কবি শেখর কর-এর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।  www.milansagar.com
*
দেখা         
উত্তরের হাওয়া, ৫ মার্চ ২০০৮

শহরের চেনা চেনা পথে
ইচ্ছে ভেজার বৃষ্টিবিকেল গুলো
শেষ না হতেই কোথায় যেন
হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি |

তারপর এক শীত বেলায়
শেষ দেখেছিলাম তোমাকে
পাহাড়িয়া বাঁকে
অনেকটাই না দেখার ভান কোরে |
তুমি আমাকে দেখে ফেলতেই
হুহু কোরে বয়েছিল বাতাস
ঝাউপাইনের সারিপথে |
সারাদিন ধরে খুব বরফ
পড়েছিল সেদিন |
মনে আছে .... |
কুয়াশায় ভিজে উঠছিল
তোমার সযত্ন পুরু মেক আপ
আর ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল
আমার অবাধ্য চশমা |



.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
১।     দেখা            
২।     
বাবা      
৩।     
বানভাসি       
৪।     
ফেরারি    
৫।     
চাঁদমারি              
৬।     
ভাঙন           
৭।     
উপহার    
৮।     
কবিতা      
৯।     
ডাক    
১০।   
বাতিওয়ালা            
১১।   
স্থিতি     
১২।   
ফেরা   
১৩।   
নীল           
১৪।   
অব্যক্ত     
   
          
*
বাবা             

এখনো পথেঘাটে সোজা হেঁটে যাওয়া
ধুতিপাঞ্জাবীতে কোন সত্তরছোঁয়া
শ্রান্ত সরল মুখ দেখলে পরে
তোমার কথাই খুব মনে পড়ে |

এখনও সিগারেটের ধোঁয়ায় ভাসানো
তোমার গায়ের গন্ধে মেশানো
বাতাসেরা যদি আসে দুপুরে
তোমার কথাই খুব মনে পড়ে |

এখনও সেতারে কিম্বা এসরাজে
বর্ষায় যদি মেঘমল্লার বাজে
রাতে যদি কেউ দরবারী গায়
তোমাকেই খুব মনে পড়ে যায় |

মাঝরাতে ছাদে একলা যখন
শূণ্য আকাশে হারায় এ মন
আয়ুর নামতা শেখায় জীবন
তোমাকেই খুঁজে বেড়াই তখন |

যখন সন্তানের হাত ধরে ধরে চলি
তাকে জীবনে বড়ো হওয়ার কথা বলি
আর স্নেহের ধারা গাম্ভীর্যে ঢাকি
তখনো তো তোমারি প্রতিচ্ছবি আঁকি |


.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
*
বানভাসি             

ভিটাহীন সংসার, আকাশ মাথায়
নিচে তুমি হও অনিকেত,
চোখেমুখে ভয় আর ভাসান-ব্যথায়
দূরে ভাসে ঘর..প্রাণী..ক্ষেত |
জাগাও হৃদয়-জমি আরো একবার
ফলবতী হোক প্রাণরাশি
ফিরে যাক্ উৎসের পারে পারাবার
ফের ঘর বাঁধো বানভাসি |


.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
*
ফেরারি                 

স্বপ্নের ঘোরে একছুটে হাওয়া
তরাইয়ের হাতছানি আর অবিরাম চলা |
রাজপথ শেষ হয়ে গেলে পরে
বাস থামে কাঁচামাটির ধারে,
সোমড়াদের ছোট্ট দোকান, বাতিঘরের মতো
সেখানেই চট্ করে নেমে যাওয়া, তারপর
সবুজ কার্পেটে মোড়া চা বাগানের
মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলা
স্বপ্নিল সফেদ নীহারিকা পথে,
নিবিড় নৈঃশব্দ ভাঙে পায়ের তলায়
নুড়ি পাথরের আলাপচারিতায়... তারপর
মংলু বুধুয়াদের বাড়িঘর ছাড়িয়ে
পৌঁছে গেলাম আমাদের কোয়ার্টারের কাছে |
লাকড়ির পিল, কাঁটাতারের বেড়া, সজনে গাছ
আছে! একই রকম আছে!
সবকিছু ধরতে যাই দু'হাত বাড়িয়ে
স্বপ্নাবিষ্টের মতো, অতলে যাই হারিয়ে |
হঠাৎ শুনতে পাই অনতি দূরে
চা-কারখানার গুম-গুম শব্দ
গম্ভীর অথচ আদুরে,
বাবার প্রশ্রয়মাখা ধমকের মতো |
নাগরিক জীবন থেকে অনেক দূরে,
এখানেই ফেলে গেছি আমার শৈশবের বাঁশি |
আমাকে খুঁজে নিতে হয়তো এখানে বেজে ওঠে,
কোন এক জাফরানি আকাশের ভোরে,
চা-পাতার স্বপ্নগন্ধ মাখা, উদাস ভেঁরোর সুরে |


.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
*
চাঁদমারি                 

চাঁদমারি মন,
একরাশ দাগ নিয়ে
দিন গোনে একা
বিষন্ন বিকেলের মাঠে |
এধারে ওধারে
অসংখ্য আঘাতের ছাপ,
অস্পষ্ট এখন সবই,
ভেজা অক্ষরের মতো |
শুধু এক লক্ষ্যভেদীর
নির্ভুল নিশানা ক্ষত
খোঁচা দেয় এখনো
ঠিক মাঝখানে |
চাঁদমারি মন
একা পায় অধিকার
জীবনের কাছে,
শুধুই আঘাত পাবার |


.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
*
ভাঙন                 

দিনরাত ঝুপঝাপ্ ভাঙে পাড়
ভেসে যায় বাড়ীঘর বাগিচা
ভিটেমাটি কেড়ে নেয় পারাবার
বাড়ে শুধু জলেদের এলাকা |

মানুষেরও চুপচাপ ভাঙে পাড়
উড়ে যায় সুখীমন বলাকা,
প্রিয়মুখ ডুবে যায় বারবার
বাড়ে শুধু জলে ভেজা এলাকা |


.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
*
উপহার                 

গোধুলির হলুদ আলোয়
ধূসর হয়ে আসে ছায়াপথ |
জীবনের হাত ধরে
নেমে আসে অমোঘ রাত্রি |
কাকজ্যোত্স্নায় তবুও,
ভুল করে ডেকে ওঠে
চন্দ্রাহত মন |

অনেক পাওয়া হয়েছে
অনেক হারিয়েছে এ জীবন |
তার মাঝে সেরা হারানো ?
সেতো তুমি |
আর সেরা পাওয়া ?
তোমারই উপেক্ষার চাহনি |


.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
*
কবিতা                 
"কিরাত ভূমি"-র কবিদের কবিতা সংকলন "কাব্য বৈদূর্য", উত্তর সরণি সাহিত্যচক্র, জলপাইগুড়ি,
জলপাইগুড়ি বইমেলা ২০০৮


কখনও অনেক চেষ্টা ক'রেও
তোমার নাগাল পাই না,
কখনও এরকম হয় জেনে
শুধুই প্রতীক্ষা করে যাই
একটা চেনা মুহুর্তের,
যখন তুমি আমার হাত ধরে
নিয়ে যাও নির্জনের কাছে,
ভালবেসে বাড়িয়ে দাও
তোমার বাউন্ডুলে হাত,
আচ্ছন্ন সন্মোহিতের মতো
আমি ক্রমশঃ ডুবতে থাকি
নিঃশব্দ শব্দের গভীরে,
তারপর একটা মনস্ক দুপুর
কিম্বা একটা নিমগ্ন রাত্রির
একাকিত্বের বিনিময়ে
পেয়ে যাই তোমায়, কবিতা |


.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
*
ডাক
"কিরাত ভূমি"-র কবিদের কবিতা সংকলন "কাব্য বৈদূর্য", উত্তর সরণি সাহিত্যচক্র, জলপাইগুড়ি,
জলপাইগুড়ি বইমেলা ২০০৮


শোনো . . . শুধু তুমিই ডেকেছিলে আমাকে,
আমার আসল নাম ধরে . . .
তারপর পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হয়ে
সে ডাক যখন ফিরে আসে
আমার কাছে, তখন মাঝ দুপুর |

সমস্ত ধরাচূড়ো ফেলে,
ফলকগুলে মাটিতে নামিয়ে
দরজা জানালা হাট করে খুলে
প্রণপনে ছুট দিয়েছিলাম
শুধু তোমাকে পাব বলে |

তারপর বিকেল গড়িয়ে সাঁঝ . . .
সাঁঝ গড়িয়ে রাত . . .
রাত গড়িয়ে আলোছায়া ভোর . . .

আমার ছায়া আমায় ফেলে
ছুটে গেল তোমার কাছে,
শোনো . . . এ যাত্রায় তোমার কাছে
আমার আর যাওয়া হলো না |


.                                              *******************                                       
উপরে



মিলনসাগর   
*
বাতিওয়ালা                 
২রা ডিসেম্বর ২০০৮
(
এই কবিতাটি পরে দেশ পত্রিকার ১৭ জুলাই ২০১০ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে)

সন্ধ্যা নামার আগেই
গলির ল্যম্পপোস্টের বাতিগুলো
একটাপ পর একটা
জ্বালিয়ে দিয়ে যেত সেই লোকটা |

নিয়নের জমানা আসতেই,
একদিন উধাও হয়ে গেল সে |

আমার ছেলেবেলার সেই গলি,
ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সেই গলি,
হারিয়েছে অন্য পথে |

তবু এখনো মাঝে মাঝে
ঘন কুয়াশা ভেদ করে
জেগে ওঠে সেই গলি,
বুকের ভিতরে |

বাতিওয়ালা আসে,
জ্বেলে দিয়ে যায় বাতি
একটার পর একটা,
ফেলে আসা ল্যাম্পপোস্টে |


.      *******************                                                
উপরে



মিলনসাগর   
*
স্থিতি                 


এখন আর হারানোর
বোধ নেই, ব্যথা নেই |

যা কিছু পেয়েছি ভালো
কেবল সেটাই দেখি ঘুরেফিরে |

বাড়ছে শুধুই আকাশের ছায়া
আমার সমস্ত আয়না জুড়ে |


.      *******************                                                      
উপরে







মিলনসাগর   
*
ফেরা                 


পেঁয়াজের খোসা যেন ছাড়ানোর পালা
খসে যায় অতীতের পাতা সুখ দুখ,
ফুল পাখি স্কুলবাড়ি চেনা গাছপালা
চলে যাওয়া স্বজনের আলোছায়া মুখ |
কেনাবেচা শেষ করে অলস বিকেলে
বয়স্ক গোধূলির মাঠ দিয়ে পাড়ি,
পাখনার তমসাকে পেছনেতে ফেলে
রোদ মেখে উড়ে যায় ডাহুকের সারি |
তারপর রোজকার ঘুম ঘুম পালা
স্বপ্নের পানসিতে ভাসে উন্মুখ,
ফুল পাখি স্কুলবাড়ি চেনা গাছপালা
চলে যাওয়া স্বজনের আলোছায়া মুখ |


.      *******************                                                      
উপরে




মিলনসাগর   
*
নীল                 


শূণ্যতার বিষে জর্জরিত
আকাশের সারা শরীর নীল,
কতটা উদারতা থাকলে
এতো নীল হওয়া যায়
কো আর বলতে পারে,
কতটা গঙীরতা থাকলে
মহাশূণ্যতা ছোঁয়া যায়,
তাও জানা নেই কারো |

অনেক শূণ্যতাকে জমিয়ে
আমিও আকাশ হবো একদিন,
সেদিন আমার নীলাভ ছায়া
পড়বে তোমার সারা শরীরে,
তুমি নিজেকে সমুদ্র ভাববে
ফেঁপে উঠবে তোমার বুক,
ছুঁতে চাইবে আমাকে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে সারাক্ষণ
আর নোনাজলে ভিজে উঠবে
তোমার দু পাড়ের ধূ ধূ বালিয়ারী |


.      *******************                                                      
উপরে




মিলনসাগর   
*
অব্যক্ত                 


দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যাচ্ছে বনানী
যবনিকার পর্দা নামার মত
সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে,
সাঁকোর ওধারে ক্রমশ বিন্দু হচ্ছে
তোমার অপসৃয়মান চেনা চেহারা |
আমি অসহায় আর্তনাদ কোরে
ডাকছি তোমাকে, তোমার নাম ধরে
অথচ আমার গলা দিয়ে কোন
আওয়াজ বের হচ্ছে না |
এ যাত্রায় তোমাকে হারালে জানি
হয়তো আর আসবে না ফিরে
তাই শেষ বারের মতো বুক ফাটা চিত্কারে
আমার রক্তাক্ত কলিজা ঝাঁকিয়ে বললাম
"শোন ....... তোমাতেই সঁপেছি এ প্রাণ
শোন ........ তোমাকেই ভালবাসি অফুরাণ" |
তবুও শীতল নীরবতায় কঠিন তুমি
ছিলে পরমাশ্চর্য নিশ্চুপ নিরুত্তর, আর
ততক্ষণে ফিরে এসেছে অমোঘ রাত্রি
নিস্পন্দ ডানায় অন্ধকার মেখে
সাথীহারা অভিমানী ডাহুকের মতো |


.      *******************                                                      
উপরে




মিলনসাগর