কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর সাবডিভিশনের "মাইঝপাড়া" গ্রামে | তিনি কিশোর বয়সেই কলকাতায় এসেছিলেন | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিকস নিয়ে এম.এ. পাশ করেন | টিউশনি দিয়ে কর্মজীবন শুরু | তারপর নানা অভিজ্ঞতা এবং পরে আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন |
তাঁর সাহিত্যের উপকরণ স্বভাবতই সংগৃহিত হয়েছে কলকাতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, কিন্তু পূর্ববাংলার স্মৃতিবিধূর অভিজ্ঞতা তাঁর রচনার একটি উত্স | সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ কবি হিসেবে | ১৯৩৪ সালে দিপক মজুমদার এবং আনন্দ বাগচীর সাথে মিলে কবিতার পত্রিকা "কৃত্তিবাস" সম্পাদনা শুরু করেন | এই পত্রিকাটি তরুণ কবিদের মুখপত্র হিসেবে দৃষ্টি আকর্শন করে | আধুনিক বাংলা কবিতায় তিনি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী এবং একালের সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম | তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "একা এবং কয়েকজন" (১৯৫৮) | "আমার স্বপ্ন" (১৯৭২), "বন্দী জেগে আছো" (১৯৫৮), "এসেছি দৈব পিকনিকে" (১৯৭৭), "সেই মুহুর্তে নীরা", "নীরা, হারিয়ে যেও না", "হঠাৎ নীরার জন্য", প্রভৃতি তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখনীয় |
তাঁর প্রথম উপন্যাস "আত্মপ্রকাশ" ১৯৬৬ সালে শারদীয়া "দেশ" পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় | স্বাধীনতা- উত্তর বাঙালী তরুণের স্বপ্ন ভঙ্গ, আশা ও আশাহীনতার অন্তরঙ্গ দলিল | তাঁর ঘরোয়া কথনভঙ্গি, প্রাত্যহিক জীবনের রূপায়ণ এবং যৌবনের উত্সাহ, উত্তেজনা ও আবেগের প্রকাশ তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা দিয়েছে | তাঁর বিশাল রচনা সম্ভারের মধ্যে রয়েছে "অর্জুন" (১৯৭০), "জীবন যেরকম" (১৯৭১), "আমিই সে" (১৯৭৪), "পূর্বপশ্চিম" ১ম ও ২য় খণ্ড, "গরম ভাত অথবা নিছক ভুতের গল্প" (১৯৭৮), "সেই সময়" (১ম খণ্ড ১৯৮১ এবং ২য় খণ্ড ১৯৮২), "প্রথম আলো" (১ম খণ্ড ১৯৯৬ এবং ২য় খণ্ড ১৯৯৭) প্রভৃতি |
তাঁর রচিত নাটকের মধ্যে রয়েছে "প্রানের প্রহরী", "রাজা রানী ও রাজসভায় মাধবী", "মালঞ্চমালা", "স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী" ইত্যাদি | এ ছাড়া বহু গল্প এবং প্রবন্ধও তিনি রচনা করেছেন |
তাঁর ছদ্মনাম "নীললোহিত", "সনাতন পাঠক" ও "নীল উপাধ্যায়" |
তিনি কিশোর সাহিত্য রচনাতেও প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন | তাঁর প্রথম কিশোর উপন্যাস "ভয়ংকর সুন্দর" | "সত্যি রাজপুত্র" (১৯৭৮), "সবুজ দ্বীপের রাজা" (১৯৭৮) উল্লেখযোগ্য |
তাঁর একাধিক কাহিনী, চলচিত্রে, বেতারে ও টিভি সিরিয়ালে রূপায়িত হয়েছে | যার মধ্যে "অরণ্যের দিনরাত্রি" ও "প্রতিদ্বন্দ্বী" উপন্যাস দুটি স্বয়ং সত্যজিৎ রায় সিনেমায় রূপান্তরিত করেন |
বহু আগে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার | ১৯৮৩ সালে পান বঙ্কিম পুরস্কার | ১৯৮৫ সালে তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয় | ২০০৮ সালে তিনি সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি নির্বাচিত হন |
সেই ব্রিটিশ জমানার পর বাংলার কোনো সাহিত্যিকের নাম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য উঠে আসে নি | তাঁর শেষ দিকে যদি বাংলার কোনো সাহিত্যিকের নাম উঠে আসতো, তবে তাঁর মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম অবশ্যই থাকতো বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস | বহু বিদগ্ধজনের মতে "সেই সময়" এবং "প্রথম আলো" উপন্যাস দুটি সেই সম্মানের যথাযত যোগ্যতার মাপকাঠির অনেক ঊর্দ্ধে | . উত্স: ডঃ শিশির কুমার দাশ, সংসদ সাহিত্য সঙ্গী ২০০৩, মিলনসাগর ০১মে২০০৮