সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
১।   ভিখারী        
২।   
হৃদয়-যমুনায়     
৩।   
নিষ্ফল প্রয়াস   
৪।   
রিতাপ     
৫।   
দৃষ্ট-দেবী    
   

.      ভিখারী          

ভিখারী এসেছি আমি চরণের মূলে,
যাহা দেবে দাও তুমি নিজ হাতে তুলে!
.        বলয় বাজুক রন্ ঝন্,
.        বরষা সম বরিষণ
যত পার তত কর আঁখি মন খুলে!


কিছু নাহি চাহি শুধু দুটি হাত ধরে'
অধর-নির্ঝর হ'তে হাসি দাও ভরে'!
.         শুভ্র বরণ রাশি রাশি
.         তরল কল স্নিগ্ধ হাসি
যত পার তত দাও ফিরায়ো না মোরে!


হাসি নাই! দাও তবে হৃদিকুণ্ড-জলে
সিক্ত করে' রাণি মোর, দুটি করতলে!
.          কোমল হৃদয়ের জল
.          মুকুতাসম নিরমল
যত পার ভরে' দাও ভিক্ষা-দান-ছলে!


কিছু নাই! ফিরিব কি দুটি শূণ্য হাতে!
সব আশা ব্যর্থ হবে আজি এ নিশাতে!
.           তবে ঐ অলক্ত-বরণ
.           নৃপুর-শিঞ্জিত চরণ
হৃদি'পরে তুলে দাও মরণ সাধাতে!

.           ***********************                                            
পরে


মিলনসাগর
.    হৃদয়-যমুনায়          

হৃদয়-যমুনায় ঐ ভাঙা তরী বাহি |
.       অনুরাগে ঝিরি ঝিরি
.       বায়ু বহে ধীরি ধীরি,
.       কূল হ'তে কূলে ফিরি,
.                   কোন বাধা নাহি |
হৃদয়-যমুনায় ঐ ভাঙা তরী বাহি ||

শীতের বেলায় যবে মেঘবিন্দু নাই |
.        নিস্তরঙ্গ হৃদি-নীর
.        প্রেমমন্ত্রে রহে স্থির,
.        আমি বাসনা-অধীর
.                    তরী লয়ে ধাই |
শীতের বেলায় যবে মেঘবিন্দু নাই ||

মধুমাসে শাখে বসে' গাহে যবে পিক্ |
.         হৃদিনদী ভরা টানে
.         কোথা দিয়ে কোথা আনে,
.         ভেসে যাই কোনখানে
.                     নাহি তার ঠিক্ |
মধুমাসে শাখে বসে' গাহে যবে পিক্ ||

নিদাঘের কালে যবে অবসন্ন ধরা |
.         তনুখানি তাপে ক্ষীণ,
.         হৃদয়-সলিলে লীন,
.         পড়ে থাকে নিশিদিন
.                      অবসাদে ভরা |
নিদাঘের কালে যবে অবসন্ন ধরা ||

বরষায় ঘন ঘন মেঘ যবে ডাকে |
.          ভয়ে সারা মনে মনে
.          তীরে আনি' সজতনে
.          বাঁধি তরী প্রাণপনে
.                       হদয়ের বাঁকে |
বরষায় ঘন ঘন মেঘ যবে ডাকে ||

আমি নিশিদিন এই ভাঙা তরী বাহি |
.           সারা ঋতু সারা বেলা
.           ভাসাইয়া প্রেম-ভেলা
.           হৃদি-মাঝে করি খেলা,
.                       কোন কাজ নাহি |
আমি নিশিদিন এই ভাঙা তরী বাহি ||


.           ***********************                                            
পরে


মিলনসাগর
.    নিষ্ফল প্রয়াস          

কত রাত্রি কত দিন জীবন মরণ
কত কিছু ভেসে গেছে নিয়ত যেমন,
.                        আমি ছিনু অন্যমনে

সবারে করিয়া দূর, ছাড়ি' সব কাজ
নেমেছিনু হৃদি-সিন্ধু-অতলের মাঝ
.                        ওই মুখ অন্বেষণে!

ছড়ায়ে মানস-জাল পাগলের মত
হারা মুখ ধরিবারে খুঁজিয়াছি কত
.                         শয়নহীন নয়নে!

ছায়ার মত কভু মনে পড়ে পড়ে,
পলক নাহি পড়িতে দূরে যায় সরে',
.                         ধরিতে নারিনু মনে!

দেখেছিনু স্বনে তারে, নিমেষের মাঝে
ঝলসিয়া চলি' গেল আলোকের সাজে
.                          বিমানে বিজুলি-পারা!

কোথা আঁখি কোথা দিঠি কোথা মুখখানি,
সব নিয়ে রেখে গেল শুধু ভাবখানি,
.                           আমি খুঁজে হনু সারা!

বৃথায় কাটিল দিন নিষ্ফল প্রয়াসে,
স্বপনের ধনে ফিরে' ধরিবার আশে
.                           বৃথা ঘুরি দিশাহারা!


.       
        ***********************                                            পরে


মিলনসাগর
.         রিতাপ          

জি সারা দিব ধরে' তোমারে পড়িছে মনে
.             একেলা এই বিজনে ;
সামান্য বলে' যে কথা মনে পায নাই ঠাঁই
.             আজি উঠিছে স্মরণে ;---

কি কথা বলেছি কবেকি ব্যথা দিয়েছি মনে
.             মনে হয় শতবার,---
নিকটে থাকিতে যাহা বায়ুসম লঘু ছিল
.             আজি তাহা গুরুভার!

আজি মোর মনে পড়ে মুখখানি ম্লান করে'
.             একা ফিরিতে কেবল!
ভাবিতে "কেন আসিনু পরের জীবনখানি
.             করিতে শুধু নিষ্ফল!"
আমি নিত্য নবসুখে মত্ত হয়ে রহিতাম
.             মদির-রস-বিহ্বল---
প্রদীপ জ্বালায়ে তুমি সারা রজনী বসিয়া
.             আঁখি দুটি ছলছল!

আজি মনে পড়ে সব আর মনে হয় কেন
.             করিনু এত প্রমাদ!
রবির কিরণে জ্বলি' আজিকে বুঝিতে পারি
.             ঘরে ছিলে তুমি চাঁদ!
যে মুখ থাকিতে কাছে আঁখি তুলে দেখি নাই
.             আজি সাধ দেখিবার!
যে প্রেম ঠেলেছি পায়ে আজি কি আদরে লই
.             যদি পাই কণা তার!

আজি সাধ যায় মনে যুগল-জীবন দোঁহে
.             পুনঃ আরম্ভ করিতে ;
যে জীবন গেছে চলে উজান বাহিয়া গিয়া
.             তারে ফিরায়ে লইতে ;
যে ব্যথা দিয়েছি মনে সে ব্যথা আপনি লয়ে
.             তোমায় সুখী করিতে ;---
প্রেমতরু-ছায়ে-ছায়ে দুটি প্রাণ এক হ'য়ে
.             ধীরে ভাসিয়া যাইতে!

রয়েছি পড়িয়া আমি, চলিয়া গিয়াছ তুমি
.             জীবনের আর কূলে ;---
পৌঁছিবে কি আজিকার বিলম্ব-বিলাপ এই
.             তোমার হৃদয়-মূলে!
গৃহের মাঝারে যবে ছিলে হায়, ঢেলেছিনু
.             অনাদরে বিষানল ;---
কাছে তুমি নাই আর, আজি মনে পড়ে সব
.             আর চোখে আসে জল !



.         
     ***********************                                            পরে


মিলনসাগর
.    অদৃষ্ট-দেবী          

কে তুমি রয়েছ মোর আন্তরের মাঝে
বিচিত্ররূপিণি! কত দিন কত সাজে
হেরেছি তোমায় ;--- কভু দীপ্ত রবিসম
আলোকে ঝলসি' হৃদয় আকাশে মম
উঠেছ গরবে ; সহস্র রশ্মির তীরে
টানিয়া লয়েছ মোর হৃদয়ের নীরে ;
ঝরায়েছ তাহা নয়নের প্রান্ত হ'তে
ঝর ঝর বৃষ্টিসম | বিমল শরতে
কভু ক্ষীণ, কভু অর্দ্ধ, কভু পরিপূর্ণ
শশিকলাসম পূর্ণ করি' হৃদি-শূণ্য
কভু বিছায়েছ শ্বেত লাবণ্য-দুকূল!---
অয়ি অদৃষ্ট আমার, বিচিত্র অতুল,
তোমায় হেরেছি কত দিন কত সাজে,---
প্রভাতে হেরেছি এক, অন্যরূপ সাঁঝে |
কোথা হতে আসিয়াছি, কোথা যেতে হবে
তাহা নাহি জানি ; জানি শুধু এই ভবে
প্রথম জনমে ভ্রুণসম এনু যবে,
তুমি এলে সাথে ; শত জনমে জনমে
জীবন মরণে মোর সকল করমে
তুমি চির রবে ;---নাড়ীতে নাড়ীতে রহি |
যমজের মত তোমাতে আমাতে অয়ি,
জনম-বন্ধন | কভু হাসি মন-সুখে
আশাতে সফল --- কভু নিরাশার দুখে
ঝরে আঁখিজল ;---এই সুখ এই দুখ
সকলি তোমারি ওগো,---পরাণ বুভুক্ষু
নিশিদিন প্রাণপণে কেমনে না জানি
তোমা হতে প্রাণরস লইতেছে টানি |
চিরতরঙ্গিত এই জীবন-সাগরে
এত দূর আনিয়াছ তুমি হাত ধরে' ;
যাহা ঘটিয়াছে মন হতে দূর করে'
এবে তোমা কাছে যাচি---জানত সুন্দরি
অন্তরের মাঝে মোর দিবস শর্বরী
কি আশা জাগিয়া আছে, তাহে পূর্ণ করি'
জীবনের সুধাপাত্রখানি দাও ভরি',---
তারপর রথচক্র-তলে বাঁধি' মোরে
যেথা খুশি নিয়ে যেয়ো জন্ম জন্ম ধরে'|



.           ***********************                                            
পরে


মিলনসাগর