কবি নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতা যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে। www.milansagar.com
|
এপার বাংলা ওপার বাংলা
রাতদিন পাথর ভাঙছি, ঢেঁকি কুঁটছি, শন কাটছি
বর্ষার আগে যদি ফুরসুত পাই সাঁকোটা পোরোনোর
ওপারে তারক কবরেজের শতায়ু মা ছাঁচি পান সাজছে পা ছড়িয়ে
গঙ্গাজলের ছেলে আমি, আমাকে দেখতে তার বড় সাধ
লায়েক হয়েছি শুনে আফশোষ করে ; যদি তোর মা থাকতো!
যদি পারাপার বুকের দুধের মত সচ্ছল আউরে পড়তো ফিনিক দিয়ে!
রাতদিন কঠকুটো জোগাড় করছি সাঁকোটা মেরামত হবে
পায়ে হেঁটে পান চিবুতে-চিবুতে পাড়া বেড়াতে যাবো
গঙ্গাজলের ছেলে আমি বাগদত্তা কিশোরীর পড়া-যৌবনের
দোসর হতে পারলেও সান্ত্বনা থাকবে গঙ্গাজলের
যদি তুমুল বন্যায় মেঘনা-গঙ্গা এক হয়ে যায়---ডুব সাঁতারে
ছড়িয়ে পড়বো মাঠে-প্রান্তরে, উনুনশালে, শিরডগায়, ছাতাওয়ালা গলি থেকে
মেছোবাজারে, চারিদিকেই গঙ্গাজলের মেয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে
নোলক নাড়িয়ে, ভালোবাসার নদীকে তোলপাড় করবো এ-সনের দুর্দান্ত বর্ষায় |
. ****************** উপরে
মাস্তুলের ডগায় দাঁড়িয়ে
( শক্তি চট্টোপাধ্যায় শ্মরণে )
কাক-ভোরে কোনোদিনই তো তোমার ভুম ভাঙে না
তাহলে আজ প্রেম ও নৈঃশব্দের মধ্যে ডুব দিলে কেন?
অবনি তো বাড়িতেই আছে, হাজারো অবনী হেমন্তের অরণ্যে
ঘুড়ে বেড়াচ্ছে | তাদেরই খুঁজে বেড়াতে কি তুমি নিরুদ্দেশ হলে?
আমি তো দেখতে পাচ্ছি, এখনও কবিতার ধুলো উড়ছে
দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠে একা তুমি মৌরী ফুলের ঘ্রাণ নিচ্ছ?
সময় সরাতে সরাতে সবটা সময় তুমি গোগ্রাসে গিলে নিলে
পানশালার সামনে এমন অসময়ে তুমি একা কেন!
কলকাতা এখন ঘুমে অচেতন | এত রাতে কেউ কি বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করে?
বন্ধু আমার, পলিমাটি-নাকানো ঘরে এই কি এক রাত ঘুমোনো!
বাউণ্ডুলে হৃদয়কে ঠোঙার মোড়কেনিঃশব্দে গিলে নিতে এত লোভ তোমার!
বন্ধু আমার, অপেক্ষা করব চিরকাল খাদি ভাণ্ডারের সামনে
কখন তুমি এসে জেব্রা জামাটা তুলে নিয়ে বলবে
এটা আমার, এটা আমার, চিরদিনের, চিরকালের |
. ****************** উপরে
[ একটি অনুরোধ - এই সাইট থেকে আপনার ব্ লগ্ বা সাইটে, আমাদের কোন লেখা, তথ্য,
কবিতা বা তার অংশবিশেষ নিলে, আমাদের মূল পাতা https://www.milansagar.com/index.html এ
দয়া করে একটি ফিরতি লিঙ্ক দেবেন আপনার ব্লগ বা সাইট থেকে, ধন্যবাদ ! ]
স্বাগত কৈশোরের শ্বাপদ
অনেক দূরের আল বেয়ে সেই রত্না নদীর চর
সেইখানেতে ছিল আমার পলিমাটির ঘর
শৈশব সেই দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনতে চায়
প্রাচীন আমলকী-বনে হৃদয় ঘুরে বেড়ায় |
মায়ের হাতের মধুর মোয়া টাটকা নলেন গুড়
সেই তো ছিল স্বর্গসুধা ক্ষুধা করতো দূর
রাজঝিঙাশাল-সরষে তোলায় গাইতো সারিগান
সেই কৈশোর ফিরিয়ে দে মা, আত্মায় দাও প্রাণ |
রাঙচিতা সেই বেড়ার ধারে কাঁদেন আমার মা :
ছেলে যাবে দূর বিদেশে মন তো মানে না---
আঁকাবাঁকা আল বেয়ে তার হারিয়ে যাবে মুখ,
কৃতি হয়ে উঠবে যখন উঠবে ফুলে বুক |
ট্রেনে উঠেও একতারাতে বাজছে কোমল সুর---
ফুঁপিয়ে উঠি : পান্না-নগর আরো কত দূর?
ধ্বংস হল হিরোসিমা-নাগাসাকির রূপ
আটম-খেলায় ক্ষান্তি দেমা---ভাসে মৃতের মুখ |
দশটি বছর শুনছি শুধু ধ্বংসলীলার গান
ছেদ পড়বে কবে, যে এর---আসবে শান্তি-প্রাণ
নিরস্ত্রীকরণের বুলি জমায় বারুদ-পাহাড়
মহড়া চলে হাইড্রোজেনের প্রার্থনা কই---আ-মেন |
পথের প্রান্তে আমলকী বন সময় থমকে দাঁড়ায়
সন্ধ্যাপ্রদীপ নক্ষত্র-টিপ, মাতাল বন্ধু পায় ;
সেই স্বপ্নপুরের পথটি চিনে কখন আসবে কিশোর
নীলকণ্ঠ পাখির পালক আনবে সফল ভোর!
. ****************** উপরে
স্বাধীনতার হীরন্ময় আলোকে
কোথায় চলেছি এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে!
জন্ম-মরণ-কুঁড়ে ছেড়ে অনির্দেশ পথে নেমে পড়া
আমার কি সাজে অবিবেক বালকের মত পালিয়ে বেড়ানো!
আমি যেটা পারি সরু আলপথ বেয়ে শিশির মাড়িয়ে
গভীর নলকূপের গায়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসা---স্বচ্ছ ঝর্নার কলকল
জলধারা, মাঠের শেষে প্রান্তের জমি টউ-টুম্বুর
সরু আল ঝাঁপিয়ে অনিলের জমি ডুবিয়ে দিলীপের
দু-বিঘেয় ঢুকে পড়েছে | অথচ সে মাঠে কোন ফসল নেই |
পড়া জমিতে জল পাইয়ে কী লাভ? "অযথা জল নষ্ট করবেন না"---
সতর্ক নির্দেশে কে কান দেয় | ব্লকের কর্তার দেখা নেই |
তাহলে কি অফিসে বসেই তৈরি রিপোর্ট চলে যাচ্ছে সেচ দপ্তরে?
ফাঁকি দেওয়া নাকি এখন জন্মগত অধিকার | কোনো-এক যুবা
প্রাণপণ চেষ্টায় রুখতে চাইছে ঘুষের ধান্দায় ঘোরা মানুষগুলিকে
চহ্নিত করাতে | জনগণের কাছে তাদের মুখোশ খুলে দিতে |
আমি কী নির্বোধ, মূল্যবোধ বিবেক এই সব পুরানো
কথায় বিশ্বাস রেখে ঘুরে মরছি দু-বেলা দু-মুঠো
ভাত জোটাতে পেটের আগুনে | ---বরাত হলে জুটে যায়, না হলে
নিঢাল উপোস---মাঠে এখন কোন কাজ নেই দিনমজুর খাটার |
স্বধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা সাবালক হতে পারি নি |
পরের দোরে শান্ কি বাড়িয়ে দিচ্ছি--- আরও ঋণ দাও
উন্নয়নশীল দেশকে | বিশাল এই গণতন্ত্রের দেশ
আরও কতকাল পর অর্জন করবে স্বাবালকত্ব?
হাজারো ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, বিনয়-বাদল-দিনেশের মত
তরুণ যুবক-যুবতীরা নিঃশব্দে রক্ত ঝরিয়েছে |
গ্রামে-গঞ্জে হাজারো মানুষের রক্তে লাল হয়েছে নদী ;
আমি সেই অখ্যাত শহীদদের প্রাণাম জানিয়ে চিত্কার করে বলতে চাই---
তাদের পরিবার এখনও নিরন্ন কেন? শিক্ষা-সংস্কৃতির
তলানিটুকুও দেশের সবখানে পৌঁছায়নি কেন?
শহীদের রক্তের উপযুক্ত মূল্য আমরা দিতে পারিনি---পারিনি তাদের
হৃদয়ের গভীরে ডুব দিয়ে রক্তস্নানে মুক্তি তুলে আনতে |
অকৃতজ্ঞ আমরা সব পথে নেমেছি হৃদয়হীন বিত্ত-সঞ্চয়ে,
তাল-তাল সোনা তুলে আনার প্রতিযোগিতায় |
"সোনাকে জমিয়ে তুলে তো পরশমণি হয় না"---
মানুষ উধাও | এখন সব হরিলুঠ চলছে বন্দরে-বন্দরে
পাল না তুলেই ভেসে যাওয়া নির্বোধের |
এখন হাজারো প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিরীহ মানুষের ঘরে |
. ****************** উপরে
খরা
কোথায় দাঁড়াব আমি মাটিতে আগুন
সর্বনাশা হাওয়া বয়, মেঘেরা উধাও
কুমারীরা ঋতুমতী না হলে বৃথা আস্ফালন
আকাঙ্খার বোনা বীজ অঙ্কুরে অঙ্গার |
কোথায় দাঁড়াব বল মাটি যদি করে প্রবঞ্চনা
পেটেতে আগুন জ্বলে জল-রেখা সুদূর নাগাল
পাতালে বালির স্তূপ মজানদী অসহায় বক
বর্ষণ-উধাও নদী কোন সনে স্রোতস্বিনী হবে?
বুকেতে পাথর বেঁধে বেঁচে আছি উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে
এ জীবন মরুভূমি হলে উটেদের পৌষ-পার্বণ
ধরিত্রীর বক্ষলগ্না সীমন্তিনী সীতার ক্রন্দন
কোথা তুমি ভগীরথ? শঙ্খনাদে ধরিত্রীতে জলস্রোত আনো |
. ****************** উপরে
বিবেক-স্তম্ভের নিচে
এইখানে বিবেক মরেছে, আজন্ম বিশ্বাসের মূলে ডেঙো পিঁপড়ে
হে আমার ধ্যানের প্রতিমা, এরপর আর কত দূর?
হেঞ্জোদারো হরপ্পার কঙ্কাল সরিয়ে
আঁতিপাতি কি খুঁজছ তুমি শব্দের ভিতর অন্ধকারে?
আত্মহননের দায়ে অভিযুক্ত নির্বোধ নায়ক
তুমি থাক অতন্দ্র প্রহরা, এই মানবতা-মিনারের নিচে
অনাগত বংশধরদের কৈফিয়ত দিতে বোলো
এইখানে বিবেক মরেছে ভদ্রবেশী শয়তানের পদপিষ্ঠ হয়ে |
. ****************** উপরে
আবাদযোগ্য জমি নেই
আবাদযোগ্য জমি পেতে তোলপাড় করেছি মাঠ---
কোথাও ধনচে বন কোথাও বা মুথাঘাস জমাট পাপোষ |
বীজ ফেলে শস্য ঘরে তোলা সে নেহাতই বরাতের জোর,
প্রতি সনে বন্যা-খরা কিংবা কোন দৈব-দুর্বিপাক |
পৈতৃক জীবিকা রাখতে হাল-হেলে সবই গোছানো,
নিয়মমাফিক রোজ পড়া কাটি আগাছা সরাই---
যদি বা মাঘের শেষে এক পশলা পুণ্য বৃষ্টি পাই
হাল সনে সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে |
দাদনে ভরে না মন, ভরতুকিও সন্মানেতে ঠেকে---
ঘাম ঝরিয়ে ফসল ঘরে তোলার পরম সাধ
কতকাল মেটে নি | এবারে অরোরা খাল ঝাড়াই হবে---
আগামী মরশুমে আমি জোড়া-মই টানবো সপাটে |
আবাদযোগ্য জমি পাওয়া সত্যিই দুর্লভ
মাটি চেখে চেখে কি সব রোগ ধরা পড়ে---
জৈবিক সারে নাকি এখন মানুষ ধুঁকছে হাঁফটান
এখন কোন মানুষের মনে একচিলতে আবাদযোগ্য জমি নেই |
. ****************** উপরে