘরে-ঘরে
ভেঙে গিয়ে নীলাঞ্জন শ্রান্ত চোখে লাগে সবাকার |
ভিজে ট্রামে ভিজে বাসে অজস্র যাত্রীর আনাগোনা
আরো বাড়ে, লোক জমে মোড়ে-মোড়ে পরন্ত বিকেলে
বাড়িফেরা প্রতীক্ষায় ; চৌরঙ্গীতে ইলেক্ট্রিক জ্বেলে
আড্ডা জমে রেস্তোরাঁয়, সিনেমায় অতৃপ্ত কামনা
চরিতার্থ করে কেউ ; তারপর স্তব্ধ অর্ধরাতে
অতল কান্নার সুরে গুমরিয়া ওঠে কলকাতা
উত্তরে হাওয়ার বেগে, কুষ্ঠরোগী জাগে ফুটপাথে
একক ভীতির রাত, শহরের পাষাণে শূণ্যতা
মৃত্যুর মতোই ভারী, কুকুরের আর্ত কণ্ঠস্বরে
নির্জন দ্বীপের কান্না, লালা ঝরে আহত অধরে |


.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
ছায়া হেঁটে যায়

আমি তুমি পাশাপাশি হেঁটে যাই যদি
আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে
আরো কেউ হাঁটে! কখনো আলোর নীচে
যদি এসে নিমেষে দাঁড়াই সন্ধ্যাকালে
দু'টি ছায়া পথের উপরে এসে পড়ে ;
কিন্তু না দু'টি তো নয় তিনটে ছায়াই
একাকার হয়ে নড়েচড়ে!

তৃতীয় ছায়াটি কা'র, কেন সারাক্ষণ
থাকে পাশাপাশি? এই ছায়া-সহচর
কী চায় তোমার কাছে সন্ধ্যায় প্রদোষে
অতবা আমার কাছে
এই অবেলায়?

সন্ধ্যা রাত্রি ভোর
কেবলি তো ঘুরে ফিরে আসে,
পিপাসা দারুণ বাড়ে রাক্ষুসি বেলায় ;
তোমার আমার ছায়া কখনো সংলগ্ন হ'লে
কোথা থেকে অন্য এক ছায়া
পাশে এসে মুহুর্তে দাঁড়ায়

একি কোনো গুপ্তচর যার শিরোস্ত্রাণ
ঢেকে আছে কালো আচ্ছাদনে,
যে কেবল কাছে কাছে হিতাকাঙ্ক্ষী সেজে
আমাদের নিয়ে যেতে চায়
বধ্যভূমির দেশে গোপন আড়ালে?
অথবা কি অন্তরঙ্গ প্রকৃত সুহৃদ
যে বাঁচায় নিয়ে যায়
যোগবিয়োগের ছায়াপথে নতুন সৃষ্টির
আশু প্রয়োজনে!

কী অদ্ভুত লাগে এই ছায়া নিয়ে বেঁচে থাকা,
যখন সামনে দেখা যায়
দিনগুলি ছিন্ন ক'রে দাঁতে ও নখরে
বাদ সাধে অদৃশ্য শ্বাপদ,
পড়ে যায় প্রতিশ্রুতি জলন্ত অঙ্গারে |


.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
ভয়

ভয়ের অনেক উপাদান
আছে পৃথিবীতে | উদ্বেগে সন্ত্রাসে
সর্বত্র সংসার কাঁপে,
ভাঙে ঘর,
বিমর্ষ নগর | গীর্জার চূড়া থেকে
ভেঙে পড়ে ঘন্টার দোলক ;
প্রাচীন
মন্দির দরজা খসে পড়ে ; যেন
জরাজীর্ণ পাতা চতুর্দিকে | কার হিংস্র হাত
.                কালি ঢেলে মুছে দিতে চায়
.                পটের সুন্দর ছবি
.                শান্ত দৃশ্যবলী |
তবু কোথাও একনো
মানব মানবী
আলো চায়, রক্ত মোছে,
ভাঙা ঘর বাঁধে, গান গায়
পশরা সাজায় ||

১৯৮৭
.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
বাতাস যেদিক থেকে

বাতাস যেদিক থেকে আসে
সেদিকে ছুটে যাওয়া যায়?
উত্তর দক্ষিণ দিকে
পূর্বে না পশ্চিমে
প্রবল হাওয়ার টানে মাঝে মাঝে
.                সব দৃশ্য কাঁপে |
কোথা থেকে আসে এই হাওয়া,
.                এরকম তরঙ্গ উচ্ছল!

ওই যে বালক কাজ করে
চায়ের দোকানে,
কাপ ডিস ধোয়, কাপ তুলে দেয়
.        হাতে হাতে ভিড়াক্রান্ত স্টলে
ওর কি বুকের মধ্যে ঢোকে
.                        এই হাওয়া?

ওই যে ভিখিরী ফুটপাথে
এখনো নিশ্চল বসে থাকে গ্রীষ্মের রৌদ্দুরে
ভাঙা থালা পেতে কিছু ভিক্ষার আশায়,
এই হাওয়া তার বুক ছোঁয়?

ওই যে মাঠের বক্তা মহতী সভায়
হাত নাড়ে, পা-ও নাড়ে,
বক্তৃতায় শ্রোতাদের মনকে নাচায়---
এই হাওয়া নিমেষের জন্যও কি এসে
.                তার বুকে
জীবনের সুস্থ কোনো ছন্দ রেখে যায়

এই হাওয়া মাঝে মাঝে প্রেমিকের
.                সুগভীর স্পর্ষের মতন ;
এই হাওয়া দূরস্থিত ফুলের সভার
.                গন্ধবহ দূত ;
অথচ শরীরে মনে স্পর্শে তার ফোটে না
.                        এখন
সুগোপন আকাঙ্খার ফুল |

বাতাস যেদিক থেকে আসে
সেদিকে কি ছুটে যাওয়া যায়?

১৯৭৭
.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
ভালোবাসা

ভালোবাসা, আহা, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে |
সমস্ত সংসার আজো রক্তস্রাবী প্রাণের লীলায়
দিশেহারা | প্রেমাস্পদা প্রেমিকেরা আপন স্বভাবে
আকাঙ্খাকে বারে বারে লাল নীল পান্নায় নীলায়
এখনো সাজায় কিম্বা ঋতুরঙ্গ বিন্যাসের দিনে
নির্জন নদীর মতো হৃদয়ের পথে প্রবাহিত
হতে গিয়ে বাধা পায় কিম্বা এক সামান্য ঋণে
একটি অঙ্কুর ক্রমে কান্তিময় প্রশাখায় স্ফীত |

যন্ত্রণার অন্য নাম ভালোবাসা | তাই হাহাকার
ক্রমশ অন্তরতম চেতনার বিরল ছোঁয়ায়
অনন্য আকার ধরে, ক্রমে নীল পূর্ণিমা-জোয়ার
সমগ্র সত্তায় সেই পুরাতন স্বাদ খুঁজে পায়
যার নাম ভালোবাসা | যেদিকে তাকাই ক্রান্তিকালে
যদিও বিপন্ন প্রাণ তোমাকেই জেনেছি আড়ালে ||

১৯৬৩
.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
উত্তর মেলে না

কবিতার কাছে আমি চাইনি কিছুই | শুধু
ডেকে বলি : এইখানে বসো | পঞ্চাশ বছর
ঘুরেছি তোমার দ্বীপে, আজ সূর্যাস্তের আলো
মিশে যায় সন্ধ্যার আঁধারে, আজ আমি
বড়ো ক্লান্ত দীর্ঘ পর্যটনে, এ মুহুর্তে চাই
তুমি কাছে এসে দাঁড়াবে এখানে মুখোমুখী,
গোধূলীর বিধূত নিমেষে |

প্রশ্ন ছিল : তোমার বাগানে যদি কিছু ফুল
কখনো ফুটিয়ে থাকি তার জন্য কিছু কৃতজ্ঞতা
তুমি কি জানাবে, নাকি তারুণ্যের যৌবনের
কল্পনার সমস্ত উদ্যোগ তোমার শরীরে
কোনো চিহ্ন না রেখেই লুপ্ত হবে অগোচরে
কালের তিমিরে?

দেখলাম তুমি নিরুত্তর কী রকম উদাসীন
প্রশ্নের উত্তরে | বোঝা গেল পৃথিবীতে বেশ
.                 কিছু প্রশ্ন থেকে যায়
কোনোকালে যার কোনো উত্তর মেলে না |


১৯৮৯
.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
রাত্রি তুমি যত পারো

রাত্রি তুমি যত পারো অবারিত হও |
অবারিত হও গাঢ় অন্ধকার উন্মোচনে
অদম্য আলোর সরু ক্ষীণতম রশ্মিটিকে
লুপ্ত ক'রে দিতে | রাত্রি তুমি

মাঝে মাঝে মোহময়ী, মাঝে মাঝে যেন
নায়িকার স্খলিত চুলের বিশালতা,
চুপিসাড়ে চোখে চোখে দেখা
নিবিড় স্নিগ্ধতা | রাত্রি তুমি

দিনের সমস্ত শব্দ আর্তনাদ ক্রুদ্ধতার ঢেউ
কোথায় হটিয়ে দিয়ে একটি নিমেষে
পৃথিবীকে রাখো অন্ধকারে, যেন তুমি
একটি চুম্বনে আত্মদানে
সমস্ত যৌবনজ্বালা প্রৌড়ের অশক্ত হাহাকার
মুছে নেবে, শিল্পের মায়াবী উদ্বোধনে
অমরতা পাবে অন্ধকার |


১৯৬৩
.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
নক্ষত্র জয়ের পর

নক্ষত্র জয়ের পর মানুষের জন্য থেকে যায়
নক্ষত্র যুদ্ধের উত্তেজনা |
কথা ছিল নক্ষত্র জয়ের পর এই পৃথিবীতে
ভাঙা ভাঙা ঘরবাড়ি সৌধ ও প্রাচীর
আবার নির্মিত হবে, আবার মানুষ
নিজস্ব স্বপ্নের সঙ্গে মুখোমিখি হবে
জতুগৃহ রাক্ষসী বেলার
দ্রুত অবসানে |

নক্ষত্র জয়ের পর পৃথিবীর দেশে দেশে
ভগ্নবুক নরনারী দ্যাখে
প্রতিদিন দিকে দিকে স্ফুলিঙ্গের মতো
কেবল ছড়িয়ে যায়
নক্ষত্র যুদ্ধের উত্তেজনা |


১৯৮৭
.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
নিরাময় হবে ভেবে

নিরাময় হবে ভেবে পীড়িত মানুষ
প্রকৃতির কাছে যেতে চায় ;
নিসর্গের আলো হাওয়া রৌদ্রের ভিতরে
নদী পাহাড়ের ধারে কিংবা কোনো অরণ্যের
সবুজ সভায় |
নিরাময় হবে ভেবে পীড়িত মানুষ
প্রতিবেশী হৃদয়ের কাছে
মুক্ত করে দিতে চায় বুকের অর্গল |

দ্যাখে সেই প্রতিবেশী নিজেই কেমন
অস্থিরতা জড় করে হৃদয়ে মননে
অন্য কোনো আশ্রয়ের খোঁজে
উন্মাদের মতো দ্রুত
ছুটে ছুটে যায় |


১৯৮৭
.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
দুঃখ করো না আমি আবার আসবো
আমি ব্যর্থ নই, শূণ্য নই
বৃক্ষ থেকে ঝরে যাওয়া শুকনো ফুল
কিংবা উড়ে যাওয়া কীটদষ্ট পাতা নই ;
আমি অন্ধকারে মিশে আছি
তাই অদৃশ্য,
আমি হাজার দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে কাঁপছি,
তাই উধাও :
আমি দারুণ ক্ষোভের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন
তাই দেখতে পাচ্ছ না ;
কিন্তু একদিন ঝরণার জলের শব্দ শোনা যাবে,
বাঁশি বাজার শব্দ ;
সে দিন সব বিষাদ সরিয়ে আমি আসব,
আমি আসব |


.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
বসন্ত


গুণগুণ শুনছি কিছুক্ষণ | সকালে রৌদ্দুরে
জানালার এক কোণে সাতটি মৌমাছি
মধুভাণ্ড গড়বার স্থান খোঁজে, সমবেত সুরে
কি যেন বলতে চায়, হঠাৎ হাওয়ায়
নিমেষেই ভেসে যায় বাইরে বাগানে
সবুজ দৃশ্যের স্নিগ্ধতায় ||
.                          বসন্ত এখন
হাওয়ায় কাঁপবে, ওই মৌমাছির দল
কণ্ঠস্বরে নিয়ে এলো ঋতুর গুঞ্জন ||


.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
কবিতালোক


কবিতার জন্য আমি বহুদূর যেতে রাজী |
পাহাড় পর্বত মাঠ যেন সব একাকার
কবিতার নীল পাখী উড়ে যায় দৃশ্য ছুঁয়ে |
কেন যে ভেতর থেকে আনন্দ-যন্ত্রণা
ঠেলে দেয় বার বার স্মৃতির সৈকতে
কিংমা দূর ওই অভ্রলীন পাহাড়ের দিকে
অথবা প্রবীণ গাছএ ওই ছায়ায় বাঁকলে
আমার স্বপ্নকে নিয়ে খেলা করে স্থির জলে স্থলে |


.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
৮ই মার্চের স্মৃতি

ফাল্গুনের উত্তাল হাওয়ায় দুপুরের রৌদ্রে
তোমার একুশ বছরের ছিন্নভিন্ন তাজা শরীর
পড়ে রউল রাস্তায়, মিলিয়ে গিয়েছিল
আড়ালে ঘাতকেক দল |

একুশ বছরের চিন্তা ভাবনার অসামান্যতা,
শোষিতের পক্ষে, জীবনের স্বপক্ষে
তোমার স্বপ্নের আলিঙ্গণের মানবিকতা
সেদিন থেকে আগুনের পাখী হয়ে
ক্রমে ক্রমে দশকেক পর দশক
পার হয়ে আজও বুকের কোথাও নিভৃতে
ধাক্কা দেয়, অবহিত করে |

সোমেন, আজ তুমি শুধু একটি নাম নও,
শূণ্যতার মরুভূমিতে এমন উচ্চারণ---
যা মন্ত্র, আমাদের মানবিক প্রত্যয়!


.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
আমাকে হত্যা করার আগে
একবার ভেবে দেখো
আমি কোন দেশে জন্মেছিলাম
আমাকে ছিন্ন-ভিন্ন করার আগে
একবার মনে রেখো
আমি কোন স্বপ্ন বুকে রেখেছিলাম |

আমাকে হত্যা করার আগে
ছিন্ন-ভিন্ন করার আগে
হে সময়, হে পৃথিবী ;
এসর জিজ্ঞাসার সদুত্তর দিও |

.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
একবার ভেবে দ্যাখো

কে তোমাকে বুকে রাখবে
শিশুর মতন?
বাংলা দেশ |

কে জড়ায় চেতনা আমার
সস্নেহ প্রত্যয়ে?
বাংলা দেশ |
কে আমাকে দিন থেকে রাতে,
রাত থেকে দিনে
অবিরাম স্পর্ষ ধন্যতায়
প্রত্যেক নিমেষে
নিয়ে যায়?
বাংলা দেশ |

প্রখর গ্রীষ্মের দিনে
মেঘ বৃষ্টি জলে
হেমন্তে শরতে শীতে,
বসন্ত বন্যায়
কে নিমেষে নিয়ে যায়?
প্রচ্ছন্ন স্বদেশ
এই বাংলা খণ্ডিত প্রদেশ |

গঙ্গায় পদ্মায় একাকার
জনমে মরণে বাঁধে সেতু
অজেয় প্রাণের বাংলা,
এই বাংলা দেশ |

.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
একচক্ষু


তবুও হঠাৎ যদি সংসারের আবর্জনা ঠেলে
.        নীড়মুখী পাখীর মতন
.        দুরন্ত আবেগ বুকে জ্বেলে
.        একঘেয়ে প্রয়াসের হয় ব্যতিক্রম,
যদি দূরে দৃষ্টি যায়
কল্পনার সিঁড়ি বেয়ে রোমাঞ্চিত মনের উদ্যম
সদ্যোজাত নীপবনে ফুলে ফলে সতৃষ্ণ তাকায়,
মনে রেখো পৃথিবীর রোমাঞ্চিত প্রকৃতির মৌন প্রতীক্ষার
কোন অন্ত কোন সীমা কোন শেষ নেই,---
.        আচ্ছাদন খুলে ফেলে রমণী নেমেছে সেই জলে
.        কামনার পদ্মগুলি ফোটে পলে পলে |
.                মনে রেখো নীতিবাক্য : অপমৃত্যু ডেকে আনে
.                        একচক্ষু যত হরিণেই |

.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
কথা

জীবনে অনেক কথা জমা হয়ে থাকে ,
সব কথা কখনো কি বলা হয়ে যায়?
মেঘে ঢাকা অন্ধকারে শ্রাবণ রাত্তিরে
স্মৃতির ঢেউয়ের বাঁকে বাঁকে
ফোটে ছবি, ফোটে মুহুর্তের,
তারপর মিশে যায় শেষ স্তব্ধতায়
ঘুমের শরীরে | ফাল্গুনের দিনে
হঠাৎ হাওয়ার ঢেউ কড়া নাড়ে দরোজায়

সজ্জিত দূতের মতো, নিয়ে আসে উদাস স্মৃতিকে,
তারপর আড়ালে কোথাও
দ্রুত মিশে যায় |

স্মৃতিতেই মিশে আছে কথাগুলি,
সব কথা কখনো কি বলা হয়ে যায়?
সমস্ত দিনের শেষে সমস্ত কাজের শেষে
তবু কথা থেকে যায় বুকের গভীরে
জীবন বিকীর্ণ হোক দিকে দিকে
না বলা অনেক কথা থেকে যায় তবু
এমনকি শেষ দিনটিতে |

১৯৮৮

.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর
*
বড়োই আশ্চর্য লাগে  

বড়োই আশ্চর্য লাগে এইসব ভ্রান্ত পরিক্রমা |
সবাই প্রত্যহ যেন ছুটে যাচ্ছি উচ্চতার দিকে,
কোনো তীক্ষ্ণ আকাঙ্ক্ষার পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছবার
ভয়ঙ্কর প্রস্তুতিতে অপসৃয়মান দৃশ্য দোলে |
যেমন মুষিকগুলো খুঁদকুড়ো মুখে মূহুর্তেই
কোথাও বিবরে যায়, লক্ষ লক্ষ মনুষ্য মুখের
তেমন বিলুপ্তি যেন ধাবমান সংসারের স্রোতে
অজ্ঞতার ব্যর্থতার সুতীব্র ঢেউয়ের অন্তরালে |
কেউ কোথাও খুব স্থিত নয়, শান্ত সমাহিতি
নেই কোনো উচ্চারণে, স্তবে কিংবা প্রতিনিবেদনে ;
কেবল বেলুন নিয়ে খেলা করে শিশুরা যেমন
সন্ত্রস্ত মনুষ্য মূর্তি অনুরূপ মিথ্যা মোহময়
আকাঙ্ক্ষার উদ্যোগেই সংসারে নিয়ত চুপসে যায় |

কোথাও বাড়ীর কোণে, বারান্দায় অথবা বাগানে
দু'চারটি সঙ্গী নিয়ে যদি বসা যেত একবার
চণ্ডীমণ্ডপের স্মৃতি বুকে নিয়ে | কিংবা সেকালের
রথের মেলায় কিংবা চড়কের প্রমত্ত গাজনে
শিশুদের বিস্ময়ের অন্তত খানিক যদি পাওয়া যেত ;
মুখোশ মুখশ্রী যদি একাকার হ'তো স্নিগ্ধতায়!
অথবা ধবল সেই অশ্বযুথ দেখি না কোথাও,
ফিটন গাড়ীর সেই বহমান সৌন্দর্যের স্মৃতি |

সমস্তি নগরীময় অন্ধ নিয়মের নাগপাশে
বড়োই বিভ্রান্ত লাগে এই সব হিংস্র পরিক্রমা ;
পাহাড়ে উঠতে সাধ একবার পতনের আগে ||

১৯৬৬

.       ****************                                                                   
উপরে


মিলনসাগর