কবি কৃষ্ণমোহন ভট্টাচার্য-র গান
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
.         আজ কৃষ্ণ! চলো হে নিকুঞ্জবন,
প্রাণাহুতি যজ্ঞ করবেন রাই, লহো তারই নিমন্ত্রণ |
.  আছেন চন্দ্রমুখী রাই, চাহিয়ে ও চন্দ্রবদন ||
.   তুমি যে ছলে শ্যামরায়, এলে মথুরায়,
.           হয়ে এক যজ্ঞে নিমন্ত্রিত ;
করলে সে যজ্ঞ সমাধান, হল তা জগতে বিদিত |
   আবার এক যজ্ঞ হবে ব্রজধাম---
.    শীঘ্র আসি তাও পূর্ণ করো শ্যাম!
.           আমরা অবলা গোপবালা,
অনেক দুঃখে করেছি সব যজ্ঞের আয়োজন |
.           তুমি হে যজ্ঞেশ্বর দয়াময়,
.          তোমা বিনে যজ্ঞ নাহি পূর্ণ হয়|
মানসে মানসে রাই                করিবেন সে যজ্ঞ,
.        তোমার ওই শ্রীচরণে সমর্পণ ||
.          করে যজ্ঞের সংকল্প প্যারি
.         আছেন যজ্ঞ-বেদিতে বসিয়ে ;
.         সজল জলধরে করিয়ে ধ্যান,
.       তৃষিত চাতকিনী হয়ে|
তোমার বিচ্ছেদ-হুতাশন, করে সংস্থাপন,
.                সমিধ আপনারই অঙ্গ ;
যোগিনীর প্রায়,                  আছেন মৌনে,
.           ত্যজিয়ে সখীর সঙ্গ ||
.  করেছেন রাই আত্মমনসংযোগ---
.  অপেক্ষা নাই সবই হয়েছে ত্রিযোগ |
.  আপনি কর্তা হয়ে, সন্মুখে দাঁড়ায়ে,
.    দুঃখিনীর যজ্ঞ করো সমাপন ||


.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
.  স্বজনি গো! আমায় ধর্ গো ধর্,
.         বুঝি কী হল আমারে |
. নিবিড় মেঘের বরণ, দলিত অঞ্জন,
.   কে আসি, প্রবেশিল অন্তরে||
. দারুন বসন্ত তাপে, কষ্ণ বিচ্ছেদে,
.   কৃষ্ণরূপ ভাবতে ভাবতে রাই ;
.   হলেন অচেতন, ধরে সখীগণ,
.   রাইতে রাই যেন আর নাই |
. তখন চৈতন্য পেয়ে কমলিনী কয়---
.     এ কী দায়, বিশ্বম্ভরের প্রায়,
.       কে আমার হৃদয়ে উদয় |
হেন জ্ঞান হয় আমার, ব্রহ্মান্ডের যত ভার,
.    পশিল আমার হৃদিপিঞ্জরে |
.   সই, ভাবিতে কেন অঙ্গ শিহরে!
.    একে শ্রীকৃষ্ণ বিহনে দেহ শূণ্য,
.   এতে  অন্য ভার কী সয় গো সই!
.     এ দুঃখিনীর তাপিত অঙ্গেতে,
.       কে আসি হল অবতীর্ণ |
.   একে সহজে দীনে ক্ষীণে মলিনে,
.            বিরহ-বিষেতে জ্বরা ;
.  আমার আপনার অঙ্গ আপনি ভার,
.            বহিতে দুঃখের পসরা||
.  আমার অকস্মাৎ কেন গো হল এমন ;
যেন এ দেহের সঙ্গেতে , করিছে প্রাণ আকর্ষণ
.  মনে ভাবি গো একবার, অন্তরে কী আমার,
.         দেখি গো হৃদয় বিদীর্ণ করে ||


.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
.                এমন দুঃখের সময় কালাচাঁদ,
.                কেন দু-খিনীর হৃদয়ে উদয় |
.        আমার অন্তরে প্রবল, বিচ্ছেদ-দাবানল,
.          পাছে তাঁর শ্যামাঙ্গ সই, দগ্ধ হয় ||
.        অন্তরের ধন কৃষ্ণ,          অন্তরে রাখিতে,
.                   কার বা অসাধ ?
.      কিন্তু ললিতে ! কপাল-গুণেতে,
.                  ঘটিল হরিষে বিষাদ ||
   কৃষ্ণবিলাসের সই, আমার এ অঙ্গ
দুঃসহ কৃষ্ণবিরহ, তাতে আসিয়া জ্বালায় অনঙ্গ |
.  সে যে ত্রিভঙ্গ কালিয়ে, মানসে হেরিয়ে,
.জুড়াই সই ! তেমন কপাল আমার নয় ||


.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
.        তোমার কমলিনী, কালো মেঘ দেখে,
.                কৃষ্ণ বলে ধরতে যায়
||
.           আমরা তায় বলি করে ধরি,
.     ও রাই, ধোরো না গো ও নয় শ্রীহরি ;
.         তবু, কই কৃষ্ণ বলে, প্যারি মূর্ছা যায় ||
.        রাধার নবম দশা হেরে, ব্যাকুল অন্তরে,
.                 সত্বরে আসি কংসধাম|
.                 শ্রীগোবিন্দে কহে বৃন্দে,
.                পদারবিন্দে করিয়ে প্রণাম |
.   ব্রজে শ্যামবিচ্ছেদে প্যারি প্রলাপ দেখে---
.        (রাধানাথ হে!) তোমার রাই বলে---
.           হৃদ্ পদ্মের নীলপদ্ম নিলে কে!
.   কেন এমন হলেন প্যারি, নারী বুঝিতে নারি,
.  শ্যাম হে, তোমায়,সমাচার দিতে এলেম মথুরায়,
.    একী ভ্রান্তি হল শ্রীরাধার, কহো শ্যামরায় |
.                কেউ বা বীণে লয়ে, বসন্তেরে,
.            বিনয়ে বীণের প্রতি খেদ জানায়
|
.            ওরে ও বীণে! ব্রজে শ্যাম বিনে,
.           বীনে আজ শান্ত সুরস কে বাজায়
||
.           কেবল নারদ বাজায় বীণে, সে বিনে,
.          তুই সাজবিনে, বাজালে সুরস বাজবিনে ;
.            বলি শোন্ বীণে রে, আমরা নবীনে রে ;
.                বীণে কি নারীর করে শোভা পায় |
.        তুই তো যাবিনে রে, যাবিনেশ যথা শ্যামরায় |
.                        হরি বিনে মরি বীণে,
.                        তোর রসেতে আর ডুবিনে,
.          ও রস ভাবিনে রে--- ও রস ভাবিনে---
.        বলি বারে বারে, যা বীণে, যমুনা পারে,
.            না গেলে সেই মধুপুরে, কৃষ্ণ পাবিনে |
.           তুই কাষ্ঠের বীণে, বসন্তে রে,
.        কৃষ্ণবোল বলো বীণে---বলো বিপদ যায় ||


.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
.        মনের দুঃখে বনে ভ্রমণ করে রাই,
.         বনফুলের মালা গেঁথে পাঠালে |
.          আছ কুব্জার প্রেম সম্বোধনে,
বসে রাজ-সিংহাসনে; হ্যাদে হে চিকনবালা !
.          রাই দিলে চিকন মালা,
.   ও মালা কার গলায় দিব মধুমন্ডলে ||
.                কুসুম-হার করে লয়ে,
.        বৃন্দে নিবেদন করে কৃষ্ণের পায় ;
.  বধু হে, এলে রেখে, শ্রীমুখ না দেখে,
. শোকে রাই অশোক বনে সীতার প্রায় ||
তোমার মধুর শ্রীবৃন্দাবন, কুঞ্জবন ফেলে রাধে---
.   মনের বিষাদে, তোমার বিচ্ছেদে---
.        বসন্তে কিশোরী, বনে ভ্রমণ করি,
.   “কোথায় হে বনমালি!” বলে কাঁদে |
.         রাধার চক্ষের জল চন্দনমাখা,
.        মালায় আছে রেখা, লেখা কৃষ্ণনাম ;
.     কৃষ্ণ তায় পথে পথে কাঁদালে ||
.       করে চিত্র বিচিত্র সাজালে |
.         (শ্যাম হে, তোমার গরবিনি রাই)
.  বনের কুসুম তুলে, নানা জাতি, জাতি যূথী---
.             দগ্ধ হয়ে শ্যামশোকে,
.           মুগ্ধ মধুর বন দেখে শ্যাম হে !
.                 তোমার গরবিনি রাই,
.         মধুর ভাবে গেঁথেছিল মধুমালতী ||
.         হয়ে বিচ্ছেদব্যাকুল, বকুল ফুল,
.         গেঁথে মালা প্যারি সে জ্বালায় ;
.        কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি, গেঁথে কৃষ্ণকলি,
.        মূর্ছা যায় কৃষ্ণ বলে পড়ে ধুলায় ||


.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
.        কৃষ্ণ, দেখো হে, একবার দেখে যাও,
.                বসন্তের প্রাণান্ত হল |
.        ব্রজের দুঃখানল, রাধার শোকানল,
.         প্রবল হয়ে বিচ্ছেদ দাবানব,
.  তোমার ঋতুরাজ সসৈন্যে পুড়ে মল ||
.         বসন্তে শ্রীকান্তে সম্বোধিয়ে,
.          বৃন্দে কয় ব্রজের বিবরণ ;
.          কৃষ্ণ হে, কৃষ্ণতাপে দগ্ধ,
.        তোমার সেই মধুর বৃন্দাবন |
.   শুক শারি ডাকে না কৃষ্ণ বলে;
মধুকরের মধু মধু রব, সে রব নাই হে ;
. কোকিল নীরবে বসে আছে তমালে |
. হল সুখহীন বৃন্দাবন, শুনো মধুসূদন !
.    এ মধুর কাল ফলে শুকাল ||
কেন শ্যাম, তায় গোকুলে পাঠালে বলো |
.         ব্রজধামে ঋতুরাজের আগমনে,
.                নব নব, তরুলতা সব,
.         সুখে মুঞ্জরিয়ে ছিল কুঞ্জকাননে |
.   তাহে মলয় সমীরণ, জ্বালায়ে হুতাশন,
.                বৃন্দাবন সেই অনলে দহিল
||


.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর
*
বলো উদ্ধব হে, কী লিখন কাঙালিনি দেখালে |
.        সজল আঁখি, মলিন বদন দেখি,
.             কী দুঃখের দুঃখী,
.   কৃষ্ণ অকস্মাৎ মূর্ছাগত রাই বলে |
.    বৃন্দাবন-বাসিনী আজি কী প্রমাদ ঘটালে ||
.      শ্রীকৃষ্ণের হস্তে হস্তলিপি কার,
দিলে কোন ক্ষণে, পত্র দৃষ্টি মাত্র চিত্ত চমত্কার,
.              যেন ছিন্নমূল বৃক্ষ প্রায়,
.          পড়লেন এই রাজসভায় হরি,
.         যেন শক্তিশেল বিঁধল হৃদকমলে ||
.       শ্রীকৃষ্ণের ভাবোন্মাদ, হেরিয়ে সে সংবাদ,
.      উগ্রসেন উদ্ধবেরে কয়---ওহে কৃষ্ণ সখা,
.          দেখো দেখহ কৃষ্ণের কী ভাব উদয় |
.              যেন কী ধন হয়েছেন হারা,
কী মনের দুঃখে, চক্ষের বারি বক্ষে বহিছে ধারা |
.      হয়ে কার মায়ায় মোহিত, ধুল্যবলুন্ঠিত,
.     হরি ত্যজে রত্নাসন, কালোবরন ভূতলে |
.             দুখী তাপী কত দেখতে পাই,
.           এই মধুরাজ্যধামে এসে যায় হে |
.          এমন কাঙালিনি, শ্যামমনোমোহিনী,
.                কখনো তো দেখি নাই |
.                কাঙালিনি বুঝি নয় সে,
.             নারীর বুঝতে নারি কী লীলে,
.        সে কোন মনোমোহিনী, দিয়ে মোহিনী,
.                দিলে কৃষ্ণের মন মোহিয়ে |
.  মায়া করে এসে মথুরায়, কাঙালিনির বেশে,
.        কৃষ্ণধন কাঙালের পাছে লয়ে যায় |
নারী মায়াবী, জানে ছল, নয়নে বহে অশ্রুজল,
.   আগে আপনি কেঁদে শ্যামকে কাঁদালে ||



.                   ****************                                                       
উপরে


মিলনসাগর