কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তবিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট কবি ছিলেন | তাঁর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় | পিতা বিজয়শঙ্কর সেনগুপ্ত ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রধান ছিলেন | মাতা মায়াময়ী দেবী, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রজনীকান্ত গুপ্তের কন্যা |
সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি অনিল রায়ের শ্রীসংঘ সন্ত্রাসবাদী (সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী) দলে যুক্ত হন কিন্তু পরে মোহভঙ্গ হবার পর সেখান থেকে বেরিয়ে এলেও লীলা রায় (নাগ) ও অনিল রায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকার দরুণ তাঁদের পত্রিকা "জয়শ্রী" তে নিয়মিত লিখেছেন |তিনি ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী নিয়ে এম.এ. পাশ করেন |
১৯৩৮ সালে বাল্যবন্ধু সোমেন চন্দের আহ্বানে তিনি "ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘ"-এ যোগ দেন |
হিটলার, স্ট্যালিনের সাথে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার এবং যুদ্ধের পরে য়ুরোপকে পরস্পরের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার লিখিত চুক্তি (২৩ অগাস্ট ১৯৩৯ এ মস্কো তে সাক্ষরিত, মলটভ-রিবেনট্রপ প্যাক্ট) ভঙ্গ ক'রে, ২২ জুন ১৯৪১ তারিখে "অপারেশন বারবারোস্সা" নাম দিয়ে, আকস্মিক রাশিয়া আক্রমন করে |
সেই সময় "ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘ"-এর উদ্যোগে গড়ে ওঠে "সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি" | এই সমিতির উদ্যোগে ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় ফ্যাসি বিরোধী সম্মেলন আয়োজিত হয় | এই সম্মেলনে যাবার পথে বিরুদ্ধবাদীদের হাতে নৃশংস ভাবে নিহত হন সোমেন চন্দ | সোমেন চন্দের সাহিত্য, আত্মত্যাগ ও বন্ধুত্ব কিরণশঙ্করকে আজীবন আচ্ছাদিত করে রেখেছিল | তাঁর সাধনা ও সম্পাদনার মুখ্য বিষয় সোমনে চন্দ | পশ্চিমবঙ্গে সোমেনকে জনপ্রিয় করতে তাঁর অবদান অসামান্য | কিরণশঙ্করের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী থেকে পবিত্র সরকারের সম্পাদনায় "সোমেন চন্দ গল্প সংগ্রহ" প্রকাশিত হয়েছে | পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাদেমী "সোমেন চন্দ পুরস্কার"-এর প্রবর্তনও করেন |
১৯৪৩ - ৪৪ সালে তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন | তাঁর সদস্য পদ আর নবীকরণ করেন নি |
কবির জীবনের কর্মযোগ বড় বৈচিত্রময়! এম.এ. পাশ করার পর কবি অল্প সময়ের জন্য ঢাকা প্রিয়নাথ স্কুলে শিক্ষকতা করেন | পরে ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জে কাকার আবগারী দোকানের ব্যবসার ম্যানেজারের কাজে নিযুক্ত হন | ১৯৫০ সালে এপার বাংলায় চলে আসেন এবং বন্ধু ঊষারঞ্জন দত্তর সাথে কলকাতার নিউ মার্কেটের পাশে একটি সেলাইয়ের দোকান দেন | সেটা চলে নি | পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রিলিফ অফিসারের চাকুরি গ্রহণ করেন | রিলিফ অফিসার এবং বি.ডি.ও-র চাকুরিতে বিভিন্ন জেলায় বদলীর পরে কলকাতায় ওয়েস্ট বেঙ্গল গেজেটিয়ারে রিসার্চ অফিসার হন |
কলকাতায় ১৯৪৯ সালে অসবর্ণ বিবাহজনিত সামাজিক অশান্তির তোয়াক্কা না ক'রে, বিবাহ করেন বীণা বিশ্বাসকে, যিনি ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী এবং বাল্যবন্ধু সোমেন চন্দ-এর মাসীমা |
তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত "শতদল" (১৯৩৮), "শান্তি" (১৯৩৯ - ৪১) এবং ঢাকার প্রগতি লেখক সংঘের মুখপত্র "প্রতিরোধ" পত্রিকা (১৯৪২ ~ ৪৪), " এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত "উত্তরণ" (১৯৫৩) ও "সাহিত্যচিন্তা" পত্রিকার (১৯৭১ - ৯৭) সম্পাদনা করেছিলেন |
তাঁর প্রথম দুটি কবিতা "শত্রু" ও "দৃষ্টান্ত" বুদ্ধদেব বসুর "কবিতা"য় প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে | প্রথম প্রবন্ধ ছাপা হয় ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক "সোনার বাংলা" পত্রিকায় | ১৯৩৬ - ৩৮ সালের মধ্যে প্রথম গল্প "নিরুদ্দেশ মেঘ" সহ তাঁর অনেকগুলি গল্প প্রকাশিত হয় "অগ্রগতি" ও "স্বদেশ" পত্রিকায় |
তিনি ছিলেন মূলত লিটল্ ম্যাগাজিনের কবি | কোনো লিটল্ ম্যাগাজিনের সম্পাদককেই তিনি বিমুখ করতেন না | দলমত নির্বিশেষে যে কোনো কবি সভায় তিনি উপস্থিত হতেন | তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে "স্বপ্নকামনা" (১৯৩৮), "স্বর ও অন্যান্য কবিতা" (১৯৫৩), "মানুষ জীবন" (১৯৫৪), "দিনযাপন" (১৯৬২), "বৃষ্টি এলে" (১৯৭২), "এই এক সময়" (১৯৭২), "রুক্ষ দিনের কবিতা" (১৯৮৩), "নির্বাচিত কবিতা" (১৯৮৯), "ছায়া হেঁটে যায়" (১৯৯১) প্রভৃতি |
১৯৯০ সালে "নির্বাচিত কবিতা" কাব্যগ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করেন | এ ছাড়া ১৯৭৫ সালে তিনি কবিতার জন্য সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার পেয়েছিলেন |
তাঁর সমালোচনা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে "সময় ও সাহিত্য" (১৯৫১), "মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরকাল" (১৯৬৪), "কবিতার রূপ-রূপান্তর" (১৯৮২), "কবিতার মানবিক উচ্চারণ ও অন্যান্য ভাবনা" (১৯৯১) প্রভৃতি |
এ ছাড়া তাঁর সম্পাদিত সংকলন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কাব্য সংকলন "শতাব্দী শতক" (১৯৬১, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে), "রজনীকান্ত গুপ্ত ব্যক্তিত্ব ও মনীষা" (১৯৭৬), "সোমেন চন্দের সুনির্বাচিত গল্প" (১৯৮৩) প্রভৃতি |
. --- উত্স: কল্যাণ চন্দ সম্পাদিত, ৩১১ গাঙ্গুলী বাগান, কলকাতা-৭০০০৪৭ থেকে . প্রকাশিত, "সাহিত্য চিন্তা" পত্রিকা, বর্ষ ২৭, বিশেষ স্মরণ সংখ্যা, . অগ্রহায়ণ ১৪০৫, ডিসেম্বর ১৯৯৮