হবুচন্দ্রের আইন


হবুচন্দ্র রাজা বলেন, গবুচন্দ্রে ডেকে----
.        “আইন জারি ক’রে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে,
.                মোর রাজ্যের ভিতর
হোক্ না ধনী, হোক্ না গরীব, ভদ্র কিম্বা ইতর,
.        কাঁদ্ তে কেহ পারবে না’ক ,যতই মরুক শোকে,
.        হাস্ বে আমার যতেক প্রজা, হাস্ বে যত লোকে |
শান্ত্রী-সেপাই, প্যায়দা-পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে,
কাঁদলে কেহ, আনবে  বেঁধে, শাস্তি হবে শেষে |”

.        বল্লে গবু----“হুজুর ,------
ভয় যদি কেউ পায় কখনো দৈত্য, দানা, জুজুর,
কিম্বা যদি পিছ্ লে প’ড়ে মুন্ডু ফাটায় কেহ,
.        গাড়ীর তলে কারুর যদি থেঁত্ লিয়ে যায়  দেহ;
কিম্বা যদি কোনো প্রজার কান দুটি যায় কাটা,
কিম্বা যদি পড়ে কারুর পিঠের উপর ঝাঁটা ;
.        সত্যিকারের বিপন্ন হয় যদি,
তবুও কি সবাই তারা হাসবে নিরবধি ?”

.         রাজা বলেন,------“গবু,
আমার আইন সকল প্রজার
.                মান্ তে হবে তবু |
কেউ যদি হয় খুন বা জখম,
.                হাড্ডিতে ঘুণ ধরে,
পাঁজ্ রা যদি ঝাঁঝ্ রা হয়ে
.                মজ্জা ঝ’রে পড়ে ;
ঠ্যাংটি ভাঙে, হাতটি কাটে,
.                ভুঁড়িটি যায় ফেঁসে,
অন্ধকারে স্কন্ধকাটা
.                ঘাড়টি ধরে ঠেসে :
কিম্বা যদি ধড়ের থেকে
.                মুন্ডুটি যায় উড়ে,
.             কাঁদ্ তে কেহ পারবে নাক বিশ্রী বিকট সুরে |
.                  হবু চন্দ্রের দেশে------
.             মরতে যদি হয় কখনো, নরতে হবে হেসে |”


.        পিটিয়ে দিল ঢ্যাঁড়া গবু রাজার আদেশ পেয়ে----
.        “কাঁদ্ তে কেহ পারবে না আর, পুরুষ কিম্বা মেয়ে ;
.        যতই শোকের কারণ ঘটুক, হাস্ তে হবে তবু,
.        আদেশ দিলেন রাজাধিরাজ হবু ;
.        রাজার আদেশ কেউ যদি যায় ভুলে,
.                চড়্ তে হবে শূলে |”


.        সেদিন হতে হবুর দেশে
.                        উল্টে গেল রীতি,
.        হর্ রা-হাসির হট্টগোলে,
.        অট্ট-হাসির অট্টরোলে,
.                জাগ্ লো তুফান নিতি |
.        হাসির যেন ঝড় বয়ে যায়
.                রাজ্যখানি জুড়ে,
.        সবাই হাসে যখন তখন
.                প্রাণ-কাঁপানো সুরে |


প্যায়দা-পাইক ছদ্মবেশে হদ্দ অবিরত,
কান্না কারো শুন্ তে না পায়, হাঁপায় রীতিমত :
.        সবাই হাসে আশে-পাশে,
.        বিষম খেয়ে ভীষণ হাসে,
আস্তাবলে সহিস হাসে, আস্তাকুঁড়ে মেথর,
হাস্ ছে যত মুমূর্ষুরা হাস্ পাতালের ভেতর |
.        আইন জেনে সর্ব্বনেশ
.        ঘাটের মড়া উঠ্ ছে হেসে,

বেতো-রোগী দেঁতো-হাসি হাসছে ব’সে ঘরে !
.        কাশ্ তে গিয়ে কেশো বুড়ো হাসতে সুরু করে |
হাস্ ছে দেশের ন্যাংলাফ্যাচাং-হ্যাংলা-হাঁদা যত,
গোম্ রা-উদো-নোংরা-ডোঁপো-চ্যাংড়া শত শত ;
.        কেউ কাঁদে না কান্না পেলেও,
.        কেউ কাঁদে না গাঁট্টা খেলেও,
পাঠশালাতে বেত্র খেয়ে ছাত্রদলে হাসে,
.        কান্না ভুলে শিশুর দলে হাস্ ছে অনায়াসে |

রাজা হবু বলেন আবার গবচন্দ্রে ডাকি’,
“আমার আইন মেনে সবাই
.                আমায় দিলে ফাঁকি  !
রাজ্যে আমার খাঁদার কথা
.                সবাই গেল ভুলে,
.        কেউ গেলনা শূলে ?
একটা লোকও  পেলাম না এইবারে
.        শূলে চড়াই যারে |
.                নিয়ম আমার কড়া
প্রতিদিনই একটি লোকের
.                শূলেতে চাই চড়া |
যা হোক্, আজই সাঁঝের আগে
.                শূলে দেবার তরে----
যে ক’রে হোক একটি মানুষ আন্ তে হবে ধ’রে |”

গবুচন্দ্র বল্লে হেসে
.                চেয়ে রাজার মুখে,
“কাঁদ্ তে পারে এমন মানুষ
.                নাই যে এ মুলুকে
আমি না হয় নিজেই কেঁদে
.                আইন ভেঙে তবে
চড়ব শূলে, মহারাজের
.                নিয়ম রক্ষা হবে
কিন্তু একি, আমিও যে
.                কাঁদ্ তে গেছি ভুলে
কেমন ক’রে চড়্ ব তবে শূলে ?”
রাজা বলেন, “ তোমার মত মূর্খ দেখি না- যে,
কাঁদ্ তে তুমি ভুলে গেলে এই ক’দিনের মাঝে ?
.        এই দ্যাখোনা কাঁদে কেমন করে’---“
এই না ব’লে হবু রাজা কেঁদে ফেল্লেন জোরে |

মন্ত্রী গবু বল্লে তখন, “এবার তবে রাজা----
নিজের আইন পালন করুন , গ্রহণ করুন সাজা  |”

বলেন হবু , “আমার হুকুম নড়বে না এক চুল,
আমার সাজা আমিই নেব, তৈরি কর শূল |”


.       ****************                                                             
উপরে    


মিলনসাগর
কবি সুনির্মল বসু-র কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
১।      হবুচন্দ্রের আইন       
২।      
সব করেছে মাটি   
৩।      
ওরে বাবা ওটা কেরে !       
৪।      
আলোর মৌচাক   
৫।      
সামিয়ানা     


*
সব করেছে মাটি

শোন্ রে মানুষ, বন-মানুষের বুদ্ধিটা নয় সোজা,
বানিয়েছি এই আজব বিমান সাত্ টি বেলুন গোঁজা |
ফুর্-ফুর্-ফুর্ হাল্ কা হাওয়ায় উড়ল বিমানখানা,
আকাশ-পথে চলছি উড়ে, সঙ্গী শুয়োর-ছানা |
শক্ত ঝুড়ির ভিতর মোরা বস্ ছি এঁটে-সেঁটে,
বুঝ্ লে তো ভাই বন-মানুষের বুদ্ধি কত পেটে !
আকাশ-পথে হঠাৎ যদি বিপদ্ ঘটে কোনো,
তারও আছে প্রতিবিধান, বল্ ছি সেটা শোনো |
শূন্যপথে ঘট্ লে বিপদ্ একান্ত বিদ্ ঘুটে,
‘সরাৎ’ ক’রে আসব নেমে ছাতার ‘প্যারাসুটে’ |
কল্ কব্জার বালাই যে নাই, ঘোরপ্যাঁচ্ নাই কিছু,
বেলুনগুলোর সুতো টেনে চালাই আগুপিছু |
বাঃ- বাঃ- বাঃ কেমন মজা, শূন্যে উঠি বেগে,
উড়ছে রঙীন বেলুনগুলো আল্ তো বাতাস লেগে |
আকাশ-পথে শোঁ- শোঁ- শোঁ চলবে উড়ে উড়ে,----
ইচ্ছামত বিশ্বখানা দেখবো ঘুরে ঘুরে |
এই মরেছে,---বিমানটা যে হঠাৎ গেল ফেঁসে,----
সঙ্গী আমার ঝুড়ির ফুটোয় বেরিয়ে এলো শেষে ?
শূন্যপথে ডিগ্ বাজি খায়, শিউরে ওঠে’ গা’টি,----
লক্ষ্মীছাড়া শুয়োর-ছানা সব করেছে মাটি |


.       ****************                                                             
উপরে    


মিলনসাগর
*
ওরে বাবা ওটা কেরে !

ওরে বাবা, ওটা কেরে, চেহারা বিকট,
কোন্ মতলবে এলো আমার নিকট ?
তোফা ছিনু একা একা ঘরের ভিতর,
হঠাৎ এলো কে ওটা, কোন্ সে ইতর ?
ধ্বক্-ধ্বক্ চোখে যেন আগুন ঝরায়,
লক্-লকে জিভে খালি লাল যে গড়ায়,
আড়-চোখ বারে বারে ঘুরিছে পাজীর,
মনে হয় যমদূত স্বয়ং হাজির |
মিট্ মিটে হাসি হেসে ভুরূটি বাঁকায়,
মুখখানা কেলে-হাঁড়ি যেন আব্ লুস্ ,
ফেটে যেন পড়ে ওর রূপের জলুস্ |
নোখগুলো বাঁকা-বাঁকা ভোঁতা- থাবাটার ,
গোঁফগুলো খাড়া যেন কাঠি সে ঝাঁটার |
সারাগায়ে ভরা লোম---কাল্ চিটে রং ,
উড়ে এসে জুড়ে বসে উজ্ বুক সং |
বন্ধু ব’লে বোধ ওরে হয় না ও-ভাই ,
এখনি সুযোগ পেলে করিবে জবাই |
ভাগ্যে এই টব ছিল ঘরের মাঝার,
নইলে মোটেই রক্ষা ছিল না আজ আর |
টবের  ও পাশে গিয়ে দাঁড়াই দু’পায়,
এ-ছাড়া এখন কোনো দেখিনা উপায় |


.       ****************                                                                 
উপরে   


মিলনসাগর
*
আলোর মৌচাক

চাঁদটা যেন সত্যিকারের
.             আলোর-ই মৌচাক---
দুষ্টু--ছেলের ঢিল্ টি লেগে
.             হঠাৎ হোলো ফাঁক |


আজকে রে তাই সাঁঝের-বেলায়
আলোর মধু সব ঝরে’ যায়,---
হাজার তারা--মৌমাছিরা
.             উড়্ লো ঝাঁকে ঝাঁকে,---
নীল-আকাশের নিতল নীড়ে
.             উড়্ লো ঝাঁকে ঝাঁকে |
চাঁদটা যেন সত্যিকারের
.             আলোর- ই মৌচাক |
গন্ধে আমি এলাম ছুটে
.                   খোলা-মাঠের ‘পর,---
নেশায় নেশায় মাত্ ল বাতাস------
.                    ভর্ লো দিগন্তর |
ভোমরা-গুলো চাখ্ তে এসে
.                     আলোর মধু মাখলো শেষে,
জ্বল্ জ্বলিয়ে জোনাক হয়ে
.                      উঠ্ লো লাখে লাখ ---
কালো-ভোমর আলোর ছোঁয়ায় জ্বল্ লো লাখে লাখ |
চাঁদটা যেন সত্যিকারের
.                      আলোর-ই মৌচাক |
জরির চাদর গায় জড়ালো
.                       হলুদ্-দীঘির বাঁধ,
মধুর ঝাঁঝে সাঁঝ- প্রহরেই
.                        ঘুমের গেছে সাধ |
চপল-হাওয়া ঘুম ভাঙ্গে তার,
আস্তে সে তার বাজায় সেতার,
টটুল চালে নাচ্ ছে তালে
.                        খাচ্ছে সে ঘুরপাক---
বন্ বন্ বন্ বন্-কিনারে খাচ্ছে সে ঘুরপাক  |
চাঁদটা যেন সত্যিকারের
.                        আলোর-ই মৌচাক |


.       ****************                                                                 
উপরে   


মিলনসাগর
*
.        সামিয়ানা


.        চৌধুরীদের সামিয়ানা
.        বাইরে সেদিন হলো আনা ;
সবাই বলে এ উহারে---“ব্যাপারটা কি, ব্যাপারটা কি ?
.        চৌধুরীদের ছোট মেয়ের বিয়ে নাকি !”


.        কেউ বা বলে ----“হয়তো নাতির অন্নপ্রাশন---
.                হচ্ছে বিপুল তাই আয়োজন |”
.        বল্লে কেহ ফিস্ ফিসিয়ে মিহিন সুরে,----
“চৌধুরীদের মেজ ছেলে হয়তো আজি
.                             আস্ ছে ফিরে বিদেশ ঘুরে |”


.        কৌতূহলে স্কুলের  ছেলে জুটল সবাই দলে দলে,
.                এ উহারে ডেকে বলে----
.            “যাত্রা হবে রাত্রে আজি আসতে হবে সন্ধ্যাবেলা !”
.                      আশে পাশে জম্ লো বহুলোকের মেলা |


.         হাটের লোকে , ঘাটের মাঝি , ইষ্টিশানের যতেক কুলী
.                        কাজ কর্ম্ম সকল ভুলি’
.                          সবাই হলো সেথায় জড়ো |
.                      যতেক জোয়ান , ছোট বড় |
.         সবার মুখে একই কথা, হদ্দ ভেবে সবাই তারা,-----
.                       সবাই হোলো ভেবে সারা |


.        ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়েছিল পাড়ার প্রচীন দীনু বুড়ো----
.        নিতাই এসে বল্লে তাঁরে, “ ব্যাপার কিহে বুঝ্ ছো খুড়ো?”
.                        বল্লে আরো হেসে নিতাই
.     “ ---- --  অনেক দিনের পরে এবার পড়বে পেটে মন্ডা মিঠাই,
.                        সুঁট্ কে ভায়া আছি মরে’,
.        ছা-পোষা লোক , জুটবে বেশী কেমন করে’  !”


.        ও দিকেতে লাগায় বাজি গদাই এবং পাড়ার হেবো---
.        বল্লে ---“ যে ঠিক্ বল্ বে তারে পাঁচটি টাকা ইনাম দেব |”
.        গদাই বলে---“ চৌধুরী- বৌ  ভাঙ্গবে ব্রত রাত্রে আজি |”
.         বল্লে হেবো ---“মানতে আমি একটুও তা নইক  রাজী |”
.                        “ আসবে আজি জমিদারের জামাই”
.                         ভীড়ের থেকে চেঁচিয়ে বলে রামাই  |


.        এমন সময় তর্ তরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে এক্কেবারে
.        চৌধুরীদের নায়েব মশাই নেমে এলেন বাইরে দ্বারে |
.        সবাই বলে নিশেষ ফেলে ---“ এবার সকল যাবে জানা
.        আজ্ কে কেন বার হোল এই বিরাট বিপুল সামিয়ানা |”
.        সাহস করে’ এগিয়ে তখন বল্লে গাঁয়ের নন্দ-গোঁসাই---
.        “সামিয়ানা বাইরে কেন, ব্যাপারটা কি নায়েব মশাই |”

.        কাষ্ঠ হেসে যষ্টি ঠুকে বল্লে তখন নায়েব মশাই----
.        ---“ উই ধরেছে সামিয়ানায়, --- বাইরে রোদে দিয়েছি তাই |”



.       ****************                                                                 
উপরে   


মিলনসাগর
*